জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--২৩/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ২৩

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 শ্রীরামকৃষ্ণ মানসপুত্র স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর সঙ্গে স্বামী অখণ্ডানন্দজীর সম্পর্ক ছিল ভারি হাস্যমধুর। স্বভাবরসিক ব্রহ্মানন্দজী নানাভাবে রঙ্গরসিকতা করতেন তাঁর সঙ্গে। একবার কোঠার থেকে গঙ্গাধর মহারাজ কলকাতায় ফিরবেন, জেদ ধরেছেন আর একদিনও থাকবেন না। রাতে আহার সম্পন্ন করে পালকিতে চেপেছেন। বেশ কিছু রাস্তা পালকিতে অতিক্রম করতে হবে। খানিকক্ষণ পরে ঘুমিয়ে পড়লেন। পালকি বাহকেরা রাজা মহারাজের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করল। তারা উল্টো রাস্তায় চলে কোঠারের বাড়িতে ফিরে এল। সঙ্গে সঙ্গে আরোহীর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটিয়ে নিজেরাও বিশ্রামরত হল!

 আরেকটি ঘটনা শোনা যায় রামকৃষ্ণ বসুর(শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ভক্ত বলরাম বসুর পুত্র) কন্যা মহামায়ার কাছ থেকে। রাজা মহারাজ একদিন তাঁর হাতে একটি খাম দিয়ে বলেন, চিঠিখানি গঙ্গাধর মহারাজের কাছে দিয়ে আসতে। গঙ্গাধর মহারাজ খাম খুলে এমন কিছু দেখেন যা অযাত্রা। সেদিন তাঁর আর কোথাও যাওয়া হল না। মহামায়ার ‘যমুনা-সই’ চিন্ময়ীর হাতে একটি কাঁকড়ার ছবি দিয়ে রাজা মহারাজ বলেন গঙ্গাধর মহারাজকে দিয়ে আসতে। কাঁকড়া ভীষণ অযাত্রা, সেদিন আর গঙ্গাধর মহারাজ ঘর থেকে বের হলেন না। আবার একদিন সকালবেলা চিন্ময়ী ও মহামায়া গঙ্গাধর মহারাজের ঘরে গিয়ে বললেন, গঙ্গাধর মহারাজ সুপ্রভাত! বলামাত্রই তিনি চোখ ফিরিয়ে নিলেন। তাঁরা আবার বললেন, গঙ্গাধর মহারাজ, সুপ্রভাত!
“না,আমি চাইব না, আমি চাইব না--আমি সব জানি, রাজার কাজ।”
“না গঙ্গাধর মহারাজ, আমরা আপনাকে প্রণাম করতে এসেচি”
মহামায়া-চিন্ময়ীর কথায় ভালোমানুষ গঙ্গাধর মহারাজ বিশ্বাস করে যখনই তাঁদের দিকে তাকালেন, তাঁরাও তাঁকে এক চোখ দেখিয়ে দিলেন। ব্যস তাঁর যাত্রাভঙ্গ! বলা বাহুল্য এই সময় মহামায়া-চিন্ময়ীরা নিতান্তই বালিকা ছিলেন।

  রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের দ্বিতীয় সঙ্ঘগুরু স্বামী শিবানন্দজীর(মহাপুরুষ মহারাজ)আকস্মিক বাকরোধের সংবাদ পেয়ে অখণ্ডানন্দজী বেলুড় মঠে ছুটে আসেন। মহাপুরুষ মহারাজের পাশে বসে পুরুষ-সূক্ত, দেবী-সূক্ত, উপনিষদ প্রভৃতি আবৃত্তি করে শোনান। সঙ্গে ঠাকুর-স্বামীজীর প্রসঙ্গ। এই সময় একটানা ছ'মাস মঠে অবস্থান করেছিলেন তিনি। মহাপুরুষজীকে তিনি ‘দাদা’ বলে সম্বোধন করতেন। বড়ই সুমিষ্ট শোনাত সেই ‘দাদা’ ডাক। একদিন তিনি সাধুদের নির্দেশ দিলেন--“১০৮ জন সাধু একদিন ঠাকুরঘরে সমবেতভাবে প্রার্থনা জানাও-- সকলের কল্যাণ হোক, ‘দাদা’ নিরাময় হয়ে উঠুন, মহাপুরুষ সুস্থ হয়ে উঠলে জগতের কল্যাণ হবে।”(স্বামী অখণ্ডানন্দ--স্বামী অন্নদানন্দ)। জনৈক সন্ন্যাসীকে ৺তারকেশ্বরে বিশেষ পূজা নিবেদন করতে পাঠালেন। সেই সন্ন্যাসী তাঁর নির্দেশানুযায়ী সেখানে কয়েকদিন ‘হত্যা’ দিলেন। এইসময় মহাপুরুষ মহারাজ ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন যে প্রতিদিন প্রাতে মঙ্গলারতির পর শ্রীশ্রী ঠাকুরকে প্রভাতী সঙ্গীত শোনানোর। অখণ্ডানন্দজী দুই ব্রহ্মচারীর উপর এই কাজের ভার অর্পণ করলেন। এই সময় দক্ষিণ ভারত থেকে জনৈক ভক্ত মহাপুরুষ মহারাজের কাছে দীক্ষালাভের জন্য মঠে আসেন। মঠের পরিচালক সন্ন্যাসীমণ্ডলী স্বামী অখণ্ডানন্দজীকে দীক্ষা প্রদানের জন্য অনুরোধ জানান মহাপুরুষ মহারাজের অবস্থা বিবেচনা করে। কিন্তু ঠাকুরের আদেশ বা নির্দে‌শ ব্যতিরেকে তিনি বিবাহিতদের দীক্ষাদানে অসম্মতি জানালেন। স্বামীজী তাঁকে নির্দেশ দিয়েছিলেন শুধুমাত্র ত্যাগীদেরই দীক্ষিত করার--‘মাথা মুড়াও, চেলা বানাও।’ কিছুদিন অতিবাহিত হওয়ার পর এইসব কথা চিন্তা করছেন, হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে উঠল কেশব সেনের বাড়িতে ঠাকুর কেশবকে বলছেন--“কেশব অনেক তো হল--এবার বন্ধ কর।” ভাবচক্ষে এই দর্শনের পর অখণ্ডানন্দজী স্থির করলেন বিবাহিত ভক্তদের ঠাকুরের এই কথাই বলবেন।

 ইতিমধ্যে দুর্গাপূজা সমাগত। মঠে মহা সমারোহে পূজা হচ্ছে। মহাপুরুষ মহারাজকে একদিন ইজি চেয়ারে করে নীচে নিয়ে এসে প্রতিমা দর্শন করানো হল। ষষ্ঠীর রাতে স্বামীজী স্বপ্নযোগে অখণ্ডানন্দকে বললেন,“গ্যাঞ্জেস! আমার কাপড়চোপড়ে ন্যাপথালিনের গন্ধ কেন রে? আমাকে আজকের দিনে নূতন কাপড় দিবি না?” মহারাজের ঘুম ভেঙে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠৈ মন্দিরের পূজারীকে ডেকে বললেন, “শিগ্গির নূতন কাপড় নিয়ে এস।” স্বামীজীর ঘর উন্মুক্ত করে দেওয়া হল, ধূপ দেওয়া হল। তিনি স্বহস্তে অগুরুযুক্ত নতুন কাপড় নিবেদন করলেন স্বামীজীকে এবং পূজারীকে মঙ্গলারতি করার নির্দেশ দিলেন। পূজারী জানালেন রাত আড়াইটে বেজেছে তখন। অখণ্ডানন্দজীর বক্তব্য--“আজ আড়াইটেই চারটে মনে কর।”(স্বামী অখণ্ডানন্দ--স্বামী অন্নদানন্দ) এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য স্বামীজী গঙ্গাধর মহারাজকে আদর কর গ্যাঞ্জেস বলে ডাকতেন। গঙ্গাধর থেকে গঙ্গা, সেখান থেকে গ্যাঞ্জেস। এদিকে মহাপুরুষ মহারাজের শরীর কিছুটা সুস্থ হওয়ায় গঙ্গাধর মহারাজ দুই সেবক সমভিব্যাহারে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে তাঁর প্রাণপ্রিয় সারগাছিতে পৌঁছলেন। অখণ্ডানন্দজী নগরের মিথ্যা কোলাহল ও ব্যস্ততা এড়িয়ে গ্রাম্য কোলাহলহীন শান্ত জীবনের পরিমণ্ডলই বেশি পছন্দ করতেন। উচ্চপদ, স্বাস্থ্য কোনওটিই তাঁর নীরব সাধনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারত না। সারগাছি আশ্রম স্থাপনের পর তাঁর কর্মক্ষেত্র একটি গ্রামে সীমাবদ্ধ থাকলেও তাঁর হৃদয় ছিল প্রসারিত। সকলের দুঃখকষ্টে কাতর হয়ে পড়তেন। বিহারের ভাগলপুর জেলায় ঘোষা নদীর ভয়াবহ বন্যায় অনেক গ্রাম ভেসে যায়। তিনি এমন পনেরোটি গ্রামে দশ সপ্তাহ ধরে নানাপ্রকার সাহায্য দান করেন। এমনকী নিজহস্তে বিসূচিকাগ্রস্তের সেবাও করেন! আবার ১৯৩৪ সালে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে বিহারের বহু নগর ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পঁয়ষট্টি বছর বয়সে তিনি সশরীরে মুঙ্গের ও ভাগলপুরে গিয়ে ধ্বংসলীলা পরিদর্শন করেন! সেখানে রামকৃষ্ণ মিশনের সেবকার্যে নিয়োজিত সেবকদের অনুপ্রেরণা দেন। একবার পূর্ববঙ্গে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের বর্ণনা শুনে ভীষণভাবে বিচলিত হয়ে পড়েন। তাঁর বিশাল হৃদয় পরদুঃখে এতটাই কাতর হয়ে পড়ে যে, সেখানকার দুর্ভিক্ষগ্রস্তদের মতো তিনিও গাছের পাতা, শাক ও পটলসিদ্ধ প্রভৃতি আহার করে পাঁচ-ছয়মাস কাটিয়ে দেন! স্বামীজীর মহামন্ত্র “জীবে প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর” অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। দেশপ্রেম তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ইতালির ম্যাৎসিনি ও গ্যারিবল্ডি তাঁর অতি শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। একইভাবে শ্রদ্ধা পোষণ করতেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গল, নিগ্রোজাতির সেবক বুকার টি ওয়াশিংটন, বাল গঙ্গাধর তিলক, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখের প্রতি।
 ১৯২৫ সালে অখণ্ডানন্দজী শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের উপ সভাপতি এবং মহাপুরুষজীর দেহত্যাগের পর ১৯৩৪ সালের মার্চ মাসে সভাপতি নির্বাচিত হন। মঠের অধ্যক্ষ হিসাবে তিনি অনেককেই দীক্ষা দিয়েছিলেন। প্রথমে দীক্ষদানে সম্মত হন নি, পরে সম্মত হন। তিনি চাইতেন শিষ্যগণ গতানুগতিকভাবে মন্ত্র না নিয়ে ব্যক্তিগত জীবনে পবিত্র জীবনযাপনের ব্যাপারে যেন সচেষ্ট হয়।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments