জ্বলদর্চি

রহিণ পূজা/সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ২২

রহিণ পূজা

সূর্যকান্ত মাহাতো

আজ ১৩ ই জ্যৈষ্ঠ। গ্রামের কচিকাঁচারা তাই দারুণ খুশি। সকাল থেকেই বেশ একটা চ্যালেঞ্জিং মুডে আছে ওরা। সেই সঙ্গে সাজো সাজো রব। ওদের যে আজ সঙ সাজতে হবে। অনেক পুরনো ছেঁড়াফাটা জামাগুলো তাই খুঁজে খুঁজে বের করেছে। ওগুলোই তো আজ পরতে হবে। গত কয়েক বছর ধরে ওরা পরাজিত হয়ে আসছে। এবছর তাই জিততেই হবে। বেশ আটঘাট বেঁধেই এবার প্রস্তুতি নিয়েছে। কোথাও এতটুকু খামতি নেই। প্যান্টের পিছনের দিকটা বেশ বড় রকমের ফুটো করেছে। কারও প্যান্টের একটা পা পুরোটাই ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে। নয়তো সেলাই খুলে ফেলা হয়েছে। জামাগুলোও সেইরকম। কোনওটার পিছনটা ছেঁড়া। কোনওটার সামনেটা। কোনওটার আবার একটা হাতা নেই। কোনও কোনও জামার সঙ্গে আবার অতিরিক্ত কাপড় জুড়ে অদ্ভুত রকমের হাস্যকর করে গড়ে তোলা হয়েছে। সব রকমের প্রস্তুতিই মোটামুটি সারা। না হলে যে, এবছরও ওদের পরাজয় স্বীকার করতে হবে।

হাস্যকর পোশাকের সঙ্গে সাজগোজেও এবছর বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। সারা মুখে কালি লেপে নিলেই এখন আর কেউ হাসে না। তাই কালিটাও লাগাতে হবে বেশ একটা অভিনবত্বের সঙ্গে। যেন একই সঙ্গে কিমভুতমাকার্ ও সরস দুটোই মনে হয়। তাই চোখের পাশ থেকে টেনে টেনে কানের দিকে কালি লাগানো হয়েছে। অনেকটা সুরমা টানার মতোই। দুই গালেও নেওয়া হয়েছে কালির ছোপ। বৈষ্ণবদের মতো নাকের ডগা অব্দি কালির তিলক কেটেছে। চোখ দুটোও গোল গোল কালির বৃত্তাকারে ঢেকেছে। নাকের নিচে মোটা করে গোঁফ এঁকেছে। তাও আবার এক দিকটা। কেউ আবার মোটা করে হিটলারের মতো শুধু একটু মাছি গোঁফ এঁকেছে। এবার শুধু কালি নয়, অন্য রঙও ব্যবহার করা হয়েছে।

একটু একটু করে বিকেল গড়িয়ে পড়ছে। দিনের আলোও ফুরিয়ে আসছে। গ্রামের মেয়েরা এবার মাথায় ঝুড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। ওরা মাঠের জমিতে যাচ্ছে। জমির মাটি তুলে আনবে। কারণ আজ "রহিণ" বা "রহইন"। 'রহিণ' মাটি নিয়ে আসাই ওদের উদ্দেশ্য। মাটি আনার সময় তাদের কঠোর ভাবে মৌনতা রক্ষা করতে হয়। এমনকি সামান্য হাসাও বারণ। এ নিয়ম ভঙ্গ করলে পুনরায় স্নান করে আবার নতুন করে মাটি নিয়ে আসতে হয়।

কচিকাঁচারা তাই আজব সাজগোজে ওদের জন্য অপেক্ষা করছে। ওত পেতে আছে লুকিয়ে। মেয়েরা 'রহিণ মাটি' নিয়ে ফেরার সময় ধাঁ করে বেরিয়ে আসবে। আর অদ্ভূত সব অঙ্গভঙ্গি করে তাদের হাসানোর চেষ্টা করবে। ঠিক সন্ধ্যের মুখে একদল মেয়ে মাথায় রহিন মাটি নিয়ে বাড়ি ফিরছিল। ওরাই ছিল বাচ্চাগুলোর এবারের টার্গেট। সামনে আসতেই হঠাৎ করে নানান অঙ্গভঙ্গি, বাজবাজনা, ডিগবাজি সহ নাচ গান শুরু করে দিল। না, তবুও কেউ হাসল না। তবে কি এ বছরও ওরা হেরে যাবে! প্রায় ৫০ মিটার ওদের সঙ্গে ঢং করতে করতে চলল। শেষে লখাইয়ের মা আর পারল না। ছোট কুনুর ডিগবাজি দেখে ফিক করে হেসেই ফেলল। আটকানোর অনেক চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারল না।  হি হি করে তাই হেসেই উঠল।

"কী মজা! কী মজা!" বলে বাচ্চারা তখন তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল। লখাইয়ের মা শেষে একটু বিরক্ত হয়ে গালমন্দ করতে করতে ফের রহিণ মাটি আনতে গেল।

"রহিণ মাটি"। কী এই রহিণ মাটি? তা জানার আগে "রহিণ" বা "রহইন" কী? তা আগে জানা দরকার।

"রহিণ" বা "রহইন" হল বছর শুরুর পরে পরেই জ্যৈষ্ঠ মাসের ১৩ তারিখ কৃষি কাজের সূচনা পর্বের একটি শুভ দিন। প্রতি বছর এই দিনটিকে "রহিণ" হিসাবে মানা হয়। 'রহিণ' 'রহইন' হল কৃষিভিত্তিক একটি পূজা বা আচার অনুষ্ঠান। এখন প্রশ্ন হল, কিসের পূজা? কেনই বা করা হয়?

'রহিণ' হল বীজ পূজা বা বীজ পূণহ্যা বা পূণ্যা (বিচ পূজাও বলে) বা বীজ রোপণের একটি শুভ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান। অর্থাৎ এই দিন  বীজ রোপণের মধ্য দিয়ে চাষের কাজের শুভারম্ভ ঘটে। বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরের কুড়মি সহ অন্যান্য সম্প্রদায়ের কৃষকদের দৃঢ় বিশ্বাস এই দিন বীজ রোপন করলে সেই বীজের ফসল ভালো হয়। পুষ্ট হয়। পতঙ্গ ও পোকামাকড় সহ অন্যান্য সমস্ত অশুভ শক্তি থেকে ফসল সুরক্ষিত থাকে। তাই এই 'রহিণ' উৎসব পালন করা হয়।

কে হন এই পূজার পূজারী? ভাবলে অবাক হতে হয়, পরিবারের যিনি সব থেকে বেশি কৃপণ তার হাতেই এই বীজ পূজা হয়। অর্থাৎ পরিবারে যার আয় সর্বাধিক কিন্তু খরচ সব থেকে কম  তিনিই হন পূজার অধিকারী। কি অদ্ভুত না! প্রথম জানলাম যে কৃষক পরিবারে কৃপণেরও গুরুত্ব কতখানি।


রহিণেরর দিন সাতসকালেই বাড়ির মহিলারা উঠে পড়ে। গোবর জল দিয়ে ঘরদোর পরিষ্কার করে। দেওয়ালে বিভিন্ন রকমের আঁক কাটে। বিষধর সাপ ও বিষাক্ত পোকামাকড়ের কাছে ওগুলো লক্ষ্মণ গন্ডির মতো। ওই কাটা দাগ অতিক্রম করে তারা সহজে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনটাই মনে করা হয়। প্রচলিত বিশ্বাস আছে যে, এই রহিণের দিনেই বিষধর সাপ সহ বিষাক্ত কীট পতঙ্গ শীতঘুম থেকে বাইরে বেরিয়ে আসে। তাই তাদের থেকে কোনও ক্ষতি যাতে না হয় তাই এমন দাগ কাটা।

একটি পৌরাণিক মতও আছে। শ্রীকৃষ্ণের দাদা হলেন বলরাম। তার অন্য এক নাম হল 'হলধর'। তিনি লাঙ্গলধারী। অর্থাৎ তার হাতের প্রধান অস্ত্রই ছিল লাঙ্গল। সুতরাং তিনিও কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই বলরামের মাতার নাম হল, রোহিণী। 'রহিণ পূজা' তাই একরকম বলরাম মাতা রোহিণীর আরাধনাও। যাতে তিনি সন্তুষ্ট হন। এবং বৃষ্টি দিয়ে ফসল রক্ষা করেন। এই 'রোহিনী' শব্দ থেকেও 'রহিন' বা 'রহইন' শব্দটি এসে থাকতে পারে।


আসলে কৃষকদের বীজ রোপন থেকে শুরু করে ফসল তোলা পর্যন্ত সময়টা পুরোটাই একরকম অনিশ্চয়তায় ভরা। সম্পূর্ন ভাবে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল থাকতে হয়। প্রচন্ড খরা কিংবা প্রবল বন্যা তো আছেই সেইসঙ্গে কীটপতঙ্গের আক্রমণেও ফসল নষ্টের সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
এমন অনিশ্চয়তা থেকেই নানান দেবদেবীর কল্পনা ও তাদের সন্তুষ্ট করতে পূজার আয়োজন করে থাকেন কৃষকেরা। 'রহিণ' বা 'রহইন' হল তেমনি একটা।

তবে রহিণ উৎসবটা হল চাষের শুভারম্ভের অনুষ্ঠান। চাষের জন্য বীজ রোপণের আনন্দ উদযাপন।  পূজায় পায়রা, মুরগি, হাঁস প্রভৃতি বলি দেওয়া হয়। দিনভর চলে আমিষ আহার। আনন্দে রাত্রিতে হয় নানা রকমের পিঠার আয়োজন।

'রহিণ' বা রহইনকে ঘিরে বাড়ির প্রত্যেক সদস্যেরই কিছু না কিছু ভূমিকা বা ক্রিয়াকর্ম থাকে। পুরুষেরা যেমন সকাল সকাল পুজো সেরে মাঠে হাল বলদ নিয়ে যায়। সেখানে লাঙ্গল দিয়ে মাটি তৈরি করে। প্রথম বীজ রোপন করে। তারপর বাড়ি ফিরে রহিণ ফল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। 'রহিণ' নামে এক ধরনের কাঁটাযুক্ত লতানো গাছ আছে। সেই গাছে এই সময় ফল ধরে। অনেকটা কাঁচা আমলকী ফলের মতো। সরস এই ফল স্বাদে বেশ কষাটে এবং কিছুটা তিক্ত। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে এই ফল খেলে সাপের বিষ ওই বছর শরীরে প্রভাব ফেলতে পারবে না। কারণ রহিণের দিন বিষধর সাপেরা গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে বলে মনে করা হয়। গরমের সময় মাঠে ঘাটে সাপেরা ঘুরে বেড়ায়। তাই চাষের কাজের সময় যাতে সর্পদংশিত  হতে না হয়, কিংবা হলেও কোনও ক্ষতি যাতে না হয় তাই রহিণ ফল খায় তারা। প্রচলিত এ বিশ্বাস অতি পুরানো। বন জঙ্গলে ঘেরা জমিগুলোতে ছিল সর্বদা সাপের ভয়। প্রতিষেধক হিসাবে রহিণ ফলকেই একমাত্র নিদান বলে মনে করা হত। তবে রহিণ ফল কতটা প্রতিরোধ গড়তে পারে তা নিয়ে এখনও বিতর্ক ও মতান্তর দুটোই রয়েছে। আজকের দিনে আর কেউ এসবে বিশ্বাসও করে না। এখন তো চিকিৎসা ব্যবস্থারও দারুণ উন্নতি ঘটেছে। হাসপাতালে দ্রুত পৌঁছাতে পারলেই আরোগ্য লাভ করা যায়। প্রতিটি গ্রামীণ হাসপাতালেই এখন এন্টিভেনাম সিরাম মজুত থাকে। মানুষও ধীরে ধীরে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠছে। সচেতনতা লাভ করছে।

বাড়ির মহিলারা এই রহিণ উৎসবে সবথেকে বেশি ভূমিকা গ্রহণ করে। সেই কাকভোরে তারা উঠে পড়ে। গোবর জল দিয়ে বাড়ির উঠোন ঘরদোর পরিষ্কার করে। সেইসঙ্গে নানান লতাপাতা দিয়ে আলপনা আঁকে, দেওয়ালে দাগ কাটে। খড়িমাটি দিয়ে দুয়ারে দুয়ারে লক্ষ্মীর পা আঁকে। তবে সব থেকে বড় কাজ হল রহিণ মাটি সংগ্রহ করে আনা। রহিণের এটাই সবথেকে বড় তাৎপর্য। স্নান সেরে কাপড় পাল্টে ওরা মাথায় ঝুড়ি, ঠেকা, টকা প্রভৃতি নিয়ে মাঠ থেকে রহিণ মাটি সংগ্রহ করে আনে। এই রহিন মাটিকে অত্যন্ত পবিত্র বলে মানা হয়। মাটি নিয়ে ফেরার সময় কঠোরভাবে মৌনতা রক্ষা করতে হয়। কথা বলা এবং হাসা সবকিছুই বারণ। নিয়ম ভঙ্গ করলে ফের স্নান করে কাপড় ছেড়ে নতুন করে মাটি আনতে হয়।

সংগ্রহ করে আনা মাটি প্রথমে তুলসী মঞ্চে রাখা হয়। তারপর বাড়ির চার কোণে একটু একটু করে রাখতে হয়। গোয়ালঘরের চালা কিংবা মাচাতেও তুলে রাখা হয়। যাতে কোনও বিষাক্ত সাপ বা পোকামাকড় কিংবা কোনও অশুভ শক্তি বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে না পারে। অবশিষ্ট অংশটুকু তুলে রাখা হয়। পরবর্তীকালে চাষের জন্য যখন আরও বেশি পরিমাণে বীজ রোপন করা হয় তখন সেই মাটি বিজে মিশিয়ে রোপন করা হয়। যাতে আরও ভালো ফসল ফলে। বীজতলার কোনও ক্ষতি না হয়। অনেকে বিয়ে বাড়ি ও শ্রাদ্ধ বাড়িতেও রহিণ মাটি ব্যবহার করে থাকে।

রহিনের দিন বাচ্চাদের ভূমিকা তো প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। তারা তালপাতার বাঁশি, টিন, থালা বাজিয়ে গান করে করে বাড়ি বাড়ি টাকা পয়সা আদায় করে। বিভিন্ন ধরনের সঙ সেজে নাচ গান করে সকলকে বিনোদনও দান করে।

রহিণের দিন অনেকেই বাড়িতে মনসা পূজা করে। কারণ রহিণ পূজার সঙ্গে সর্প দংশনের ক্ষত নিরাময়ের একটা সম্পর্ক আছে। রহিণের দিন মন্ত্র তন্ত্রের কারবারিরা শেখা মন্ত্রগুলোকে আর একবার ঝালাই করে নেন। অনেকে ওঝার কাছে শিষ্যত্বও গ্রহণ করেন এই দিন। পুরুলিয়ার অনেক ওঝা তো সর্পাঘাতে আহত ব্যক্তির চিকিৎসায় রহিণ মাটি ব্যবহারও করতেন।


এখন রহিণের সেই জৌলুস কিছুটা হলেও ম্লান। বর্তমান প্রজন্মও বেশ উদাসীন। এরা তো রহিণ গাছ বা ফলটাই চেনে না। রহিণের ইতিহাসটুকুও জানে না।

তথ্যসূত্র: লোকউৎসব ও লোকদেবতা প্রসঙ্গ: লেখক- ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments