জ্বলদর্চি

গ্রামের শহুরে রূপকথা /দ্বাবিংশ পর্ব: পথের সাথী/ সুরশ্রী ঘোষ সাহা

গ্রামের শহুরে রূপকথা

দ্বাবিংশ পর্ব: পথের সাথী

সুরশ্রী ঘোষ সাহা

একটা সময় ছিল যখন গ্ৰামজীবনে শুধু পায়ে হাঁটা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কিচ্ছু ছিল না তখন পথে এখান থেকে ওখানে যাতায়াতের জন্য। গরুর গাড়ি এল বহু পরে। বেতের লাঠি দিয়ে ছটাৎ ছটাৎ করে বড় বড় শিংওয়ালা গরুকে পেটাতো ধুতি পরা গাড়োয়ান। আর একচালা ছাউনিতে বসে দুলতে দুলতে পথিক পৌঁছে যেত নিজের গন্তব্যে। কল্পনায় গ্ৰামের পথ ভাবতেই একসময় এমন দৃশ্যই চোখের সামনে ভেসে উঠত।

 খুব প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়  যাতায়াতের জন্য পাল্কির ব্যবহার শুরু হল। গ্ৰামের কিছু বড়লোকের বাড়িতে পাল্কি রাখা থাকত। তারা সেই পাল্কিতে শুধু নিজেরাই চাপত না, ভাড়াও খাটাতো। সারা বছরের জন্য তাই কাহার সম্প্রদায়কে পুষে রাখা থাকত বাড়িতে। যাদের বংশ পরম্পরায় পাল্কি বহন করাই পেশা ছিল। একসময় সেই হুনহুনা হুনহুনা দৃশ্যও গ্ৰামজীবন থেকে হারিয়ে গেল। 


  যখন দু'চাকার সাইকেল এল, তখন সেই সাইকেল ব্যবহারের জন্য লাইসেন্সের ব্যবস্থা করল সরকার। প্রথমদিকে খুব কম মানুষই লাইসেন্সের সাইকেল চড়ত। পাড়ার সকলের বাড়িতেই যে থাকত তা নয়। টাকা জমিয়ে একটা সাইকেল কেনা তখন বিলাসিতার মতন ছিল। যার সাইকেল, কত যত্ন দেখা যেত তার সেই সাইকেল ঘিরে। নিয়ম করে মোছামুছি চলত। রাতে চুরির ভয়ে ঘরে ঢুকিয়ে রাখত। যে ঘরে হয়ত মানুষেরই হাত পা ছড়ানোর জায়গা নেই। কিন্তু বাড়িতে সদ্য বিয়ে হয়ে আসা নববধূর মতন সাইকেলটা ঠিক সেখানে নিজের জায়গা করে নিত। সাইকেলের চারিদিকে নানা জিনিসপত্র বেঁধে ছেদে আমার বাপ - কাকা - দাদারা এদিক সেদিক যাতায়াত শুরু করল। কত আনন্দ তখন ওদের, অতদিনকার হাঁটাহাঁটির কষ্ট দূর হল। সময়ও বাঁচল অনেক।


 পরের দিকে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাইকেল বিক্রি এতটাই বেড়ে গেল যে, সরকার আর তার রাশ টেনে ধরে রাখতে পারল না। সাইকেল থেকে লাইসেন্স উঠে গেল। সাইকেল ততদিনে হয়ে উঠেছে নিত্য ব্যবহার্য এক জিনিস। একটা বাড়িতেই চার - পাঁচটা সাইকেল। সবার নিজস্ব একটা করে। কেউ সাইকেল চেপে স্কুলে যায়। কেউ যায় কলেজ। কেউ-বা চাকরিতে। কেউ জমা রাখে দূর শহরের বাসস্ট্যান্ডে, সেখান থেকে তাকে বাসে চেপে যেতে হয় আরো দূরের কোন জায়গায়। কেউ জমা রাখে গঙ্গার ঘাটের গ্যারাজে। তারপর সেখান থেকে নৌকা করে চলে যায় অন্য শহরে। কখনো ভাড়া দিয়ে নৌকাতেও উঠিয়ে নেয় সাইকেল। কেউ আবার সাইকেল জমা রাখে কোন স্টেশনে। তারপর ট্রেনে চেপে বহু দূরের পথে পাড়ি দেয়। গ্যারেজওলারা জানে কে কখন ফিরবে, কখন এসে তার সাইকেল নিতে চাইবে। তারা মাঝের কিছু ঘন্টা তাই সেইসব সাইকেল ভাড়া খাটিয়ে বাড়তি রোজগারের ধান্ধা করে নিত। আমার পরিচিত এক স্কুলের ক্লার্ককে চিনতাম যে সারা চাকরি জীবন পান্ডুয়া থেকে ট্রেনে এসে চুঁচুড়া স্টেশনের গ্যারেজ থেকে সাইকেল নিয়ে স্কুলে এসে, বিকেলে সেই সাইকেল আবার জমা দিয়ে ট্রেনে চাপত। এক একদিন এক একটা সাইকেল তার সঙ্গী হত। ঘটনাটা শুনে আমার মনে হয়েছিল, ভাগ্যিস! সাইকেলরা কথা বলতে জানে না, নইলে তারা সবকথা মালিককে জানিয়ে দিত। 

  সমাজে সাইকেল যখন জলভাতের মতন বাহন হয়ে উঠল, তখন নতুন করে এল তেলের বাইক। বাইকে করে আরো বহু দূরের পথ খুব কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। মনে পড়ে, আমার শ্বশুর বাড়িতে প্রথম একটা স্কুটার কিনল আমার বর। পাড়ার লোক ভিড় করে দেখতে এসেছিল সেদিন। নতুন জিনিস। তোর বাবা আসত শহর থেকে রাজদূত গাড়ি চালিয়ে। সে কী তার ভটভট ভটভট গুরুগম্ভীর আওয়াজ। দূর থেকে শোনা যেত, ধুলো উড়িয়ে বাইক আসছে। বাইক আসায় আরো সুবিধা বাড়ল তখন মানুষের। বাইকের দুই হ্যান্ডেলে ও আশেপাশে সাইকেলের চেয়েও বেশি জিনিসপত্র ঝুলিয়ে নেওয়া যায়। সে জ্যান্ত মুরগি হোক, কী দুধের বড় বড় ড্রাম। 


 বহুকাল হল জেঠিমার বাড়িতে পাঁচছেলের পাঁচটা বাইক আছে। দুই বৌমার দুটো লাল ও গোলাপী স্কুটি দাঁড়িয়ে থাকে পাশে। জেঠুর সবুজ স্কুটারটা বুড়ো হওয়ায় এখন অচল। বাচ্চারা যে আজও লেংচে লেংচে হাফ প্যাডেল করে একা একাই সাইকেল শিখে নেওয়ায় আগ্ৰহ দেখায়, এটাই অনেক। তবে ওরাও তেরো - চোদ্দ বছর বয়স পেরিয়ে গিয়ে ফুলপ্যান্ট ধরলে মা - কাকিমার স্কুটি ধরে টানাটানি করে। আরো খানিক ঢ্যাঙা হলে বাবার বাইক। 

  জেঠিমা গল্প শোনালো, গাড়িঘোড়ার এত উন্নতি হলেও আজও বেশ কিছু গ্ৰাম আছে যেখানে আগেকার মতন শুধুমাত্র ট্রলি চলে সবধরণের মানুষের যাতায়াতের জন্য। ট্রলিগুলোর সাইজও বড় হয়েছে সময়ের হাত ধরে। ট্রলিতে বসেছে মোটর। ঘডঘড ঘডঘড আওয়াজ ও ধোঁয়া ছড়িয়ে একসাথে বহু মানুষকে বসিয়ে নিয়ে চালক ছুটে চলেছে। যাত্রীদের মধ্যে সেখানে হাঁটু মুড়ে যেমন ঘোমটা টানা বৌ আছে। তেমনি আছে লুঙ্গি পরা ঝুলে থাকা দুই-পা। মাঝখানে কোলে করে উঠিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয় ছোট ছোট কুচোকাচাকে।

 তবে বর্তমানে বেশিরভাগ গ্ৰামের রাস্তায় চলছে হলুদ- সবুজ অটো। লাল - নীল টোটো। জমি থেকে উঠে এসে পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকছে ট্রাক্টর। কলকাতা কিংবা বড় শহরের যানবাহন অ্যাকসিডেন্টের খবর মানুষের কানে পৌঁছলেও, গ্ৰামের পথে যে কত অ্যাকসিডেন্টে মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, তার কোন খবর মিডিয়ায় পৌঁছচ্ছে না। 

  গ্ৰামের ধনী মানুষের বাড়িতে মোটরগাড়িও এসে গেছে। প্রত্যেক পড়ুয়ার হয়েছে দুটো করে সাইকেল। একটা বাড়ি থেকে কিনে দেওয়া, আর একটা সবুজ সাথী প্রকল্প থেকে পাওয়া। সাইকেলে চাবি দেওয়া না থাকলেও আজ আর তা চুরি হয় না। 

সবচেয়ে আনন্দের খবর হল গ্ৰামের মেয়েরা শহরে গিয়ে গাড়ি চালিয়ে রোজগারও করছে। কেউ বাস, কেউ ট্যাক্সি, কেউবা রেলে চাকরি পেয়ে ট্রেন চালাচ্ছে। গ্ৰামের পথেও তাদের টোটো - অটো চালাতে দেখা যাচ্ছে। কান পাতলে শুনতে পাওয়া যাবে, গ্ৰাম থেকে উঠে আসা মেয়ে পাইলট হয়ে প্লেনও চালাচ্ছে। 

 গ্ৰামের হাজারো উন্নয়নের মধ্যে মাটির রাস্তা বদলে যেমন কালো পিচের পথ হয়েছে। তেমনি পথের সাথীর উন্নয়নও নজরকাড়া রকম ভাবে বদলে গিয়েছে বেশ কিছু বছরে। 

এখন বহু গ্ৰামে লাল মাটির পথ খুঁজে পাওয়া যেমন দুস্কর, তেমনি সেই মাটির পথ ধরে গরুর গাড়ি এগিয়ে চলেছে দেখতে পাওয়াও খুব দুর্লভ এক দৃশ্য।

                                                                            ক্রমশ...

ছবি: কোয়েল দন্ডপাঠক

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments