জ্বলদর্চি

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান-১২/দিলীপ মহান্তী

অশোক মহান্তীর কবিতা : জীবন ভাঙা পথে ঈশ্বরের গান

দিলীপ মহান্তী


১২.
অশোক মহান্তী লিখেছিলেন:
   ‘একজন কবি সারাজীবনে কতগুলি কবিতা লিখতে পারেন বল তো?
   তিনটি।
   একটি প্রেমের, একটি প্রতিবাদের, একটি মৃত্যুর।
      (একজন কবি: ৪৮ বছরের স্বীকারোক্তি )

   তাঁর সারাজীবনের কবিতাচর্চায় প্রতিবাদী স্বর খুব সক্রিয় ভাবেই জানান দিয়ে গেছে। পৃথিবীর যেখানে যেখানে মানবতার অপমান দেখেছেন, শ্রেণীসংগ্রাম দেখেছেন, অন্যায় অবিচার দেখেছেন, ক্ষুধার জন্য হাহাকার দেখেছেন, নারীর অসম্মান দেখেছেন সেখানেই তাঁর কলম শুশ্রূষার বার্তা ছড়িয়ে দিতে চেয়েছে। এই নারী যেমন একালের তেমনি মহাভারত থেকে তুলে এনেছেন সেই সব নারীদের যাঁদের প্রতি পিতৃতান্ত্রিক সমাজ অবিচার করেছে, বঞ্চনা করেছে। সিমন দ্য বোভেয়ার তাঁর 'The Second Sex' গ্রন্থে বলেছেন ‘One is not born, but rather becomes, a women’ নারী হয়ে কেউ জন্মায় না, নারী হয়ে ওঠে। এ কথা সব কালের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে নারীবাদীদের প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ সার্বিক ও সর্বাঙ্গীণ। সামাজিক অবস্থানের কারণে তারা প্রান্তিক। পিতৃতন্ত্র চায় নারীর শ্রম ও প্রজনন ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। সেইজন্য দেখা যায় পিতৃতন্ত্র, নৈতিকতা, যৌনতা, আধিপত্য ইত্যাদি বিষয় নারীদের নিজস্ব জগৎ নির্মাণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পুরুষসর্বস্ব সমাজে নারীর অন্তর্জগৎ ঠিকমতো আবিষ্কৃত হয়নি। নারীর এই অন্তর্দহন, সামাজিক বিড়ম্বনা ও বঞ্চনার ইতিহাসকে অশোক মহান্তী সহানুভূতির সঙ্গে শ্রদ্ধাসহকারে তুলে ধরেছেন। সঙ্গে আছে তীব্র প্রতিবাদ।

    এই পথ বেয়েই তিনি চিঁচুড়গেড়িয়ার মৃত পাথর শ্রমিক শকুন্তলা মাহাতকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন। যার মৃত্যু হয়েছে শ্রেণীবৈষম্যের কারণে। অভাবের যন্ত্রণায় শরীরে বাসা বেঁধেছে মারণ রোগ। পরিবেশ দূষণের ফলে ঘুণ শুধু শকুন্তলা মাহাতর শরীরে ধরেনি, সমাজের যেখানে যেখানে ঘুণ ধরেছে সেই জায়গাগুলি তিনি  চিহ্নিত করেন। পরিবেশ মন্ত্রক, সুপ্রিম কোর্ট, ভারতীয় গণতন্ত্র সমস্ত জায়গায় ঘুণ ধরেছে।

   এখন এই শ্রেণী বৈষম্য, বঞ্চনা, অন্যায় অবিচার, ক্ষুধা যে শুধু একালেই আছে তা নয়। প্রাচীন যুগেও ছিল। ইতিহাস আমাদের সেই সাক্ষ্য দেয়। বৈদিক সাহিত্যে ও মহাভারতে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। রবীন্দ্রনাথও এই বঞ্চিত শোষিত অবহেলিত শ্রমজীবীদের কথা ‘রাশিয়ার চিঠি’তে লিখেছেন: চিরকালই মানুষের সভ্যতায় একদল অখ্যাত লোক থাকে, তাদেরই সংখ্যা বেশি, তারাই বাহন; তাদের মানুষ হবার সময় নেই; দেশের সম্পদের উচ্ছিষ্টে তারা পালিত। সব চেয়ে কম খেয়ে, কম পরে, কম শিখে, বাকি সকলের পরিচর্যা করে; সকলের চেয়ে বেশি তাদের পরিশ্রম, সকলের চেয়ে বেশি তাদের অসম্মান। কথায় কথায় তারা রোগে মরে, উপোসে মরে, উপরওয়ালাদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে মরে - জীবনযাত্রার জন্য যত-কিছু সুযোগ সুবিধে সব-কিছুর থেকেই তারা বঞ্চিত। তারা সভ্যতার পিলসুজ, মাথায় প্রদীপ নিয়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে – উপরের সবাই আলো পায়, তাদের গা দিয়ে তেল গড়িয়ে পড়ে।
   মহাভারতের বনপর্বে বকরূপী যক্ষ (ধর্ম) যুধিষ্টিরকে প্রশ্ন করেছিলেন জীবিত অবস্থায় মানুষ কেন মৃতের মতো থাকে। যুধিষ্টির তার সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন- দারিদ্রের কারণেই মানুষ মৃতের মতো থাকে। দারিদ্র, শুধু এই শব্দ আমাদের যথেষ্ট সচেতন করে, আতঙ্কিত করে, বিষাদগ্রস্ত করে, আবার মহাভারতের যুগ সম্পর্কে বিশেষ ভাবে আগ্রহী করে তোলে।

   মহাভারতের যুগে যেমন শ্রেণী বৈষম্য ছিল তেমনি বেদের যুগেও তা যথেষ্ট পরিমাণে ছিল। আর এই বৈষম্যের মূলে ছিল ক্ষুধা, দারিদ্রের যন্ত্রণা। ঋগ্বেদের সূক্তে তার উল্লেখ আছে। ক্ষুধার কথা যেমন আছে তেমনি ক্ষুধার জন্য হাহাকার আছে, অন্নদানের কথাও আছে।

   শুধু ক্ষুধার কথাই নয় বর্ণ ব্যবস্থার কথাও আছে বৈদিক সাহিত্যে ও মহাভারতে। ঋগ্বেদের দশম মন্ডলে আছে সৃষ্টিকর্তার মুখ থেকে ব্রাহ্মণের, বাহু থেকে ক্ষত্রিয়ের, উরু থেকে বৈশ্যের, আর পা থেকে শূদ্রের জন্ম। গীতায় এই বর্ণ ব্যবস্থার কথা একটু অন্যভাবে পাই। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন- গুণ ও কর্মের ভিত্তিতেই তিনি চার বর্ণের সৃষ্টি করেছেন। যার অর্থ গুণ ও কর্মের ভিত্তিতেই সমাজে বর্ণ ব্যবস্থার সৃষ্টি। আর গুণ ও কর্মের ভিত্তিতে যে বর্ণ ব্যবস্থার প্রচলন হয়েছিল তারপর থেকে তা জন্মসূ্ত্রেই নির্ধারিত হত। এখনো পর্যন্ত সেই ব্যবস্থাই চলে আসছে।

   মহাভারতের যুগে সমাজে শ্রেণী বৈষম্য ও বর্ণ ব্যবস্থার জাঁতাকলে পড়ে নিচু তলার মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল কিন্তু সেটাকে আটকাত ধর্মীয় বোধ। মানুষের কর্মফল নিয়ে চিন্তা ভাবনা। মানুষের এই পরিণতির জন্য দায়ী তার পূর্ব জন্মের কর্মফল। এই বক্তব্য সমর্থনের ভাষা পাই মনুসংহিতাতেও। যেখানে বলা হচ্ছে মানুষের উত্তম মধ্যম ও অধম এই অবস্থা তার কর্মফলের জন্যই। অর্থাৎ সবই কাল অদৃষ্ট ও কর্মফলের অধীন। তারফলে শ্রেণী বৈষম্য, সামাজিক বঞ্চনা, অন্যায় অবিচার সবকিছুই ঈশ্বরের দান বলে ধরে নিতে হবে। এক শ্রেণীর মানুষ এটাকেই নিয়ম বলে মানেন। তাই তাদের প্রতিবাদী ও বিদ্রোহী রূপ নষ্ট হয়ে যায় এই ভাবনাতেই। তারা সময়ের, পরিস্থির দাস হয়েই থেকে যান।

   ঋগ্বেদে সবচেয়ে বেশি প্রার্থনা করা হয়েছে অন্নের জন্যই। প্রত্যেক দেবতার কাছে আলাদা আলাদা ভাবে  প্রার্থনা করা হয়েছে তারা যেন ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করে বাঁচিয়ে রখেন। উপনিষদে অন্নকে দেবতা বলা হয়েছে। তাই দেখতে পাচ্ছি খিদের জ্বালার কথা বেদ থেকে শুরু করে মহাভারত হয়ে এযুগেও সমান ভাবেই পৌঁছেছে। প্রচুর পরিশ্রম করেও এক শ্রেণীর মানুষ চাহিদা মতো খাবার জোগাড় করতে পারে না আর এক শ্রেণীর মানুষের ঘরে প্রচুর খাবার। এই ছবি চিরকালের। সব কালেই অন্ন দানের কথা পাই। ছান্দোগ্য উপনিষদে আছে জানশ্রুতি পৌত্রায়ণ প্রচুর পান্থশালা খুলেছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য, যেখানে রান্নার আয়োজন ছিল। সেখানে ক্ষুধার্তরা এসে পেটপুরে খেতে পেতেন। কিন্ত শুধু দানের মাধ্যমে তো সমাজে ক্ষুধার্তকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কোনো কালেই তা সম্ভব নয়।

   আর একটি দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার তা হল সময় পরিবর্তন। সব যুগে সমস্যা থাকলেও সময় পরিবর্তনের ফলে তার রূপ ও তীব্রতাও পাল্টাচ্ছে। এই প্রসঙ্গে আর একবার মহাভারতের কাছে যাব। মহাভারতের শান্তি পর্বে  ভীষ্ম মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় যুধিষ্টিরকে অনেক উপদেশ দিয়েছিলেন রাজকার্য পরিচালনার বিষয়ে। সেই প্রসঙ্গে নষ্ট সময়ের কথা বলেছেন। সমাজ ও সভ্যতা একসময় কত সুন্দর ঐশ্বর্যময় ছিল। মানুষের সুখ ছিল। কিন্তু সেই কাল সুদীর্ঘ হয়নি। কালের দূষণে তা নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যক্তির চাহিদা, স্বার্থচিন্তা, লোভের ফলে মানুষের মনে বিকৃতি দেখা দিল। অর্থাৎ সময়ের পচন সেই সময়েও ছিল। এই অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে সমাজে ধনীর ধন বেড়েছে গরীব আরো গরীব হয়েছে। পুঁজিবাদের বিকাশ হয়েছে।
   এই প্রেক্ষাপটে অশোক মহান্তীর ‘সিলিকোসিস’ কবিতাটি পড়লে দেখা যায় শ্রেণী সংগ্রামের পথ ধরে এক নারীর মহীয়সী হওয়ার ইতিহাস। একদিন যে শকুন্তলারা দুষ্মন্তকে আকৃষ্ট করত আজ তার শরীর ক্ষুধা ও অসুখের যন্ত্রণায় লাশ হয়ে গেছে। এই শকুন্তলার কাজ ছিল পাথর ভাঙা। এক মুঠো খাবারের জন্য অমানুষিক পরিশ্রম। যে পাথরের ধুলো পথ করে দিয়েছে মৃত্যুর দরজায় পৌঁছানোর। তারা পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে কোন বার্তা পৌঁছে দিচ্ছে জানতে ইচ্ছে করে। সেই ধুলো উড়ে যাচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের আকাশে, সেই ধুলো আছড়ে পড়ছে ভাতের থালায়। আর এই পরিবেশেই শকুন্তলার শিশুর হাসি ভারতের মাঠে আকাশে পাথরে পলাশ হয়ে ফোটে। সেই হাসি খাপ খোলা ভোজালির মতোই ধারালো। বিদ্ধ করে সংবেদনশীল মানুষকে। পুঁজি বাড়ে ওপরতলার মানুষের, প্রান্তিক মানুষদের শ্রম ও শরীরের বিনিময়ে। আর শিশুর সেই ধারালো হাসিতে কবি দেখতে পাচ্ছেন অন্য সুর অন্য ইশারা অন্য পৃথিবীর স্বপ্ন:
   ‘সারারাত ধরে তুমি কাশো।

   হাসপাতালের বেড-এ নিশুতিরাতের ছায়া ঘন হলে
   ডেকে ওঠে অজন্তা-ইলোরা-তাজমহল, ডেকে যায়, যে-অসংখ্য লাশ
   তারা পরিবেশমন্ত্রকের কানে-কানে কি কথা বলেছে?

   ধুলো, সুপ্রিম কোর্টের দিকে উড়ে যাচ্ছে,
   ধুলো এসে ছিটকে পড়ছে ভাতের থালায়-
   আমি কোনদিকে, কোথায় তাকাবো?

   যেদিকে তাকাই, দেখি, তোমার হাসি
                 ভারতের মাঠে ও আকাশে
                 পাথরে পলাশ হয়ে ফুটে আছে,
   এ-হাসি আট-ইঞ্চি খাপখোলা-ভোজালির মতো।

   হাসপাতালের বেড-এ শুয়ে আছো। খোলা বুক।
   এখন, বুকের মধ্যে হাপরের টান শুধু। কাশির হিল্লোল।
   একদিন, তোমারও শরীর থেকে পাতা ঝরতো,
   দুষ্মন্তরা মৃগয়ায় এসে দেখতো- ফুটে উঠছে সেগুনমঞ্জরী
                       আজ, বাকলে-বাকলে শুধু ঘুণ।

   পাথর-প্রতিমা গড়ে সেই কোন অনার্তব কুমারী-বয়সে তুমি
                       শিখেছিলে স্তব
        শশালতাটির কাছে মা-হবার প্রথম গৌরব
                সেও কোন বালিকা-বয়সে।

       পাথর তোমাকে আজ খায়।
       তারিয়ে-তারিয়ে খায়, হাড়রক্ত চেটে-পুটে খায়
                     পুঁজির পৃথিবী ভরে
                     সিলিকার রূপের আগুনে।

   পাথর খেয়েছে যারা, পাথর যাদের আজ খায়
             সেই বিশ্বকর্মাদের
             গভীর – গভীর তীব্র-ঘুমের মতন
             এই ভারতীয় গণতন্ত্র,
   একজন বিচারক তাকে, আঙুলে আঘাত করে
               জাগাতে চাইছেন-

   তুমি দ্যাখো।
   তোমার শিশুর হাসি ভারতের মাঠ-ঘাট-প্রান্তর পেরিয়ে
   ধুলোহীন অন্য শতাব্দীর দিকে ভেসে যাচ্ছে দ্যাখো,

   কই, তাকিয়ে দেখছো না।
      ( সিলিকোসিস: ঘাস রঙয়ের আকাশ )

   মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে ‘কুমারী গর্ভ’ কবিতাটি রচিত। কবিতাটি আছে ‘ধৃতরাষ্ট্রের মা’ কাব্যগ্রন্থে। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ ছিলেন। তাঁর জন্ম ইতিহাস ও অস্থিরতার ইঙ্গিত আছে। অন্ধকার সময়ে অনেক অন্ধকারের কথা বলতে চায় এই কাব্য । ‘কুমারী গর্ভ’ ছাড়াও ‘গর্ভপাত১’, ‘গর্ভপাত২’, ‘শকুন্তলার গর্ভসঞ্চার’, প্রভৃতি কবিতা নারীর এক বিশেষ অবস্থা এক বিশেষ চেতনার কথা বলে। সমাজে নারীর অবস্থান চিত্রিত হয়। নারীর গর্ভসঞ্চার, গর্ভপাত, ভ্রূণ হত্যা ইত্যাদি বিষয় ভাষা পায়। ‘কুমারী গর্ভ’ কবিতার কাহিনী প্রায় সবার জানা। সেটি হল সত্যবতীর কাহিনী। সত্যবতীর বাল্যকালে নাম ছিল মৎস্যগন্ধা। তিনি জন্মেছিলেন মৎসরূপা অপ্সরা অদ্রিকার গর্ভে, বসুরাজের ঔরসে। মৎস্যের পেটে জন্ম হওয়ায় তাঁর গায়ে আঁশটে গন্ধ ছিল সেজন্যই তাঁর নাম মৎস্যগন্ধা। জন্মের পর তিনি দাশরাজের কাছে লালিতপালিত হন। পরে বয়স বাড়লে তিনি যমুনা নদীতে নৌচালন কার্যে নিযুক্ত হন। এক সময় পরাশর মুনি সেই নৌকায় যমুনা পার হওয়ার সময় মৎস্যগন্ধার সঙ্গে মিলিত হয়ে তাঁর গায়ের মৎস্যগন্ধ দূর করে পদ্মগন্ধে ভরিয়ে তোলেন। আর নাম রাখেন সত্যবতী। পরাশর মুনির ঔরসে সত্যবতীর গর্ভে বেদব্যাসের জন্ম হয়। পরে এক শর্তে সত্যবতীর সঙ্গে গঙ্গাদেবীর স্বামী শান্তনুর বিয়ে হয়। শান্তনুর প্রথম পুত্র দেবব্রত প্রতিজ্ঞা করেন তিনি কখনো রাজা হবেন না ও চিরকৌমার্য ব্রত পালন করবেন। যার ফলে কোনো উত্তরাধিকার আসবেনা। সিংহাসনের দাবী জানাবে না। এই শর্তেই দাশরাজ সত্যবতীর সঙ্গে শান্তনুর বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর সত্যবতীর দুটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। যাঁদের নাম চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। শান্তনুর মৃত্যুর পর দেবব্রত বা ভীষ্ম চিত্রাঙ্গদকে রাজা করেন। কিন্তু চিত্রাঙ্গদ কিছুদিন পরই মারা যান। এরপর ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যকে রাজা করেন। ভীষ্ম কাশীরাজের কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে হরণ করে আনেন বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিয়ে দেবেন বলে। কিন্তু অম্বা সৌভরাজ শাল্বকে বরমালা দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন। তাই অম্বিকা ও অম্বালিকার সঙ্গে বিচিত্রবীর্যের বিয়ে হল। বিচিত্রবীর্যও নিঃসন্তান অবস্থায় অকালে মারা যান। এই ঘটনায় সত্যবতী তাঁর স্বামীর বংশলোপ পাবে এই আশঙ্কায় দুঃখিত ও বিচলিত হলেন। তারপর ভীষ্মের সঙ্গে পরামর্শ করে নিজের কুমারী অবস্থায় জন্ম নেওয়া পুত্র ব্যাসদেবের সাহায্যে নিজ দুই পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকাকে গর্ভবতী করেন। তারফলে ধৃতরাষ্ট্র ও পান্ডু নামের দুই পুত্রের জন্ম হয়। এই কাহিনী অবলম্বন করে অশোক মহান্তী ‘কুমারী গর্ভ’ কবিতায় একটি বিশেষ দিকের প্রতি আলোকপাত করেছেন। সত্যবতীকে নিয়ে এই কবিতা লেখা হলেও মহাভারতের অন্য নারীরাও যেমন দেবযানী, শকুন্তলা, দ্রৌপদী, গান্ধারী উঠে এসেছেন। উঠে এসেছেন কর্ণ, একলব্য ইত্যাদি বঞ্চিত অপমানিত অবহেলিত পুরুষ । উঠে এসেছেন একালের বঞ্চিত প্রান্তিক নারী রঞ্জনা সরেন। দীর্ঘ কবিতা কিন্তু শেষ অংশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম কিছুটা বাদ দিয়ে আমরা শেষ অংশ পড়ব। কবিতাটির শেষে এস দেখবো শুধু আলো নয়, বিস্ফোরণ।

   ‘কী যেন আর্তির পরশ ছুঁয়ে যায় অনূঢ়া কুমারীর গলাতে
   কী যেন আটকায়, বলতে চেয়ে তবু কিছুতে বলা আর যায় না
   ভেতরে গেছে বিষ, ও বিষ গর্ভের ভেতরে ঢুকে গেছে তলাতে
   নারী যা চায়, আর নারী যা চেয়ে থাকে, কুমারী কিছুতে চায় না

   শরীর ভরে আসে ঘুমের তীব্রতা, চোখের পাতাগুলি কাঁপছে
   শরীরে হিমবাহ, জ্যোৎস্না খেয়ে ফেলে জনতা, জনপদ থৈ থৈ
   ভেতরে জন্মের গভীর শেকড়ের লজ্জা ক্রমাগত টানছে
   তা যদি ঠিক হয়, সত্যি হয়ে ওঠে, লজ্জা লুকোবার স্থান কই?

   অগম্য বনে মুনি চলে যান কুমারী ফিরেছে গজে
   মাছের গন্ধ, আঁশের গন্ধে, জেলে পল্লীর কুঁড়েঘর
   দূরে হস্তিনা, শত জনপদ, রাজা বসেছেন মঞ্চে
   কুমারী ওসব কিছুই জানে না, বালি উড়ে আসে ঝর ঝর

   কী জানি আজই কেন আঁশুটে গন্ধের তীব্র ঝাঁজ ঢোকে নাসিকায়
   তরুণী ঘাট থেকে গভীর জ্যোৎস্নায় নীরবে একা এসে দাঁড়ালো
   ওপারে হর্ম্যের চূড়োটি দেখা যায় হয়তো হস্তিনা হবে ওই
   মুনি যা বলে গেছে, তাই কি হবে ঠিক, নাকি সে নিজেকেই ভাঁড়লো

   শরীর হিম হয়, শরীর ক্রমাগত গভীর ক্লান্তিতে পুড়ছে

   শরীর ভারি হয়, রাতের পল্লব, দু-হাত তুলে বলে ভয় নেই
   লজ্জা লুকোবার আদিম মাটি আছে গর্ভনাশ করা বৈধ
   তরুণী ভাবে ছি ছি, মুনির বীজ আছে, তাছাড়া সন্তান পুঙ্গব

   সুদূর হস্তিনা, জনতা জনপদ, স্বপ্ন এঁকে দেয় কুমারীর
   তাছাড়া শরীরের উগ্র কটু আঁশ গন্ধ নিয়ে গেছে মুনিবর
   ভারতকাব্যের স্রষ্টা হবে ওই জারজ সন্তান ব্যাসদেব
   তরুণী ভাবে- আর দু’চোখ জুড়ে আসে, জ্যোৎস্না রাত্রির পল্লব

   কোন স্বপ্নই মরে না, কিছুতে মরে না
   শুধু দিন যায়- দিন চলে যায়, অস্থির।

   হঠাৎ একদিন গর্ভ মোচড়ায় জরায়ু খসে নামে শাদা জল
   ভারতকাব্যের স্রষ্টা সেই শিশু ধীবর পল্লীতে নামলো
   কীভাবে নিলো তাকে সমাজ? সংসার? কিছুই জানেনা সে শিশুটি
   সে শুধু মা-কে দেখে, কুমারী মা-কে দেখে, চোখের পাতা দুটি ঢাকলো

   হস্তিনা নগরে আজ বৈধ সন্তানের হত্যা হবে। আগেও হয়েছে সাতবার!
   রাণী খুব সমাদরে শিশুটিকে বুকে নিয়ে চলেছেন ঐ গঙ্গাধ্বনি
   যেখানে ছলাৎছল্ যেখানে ছলাৎছল্ বয়ে যায় ক্রম-নিম্নমুখী
   অবাধ সাগরে-ছন্দে।

   মহাভারতের বীজ, ভারতকাব্যের স্রষ্টা, বৈধাবৈধ, ছলনা ও নারী
   এ নিয়ে ভারতকাব্য।
   সুদূর হস্তিনা কিম্বা ধীবর পল্লীর ঘোলাজল আজ খুব মনে পড়ে।
   এ দেশে সহস্র বৈধ সন্তানের হত্যা হয় তবু, কুমারী মোচন করে
   গর্ভশাপ।

   নারী ও ছলনা থেকে, পাপ থেকে, আত্মভুক্ অভিমান থেকে
   যে কাব্যের শুরু হলো তার, আমূল সংস্কার বেঁধে মনের মাটিতে,
   তবু মুক্তি নেই ভারতবর্ষের, কুমারী গর্ভের কোন মুক্তি নেই
  
   মুক্তি আছড়ায় নারীর তলপেটে, মুক্তি আছড়ায় জানালায়
   গোপন জরায়ুতে ধীবর পল্লী ও সুদূর হস্তিনা এক হয়
   বৈধাবৈধের কোনই নীতি নেই, মানুষই নীতি ভেঙ্গে গড়ছে
   যা ছিল এককালে কুমারী-সভ্যতা, ক্রমশঃ আজ তাই জায়মান

   বৈধ সন্তান হত্যা হতে পারে, কুমারী গর্ভই ভ্রূকুটির
   এ নিয়ে দেশ জাতি, মানবসভ্যতা, কোথাও কারো মুখে স্বর নেই
   অথচ কুমারীর গর্ভনিকাশের সকল আয়োজন প্রস্তুত
   পুরুষশাসিত এ সমাজ জানে শুধু নিজের স্বার্থের রক্ষণ

   আমরা গর্ভমোচন করেছি বেশ তো
   আমরা গর্ভ অধিকার বোধে রাখতে চাই
   আমরা সবাই মহাভারতের নারীকূল
   ব্যাস, কর্ণ ও ভরত রাজার মায়েরা
   জলে, জঙ্গলে যেখানে যখন ভ্রূণ পাই
   রাখা-না-রাখার পুরো অধিকার আমাদের
   আমরা সবাই মহাভারতের নারীরা।

   হস্তিনা নগরে আজও বৈধ সন্তানের হত্যা হয়। হত্যা হয় ভবিষ্যের।
   কুমারীর গর্ভ থেকে প্রতিদিন রক্তের ক্ষরণ, রিরংসা ও বিবমিষা
   পাপ নয়, অপরাধ নয়, তবু বৈধাবৈধ, নীতি ও ছলনা থেকে দূরে
   প্রতিদিন আত্ম-ক্ষয়।
   ভারতকাব্যের সুস্থ সামাজিক অঙ্গীকারে আজ যুদ্ধের দামামা বাজছে
   যুদ্ধ হচ্ছে কুরুক্ষেত্রে, ধর্ম ও জীবনক্ষেত্রে, কুমারীর লজ্জা থেকে ভ্রূণে।
   একলব্য ছুটে আসছে, ছুটে আসছে প্রথম পান্ডব
   দ্রৌপদীর হাতে তীর।

   তৃতীয় বিশ্বের চোখ, ভারতকাব্যের শোক থেকে, উঠে আসছে দেবযানী
   মা গান্ধারী, শকুন্তলা ইত্যাদি নারীরা, উঠে আসছে
   রঞ্জনা সরেন।
     ( কুমারী গর্ভঃ ধৃতরাষ্ট্রের মা )
        ( ক্রমশ )

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments