জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে--২০/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ২০

বালুরঘাটে মায়াদি হলেন আমার শিক্ষাগুরু। ওনার কাছে উলবোনা শিখে অল্প কিছুদেনের মধ্যে বেশ  নিপুণা হয়ে উঠলাম। একদিন ওনার মেয়ে দেখে বললেন, মা তোমার ছাত্রী তো গুরুমারা বিদ্যা শিখে নিয়েছেন! আমাদের দিকে কেউ এত সুন্দর উল বুনতে পারেনা। আমি কাঁটা, ক্রুশ, ইউপিন দিয়ে নানা ধরণের বোনা শিখে ফেললাম। বকুল খুব দুষ্টুমি করত, ওর কোনও হাতের কাজ করতে পারতাম না। রাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে, আলো নিভিয়ে, হ্যারিকেন জ্বেলে উল বুনতাম। উনি বকাবকি করতেন, না ঘুমিয়ে এসব কাজ করার জন্য। আসলে সারাদিন রেস্ট পেতাম না।

 রান্নাবান্না অন্যান্য কাজ তো ছিলই, তার অপর বকুলকে চোখে চোখে রাখতে হত। একদিন বাবলিকে মায়াদির সঙ্গে গিয়ে রাস্তার ওপারে একটি সরকারি প্রাইমারি স্কুল ছিল একটাকা দিয়ে ভরতি করে এলাম। দুপুরে ছুটি হয়ে যেত। স্কুলে খুব মোটা একপিস পাউরুটি দিত, সেটা ও ভাইয়ের জন্য নিয়ে আসত (যদিও বকুল আড়াই বছর বয়স পর্যন্ত দুধ ছাড়া অন্য কিছু খেত না)। কয়েক মাস পর বাবলি  রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে খাদিমপুর স্কুলে হয়। 
      ১৯৭৯/৮০ সালে ভগীরথদা(মিশ্র) বালুরঘা্টে জয়েন বিডিও ছিলেন। ওখানকার স্থানীয় লিটিল ম্যাগাজিনে লিখতেন।  খান সাহেব অফিস থেকে ফিরে এসব গল্প করতেন। শুনে আমার বুকের ভিতরটা হাহাকার করে উঠত, আমারও তো কত স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বিয়ের পর কবিতা কোথায় যে হারিয়ে গেল, তাকে খুঁজেই পাচ্ছি না। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া, কিছুই করতে পারিনা। এই বয়সে অফিসের  রান্না, বাচ্চাদের বড় করা,  তারই ফাঁকে যেটুকু সময়  পাওয়া যায়, সেলাই  করতাম, উল বুনতাম। এভাবে বেবিই থেকে গেলাম, কবি হতে পারলাম না।

      সেইসময় আসামে খুব গণ্ডগোল চলছিল, তাই অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে আসছিলেন। এপাড়াতেই একটি বাড়ির নাম মণিকাঞ্চন। ওঁরা ১৯৭১ এ এপারে এসেছিলেন, আর ফিরে যাননি। ওঁদের সোনা রূপোর গহনার দোকান ছিল। আমার ছেলেমেয়েরা ওঁদের বাড়ি খেলতে যেত, ওরাও আসত। ওবাড়ির বড়ছেলে আসামে  থাকেন। খারাপ পরিস্থিতির কারণে দুই মেয়েকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। ছোট মেয়েটি প্রায়দিন আমার কাছে এসে তার অসুবিধার কথা বলত। বিশেষ করে খাওয়ার খুব অসুবিধা হত। ও অনেককিছুই খেতনা, তা নিয়ে কাকিমারা বকাবকিও করতেন। একদিন ওই বাড়ির মাসিমা এলেন আমার সঙ্গে আলাপ  করতে। চা খেতে খেতে অনেক গল্প করলেন।

 ছোট থেকে বড়, ওবাড়ির সবাই মাসিমাকে কর্তামা বলে সম্বোধন করতেন। আমাকে অনেক করে ওনাদের বাড়ি যেতে বলে গেলেন। একদিন সন্ধ্যাবেলা বাবলি বকুলকে সঙ্গে নিয়ে ওনাদের বাড়ি গেলাম। তখন সবে দুর্গাপুজো শেষ হয়ে বিজয়া পর্ব চলছে। সেইসময় ওনাদের এক আত্মীয়াও এসেছেন বিজয়ার প্রণাম করতে। ওদের ভাইবোনের চেনা বাড়ি, আমার হাত ছাড়িয়ে ওরা বাড়ির ভিতর চলে গেল। আমি উঠোনে বসে ওনাদের সঙ্গে গল্প করতে লাগলাম। একসময় বাড়ি ফেরার জন্য ওদের ডাক দিলাম। বাবলি বলল, মা, আর একটু থাকি না। আমাকে মা বলাতে সেই আত্মীয়া চমকে উঠে বললেন, মা? এরা তোমার ছেলেমেয়ে? আমি ভেবেছিলাম ভাজতা ভাজতি! ভাবতেই পারিনি তুমি বিবাহিতা! আমার ভাশুরপোর জন্য অনেকদিন ধরে পাত্রী খোঁজা হচ্ছে, কিন্তু পছন্দ হচ্ছে না। ভাবলাম বাড়ি গিয়ে বলব, খুব সুন্দর একটি মেয়ে দেখে এসেছি। ভুল হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল। ২১/২২ বছর বয়স, শাঁখা পলা সিঁদুর নেই। মাথায় ঘোমটা নেই। সে যাইহোক, এরকম মজার ঘটনা বহুবার ঘটেছে।

    বালুরঘাট  থেকে ৫ কিমি দূরে ডাঙ্গি গ্রামটি ছিল বাংলাদেশের বর্ডার। ওপার থেকে আসা মাছ, ডিম, খেজুরগুড়ের পাটালি এখানের বাজারে বিক্রি হত। এমনকি কাজের লোকও আসত। আমি ওইরকম একটি বৌকে কাজে রেখে বিপদে পড়ে ছিলাম। ২/৩ দিন কাজ করার পরই দেখি একটি বড় কাঁসারথালা বাইরের ঘরে লুকিয়ে রেখেছে। ভাগ্যিস চোখে পড়ে ছিল! দামি কিছু নিতে পারেনি। তারপর প্রমীলাকে কাজে রেখে ছিলাম। মাইনে ছিল ১৫ টাকা। আমরাই ওকে বেশি টাকা দিতাম। অন্যরা ১০/১২ টাকার বেশি দিতেন না।

      একবার হিলি গেলাম বর্ডার দেখতে। এখান দিয়ে মানুষ আইন মেনে যাতায়াত করে। আবার আইন অমান্য করতেও দেখলাম। আমরা কাঁটাতারের  বেড়ার পাশে দাঁড়য়েছিলাম। ওপারের একজন কাঁটাতারের বেড়ার পাশে দাঁড়ালেন। এপার থেকে একজন গিয়ে তাঁর থেকে কিছু নিলেন এবং কিছু নিলেন। তাঁদের কিছু  কিছু কথা শুনতে পাচ্ছিলাম, ওপারের লোকটি আনন্দবাজার পত্রিকা ও একটি বিশেষ কম্পানির পুরুষদের ইনার চাইলেন। হঠাৎ ট্রেনের আওয়াজ পেয়ে চোখ ফিরিয়ে দেখি, ট্রেন ধির গতিতে চলছে, ট্রেনের ওপর থেকে কিছু লোক বড় বড়  বস্তা লাইনের ধারে শুকনো খাল বা নালায় ফেলছে, এপারের কিছু লোক অতি দ্রুত সেই বস্তাগুলো মাথায় নিয়ে কলা বাগানে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি ওদের একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বিএসএফ’ এর লোকেরা ধরে না? ওরা বলল, বিএসএফ এর লোক গ্রামে ঢুকলে কারো না কারো চোখে পড়ে যায়। তখন তারা জোর হল্লা করে আমাদের সজাগ করে দেয়। আমরা সাবধান হয়ে যায়। কেন জানিনা আমার মনে হল বর্ডারের সিকিউরিটিরা ওদের সুযোগ করে দেয়। না হলে দিনদুপুরে এসব করা সম্ভব হত না।

    বালুরঘাটে দুই দেশে নিষিদ্ধ একটি বই পেয়েছিলাম।বইটির নাম সম্ভবত ‘মুজিব হত্যার নেপথ্যে’। সবটা মনে নেই, সারমর্মটুকু হল, মুজিবের  স্বজন  পোষণ, ছেলের উৎশৃঙ্খলতা, মহিলাদের সঙ্গে নোংরা আচরণ করা ইত্যাদিই ওই হত্যাকাণ্ডের কারণ। এই বইটিতে বারবার ডালিমের নাম উঠে এসেছে। ডালিমের  স্ত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা করেছিলেন মুজিবের ছেলে। এই কারণেই ডালিম  প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন।আর কিছু মনে পড়ছে না।

      আমাদের খুব কম বাড়ি আসা হত। উনি বাড়ির কাছে বদলির চেষ্টা করতে লাগলেন। সেজকাকার ওপরমহলে পরিচিতি থাকায় উনিও চেষ্টা করছিলেন। সম্ভবত ১৯৮১ সালের  ফেব্রুয়ারি মাসে নজরুল ইসলাম অফিসের কাজে বালুরঘাট এসে জানালেন, খান সাহেবের বদলির অর্ডার হয়ে গেছে। আমাদের বাড়িতেই ওনার দুপুরের খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল। উনি এসেই বাবলিকে কোলে নিয়ে চকলেট কিনতে  গেলেন। বদলির খবর শুনেও আমরা সরকারি আবাসনে উঠে গেলাম। আবাসনটি এই ভাড়াবাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়, একটি বড় ফলের বাগান কেটে এই আবাসন তৈরি করা হয়েছে। এখনো বেশকিছু আম, তেঁতুল, লিচুগাছ রয়েছে। আমাদের ল্যান্ডলর্ডের এক আত্মীয় পারিবারিক অশান্তির কারণে স্ত্রী ও বাচ্চাকে নিয়ে ওনার বাড়িতে এসে উঠেছিলেন। ছেলেটি বাবলির সঙ্গে পড়ত এবং খেলাধুলাও করত। ভদ্রলোক কোন এক অফিসের বড়বাবু ছিলেই। উনি খান সাহেবের থেকে বয়সে অনেক বড় ছিলেন। তবুও আমাকে বৌঠান বলে সম্মান দিয়ে কথা বলতেন। একদিন রাতে একমুঠো আলুভাজা আর ছেলেকে কোলে নিয়ে এসে  বললেন, বৌঠান হাবলু জেদ ধরেছে কাকিমার বাড়িতে ভাত খাবে। বাবলি বকুলের সাথে ওকেও খেতে দিলাম। তবে রঙিন পানীয় পান করার নেশা ছিল বলে ওনাকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। ওনার স্ত্রী রুমাদির সঙ্গে আমারও খুব ভাব হয়ে গেছল। দুজনে অনেক গল্প করতাম। কথা প্রসঙ্গে একদিন বললেন, নারে, সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে আমি আগে মরতে চাইনা, আমি আগে মারা গেলে ওনাকে কে দেখবে? আমার ছোট মাথায় কথাটা বেশ ধাক্কা দিয়েছিল। পরবর্তী কালে আমিও মনে মনে এটাই চেয়ে ছিলাম। এই বাড়িতে খুব খারাপ অভিজ্ঞতাও হয়েছিল। একটি রুম ভাড়া নিয়ে ল্যান্ডলর্ডের এক আত্মীয়ের কলেজ পড়ুয়া ছেলে ঠাকুমাকে নিয়ে থাকত। বৃদ্ধার ছোঁয়াছুঁয়ির বাতিক ছিল।বকুল হাবলুর সঙ্গে খেলছিল, আমি ওকে ডাকার জন্য দাওয়াতে পা রেখেছি কি রাখিনি, উনি বলে উঠলেন, উঠোনা উঠোনা! আমি ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলাম। আজকের ‘আমি’ হলে কী যে করতাম সে আমিই জানি। এসব আঘাত আমাকে প্রতিবাদী হতে বাধ্য নয়, সাহায্য করেছে। যাইহোক, এই ঘটনার পর রুমাদি বলেছিলেন, হাবলুর বাবা বলেছেন, একদিন মাংস রান্না করে সব বাচ্চাদের খাওয়াব। দেখব উনি কী করেন।

      তার আর সুযোগ হয়নি। আমাদের সঙ্গে ওনারাও সরকারি আবাসনে উঠে আসেন। ওনারা অন্য বিল্ডিঙে থাকতেন। যেহেতু কোয়াটারগুলি চাকরির পোষ্ট অনুযায়ী দেওয়া হয়। এত সুবিধাযুক্ত এক ছাদের তলায় সবকিছু পেয়ে খুব ভাল লাগল, তখন গ্যাস ওভেন আসেনি, প্রতিটি রান্নাঘরে সিমেন্টের তৈরি ঢাকা দেওয়া গুলের উনুন ছিল, ধোঁয়া বাইরে বের হওয়ার পাইপ লাগানো থাকত। আগুন দেওয়ার সময় উনুনের মুখ ঢেকে দিলে রান্নাঘরে ধোঁয়া হত না। কয়েক দিনের মধ্যেই অনেকের সঙ্গে  পরিচয় হল। তবে আমাকে ঘিরে অনেকের মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করল। রুমাদি একদিন বললেন, আমাদের বিল্ডিংএর সুজয়বাবু ওনার স্ত্রীকে বলেছেন, মিসেস খান কিছুতেই মুসলিম হতে পারেন না। খোঁজ নিয়ে দেখ, বিয়ের আগে উনি নিশ্চয় হিন্দু ছিলেন। ভদ্রমহিলা তাই আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেন।


    যেহেতু এই আবাসন থেকে পুরনোপাড়া বেশি দূর ছিলনা, ভাইবোন প্রায়দিন ওপাড়ায় খেলতে যেত। একদিন ওদের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কাজের  মেয়ে প্রমীলা পুরনো পাড়ায় খুঁজে এসে বলল, বৌদি, ওরা আজ ওপাড়ায় যায়নি। বাগানেও খোঁজা হয়েছে। এখন গাছ থেকে ছোট ছোট আম পড়ছে, হয়ত কোথাও আম কুড়চ্ছে। কিন্তু কোনও আম তলাতেও নেই। আমি কাঁদতে শুরু করে দিয়েছি। খান সাহেব তো অফিসে, খবর দেবার ও উপায় নেই। আমাকে কাঁদতে দেখে প্রমীলা আর একবার ওদের খুঁজতে গেল। কিছুক্ষণ পরে দেখি প্রমীলা ওদের বকতে বকতে বাড়ি নিয়ে আসছে। একটা লিচুগাছ কাটা হয়েছে। ভাইবোনে ডালপালার আড়ালে লিচু তুলতে ব্যস্ত ছিল।


      ইতিমধ্যে বদলির অর্ডার এসে গেছে। বদলি হয়েছে তমলুকে। ন’সেজ  দেওর আমাদের নিতে এলো, বাসনপত্র, জামাকাপড় ছাড়া সবই প্রায় জলের দামে বিক্রি করে দেওয়া হল। তখন পরিচিত কাউকে দিয়ে মালদা থেকে হাওড়া বা শিয়ালদা পর্যন্ত ট্রেনে রিজার্ভেশন করাতে হত। একটা কথা বলা হয়নি, ওখানে  মাহিনগরে একটি পরিত্যক্ত বিমানবন্দর ছিল। একসময় বিমান ওঠানামা করত। এখন করলে কত ভাল হত, কারণ বাড়ি ফিরে আসার সময় মালদাতে এসে জানতে পারি আমাদের রিজার্ভেশন হয়নি। গরমের মধ্যে বাচ্চাদু্টোকে নিয়ে সারারাত জেগে কী কষ্টে যে বাড়ি ফিরেছিলাম, তা ভোলার নয়।

                                      ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments