জ্বলদর্চি

তুর্কী নাচন পর্ব- ২০ (শেষ পর্ব)/মলয় সরকার

তুর্কী নাচন 

পর্ব- ২০ (শেষ পর্ব)

মলয় সরকার


এই ট্রামটা চলে কাবাতাস থেকে ট্যাক্সিম পর্যন্ত। তবে ট্যাক্সিম ট্রাম স্টেশন থেকে ট্যাক্সিম স্কোয়ার যেতে একটা নতুন জিনিসে চাপতে হল। তার নাম ফানিকুলার (Kabataş-Taksim Funicular line F1) এটি দু’কামরার প্রায় পুরো কাঁচের ট্রাম বা ইলেক্ট্রিক ট্রেনের মত। এটি আসলে একটি  ‘কেবল কার’।এটি স্থাপিত হয়েছে খুব সম্প্রতি, ২৯শে জুন ২০০৬ এ। পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই এরকম আছে। এগুলি পাহাড়ী বা উঁচু জায়গায় ওঠার বা নামার জন্য ব্যবহৃত গাড়ী, যেগুলি আসলে মাটিতে পাতা তারের সাহায্যে বড় মোটরে টেনে চালানো হয়।অর্থাৎ রোপ ওয়ে যদি মাটিতে পাতা হয়, তাহলে যা হবে তাই আর কি। শুধু বসার জায়গাটি ট্রামের মত কম্পার্টমেন্ট করে দেওয়া আছে এবং বেশ সুখকর। এরকমের কেবলকার আগে দেখেছি এবং চেপেছি, আমেরিকার সানফ্রান্সিস্কো তে ।

  যাই হোক , ট্রাম থেকে নেমে, এই ফানিকুলারে চেপে মাত্র ২ মিনিটের মধ্যে গেলাম ট্যাক্সিম স্কোয়ারে। তার জন্য আবার আলাদা টিকিট আছে। যেখানে নামাল, সেখান থেকে আবার সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে তবে স্কোয়ারে পৌঁছানো গেল। ভিতরের স্টেশনটা অনেকটা মেট্রো স্টেশনের মত।
 
  স্কোয়ারে এসে দেখি এটি এক বিশাল ফাঁকা জায়গা। এটি আসলে, শহরের বিভিন্ন জায়গায়, এখানকার জমা জল বিতরণের কেন্দ্র। এই বিতরণের নাম তুরস্কের ভাষায় 'ট্যাক্সিম'। যেহেতু জায়গাটা একটু উঁচুতে, কাজেই জল সরবরাহের ক্ষেত্রে এটি সুবিধাজনক।সেই থেকেই এর নাম ট্যাক্সিম স্কোয়ার।
 এখানে রয়েছে একটি  রিপাব্লিকান মনুমেন্ট, যেটি তৈরী হয়েছে ১৯২৮ এ।তৈরী করেছেন এক ইটালিয়ান স্থপতি, পিয়েত্রো ক্যানোনিকা।এই স্কোয়ারটি অনেকটা  আমাদের এসপ্ল্যানেডের মতই। যত কিছু রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক বিক্ষোভ প্রতিবাদ সমাবেশ সব এখানেই হয়।এখানে রয়েছে চারধারে সব নানান খাবার দোকান, তার মধ্যে পিজা হাট, ম্যাকডোনাল্ড, ইত্যাদি সব নানান খাবার দোকান, বড় বড় হোটেল এইসব। সবাই আড্ডা মারছে চারদিকে।পর্যটকও বেশ কিছু রয়েছে।প্রায় তিন লক্ষ মানুষ এখান দিয়ে রোজ যাতায়াত করেন।


   মাঝের মনুমেন্টটি বেশ। অনেকে যেন বের হচ্ছেন একটি দরজার ভিতর থেকে, এরকম একটি (বোধ হয় ব্রোঞ্জের) শিল্প রয়েছে, একটা উঁচু বেদীর উপর।তাঁরা অবশ্যই বিভিন্ন রাজনৈতিক বিখ্যাত নেতারা।(আমি তো আর সকলকে চিনি না)।এর একদিকে রয়েছে তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতীক, এর অপর দিকে বর্তমান তুরস্ক রিপাব্লিকের। এই ৮৪ টন ওজনের স্মৃতিসৌধটি পিয়েত্রো রোমে তৈরী করে ,জাহাজে করে ইস্তানবুলে এনেছিলেন।এই স্মৃতিসৌধটিতে কামাল আতাতুর্কের সাথে আরও বেশ কয়েকজনের মূর্তি রয়েছে।এটি তৈরীতে সময় লেগেছিল আড়াই বছর।

  এখানে কাছেই আছে আতাতুর্ক কালচারাল সেন্টার।এখান থেকে ট্রামলাইনও যাচ্ছে।আমরা হাঁটলাম এপাশে ওপাশে খানিকটা। বেশ ভাল লাগল।এখানে রয়েছে ট্যাক্সিম স্কোয়ার মসজিদ।কয়েকটা দোকানেও ঘুরলাম উইণ্ডোশপিং এর মত । 


  ফেরার সময়, ফানিকুলারে চাপতে এসে টিকিট আর কাটতে পারছি না কিছুতেই।কি করি,  দেরীও হচ্ছে পিছনে লোক জমে যাচ্ছে।বিপত্তির একশেষ। বাধ্য হয়ে, একটি ছেলেকে বললাম ব্যাপারটা।সে এগিয়ে এসে, আমার কাছ থেকে পয়সা নিয়ে টিকিট কেটে দিল। 

  আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।আপদে বিপদে স্বদেশে বিদেশে বিভিন্ন জায়গায়, সে রোম কি ইম্ফল, কোলকাতা কি চীন বা মেক্সিকো, যে কোন জায়গাতেই হোক মানুষ যখন মানুষের জন্য এগিয়ে আসে, সাহায্যের হাত বাড়ায় তখন তার কোন দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি ধর্ম কিছুই থাকে না।তখন সে শুধুই মানুষ। এই একটাই তার পরিচয়, একটাই তার ধর্ম, একটাই তার ভিতরের স্বভাব।সারা পৃথিবীর যতটুকু ঘুরেছি, এই মানুষের ভিতরের ঐক্য, ভিতরের পরিচয় টাই আমি খুঁজে দেখতে চেয়েছি।তখন মনে হয়েছে, দেশের নেতারা যদি ক্ষমতার লোভে দেশের সীমারেখা না রাখত, মানুষ জাতটারও পাখী মাছ বা অন্যান্য প্রাণীর মত কৃত্রিম ভৌগোলিক সীমারেখা থাকত না।তারা, যেখানে ভাল লাগত, প্রকৃতিকে যেখানে মানিয়ে নিতে পারত সেখানেই থাকত।ভাষা বা  ধর্মটা আসলে কোন বিভেদই নয়। ওটা আঁকড়ে ধরেই সমস্ত ক্ষমতালোভীরা , সে ধর্ম ব্যাপারেই হোক এর রাজনৈতিক ব্যাপারেই হোক, মানুষের ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে , মিথ্যে ভেদাভেদ সৃষ্টি করে আপন স্বার্থ কায়েম করতে চেষ্টা করেছে।এটাই আসল ভেদাভেদ।এটা যদি না  থাকত, সে পৃথিবীই হত আসল স্বর্গরাজ্য।তাহলে আর  পৃথিবীতে এই লড়াই বিভেদ দখল হয়ত কিছুই থাকত না।সেটাই আমার স্বপ্নের দেশ।আর মানুষের এই পরিচয় খুঁজতেই আমার দেশে দেশে ঘুরে বেড়ানো।
  ঘুরলাম তুরস্কের অনেক খানি জায়গা। দেখলাম অনেক কিছু ইতিহাস ভূগোল অতীত বর্তমান। আলাপ হল অনেক মানুষের সঙ্গে।খাওয়াও হল অনেক নতুন কিছু। মাত্র এই ক’দিনেই যেন দেশটিকে বেশ ভালবেসে ফেলেছিলাম।কাল ছেড়ে যেতে হবে এই দেশ ছেড়ে। ভাবতেই যেন মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনে পড়ছে সেই হাস্যময়ী মেয়ে রুইয়ার কথা, সেই বাঙ্গালী টিপ পড়ে আনন্দে ডগমগ বিক্রেতা মেয়েটির কথা, কদিন ধরে আমাদের সঙ্গ দেওয়া মিতভাষী ইউসুফের কথা, কিংবা বিদেশে এসে পাশের ঘরের মানুষকে কাছে পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরা। এই সবই থাকবে বুকের মণিকোঠায় সিন্দুকে ভরা মণিমুক্তোর মত। অলস দিনের অলস ক্ষণে আপনমনে মাঝে মাঝে বের করব এই্সব মণি মুক্তো একটি একটি করে দেখব ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, ঝাড়ব মুছব আবার গুছিয়ে রাখব সিন্দুকের যথাস্থানে।

  আবার হয়ত উড়ে যাব দেশ থেকে দেশান্তরে , দেখা হবে আবার অন্য নানা মানুষের সঙ্গে, পরিচিত হব নানা পরিস্থিতি নানা জায়গার সাথে।তবু তুরস্কের একটা আলাদা জায়গা থেকেই যাবে আমার মনের মধ্যে।  

  অনেক কিছু দেখা হল।এবার  সংক্ষেপে দেশটার অতীত বর্তমান নিয়ে দু চার কথায় একটু রূপরেখাটা এঁকে নেওয়ার চেষ্টা করি।

  সেই অতীতে কৃষ্ণসাগর বা ব্ল্যাক সি র মধ্যবর্তী অঞ্চলটার নাম ছিল এশিয়া মাইনর অর্থাৎ  এশিয়ার  ক্ষুদ্রতর অংশ।এই নামকরণ করেছিল রোমানরা।পরে যখন গ্রীকরা আসে তারা এর নামকরণ করে আনাতোলিয়া। অবশ্য এখন ইস্তাম্বুলের মধ্যে শুধু এশিয়া নয় ইউরোপের অল্প অংশও আছে। ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বে হিতাইত নামে এক দল মানুষ কৃষ্ণসাগরের পূর্ব দিক থেকে এসে এখানে বসবাস করতে আরম্ভ করে। তারা এখানকার ভূমধ্যসাগরীয়  গরম ও শুষ্ক আবহাওয়ায় ভাল ফল সবজি হত বলে ভালই উপযুক্ত মনে করেছিল জায়গাটা।

 পরে ১২০০ খ্রীষ্টপূর্বে এই জায়গাটা চলে আসে আসিরীয়দের হাতে। তার জন্যই সম্ভবতঃ নজরুল ইসলাম তাঁর কবিতায় একে বলেছেন, "অসুরপুর"।

( --’ ঐ খেপেছে পাগলি মায়ের দামাল ছেলে কামাল ভাই,
অসুর-পুরে শোর জেগেছে জোরসে সামাল সামাল তাই।
কামাল, তু নে কামাল কিয়া ভাই–”)

   এই আসিরীয়দের নামই পরবর্তীকালে আমরা 'অসুর ' করেছি কি না, সঠিক জানি না, হয়ত ইতিহাসবিদরা বলতে পারবেন।এই আসিরীয়দের থেকে ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বে আবার এর দখল নেয় গ্রীকরা। তারা সেই বিখ্যাত ট্রয় যুদ্ধের পর এর দখল নেয়।এটি পরে কোন এক সময় তাদের হাতছাড়া হয়।তার পর আবার মহাবীর আলেক্সাণ্ডার এটি নিজেদের হাতে ফিরিয়ে আনেন। দ্বিতীয় খ্রীষ্টপূর্বে আবার এটি যায় রোমানদের হাতে।তখনই এখানে খ্রীষ্টধর্ম বিস্তার লাভ করে এবং বাইজান্টাইন সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা হয়। তখনই ওই আয়া সোফিয়া, একটি চার্চ হিসাবে তৈরী হয়।রাজধানী হয় রোমান সম্রাট কন্সটান্টিন, দ্য গ্রেট  এর নামে কন্সটান্টিনোপল।

  এর অনেকদিন পর রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে, ওদিক থেকে আরব ও মুঘলরা একে আক্রমণ করে।এখানে অটোমান দের রাজত্ব শুরু হয়।তখনই সমস্ত খ্রীষ্টধর্মের উপর ইসলাম ধর্মের প্রাবল্য বাড়ে ও আয়া সোফিয়াকে আবার মসজিদে রূপান্তরিত করা হয়।তখন এই কন্সটান্টিনোপলের নাম হয় ইস্তাম্বুল।এই অটোমান রাজত্ব চলে ১৯২২ সাল পর্যন্ত, যখন বীর নেতা কামাল আতাতুর্ক অটোমানদের হাত থেকে রাজত্ব কেড়ে নিয়ে একে তুরস্ক রিপাব্লিকের পত্তন করেন।তিনি নতুন রাজধানী করেন আঙ্কারাতে। ইস্তাম্বুল তখন এর রাজধানী হওয়ার গৌরব হারায়। আর আতাতুর্ক ছিলেন অনেকখানি ধর্ম নিরপেক্ষ মতের।তিনি এই আয়া সোফিয়াকে মসজিদ থেকে জাতীয় সম্পদ হিসাবে, সমস্ত দ্বন্দ্বের উপরে গিয়ে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত মিউজিয়াম হিসাবে ঘোষণা করেন।এরকম তিনি হয়ত আরও করেছিলেন।যেমন, আমি নিজে দেখে এসেছি, বোডরামেও এরকম একটি দ্বন্দ্বমূলক জায়গাকে মিউজিয়াম বলে ঘোষণা করেছিলেন।
এই হল খুব সংক্ষেপে তুরস্কের ইতিহাস। 

  এবার বলি তুরস্কের সংস্কৃতিকে বাইজান্টাইন সংস্কৃতি বলা হয় কেন। এর হয়ত অনেকগুলো মত আছে। তথ্য বলছে, কয়েক লক্ষ বছর আগে, যখন এর এশিয়া অঞ্চলটিতে মানুষ এসে বসতি স্থাপন করে, তার অনেকদিন পর তাদের এক রাজা ছিলেন যাঁর নাম বাইজাস (Byzas)। তিনি এখানে একটি নগরীর পত্তন করেছিলেন, তার নাম হয় বাইজান্টিয়াম ( বসফরাসের পাশের অঞ্চলকে গ্রীকরা এই নামে ডাকত) আবার কেউ বলে, ইংরাজী উচ্চারণে প্রাচীন ফরাসী উচ্চারণ (besanz), যেটি মুদ্রা সম্পর্কিত কিছু, সেটি রোমান সাম্রাজ্য বোঝাতে, ব্যবহৃত হত।সেই থেকেই এই বাইজান্টাইন বা বাইজান্টিয়াম কথাটি এসেছে।এটি বলতে ইস্তাম্বুল বা বৃহৎ অর্থে, তুরস্ককে বোঝায়।

 এবার বলি, অটোমান সান্রাজ্য বলতে কি বুঝি।

  আসলে, এই অটোমান সাম্রাজ্য এক বিশাল শক্তিশালী  সাম্রাজ্য ছিল সুদীর্ঘদিন ধরে যারা তুরস্কের উপর শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছিল।শুধু তুরস্কই নয়, এরা মধ্য এশিয়া, উত্তর ইউরোপ, এবং আফ্রিকার বেশ কিছুটা অংশের উপর রাজত্ব চালাত।এরা পৃথিবীতে প্রায় ৬০০ বছর রাজত্ব করেছে।এর সুলতানের হাতে অশেষ ক্ষমতা ছিল, সমস্ত ধর্মীয় এবং শাসনকার্য সম্পর্কিত বিষয়েই।এদের সময়েই রাজ্যে ভীষণ উন্নতি হয়, শিল্প বিজ্ঞান, ধর্ম ও সংস্কৃতির।সারা পৃথিবীর সমস্ত শক্তিই একে সমীহ করে চলত।আসলে এই অটোমান বংশের প্রতিষ্ঠাতা প্রাচীন আনাতোলিয়ার এক উপজাতি সম্প্রদায়ের নেতা ওসমান (প্রথম)।তাঁর নাম থেকেই 'অটোমান' কথাটির উৎপত্তি। একে আরবীতে বলত, 'উথমান'।আর ১৪৫৩ সালে মেহমেট (দ্বিতীয়) বাইজানটাইন রাজত্ব ছিনিয়ে নেন। কন্সটানটিনোপলে শুরু হয় বাইজানটাইন রাজত্বের বদলে অটোমান রাজত্ব। এই কঠিন,  শক্তিশালী রাজত্বের অবসান হয় কামাল আতাতুর্কের হাতে।আর এই মেহমেটই কনস্টানটিনোপলের নামকরণ করেন ইস্তাম্বুল।
(শেষে বলি, সম্প্রতি আয়াসোফিয়াকে মিউজিয়াম থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করায় ইউনেস্কো থেকে শুরু করে পৃথিবীর অনেকেই ভীষণ নানা অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে ছিলেন। তখন তুরস্ক সরকার সেজন্য ঘোষণা করেছেন, এটি মসজিদ হলেও এখানে সাধারণ দর্শকের জন্য আগের মতই উন্মুক্ত থাকবে।) 


  পাঠকের কাছে তুলে ধরলাম, আমার এক নতুন দেশ দেখার অভিজ্ঞতা নিজের মত করে। যদি সকলের ভাল লেগে থাকে, সফল হবে আমার এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।সঙ্গে থেকে এতদিন মতামত দিয়ে আমাকে সাহচর্য দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ সবার কাছে।

আগামী কাল আমরা উড়ে যাব আর এক নতুন দেশে - জর্ডনে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments