জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-২৬/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২৬

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দ্বিতীয় মঠ হিসেবে বিবেচিত হয় আলমবাজার মঠ। ১৮৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এটি প্রতিষ্ঠা হয়। ১৮৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এখানেই সঙ্ঘের মঠ ছিল। এরপর গঙ্গাতীরবর্তী বেলুড়ে স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়। এই আলমবাজার মঠ ভূমিকম্পের কবলে পড়ে। এই বিষয়ে জানা যাচ্ছে ১৫ জুন, ১৮৯৭ সালে তুরীয়ানন্দজী লিখিত পত্র থেকে। তিনি গুরুভাই গঙ্গাধরকে (স্বামী অখণ্ডানন্দজী) লিখছেন--“ভাই গঙ্গাধর, তোমার একখানি পত্র পাইয়া তোমাদের কুশল সংবাদ পাঠে অতিশয় আনন্দিত হইলাম। আমরাও তোমাদের জন্য বিশেষ চিন্তিত ছিলাম। এখানেও গত শনিবার ঠিক পাঁচটার পর ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হইয়া গিয়াছে। আমাদের সম্মুখের বাটীর বহির্দেশের উপরিভাগ একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। আমাদের মঠের যদিও কোনস্থান একেবারে পড়িয়া যায় নাই, কিন্তু অনেক স্থানই ফাটিয়া বিশেষ জখম হইয়া একেবারে বাসের অনুপযুক্ত করিয়াছে। আমরা পরদিন হইতেই বাটীর সন্ধান করিতেছি, কিন্তু সুবিধামত পাওয়া যাইতেছে না। এমন বাটী নাই যাহা গত ভূমিকম্পে কোন আঘাত পায় নাই। কলিকাতায় অনেক বৃহৎ বৃহৎ অট্টালিকাও ধূলিসাৎ হইয়াছে, শুনিয়াছি অনেক জীবনও নাকি নষ্ট হইয়াছে, কি দুর্দৈব!”

 বস্তুতপক্ষে স্বামী তুরীয়ানন্দজীর পত্রসমূহ ত্যাগী ও গৃহস্থ উভয় ভক্তকুলের কাছে অনুপ্রেরণাস্বরূপ। জনৈক সন্ন্যাসীকে একটি চিঠিতে লিখছেন--“বেশ সুভিক্ষ দেশ দেখিয়া নিরুপদ্রব স্থানে একান্তে অবস্থান করিবে এবং সর্ব্বোপরি নিরন্তর তাঁহার ভজনে নিযুক্ত থাকিবে, এবং সৎসঙ্গ ও সৎশাস্ত্রের চর্চ্চা কখনও পরিত্যাগ করিবে না। কিছুদিন আবার এইরূপ করিতে পারিলে তাঁহার কৃপায় শান্তি আসিবে এবং ভজনে মন বসিয়া যাইবে। যদি অধিকক্ষণ ধ্যান করিতে কষ্টবোধ হয়, কিছুক্ষণ জপ করিবে, তাহাতে ক্লান্তিবোধ হইলে একটু পাঠ করিবে নতুবা স্তব স্তুতি গান প্রভৃতি করিয়া মনকে তাঁহার প্রতিই নিযুক্ত রাখিবে। অর্থ সঞ্চয়ে মন দিবে না, অর্থ থাকিলে নানা অনর্থ আসিয়া জোটে। দুই প্রকার মায়া আছে -- কাম ও কাঞ্চন। দুইই হইতে দূরে থাকিলে তবে ভজন হয়।” দীক্ষা বিষয়ে একটি পত্রে জনৈককে জানাচ্ছেন --“তোমার প্রশ্নের আর কি দিব উত্তর? দীক্ষা তো গ্রহণ করিতেই হয়। আমি কিন্তু দীক্ষাদি কখনও দিই নাই এবং দিবও না। সুতরাং এ সম্বন্ধে তোমার অন্যত্র চেষ্টা পাইতে হবে। আমি যেমন বুঝি -- যথাসাধ্য উপদেশাদি দিয়া থাকি, এই মাত্র। কর্ণে মন্ত্র দেওয়া প্রভৃতি কার্য আমার দ্বারা হইবে না, হয়ও নাই। সোজা কথা সোজাভাবে বলাই ভালো। ভগবান অন্তর্যামী। শ্রদ্ধা থাকিলে তিনি তোমার ইচ্ছামত সকল বিধান করিবেন। আমি ইহা সম্পূর্ণ বিশ্বাস করি। তিনি তোমার আন্তরিক দীক্ষাগ্রহণ-কামনা পূর্ণ করুন-প্রার্থনা।” সম্ভবত এই ব্যক্তিকেই পরবর্তী পত্রে তিনি লিখছেন -- “দীক্ষাগ্রহণ ধর্মজীবনলাভের সহায়ক নিশ্চিত। তবে যিনি ধর্মলাভের জন্য উৎসর্গ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইয়াছেন, অন্তর্যামী স্বয়ংই তাঁহাকে সকল প্রকার সুযোগ করিয়া দেন। দীক্ষার জন্য তাঁহাকে বিশেষ চেষ্টা করিতে হয় না। আসল কথা হইতেছে, তাঁহাকে লাভ করিবার জন্য অন্তরের ব্যাকুলতা এবং যাহাতে লাভ হয়, তাহা করিবার জন্য কায়মনোবাক্যে প্রস্তুত থাকা এবং নিজেকে নিযুক্ত করা। তাহা হইলেই কার্যসিদ্ধি আপনিই হইয়া যায়। গুরুরূপে তিনিই সকল দীক্ষা শিক্ষা দিয়ে থাকেন। ইহা দ্বারা আমি দীক্ষাগ্রহণের অনাবশ্যকতা প্রতিপন্ন করিতেছি না। অনেকের ইহাতে উপকার হয় এবং অধিকাংশের ইহা আবশ্যক হইতে পারে। কিন্তু অন্তরের শ্রদ্ধাই বিশেষ কার্যকরী। ইহা বলাই আমার অভিপ্রায়।” এই পত্রের আরেক অংশে তিনি লিখছেন --“গীতার অনুশীলন ও সেবা করিলে চিত্ত শুদ্ধ হইয়া যায়। সকল বিষয়ে সম্যক অবধারণের ক্ষমতা জন্মে। পরা শান্তি লাভ হয়। তোমার বুদ্ধি পরিষ্কার হইতেছে বুঝিতে পারিতেছ, ইহাতে আমি যার-পর-নাই প্রীতি অনুভব করিতেছি। তাঁহাতেই আত্মসমর্পণ কর, তিনি তোমার পক্ষে যাহা ভাল তাহাই করাইবেন। অধীর হইও না। তিনিই পথ দেখাইয়া দিবেন। যেখানেই থাক, তাঁহাকে ধরিয়া থাকিলে কোন ভয় নাই। খুঁটি ধরিয়া ঘুরিলে পড়তে হয় না। সম্পূর্ণরূপে যে ভগবানে আত্মসমর্পণ করে, তাহার কোন কর্তব্যই অবশিষ্ট থাকে না।

 দেবর্ষিভূতাত্মণনাং পিতৃণাং ন কিঙ্করো নায়মৃণী চ রাজন্। সর্বাত্মনায়ং শরণং শরণ্যং গতো মুকুন্দং পরিহৃত্য কৃত্যম্ -- ইহা ভাগবতোক্তি। কোন চিন্তা নাই, যেমন চলিতেছ, চলিয়া যাও। ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান তাঁতে অর্পণ কর। নিজে কিছু কল্পনা করিও না। দেখিবে, তিনিই তোমার জন্য সকল ব্যবস্থা করিয়া দিবেন।”
 অসাধারণ সব পত্র রয়েছে তুরীয়ানন্দজীর! এগুলি ভক্তহৃদয়ে তীব্র অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করে। পাশাপাশি এই পত্রগুলি যেন সময়ের দলিলও বটে। নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। পরম প্রিয় গুরুভ্রাতা স্বামী অদ্ভুতানন্দজীর (লাটু মহারাজ) মহাসমাধিলাভ নিয়ে স্বামীজীর বিশিষ্ট মার্কিন ভক্ত মিস ম্যাকলাউডকে ইংরেজিতে লিখেছেন অসামান্য পত্র। স্বামী প্রভানন্দ অনূদিত পত্রটি এইরকম -- “(পত্রটি তিনি লিখেছেন রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রম, লাক্সা, বেনারস সিটি, ভারতবর্ষ থেকে ১২ মে, ১৯২০ সালে) প্রিয় মিস ম্যাকলাউড, বরোদভেঞ্জ (Borodvenz) থেকে ৩১ মার্চ তারিখে লেখা তোমার সহৃদয় পত্রখানি আমি পেয়েছি ৬ মে। তোমার নির্দেশানুসারে এ-পত্রের উত্তর পাঠাচ্ছি ইংল্যাণ্ডের ঠিকানায়। খুবই দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, স্বামী অদ্ভুতানন্দ ধরাধাম থেকে বিদায় নিয়েছেন। বিগত ২৩ এপ্রিল মরদেহ ত্যাগ করেছেন। তাঁর মহাপ্রয়াণ বাস্তবিকই এক অতি বিস্ময়কর ঘটনা। যে-মুহূর্তে তিনি এই শেষ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন সেই সময় থেকেই তিনি ধ্যানীর তূষ্ণীম্ভাব আশ্রয় করেছিলেন এবং ধ্যানের গভীরে নিমজ্জিত হয়েই মরদেহ ত্যাগ করেছেন। 

 তাঁর ডান পায়ের গোড়ালিতে একটি ছোট ফুস্কুড়ির মতো হয়েছিল। অস্ত্রোপচারের পর কয়েকদিনের মধ্যে সেটিতে পচনশীল ক্ষত (গ্যাংগ্রীন) দেখা দিয়েছিল। স্থানীয় সর্বপ্রকারের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও কোন সুফল পাওয়া যায়নি, ১০-১২ দিনের মধ্যে পরলোকগমন করেন। রোগ চলাকালীন তাঁর নিকট থেকে রোগযন্ত্রণা বা অপর কোন বিষয়ে কোন অভিযোগ শোনা যায়নি। আশ্চর্যতম বিষয় এই যে, তাঁর মহাপ্রয়াণের পর কিছু অনুষ্ঠানের বিধি অনুযায়ী যখন তাঁকে আসনপিঁড়ি করে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন তাঁকে আমরা দেখলাম চমৎকার সুন্দরদর্শন -- শান্ত, সমাহিত এবং দিব্যভাবে পরিপূর্ণ। তাঁর মুখমণ্ডল অবর্ণনীয় জ্যোতি ও চৈতন্যালোকে সমুজ্জ্বল। মনে হচ্ছিল, তিনি যেন প্রীতিপূর্ণ কল্যাণাকাঙ্ক্ষার উচ্ছ্বাসসহ তাঁর বন্ধুজনেদের নিকট থেকে শেষ বিদায় গ্রহণ করছিলেন। বাস্তবিকই এ-দৃশ্য দেব-ঈপ্সিত। একনাগাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে আমরা শ্রীভগবানের নাম উচ্চারণ করলাম। অতঃপর ফুল, ফুলের মালা, চন্দন ইত্যাদি দিয়ে সুসজ্জিত তাঁর দেহ শোভাযাত্রা করে গঙ্গার তীরে এবং গঙ্গাতীরবর্তী মণিকর্ণিকার ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। জলসমাধির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু আচার-অনুষ্ঠানাদির পর তাঁর দেহ নৌকা করে নিয়ে গিয়ে মা-গঙ্গার পূতবারিতে সমাহিত করা হয়।

 লাটু মহারাজ চলে গেলেন চিরশান্তিনিলয়ে। শ্রীরামকৃষ্ণের অপর একটি সন্তান তাঁর সঙ্গে চিরকালের জন্য মিলিত হলেন। তাঁর অভাবজনিত অপূরণীয় ক্ষতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে, আমরা আজ অধিকতর নিঃস্ব। সত্যিকথা বলতে কি, লাটু মহারাজের তিরোধানে আমরা একজন আধ্যাত্মিক মহামানবকে হারিয়েছি। তাঁর নিরক্ষরতা ও অ-পরিমার্জিত জীবনই তাঁকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছিল তিনি যা, তা হতে অর্থাৎ শ্রীরামকৃষ্ণের একজন নিখাদ ও অত্যুৎসাহী ভক্ত হতে।” এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, জীবনের প্রত্যন্তে স্বামী অদ্ভুতানন্দ কাশীধামে ৯৬ নং হাড়ারবাগ বাটীতে বাস করছিলেন। সেখানেই তাঁর মহাপ্রয়াণ ঘটে।

 (উপরোল্লিখিত সমস্ত পত্র উদ্বোধন কার্যালয় প্রকাশিত ‘স্বামী তুরীয়ানন্দের পত্র’ দ্বিতীয় ভাগ,  থেকে গৃহীত)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments