জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা-১৮/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা

অষ্টাদশ পর্ব : শৈশবের খেলাধূলা

সুরশ্রী ঘোষ সাহা


মানুষের জীবনে সবচেয়ে সুখের যদি কোন সময় থেকে থাকে, তা হল শৈশব। প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা গ্রামের ছেলেমেয়েদের শৈশব যে শহুরে ছেলেমেয়েদের শৈশবের থেকে অনেক বেশি মিষ্টি মধুর হয়, তা নদীয়ার বগুলা গ্রামের মেয়ে দীপিকার কথা না শুনলে জানা হত না। এখনকার বাচ্চাদের খেলাধূলার রকম সকম দেখলে আমার মায়া হয়। ভাবি আমার শৈশবটা কতই না সুন্দর ছিল। কিন্তু আজ আমার নয়, বরং গ্রামের ছেলেমেয়েদের খেলাধূলা নিয়ে লিখব।

 আমারই মতন চল্লিশের কোঠায় পৌঁছচ্ছে দীপিকা। ফর্টিস সিনড্রোমের প্রথম লক্ষণ যে বড় নস্টালজিক হয়ে পড়া, তা ওকে দেখেও টের পাই। দীপিকার মুখেই শোনা, আজ বগুলা গ্রামও শহর হয়ে উঠেছে ভিতরে ভিতরে। ওদের বাড়িটা তখন চারবিঘা জমির মাঝে দাঁড়িয়ে থাকত। এখনকার মতো পাঁচিল ছিল না। পাঁচিলের মতো দাঁড়িয়ে থাকত সারি সারি খেজুর গাছ। একান্নবর্তী পরিবারে ওরা চোদ্দটা ছেলেমেয়ে মিলেমিশে বড় হয়েছে। শীতের ভোরে যখন খেজুর গাছে বেঁধে রাখা রসের হাঁড়িটা পেড়ে আনা হত, ওরা ছোট ছোট বাচ্চারা মাটির পথের ধারে মুখে রোদ মেখে চটের বস্তা পেতে সারি দিয়ে বসে পড়ত। বাটি করে সেই সদ্য পাড়া রস আর খুদে মুড়ি মেখে খাওয়ার মধ্যে অভূতপূর্ব সুখ খুঁজে পেত। 

 দীপিকার মুখে সেই গল্প শুনে আমি কল্পনা করতে থাকি সেই দৃশ্য। দূর থেকে ঝাপসা হয়ে থাকা এক ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমরা শহুরে কায়দায় বড় হওয়া ছেলেমেয়েরা যে ছবির সাথে কোনদিনই পরিচিত হইনি। আমাদের পাড়ায় শীতের ভোরে কাঁধে বাঁকে করে হাঁড়িতে করে খেজুরের রস নিয়ে যেতে দেখেছি। স্টিলের গ্লাসে ঢেলে দিয়ে যেত সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে। সেই রস বেশি বেলায় এলে বাবা খেতে দিত না। মজে গিয়ে থাকবে, সেই ভয়ে। 

 অর্ধেক জীবন আমরা শহরের মানুষরা তো ভয়েই কাটিয়ে দিই। অথচ দীপিকার মুখে শুনি, কত শীতের দুপুরে জমি থেকে কড়াইশুটি ছিঁড়ে এনে কালি লাগানো হাঁড়ি উনানে বসিয়ে প্যাকাটি ও শুকনো কাঠ দিয়ে আগুন ধরিয়ে, সেই মটরশুটি সেদ্ধ করে ওরা ভাইবোনেরা নুন দিয়ে খেত। শিশুমনে কত আনন্দ ছড়িয়ে পড়ত। আমরা কি নিজেরা পেরেছি তা কখনো? নাকি আজও আমাদের ছেলেমেয়েদের ছেড়ে দিচ্ছি আগুন নিয়ে খেলতে। ঐ যে ভয়... 

 খেজুর গাছের যখন আগা কাটা হত, তখন মাঝের অংশ কাটার সময় মাজি পাওয়া যেত। যা ছিল অনেকখানি মিষ্টি থোড় টাইপের। সেটা খেতেও নাকি শিশুমুখে খুব ভাল লাগত। বাচ্চারা দৌড়াত মাজি খাবে বলে। গাছের আতা পেড়ে বিচালির পালার মধ্যে রেখে লুকিয়ে রাখত। তারপর সেই আতা পেকে উঠলে সবাই মিলে খেত। 

 জমির ছোলাসুদ্ধু গাছ পুড়িয়ে তার ভিতর থেকে ছোলা বের করে খাওয়ার মজাও ছিল প্রচুর। বাড়ির গাছের বাতাবি লেবু গাছে উঠে লেবু পেড়ে কোয়া বের করে লবন লঙ্কা দিয়ে মেখে খাওয়া, কী গাছের পাকা তেঁতুল পড়ে গেলে তাকে ধুয়ে লবন লঙ্কা দিয়ে চটকে কাঁঠাল পাতা মুড়ে ঠোঙা করে চুমুক দিয়ে খাওয়া ছিল খেলার মতন। এছাড়া কুল, আমড়া ও তার ডাঁটি চিবিয়ে রস খাওয়া, গাছের পেয়ারা, কাঁচা আম কুড়িয়ে মেখে খাওয়া যেন ছিল সারা বছরের খেলা। কাঁচা-পাকা পেঁপে গাছ থেকে পেড়ে ধনেপাতা আর তেঁতুল লঙ্কা মেখে খেজুরের কাঁটাকে চামচের মতো ব্যবহার করে মুখে ভরতো। এমনটা ঐ গ্রামের পরবর্তী প্রজন্মও করতে শেখেনি। 

 দীপিকা হাসে, বলে জানো, আজ বড় হয়ে বুঝতে পারি, কী প্রচন্ড আয়রন - ভিটামিন - প্রোটিন - ক্যালসিয়াম সংগ্রহ করে নিতাম শুধু খেলার ছলে। কখনো খাবারের ঘাটতিজনিত কোন অসুখ-বিসুখ বাঁধেনি। আর এখন মায়েরা হরলিক্স-কমপ্ল্যান নিয়ে বাচ্চাদের পিছনে ছুটছে। ছোট ছোট বাচ্চাদের কত অসুখ বিসুখের খবর শুনতে পাই। 

 ফাল্গুনে যখন গোড়া থেকে সর্ষে ধরা গাছগুলো কেটে এনে শুকাতে দেওয়া হত, রোদের তাপে ফট ফট করে সর্ষে ফেটে ছড়িয়ে পড়ত সারা উঠোন। আর বাচ্চারা তার উপর উঠে লাফালাফি করতেই গড়িয়ে পড়ত। যত পড়ে যাওয়া ততই খিলখিল হাসি... 

 পাট পচার গন্ধ যে কখনো শিশু মনে সুখ সঞ্চার করতে পারে, গ্রামে বেড়ে ওঠা মেয়ে দীপিকার কথা না শুনলে কি জানতাম কোনদিন! দীপিকা গল্প করে, বর্ষার সময় যখন পাট পচতো জলা জায়গায়, খুব বাজে গন্ধ উঠতো। অথচ, সেই গন্ধ ছিল আমাদের কাছে মন ভাল করা এক গন্ধ। কারণ, এর পরপরই যে পুজো আসবে। নতুন জামাকাপড় হবে। বর্ষার শেষেই যে শরতের আগমন। 

 জানো, আমাদের সবচেয়ে ভাল সময় কাটতো যখন ঝুলোন আসত। আমাদের বাড়িতে মাঝে মধ্যেই কাঠের মিস্ত্রিরা বসে বসে এটা ওটা আসবাব বানিয়ে দিয়ে যেত। এখন যেমন, দোকান থেকে ঘরে আসবাব কিনে আনার চল। কিন্তু তখন ঘরে ছুতোর মিস্ত্রিরা এসে সেসব করে দিয়ে যেত। আমরা বাচ্চারা তক্কে তক্কে ঘুরতাম। মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা কাঠের গুঁড়ো মুঠোয় ভরে প্যাকেটে কিংবা ঠোঙায় করে সরিয়ে রাখতাম। তারপর ঝুলোনের সময় সেই গুঁড়ো দিয়ে পাহাড় বানানো হত। আঙুল দিয়ে খাবলে শ্যাওলা নিয়ে এসে সেই পাহাড়ের গায়ে দিয়ে দিতাম। দেখতে যেন অবিকল পাহাড় হয়ে উঠত। লোকের বাড়ির বাহারি গাছের ডাল ভেঙে এনে জঙ্গল বানাতাম। তখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে মাথায় ঝুড়ি করে মাটির পুতুল বিক্রি করতে আসত। বায়না করে কত ছোট ছোট মাটির পুতুল কিনতাম আমরা। পশুদের মতো দেখতে, কিংবা মানুষের আকৃতির। অনেক পরের দিকে সেই মাটির পুতুল হারিয়ে গেল। এল প্লাস্টিকের পুতুলের চল। 


 ইঁটের উপর পাটকাঠি দিয়ে বেঁধে গোবর আর মাটি লেপে গোলা বাঁধা হত তখন। মাথায় থাকত বিচালির ছাওয়া। সেই গোলায় ধান ঢুকিয়ে রাখা হত। গোলায় ধান ঢোকানোর আগে ইঁদুরেরা জমির সদ্য ঝাড়া ধান মুখে করে নিজেদের গর্তে ঢুকিয়ে নিত। আর আমাদের বাচ্চাদের খেলা ছিল, ইঁদুরের গর্তে হাত ঢুকিয়ে সেই চুরি যাওয়া ধান মুঠোয় ভরে বের করে আনা। 

 ধান কাটার পর জমিতে থেকে যাওয়া গোড়ার উপর দিয়ে দৌড়ে দৌড়ে গোলাছুট খেলতাম। কত ডাংগুলি খেলা খেলেছি, কাঠের ফালি দিয়ে কিংবা লাঠি দিয়ে। বাবা জ্যাঠারা মেয়েগুলোকে বকত। বলত, তোদের বিয়ের জন্য যে ছেলে পাওয়া যাবে না। 

 আমাদের আরো এক মজার জিনিস ছিল, নৌকা চালানো। হাত বদল করে করে খাল পথে নৌকা বাইতাম। চূর্ণী নদীর জল খাল পথে বিলে গিয়ে মিশতো। সেই খাল দিয়ে নৌকা করে বিলে গিয়ে উঠতাম। পরে বড় হয়ে জেনেছি, ৩৪ নং সড়কের নিচ দিয়ে ঐ খালের জল বিলে গেছে। বগুলা থেকে কৃষ্ণনগর যাওয়ার রাস্তার নিচে সেই খাল। ত্রিকোণ আকার বাঁশ দিয়ে জলে জাল ফেলে মাছ ধরার ব্যবস্থা করা থাকত। হাঁ করে তাকিয়ে দেখতাম, কত সুন্দর কায়দায় সেই বাঁশের আটকানো জাল জলে ফেলে দেওয়া হত। আর জলের তোড়ে মাছ উঠে আসত জালে। তারপর আবার বাঁশ সরিয়ে ফেলতেই মাছসুদ্ধু জাল উপরে উঠে পড়ত। পাশে রাখা পাত্রে জেলেমাঝিরা মাছ ভরে নিত। আমরাও আমাদের নৌকায় ছোট ছোট মাছ, কাঁকড়া যা পেতাম ভরে নিয়ে ফিরতাম। গোলাপী শাপলা সুদ্ধু লম্বা ডাঁটা ভরে নিতাম। মন ভরে উঠত শীতের বিকেলে দূর দেশ থেকে উড়ে আসা পরিযায়ী পাখি দেখে। তারা সারা দুপুর-বিকাল বিলে চরে বেড়াত। গোধূলির রঙ মাখা সোনালী আলো ওদের ডানায় পড়ে চিকচিক করত।

 দীপিকার স্মৃতি রোমন্থন শুনে আমার আফসোস হয়, আহা, আমিও যদি সবুজ গাছগাছালি ঘেরা, নদী পাখ-পাখালি ঘেরা গ্রাম্য পরিবেশে শৈশব কাটাতে পারতাম! 
                                                                      (ক্রমশ...)

ছবি : সৌমায়ণ বিশ্বাস

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments