জ্বলদর্চি

গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় পর্ব -৯/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী


গওহরজান - এক বিস্মৃত অধ্যায় 
পর্ব -৯                               

দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী    


কলকাতাতে ফিরে আসার পরে তার জীবন যেন আরো জটিলতার মধ্যে আবর্তিত হলো। একদিকে গ্রামোফোন কোম্পানির ক্রমাগত রেকর্ডিংয়ের চাপ অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী সঙ্গীতশিল্পীদের সাথে প্রতিযোগিতা। এছাড়াও তার মায়ের আশ্রিত ভগলু, যাকে তাঁর মা সন্তানবৎ পালন করে নিজের কেনা বাড়ির একাংশ দানপত্র করে দিয়েছিলেন তার ক্রমাগত দুর্ব্যবহার এবং গওহরের ম্যানেজার ইউসুফের বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা। গওহর স্থির করলেন ইউসুফকে প্রথমে বিদায় করার কথা। এই সময়ে তার এক পারিবারিক বন্ধু এক পাঠান যুবক, সৈয়দ গুলাম আব্বাস সওজোয়ারিকে নিয়ে এলেন যাকে গওহর তার ম্যানেজারের দায়িত্ব দিলেন। এই যুবকটি গওহরের থেকে দশ- বারো বৎসরের ছোট, কিন্তু শান্ত বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের। ধীরে ধীরে তার কাজকর্মের গুনে ও সুস্বভাবের জন্য আব্বাস গওহরের বিশ্বাসভাজন হয়ে গেল। এরপরে যখন কলকাতার বাইরে গওহর অনুষ্ঠান করতে যেতেন তখন এই আব্বাস ও তার বাবা গুলাম মেহেদী হাসান খানকে দায়িত্ব দিয়ে যেতেন ভগলুর বিভিন্ন অনৈতিক কাজ কর্মের ব্যাপারে নজর রাখার জন্য। একবার কলকাতার বাইরে অনুষ্ঠান চলাকালীন ম্যানেজার আব্বাসের কাছ থেকে খবর পেলেন ভগলু গওহরের সিন্দুকের তালা ভেঙ্গে টাকা চুরির চেষ্টা কালীন আব্বাসের হাতে ধরা পড়ে এবং আব্বাস তার নামে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে। 

সব খবর পেয়ে গওহর ভাবলেন আব্বাস দায়িত্বশীল ম্যানেজারের ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু আব্বাসের এই সমস্ত বিশ্বাসভাজন হওয়ার কাজ যে ভবিষ্যতে গওহরের জীবনকে দুর্বিষহ করে দিয়েছিল সেই ঘটনা আমরা ধীরে ধীরে ব্যক্ত করব। আপাততঃ কিভাবে গওহর আব্বাসের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন সেই ঘটনা বলছি।        কলকাতায় ফিরে এসে গওহর আব্বাসকে নিয়ে চীফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে যেয়ে ভগলুর নামে মদ্যপান করে অশান্তি সৃষ্টি, টাকা চুরির চেষ্টা, জোরকরে বাড়ির দখল নেওয়া এবং বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগ জানিয়ে মামলা দায়ের করলেন। এরপরে ভগলু প্রথমে ম্যানেজার আব্বাস ও তার বাবার নামে এবং পরবর্তীকালে গওহরের নামে পাল্টা মামলা করে দিল।গওহরের বিরুদ্ধে মামলায় তার অভিযোগ ছিল ভগলুই মলকাজানের একমাত্র পুত্র এবং গওহর তার সৎ বোন। যেহেতু মলকাজান মারা যাবার সময় কোন উইল করে যেতে পারেননি তাই ভগলু সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার। সে আরো অভিযোগ করেছিল মলকাজানের সাথে এক আর্মেনীয় ভদ্রলোকের অবৈধ সম্পর্কের ফল এই গওহরজান। স্বভাবতঃই গওহরের দায়িত্বে এসে পড়লো তার আসল পিতা ও মা মলকাজানের সম্পর্ক কি ছিল এবং আসল পিতার অনুসন্ধান করে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়ার। কাজটি যদিও খুবই দুরূহ কিন্তু গওহর কিভাবে সেই অনুসন্ধান করে তার বাবাকে আদালতে সাক্ষ্য দিতে নিয়ে এসেছিল তা গোয়েন্দা কাহিনীর মতো টান টান উত্তেজনায় ভরপুর।    

আদালতে মামলা শুরু হওয়ার পরে কলকাতা ও কলকাতার বাইরের কিছু সাজানো সাক্ষী নিয়ে এসে ভগলু আদালতে ভুল তথ্য পরিবেশন করে গওহরের জন্মের জটিলতা বাড়িয়ে দিল। গওহর তার সঠিক জন্ম বৃত্তান্ত আদালতে পেশ করার জন্য সে আদালতের কাছে কিছু সময় প্রার্থনা করে নিজেই অগ্রসর হল। কলকাতা থেকে গওহর ছদ্মবেশে বোরখাতে মুখ ঢেকে আজমগড়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন যাতে পথিমধ্যে তাকে কেউ না চিনতে পারে। কিন্তু আজমগড়ে পৌঁছানোর পরে রবার্টের সন্ধান কেউ দিতে পারল না। শেষ পর্যন্ত তার ঠাকুমা রুক্মিণী যে শুকনো বরফের কলে কাজ করতেন সেখানকার এক বৃদ্ধ জানালেন রবার্ট নামে একজন এখানে বরফ কলে কাজ করতেন কিন্তু কিছুদিন পরে সে এলাহাবাদে চলে যায়। এই খবর শুনে গওহর এলাহাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। এলাহাবাদে বহু খোঁজাখুঁজির পরে কিছু লোক রবার্টের নাম শুনে চিনতে পারল এবং তারা একটি বাড়ি দেখিয়ে দিল যেখানে রবার্ট তার বর্তমান স্ত্রীকে নিয়ে বাস করছিলেন। সেখানে যেয়ে দরজায় টোকা দিতে মাঝবয়সী বছর পঞ্চান্নোর এক আর্মেনীয় ভদ্রলোক বেরিয়ে আসতে গওহরের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন তাকে জানিয়ে দিলো এই তোমার বাবা রবার্ট ইয়েওয়ার্ড। গওহর যখন সেই ভদ্রলোককে বললেন যে সে তার প্রথম স্ত্রী বিকি ওরফে ভিক্টোরিয়ার মেয়ে তখন সেই ভদ্রলোক অস্বীকার করলেন। কিন্তু গওহর যখন তার পকেট থেকে একটি আংটি বের করে দেখালেন যেটি রবার্ট ভিক্টোরিয়াকে বিয়ের দিনে পরিয়ে দিয়েছিলেন। 

আংটিটি দেখার পরে রবার্ট সমস্ত ঘটনা স্বীকার করে জিজ্ঞেস করলেন বর্তমানে সে কোথায় থাকে এবং কি করে। তার উত্তরে গওহর সহ ঘটনা জানিয়ে বললেন সে এখন কলকাতার এক নম্বর বাইজি এবং গ্রামোফোন কোম্পানির 'সেলিব্রিটি' গওহরজান। তার সম্পত্তি নিয়ে মামলার বিবরণ শুনে রবার্ট বললেন কলকাতায় যেয়ে তিনি ইওহরের জন্ম পরিচয় সম্পর্কে আদালতে বিশদ সাক্ষ্য দেবেন তাতে আদালত সত্য ঘটনা জানতে পেরে সঠিক বিচার করেন, কিন্তু তার জন্য তাকে ৯০০০ টাকা দিতে হবে। এই কথা শুনে গওহর তার বাবার উপরে অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে কলকাতা ফিরে গেলেন এবং তার উকিলের কাছে সমস্ত ঘটনা ব্যক্ত করলেন। ফলস্বরূপ আদালতের সমন পেয়ে রবার্ট বাধ্য হয়েছিলেন আদালতে এসে গওহরের জন্ম বৃত্তান্ত ব্যক্ত করতে এবং গওহরের পক্ষে মামলার রায় দিয়ে বিচারক তাকেই সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার সাব্যস্ত করেছিলেন। এই সময়ে গওহর আবেগের বশবর্তী হয়ে এমন একটি ঘটনা ঘাটালেন যা তার জীবনকে পুনরায় বিপর্যস্ত করে তুলল।        

  এলাহাবাদে গওহর তার বাবার ব্যবহারে বীতশ্রদ্ধ হয়ে কোনরূপ সহানুভূতি না পেয়ে কলকাতায় তার বাড়িতে ফিরে ম্যানেজার আব্বাসকে দেখে একান্ত আপনজন ভেবে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাচ্চা মেয়ের মতো কাঁদতে লাগলেন। আব্বাস তার ব্যবহারে হকচকিয়ে গেল কারণ যে মালকিনকে সে শ্রদ্ধা, ভক্তি করত তার আজ একি আচরণ। সে তো এলাহাবাদের ঘটনা না জেনে এইভাবে ভুল ধারণা করল। কিন্তু গওহর যা করেছিলেন সেটি তার আবেগের বশবর্তী হয়ে এবং আব্বাসকে তার একান্ত হিতাকাঙ্খী ও সুহৃদ হিসেবে। পূর্বে উল্লেখ করেছি ভগলুর দায়ের করা মামলাতে রবার্টের সাক্ষ্যদানের ফলেই গওহর জয় লাভ করে এবং আদালত ভগলুকে বাড়ির মালিকানার দাবি অগ্রাহ্য করে তাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। এদিকে আব্বাসের কাছে আবেগে আত্মসমর্পণ করার পরে গওহর আব্বাসকে নিজের ভবিষ্যতের আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করলেন এবং সেই ধারণার বশবর্তী হয়ে সেই সম্পর্ককে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মের প্রথানুযায়ী 'মুটা ম্যারেজ' করলেন। ইসলাম ধর্মে 'মুটা ম্যারেজ' একটি বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের প্রথা যার দ্বারা দুটি প্রাপ্তবয়স্ক নর-নারী একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে বিবাহিত জীবন যাপন করতে পারে। এর ফলে আব্বাস ও গওহর স্বামী স্ত্রী রূপে বসবাস করতে লাগলেন। আগেই বলেছি গওহর ছিলেন ভালবাসার কাঙ্গাল। তিনি আব্বাসকে প্রেমে ভরিয়ে দিতে লাগলেন। শুধু তাই নয় আবেগের বশবর্তী হয়ে আব্বাসকে চিৎপুর রোডের প্রাসাদতুল্য বাড়ীটিও তাকে দানপত্র করে দিয়ে দিলেন। 
      ক্রমশ ……

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments