জ্বলদর্চি

সমুদ্রের গন্ধ/অমিতরূপ চক্রবর্তী

সমুদ্রের গন্ধ

অমিতরূপ চক্রবর্তী

বহুদিন, বহুদিন পর আমি অনিন্দিতার গা থেকে সেই নীল নীল সমুদ্রের গন্ধটা পেলাম। আহ্, কতদিন পর। এটা অবশ্যই কোনো বিদেশী ব্র্যান্ড। অনিন্দিতা এখনো ব্যবহার করে যাচ্ছে সেটা, পাল্টায়নি। অটোর মধ্যে ঠাসাঠাসি ভীড়। রোগা, মোটা জামায় তিলা পড়া মানুষের ঘাম-ধুলো মিশ্রিত বোঁটকা গন্ধ। এরমধ্যে অনিন্দিতা অটোয় চেপে বসতেই অটোর ভেতরটা  কোনো দ্বীপপুঞ্জের সূর্যকরোজ্জ্বল সমুদ্র সৈকত হয়ে উঠল যেন। 

  আমি অনিন্দিতার চোখ আর নাকের আশপাশের অঞ্চলই দেখতে পাচ্ছিলাম। কারণ অনিন্দিতা মুখে মাস্ক পড়ে আছে। অপ্রত্যাশিত এক অতিমারি মানুষের সহজ স্বচ্ছন্দ জীবনকে যেন হাতুড়ির ঘা মেরে বেঁকিয়ে ফেলতে চাইছে। কথা বলার সময় ওর মুখ মাস্কের আড়ালে নড়ছিল। আমি ওর পাতলা ঠোঁট আর সুন্দর তন্বী দাঁতগুলি দেখতে পাচ্ছিলাম না। 
এবড়ো-খেবড়ো রাস্তায় ঝাঁকুনি খেতে খেতে অটো চলছিল। কখনো পেছনের চাকা এমনভাবে কোনো খানাখন্দে পড়ছিল যে মনে হচ্ছিল যাত্রীসমেত গোটা অটোটাই উল্টে যাবে। বাইরে খর রোদ। হাওয়ায় শুকনো ধুলো উড়ছে। শীতে পাতা খসিয়ে উলঙ্গ হয়ে যাওয়া গাছগুলি কেমন নির্লজ্জের মতো দৃষ্টিপথে দাঁড়ানো। 

  অটো যখন ঝাঁকুনি খাচ্ছে, অনিন্দিতার সঙ্গে স্পর্শসংযোগ ঘটে যাচ্ছে আমার। একবার তো এমনভাবে অটোটা ঝাঁকুনি খেল অনিন্দিতা সহজাত প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় আমার বাঁ-হাত আঁকড়ে ধরল। আমি বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেলাম। রেলবাঁধের ওপরে দাঁড়িয়ে দূরের গাছপালার দিকে শব্দ ছুড়ে দিলে যেমন তা প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসে- তেমনই একটা প্রতিধ্বনি দূর দূর থেকে ফিরে আসছিল আমার মধ্যে। মনে হচ্ছিল জামাকাপড়ের নীচে আমার দেহ বলে কিছু নেই। বদলে শুকিয়ে-যাওয়া একটা পাথুরে নদী, যেমন আমাদের মফসসলের সীমানা ছাড়িয়ে গেলে আছে। তার ওপর লোহার সেতু। দূরে বনের রেখা। তার মাথায় ম্লান একটা সূর্য। আকাশে উড়ান দেওয়া একঝাঁক কালো পাখি। মাটির গায়ে ঝোপ-জংগল। কখনো-বা বুনো ফুল। আমার দেহের অস্থি, রক্ত-মাংসের সংস্থিতির বদলে এইসব। 

  অনিন্দিতা মাস্কের আড়াল থেকে বলল ‘বহুদিন পরে তোর সঙ্গে দেখা হল। কেমন আছিস?’
আমি মাস্ক পরিনি। আমার গাল, চিবুক, কপালের চামড়ার নীচে পুরোনো হয়ে-যাওয়া কিলবিলে শিরা- সব দেখা যাচ্ছে। আমি উত্তর ফেরালাম ‘হ্যাঁ, অনেকদিন পরে দেখা হল। চলছে কোনোরকম।‘
-‘কী করছিস এখন?’
চট করে এই কথার উত্তর কী দেব বুঝে পেলাম না। একটা সময় যখন চারিধার থেকে জীবন-তাগিদের শিখা বন্য আগুনের মতো লকলক করে ওঠে, তখন একটা পুরুষমানুষের পক্ষে এটাই সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন। যারা সফল, তাদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না, তাদের মুখ খোলার আগেই উত্তরটা নিজেই অগ্রবর্তী হয়ে অন্য দিক থেকে ছুটে আসা প্রশ্নটিকে আঙুলে টিপে ছাড়পোকার মতো মেরে ফেলে। কিন্তু যারা তেমন সফল নয়, তাদের বেলায় হয় একেবারে উল্টো। প্রশ্নটা শতবিভক্ত হয়ে উত্তর যে দেবে, তাকে ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে বিঁধে ফেলে একেবারে মাটিতে শুইয়ে দেয়। 
আমি বললাম ‘না, তেমন কিছু নয়। কয়েকজন মিলে বনবস্তি এলাকায় একটা ওয়েলফেয়ার সোসাইটি চালাচ্ছি। বাচ্চাদের লেখাপড়া, সেফ মাইগ্রেশন, অ্যাডোলেসেন্ট হেল্থ অ্যান্ড হাইজিন, ভোকেশনাল অপশন এইসব নিয়ে।‘ কথাগুলো বলার সময় কেন জানি না মুখ নীচু করেই বললাম। 
-‘বিয়ে করেছিস? বয়েস তো হল।‘
-‘নাহ্!’ এই নাহ্ শব্দটি আমি ছোট করেই বললাম, তবু মনে হল শব্দটি ভেঙে ভেঙে বিরাম দিয়ে বেজে বেজে অনেকক্ষণ ধরে যেন দিকে দিকে পাথারে পাথারে উচ্চারিত হল।
‘এবার একটা বিয়ে কর। মাথার চুল তো খসে যাচ্ছে, এরপরে মেয়ে দেবে কেউ?’

  অটোটা হেলেদুলে, কখনো হঠাৎ গতিময় হয়ে উঠে ছুটছে। আশেপাশের যাত্রীরা যেন প্রাগৈতেহাসিক সব পুতুল। একটি নেপালি মহিলার কোলে আনাজের ঢাউস ব্যাগ। অনিন্দিতার এই প্রশ্নে কেমন যেন রাগ হল আমার। অনিন্দিতা কি আমার অবস্থা নিয়ে ঠাট্টা করছে? কিন্তু রাগটা স্থায়ী হল না। একঝলক শুকনো বাতাসের ঝাপটা অটোর পেট দিয়ে উড়ে গেল।  অনিন্দিতা বলল ‘মনে হয় ছ-সাত বছর পরে আমাদের দেখা হল।‘
আমি মনে মনে হিসেব করে দেখলাম অনিন্দিতা ঠিকই বলছে। ছ-সাত বছরই হবে। অনিন্দিতার সঙ্গে আমার শেষবার দেখা শিলিগুড়ি বিধানমার্কেটে শীতের মরসুমে। অনিন্দিতার সঙ্গে সেদিন ওর মা আর শুভ। 
শুভ-র নাম আমি শুনেছিলাম কিন্তু কখনো ওকে দেখিনি। সেদিনই দেখলাম। লম্বা, ছিপছিপে গড়নের ছেলে। গায়ের রঙ ফরসা। মাথায় মেয়েলি-মেয়েলি চুল। আশুর বুদ্ধিতে আমি তখন পিস-কাপড়ের ব্যবসায় নেমেছি। শিলিগুড়ি থেকে মাল আনি। আমার কাঁধে ঢাউস ঝোলা। তাতে শীতের পোশাক-আসাক। হাতেও একটি। সেখানে পশমি-চাদর, শাল এইসব। সারাদিন ঘুরে বেরিয়ে ধুলোট হয়ে গেছি। বিধানমার্কেটের একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে সিটিঅটোর জন্য অপেক্ষা করছি, তখনই রাস্তার উল্টোদিকে তন্দুরি নামের একটা রেস্তোরাঁর সামনে ওদের দেখতে পেলাম। অনিন্দিতার পরনে শাড়ি, চোখে রোদচশমা। ওর মা তখনো বেশ জাঁদরেল আর শক্তসমর্থ। ওদের পাশে ছেলেটি যে শুভই, কেউ না বললেও আমি বুঝে গিয়েছিলাম। ছেলেটাকে একটা রোগা, হাওয়ায় দোল-খাওয়া কাগজফুলের ডালের মতো লাগছিল।   

  রাস্তার ও পাশ থেকে রোদচশমার আড়াল থেকে আমাকে দেখেছিল অনিন্দিতা। একটা গোল ছাতার নীচে চেয়ারে বসেছিল ওর মা আর ছেলেটা বুঝি ওনার সুধিধে-অসুবিধের তদারক করছিল। ওদেরকে কিছু একটা বলে সাবধানে রাস্তা পেরিয়ে এসে একেবারে আমার মুখোমুখি অনিন্দিতা। 

-‘কী ব্যাপার? তুই?’
একটু হেসে চোখের ইশারায় হাতের ব্যাগ আর ঢাউস ঝোলা দেখিয়ে বললাম ‘এই তো, মালপত্তর নিতে এসেছিলাম।‘
-‘কখন এসেছিস?’
-‘সকালের ট্রেনে।‘

অনিন্দিতার রোদচশমাটি আমার মুখের দিকে স্থির হয়েছিল। আমি ওর চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম না ও কী ভাবছে। কিছুটা সময় আমার দিকে রোদচশমা তাক করে রেখে তারপর ও মুখ ঘুরিয়ে রাস্তার ওপারে অন্যদের একঝলক দেখে নিল যেন। তারপর বলল ‘খেয়েছিস কিছু?’
না, সেদিন তেমনভাবে আমার কিছু খাওয়াই হয়নি। মাঝে মাঝে রাস্তার স্টলে চা-বিস্কুট বা রোল- এইসব। আর কখনো বিড়ি নয়তো সিগারেট। অনিন্দিতা যখন আমার সামনে, তখন আমার পেটে বিকেলের আলো ছাড়া কিছু নেই। 

  নিজের অবস্থাটাকে তখন প্রাণপনে মাটিতে পিষে ফেলার চেষ্টা করছিলাম আমি। আমার কানের গোড়া বুঝতে পারছিলাম তপ্ত হয়ে উঠেছে। এভাবে আমি অনিন্দিতার কাছে ধরা পরে যেতে চাই না। পথ-হারানো বদরাগী একটা মহিষের মতো বিপন্নতা তখন জমে উঠেছে আমার মধ্যে।
অনিন্দিতা বলল ‘তোর ব্যাগপত্তর ওই কোনার হোটেলটায় নিয়ে চল।‘
সেই মুহূর্তে আমার যেমন লাগছিল, সেটাকে পিতৃবিয়োগে অথবা মাতৃবিয়োগের অনুভূতির সঙ্গে তুলনা করা চলে। যেন লহমায় এই জনসমুদ্রময় পৃথিবী ফাঁকা হয়ে গিয়ে আদিগন্ত ধূ ধূ করছে। কেউ নেই কোথাও। পায়ের নীচে গরম কাঁচা মাটি আর ভুবনজোড়া আমারই এক ব্যর্থ আক্রোশ। এমন সব অনুভূতি ঠিক বলে বোঝানো যায় না। হয়তো তা সম্ভবও না। যেদিন তা সম্ভব হবে, মানুষ তখন হয়তো একটি রোবটজাতীয় কিছু হয়ে যাবে। ভূতগ্রস্তের মতো আমি অনিন্দিতার পেছন পেছন এগিয়ে গেলাম।  
হোটেলে তেমন লোকজন নেই। চেয়ার- টেবিলগুলো ফাঁকাই। কোনো কোনোটাতে ভনভনিয়ে মাছি উড়ছে। টেবিলক্লথে বাসি খাবারের গন্ধ। রোদচশমা না খুলেই অনিন্দিতা ক্যাসে-বসা ম্যানেজার বা মালিক যেই-ই হোক- তাকে বলল ‘এখানে একটা খাবার দিন।‘
আমার সর্দি লাগেনি, তবুও আমার নাক সুড়সুড় করছিল। গলার কাছটা ব্যথা করে উঠছিল। ঘন বর্ষার দিকে ছুটে যাচ্ছিল চোখ। দুটো টেবিল দূরে অনিন্দিতা রোদচশমা পড়ে বসে আছে। বাতাসের হলকায় ওর একগোছা চুল গাল পেরিয়ে ঠোঁটের কাছে। ওর রঙিন ঠোঁটদুটি দৃঢ়বদ্ধ। আর এদিকে আমি চোখের জল নাকের জল মিশিয়ে ভাত হামলে খাচ্ছি। আমৃত্যু আমি এই দিনটির কথা ভুলতে পারব না। কোনো দুঃসাহসিক কল্পনাতে এই দৃশ্যটির একটি ক্ষুদ্রতম অংশও আমি নিজের মতো করে বদলে নিতে পারব না। কোনো ঘটনা, মুহূর্ত বা অনুভব যেমন নৈর্ব্যক্তিক হয়ে আবহমানের হাতে চলে যায়, এও ছিল সেইরকম। 

২.
বনবস্তির কাছে এসে অটোটা থামতেই আমি নেমে ভাড়া মেটাতে গেলাম। অনিন্দিতা বাধা দিল। বলল ‘থাক, ভাড়া দিতে হবে না। আমিই দিয়ে দেব।‘
মেইন রাস্তা থেকে নেমে নুড়িপাথর ছড়ানো দু’মাইল পথ হাঁটলে তবে বনবস্তিটি। যেখানে ঊষা বলে আমাদের ওয়েলফেয়ার সোসাইটি চলে। বাঁশের চাটাই আর টিন দিয়ে মোড়া দু-কামরার একটা অফিসঘর আছে ওখানে। আর আছে লম্বাটে নাটমণ্ডপের মতো একটা শেড। ওখানে স্কুলছুট বাচ্চাদের কখনো কখনো পড়ানো হয়। কিশোরী মেয়েদের হাতের কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। গ্রাম্য মিটিং বা সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান করা হয়। দু-বছর বয়েস হতে চলল প্রোজেক্টটার। সরকারি ফান্ড তেমন মোটা অঙ্কের নয় কিছু। তাও প্রতি ছয়মাস পর পর পেতে দেরী হয়। আমি নুড়িপাথরের রাস্তায় অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলাম। অনিন্দিতার কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়। শুভর সঙ্গে বিয়ে হবার পর ও শুনেছি এলআইসি বিল্ডিংয়ের কাছাকাছি কোথাও ভাড়া থাকে। বাপের বাড়িতে বিশেষ যাতায়াতও নেই। বছর তিনেক আগে ওর বাবা মারা গেছে বলে শুনেছি। শুভ আর ও দুটো কাছাকাছি ইস্কুলে চাকরি করে। একটি ছেলে আছে ওদের। একটা পাবলিক ইস্কুলে পড়ে। এইসব খবর টুকরো-টাকরা আমি পেয়েছি। কিন্তু কী কারণে যেন ওর সঙ্গে দেখা করার কোনো তাগিদ কখনো অনুভব করিনি। এখানকার মুখ্য রাস্তাগুলোয় যখন আমি আসা-যাওয়া করেছি, অজান্তেই যেন চাইতাম অনিন্দিতার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ না হোক। কখনো ভগবান বলে নিরাকার বস্তুটি মানুষের প্রতি অত্যন্ত দয়াপ্রবণ হয়ে ওঠেন এবং এই হয়তো কারণ যে গত ছ-সাত বছরে কখনোই কোথাও ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। 
 
  আমি লক্ষ্য করেছি অনিন্দিতা আগের থেকে বেশ মুটিয়ে গেছে। তলপেটের মাংস ঢলে পড়েছে শাড়ির কুঁচি যেখানে গোঁজা, তার ওপর। গালও বেশ ভরাট। আঁচলের আড়াল থাকলের স্তনের ওজন বোঝা যায়। সুখের চিহ্নই হয়তো এইসব। সুখ মানুষকে স্ফিত করে। 
হঠাৎ আমার মনে হল তাহলে আমার মায়ের সঙ্গে ব্যাপারটা একইরকম হল না কেন। বাবার মহাজনি ব্যবসা ছিল ভালই। একটু গ্রামের দিকে পাকা দোতলা বাড়ি। লিজ-দেওয়া জমিজায়গা। বাড়িতে ধান-চালের আড়ত। অথচ মা দিনদিন কেমন শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। শেষ অবস্থায় মায়ের কঙ্কালের ওপর জড়ানো ছিল শুধু চামড়াটুকু। কাঁচা পয়সায় ফুলেফেঁপে ওঠা বাবা একদিন ট্রাক কিনল। মায়ের নামে সেই ট্রাকের নাম দেওয়া হল সবিতা। দুই মেয়ের ভাল বিয়েও হল কিন্তু মায়ের শীর্ণতা কমল না কিছুতেই। 

  শেষ বয়েসে বাবাও কিন্তু খুব রোগা হয়ে গিয়েছিল। হ্যালুসিনেশনে পেয়ে বসেছিল বাবাকে। মাঝে মাঝেই বলত ‘কীরে নূপুর এলি? দ্যাখতো তোর মা কোথায়?’ নূপুর আমার বড়দির নাম। মালদাতে ওর বিয়ে হয়েছে। 
হু হু করে এখন চৈত্রমাস ফুরিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো দিন ঘুম ভেঙেই দেখি চারিদিকে ভীষণ মেঘলা আলো। হাওয়ায় কেমন সজল সজল একটা গন্ধ। কোথাও বৃষ্টি হলে যেমন হয়। সেদিন আমার পুরোনো বাড়ি বাবা-মায়ের কথা খুব মনে হয়। আর মনে হয় একটি প্ল্যাংকিন-করা কাঠের ঘরের কথা। যে-ঘরটি ছিল আমার জ্যাঠামশাইয়ের প্রেসের পেছনে। বড়ো একটা সম্ভবত তেঁতুল গাছের নীচে। ওখানে কার যেন একজোড়া খরম আর হুঁকোর থলে রাখা ছিল। 
এমন দিনগুলিতে কখনো কখনো আমি আমাকে নিয়ে ভাবি। ভাবি আদতে আমার পরিণাম কী? মোটামুটি ডিগ্রি তুলেও কোনো চাকরিবাকরি পেলাম না। বাবা মারা যাওয়ার পর বাড়ি ভাগাভাগি করে যেটুকু পয়সা হাতে এলো, তা নানা কিসিমের ব্যবসায় ডুবে গেল। অনিন্দিতার হাজার বারণ সত্ত্বেও আমি একবার প্রোমোটারিতে পয়সা লাগালাম। লোকসান খেয়ে যখন আমার উদভ্রান্ত অবস্থা অনিন্দিতাই আমাকে নিয়ে গেল মঞ্জরীর কাছে। মঞ্জরী অনিন্দিতার পিসির মেয়ে। ও একটা বেশ ভাল মন্তেসরি চালায় শহরের মধ্যে। আমাকে বলল ‘কিছুদিন এখানে পড়া। আমি বিটিটা কমপ্লিট করি।‘
মঞ্জরী আমাদের সব কথাই জানত। মাসিক বেতন কম হলেও ও আমার থাকা-খাওয়ার বেশ ভালই ব্যবস্থা করেছিল মান্তেসরির একদিকে। বেশ কিছু টিউশানিও জুটে গিয়েছিল ওরই চেষ্টায়।

  আমি এখন বুঝতে পারি এই কথাটির মধ্যে অনিন্দিতার কী দৃঢ়প্রতিজ্ঞা ছিল। এখন পারি তবে তখন বুঝতে পারিনি। তখন যেভাবেই হোক চট করে পয়সা কামিয়ে নেওয়ার একটা ভূত আমার মাথায় চেপে বসেছে। বন্ধুদের অধীনে বাইক, মোবাইল। কারো কারো পছন্দের মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। আশু বলল ‘তোর বৌয়ের বিটি কমপ্লিট করে চাকরি পেতে পেতে কয়েকবছর। ততদিন বসে থাকবি? আমার সঙ্গে পিস-কাপড়ের বিসনেসে চলে আয়। আঁটঘাট আমি সব জানি।‘
কতদিন করেছিলাম মন্তেসারির চাকরি? মাসতিনেক। তারপর আশুর ডাকে পুঁজি যেটুকু ছিল, তা নিয়ে নেমে পড়লাম পিস-কাপড়ের ব্যবসায়।

  এরপরে অনিন্দিতার সঙ্গে যেদিন দেখা হল, আমি কিছু বলতে পারছিলাম না। অনিন্দিতার এক মাসি-মেসোমশাই বিদ্যুত সরবরাহ দপ্তরে কাজ করেন। সরকারি আবাসনের তে-তলায় ওদের ফ্ল্যাট। বারান্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠলে একটুকরো ছাদ। অনিন্দিতা সেখানেই আমাদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেছিল। ওর মাসিও আমাদেরকে একলা ছেড়ে দিতে কোথাও বেরিয়ে গিয়েছিলেন। সবে শীতের আঁশ এসেছে বাতাসে। বেলা দেড়টার রোদ বেশ মিঠে আর ঝিম-ধরানো। হাউজিংয়ের আশেপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অনেক গাছ। লম্বা লম্বা সুপুরিগাছের মাথাগুলি অল্প অল্প দুলছে। ছাদটা নির্জনতায় টইটম্বুর। 
অনিন্দিতা বলল ‘তাহলে ব্যবসাই করবি?’
আমি কোনো কথা না বলে ছাদে কয়েকটি পিঁপড়ে মুখে একটা পোকার ডানা নিয়ে মিছিল করে যাচ্ছিল, তাই নিবিষ্টমনে দেখছিলাম। 
-‘তোর জীবন। সিদ্ধান্ত তুই নিতেই পারিস। এতে অন্যায় কিছু নেই। তবে একটা কথা, মা কিন্তু সব ব্যাপারটা জেনে ফেলেছে। বিয়ের জন্য কথাবার্তাও শুরু করে দিয়েছে। কয়েকটা সমন্ধও এসেছে আমার।‘
আমি চুপ করেই থাকলাম।
-‘তোর কিছু বলার নেই?’
-‘আমি কী করতে পারি?’
-‘বাহ! এই তোর উত্তর! একটি মেয়ে যখন কাতরভাবে তার অসহায়তার কথা বলছে, তুই এমন রিঅ্যাক্ট করবি?’
-‘এছাড়া আমি এখন কী করতে পারি বল? সবেমাত্র ব্যবসায় নেমেছি। কী হবে কিছুই জানি না। জীবনটা তো সিনেমার পর্দা নয় যে আমি তোকে নিয়ে পালিয়ে যাব। জংগলের কাঠ কেটে ঘর বানিয়ে থাকব। ঠেলা চালিয়ে তোকে খাওয়াব।‘ এইকথাগুলি একদমে বলেছিলাম। বলার সময় অনিন্দিতার মুখের দিকে তাকাইনি। তাকাতে পারিনি। 

  এরপর একটা লম্বা নৈঃশব্দ্য। মধ্যে মধ্যে আশেপাশের কোনো বাড়ির হাতকল চাপার বিশ্রী শব্দ শোনা যাচ্ছিল। আর শোনা যাচ্ছিল বড়ো রাস্তায় গাড়িঘোড়া ছুটে চলার আওয়াজ। কী একটা পাখির কুব কুব করে ডাক।
সাদা সুতির একটা আটপৌরে কামিজ পরে সেদিন এসেছিল অনিন্দিতা। গায়ে খুব ফিকে কমলা রঙের নেটের ওড়না। তখন অনিন্দিতা রোগা। কাপড়ের দোকানে যেমন ম্যানিকিন অর্থাৎ মানব-পুতুলগুলি থাকে, সেইসব মেয়ে মানব-পুতুলগুলির মতোই খোঁচা খোঁচা স্তন। মাথার চুল দু-ভাগে ভাগ করে বিনুনি করা। 
কিছু না বলে আমার পাশে গাঢ় হয়ে এসে বসল অনিন্দিতা। আমি ছাদেই একটা ইটের থাকের ওপরে বসেছিলাম। আমার পাশে বসে অনিন্দিতা আমার গলা জড়িয়ে ধরল। বলল ‘আমার বিয়ে হয়ে গেলে থাকতে পারবি তুই? একটুও কষ্ট হবে না?’
মানুষের মস্তিষ্ক, হৃদয় যে কখনো কখনো বিকল যন্ত্রের মতো কাজ করে, সেদিন বুঝেছিলাম। আরও বুঝেছিলাম যে তারা যে বিকল হয়ে যায়- তাই নয় বরং বিপরীত দিকে সমস্ত ব্যবস্থাটিকে চালনা করতে থাকে। আমার গায়ে প্রায় মিশে আছে অনিন্দিতা। আমার চেতনায় নীল হয়ে আছে একটা কখনো-না-দেখা সমুদ্র। সেই সমুদ্রে ঝড় নেই, ঝঞ্ঝা নেই বরং কী সুব্যাপ্ত প্রশান্তি। ছোটো ছোটো ঢেউয়ের মাথায় পানসি। আমার চিবুকের কাছে অনিন্দিতার ঠোঁট। ভিজে ভিজে, উদগ্রীব। ওর স্তন আমাকে স্পর্শ করেছে। হঠাৎ আমার কেমন একটা ঘেন্না হল। কারণ ও যখন আমার গলা জড়িয়ে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে কথাগুলি বলছে, তখন কথা বলার সময় আমার চোখে পড়েছে ওর দাঁতের ফাঁকে খাবারের হলুদ লেগে আছে। 

  আমি ওর হাতের বন্ধন ছাড়িয়ে রূঢ়ভাবে উঠে দাঁড়ালাম। বললাম ‘হয়তো হবে কিন্তু আবেগের বশে কোনো হঠকারি কাজ আমি করতে পারব না। ব্যবসাটা সবেমাত্র শুরু করেছি। এখন অনেক খাটতে হবে আমাকে। আর ওই যে বললাম, জীবনটা সিনেমার পর্দা নয়।‘
কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে একটা ক্রুদ্ধ সিংহীর মতো উঠে দাঁড়াল অনিন্দিতা। ওর মুখে যেন গোটা দেহের রক্ত এসে জড়ো হয়েছে। খসে-পড়া ওড়নাটা ভাল করে গায়ে পেঁচিয়ে নিতে নিতে বলল ‘তাহলে শোন, এই যে আমি সুতির কামিজটা পরে আছি না, সেটা কার বলতো? শুভ-র মায়ের।‘

  সেই প্রথম শুভ নামক একজন আমার দুনিয়ায় ছায়া ফেলে এসে দাঁড়াল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু বুঝতে পারছি চওড়া পাথরের মতো দরাজ বুক তার। ছড়ানো কাঁধ। হাতের পেশীতে অ্যাটলাসের মতো শক্তি। হাত ওঠালে সে নক্ষত্র ছিঁড়ে আনতে পারে। তার ঘামে হয়তো চন্দনের গন্ধ। 

  সিঁড়ি দিয়ে প্রায় দৌড়ে নেমে গেল অনিন্দিতা। আমি সেই গরম ছাদটায় বসে ছিলাম আরো কিছুক্ষণ। কোনো অনুভূতি কাজ করছিল না। শুধু তলপেট ভারী হয়ে উঠে ভীষণ পেচ্ছাপ পেয়েছিল। আমি সেই খোলা নির্জন ছাদেরই এক কোনে খোলা আকাশ আর রোদের ঝালর মাথায় নিয়ে কী একটা ভাবতে ভাবতে পেচ্ছাপ করে খানিকটা ধাতস্থ হয়েছিলাম। পেচ্ছাপের জল শিকারি সরীসৃপের মতো গড়িয়ে এসেছিল ছাদের প্রায় মাঝখানে। সেই পরিপূর্ণ রোদে কী কটু লাগছিল ছাদের গা বেয়ে আমার পেচ্ছাপের গড়িয়ে আসা ধারাগুলিকে দেখতে। 

৩.
অনিন্দিতার সঙ্গে আমার বিয়ে হলে হিন্দুমতে সেটা নিষিদ্ধ বিবাহই হত। কারণ অনিন্দিতা ছিল আমার দূর সম্পর্কের এক মামার মেয়ে। আমার আর অনিন্দিতার ব্যাপারটা যখন ওর মা জানতে পারেন, তখন উনি ভয়ংকর রণংদেহি মূর্তি ধারন করেছিলেন। একবার তো অনিন্দিতা ওর পিঠ খুলে আমাকে লম্বা লম্বা কালসিটেগুলিও দেখিয়েছিল। আমার চিঠিপত্র ( ফোন করায় সমস্যা ছিল, তাই অনিন্দিতাকে আমি চিঠিই লিখতাম) উনি ডাঁই করে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমার বাবার কাছে সেই খবরও পাঠিয়েছিলেন। বাবা তখন রোগশয্যায়। স্পষ্ট করে কথাও বলতে পারেন না। আমি একদিন বাবার ঘরে গিয়েছি। বাবা উঠে পায়খানায় যেতে পারতেন না তখন। বেডপ্যানে পায়খানা করতেন। তারফলে ঘরের মধ্যে কেমন একটা পায়খানা-পেচ্ছাপের হালকা দুর্গন্ধ ভেসে বেড়াত সবসময়। আমাকে দেখে বাবা হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন। আমি বাবার বিছানার পাশে গিয়ে বসলাম। 
বাবা ওর শক্ত হাড় হাড় আঙুলগুলি দিয়ে আমার কবজি চেপে ধরলেন।
-‘কিছু বলবে?’
বাবা কফ-বসা হড়হড়ে গলায় বললেন ‘রবির মেয়ে তোর মামাতো বোন। এসব ওর সঙ্গে করিস না।ভাল হও, বড়ো হও।‘
কী কারণে যে তখন আমার মধ্যে অনিন্দিতার জন্য তীব্র একটা প্রতিহিংসাপরায়ণতা তৈরি হয়েছিল, তার ব্যাখ্যা এখনো আমার অজানা। অনিন্দিতা তখন পাশের শহরে বিটি করতে চলে গিয়েছে। আর আমার মধ্যে রেখে গ্যাছে ওর আমাকে বলা সেই কথাটি ‘এই যে আমি সুতির কামিজটা পরে আছি না, সেটা কার বলতো? শুভ-র মায়ের।‘ আমাদের বাড়ির পেছনে গাছপালায় ছায়াচ্ছন্ন হয়ে থাকা একটুকরো জমির ওপরেই ছিল সেই নড়বড়ে, একদিকে কাত হয়ে পড়া কাঠের প্ল্যাংকিন-করা ঘরটি। যেখানে ছিল একটি তক্তপোশ, একটি ভারী হাতল-দেওয়া কাঠের পুরনো চেয়ার, কার যেন একপাটি খড়ম আর একটি হুকোর থলে। যেদিন যেদিন ব্যবসায় যেতাম না, সেদিন ওই কাঠের ঘরে গিয়ে অনিন্দিতার কথা মনে করে হস্তমৈথুন করতাম। ভাবতাম আমার গরম টাটকা বীর্য অনিন্দিতার সারা শরীরে পড়ে ওকে ফুটো ফুটো করে দিচ্ছে অথবা পুড়িয়ে দিচ্ছে- যেভাবে অ্যাসিডে মানুষের শরীর পুড়ে যায়। একটি নোংরা গামছায় আমি আমার শিশ্ন মুছে সেটা গুঁজে রাখতাম কাঠের বেড়ার কোনো ফাঁকে। ক্রমাগত আঠালো বীর্য মুছতে মুছতে গামছাটি নিজের মধ্যে কুঁকড়ে গিয়ে একটা কাপড়ের বলের মতো চেহারা নিয়েছিল। কখনো ভাবতাম আমার বীর্য ছিটকে গিয়ে পড়েছে ওর মুখে-ঠোঁটে, যেখানে শুভ চুমু খাবে বা চোখের দৃষ্টি রাখবে। কেমন যেন তাতে শান্তি হত আমার। মনে হত শুভ নামক এক মহাবলীকে ওর অজান্তে কোথাও আমি হারিয়ে দিয়েছি। ও আমাকে হারানোর আগেই আমি ওকে হারিয়ে দিয়েছি।  
কোনো কোনো দিন আবার হস্তমৈথুনের পর প্রচণ্ড অপরাধবোধও হত। মেজাজ খিঁচ ধরে থাকত। ওই ঘরেরই তক্তাপোশে শুয়ে শুয়ে বিড়ি-সিগারেট খেতাম আর ভাবতাম অনিন্দিতা এইমুহূর্তে কী করছে। আমার যেমন মনে পড়ছে ওর কথা, ওর-ও কি মনে পড়ছে? আমি কি কোথাও কিছু দুরারোগ্য ভুল করে ফেললাম? কোনোদিন কি আর আমার অনিন্দিতার সঙ্গে দেখা হবে? আমি ওর ভিজে ভিজে ঠোঁটে একটা চুমু খেতে পারব? খোঁচা খোঁচা স্তনগুলি ছুঁতে পারব? কোনো আশ্চর্য কারণে আমার লিঙ্গ চালনা করতে পারব ওর যোনিতে? 

  ব্যবসা করতে গিয়ে খাবি খাচ্ছিলাম। প্রথম প্রথম আশু আর আমি সপ্তাহের শেষে সকালের ট্রেনে শিলিগুড়ি গিয়ে মাল কিনে আনতাম। পরেরদিকে আশু আর যেত না। নানারকম বাহানা ফেঁদে আমাকেই পাঠিয়ে দিত। কয়েকদিন যেতে না যেতেই বুঝলাম আশু আমার পয়সায় বসে মধু টানছে। একদিন সোজা গিয়ে হাজির হলাম ওর বাড়ি। 

   বাড়ি বলতে দাঁত বের করা একটা ইটের গাঁথনির ঘর। নোংরা মশারি বিছানার কোনে ডাঁই করে রাখা। মেঝের কোনায় কালি-মাখা কেরোসিন স্টোভ আর গতদিনের না-ধোয়া এঁটো থালাবাসন। লিন্টেলের ওপরে টিন তেল-ঝুলে মাখামাখি। সেদিন শনিবার। আশুরই ব্যবসায় যাবার কথা। ব্যবসা মানে সপ্তাহে আশেপাশের এলাকায় যে গ্রামীন হাটগুলি হয়- সেখানে। আমি গিয়ে দেখলাম আশু বিছানায় বসে হাতের চেটোয় গাঁজা বানিয়ে সিগারেটের খোলে পুরছে। 
-‘কী ব্যাপার? তুই আজ হাটে গেলি না?’
-‘শরীরটা ভাল নারে! কেমন জ্বর-জ্বর এসেছে।‘
-‘এ সপ্তাহে মোট চারটে হাট হয়েছে। তার হিসেব দেখা। আমার টাকার দরকার।‘
-‘টাকা এখন পাবি না। যে টাকাটা উঠেছে ওটা আমি খরচ করে ফেলেছি। খরচ করে ফেলেছি মানে জুতোর দোকানের সাহা-দা সুদে চাইল, দিয়ে দিলাম। টেন পার্সেন্ট ইন্টারেস্ট। একমাসের জন্য।টাকাটা উঠলে আধাআধি।‘
আশুর বিভিন্ন ব্যবহারে ওর ওপর তিক্ত একটা অসন্তোষ জমে উঠেছিল আমার মধ্যে। ওর এই কথায় আমি নিজেকে আর সামলে রাখতে পারিনি। এক ঝটকায় ওর গেঞ্জির গলা টেনে ওকে উঠিয়ে বসিয়ে দিলাম। 
-‘শুয়োরের বাচ্চা, ইয়ার্কি মারিস?’
আশু থতোমতো খেয়ে বলল ‘এই, কী করছিস?’
আমি তখন বাজ পড়া শুকনো গাছের মতো জ্বলছি। বললাম ‘বাঞ্চোৎ, সবই তো আমার পয়সা। আমার পয়সায় ওস্তাদি মারতে লজ্জা লাগে না?’
চেহারা পাল্টে খেঁকি কুকুরের মতো হয়ে উঠল আশুও। দাঁত খিঁচিয়ে বলল ‘বড়ো বড়ো বাতেলা দিচ্ছিস শালা? বড়ো বড়ো বাতেলা? আমি বুদ্ধি না দিলে তো ওই বালের মান্টেসরি ইস্কুলে দিদিমণিদের মাই ধরে ঝুলে থাকতিস!’
আমি গায়ের সমস্ত শক্তি নিংড়ে ঠাঁটিয়ে একটা চড় বসালাম আশুর তোবড়ানো গালে। আঘাতটা অ্যাতোই জোরালো ছিল যে আশু টাল সামলাতে না পেরে হুড়মুড়িয়ে পড়ল কেরোসিন স্টোভ আর এঁটো থালা-বাসনের গাদায়। চড়টা বসিয়ে একটা অদ্ভুত শান্তি যেন মহাশূন্য থেকে নামল আমার মনে। যেন এইরকম কিছু একটা করার জন্যই আমার অবচেতন মন ছটফট করছিল। আশু উল্টে পড়ার পর আমি আর দাঁড়ালাম না। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। পেছন থেকে আশু হয়তো তখন অনর্গলভাবে খিস্তি করছিল কিন্তু আমার কানে তার কিছুই পৌঁছাচ্ছিল না। 

  রাস্তায় তখন অফুরন্ত জীবনের স্রোত। পশ্চিম আকাশ থেকে বড়ো একটা হ্যালোজেন আলোর মতো তেরছা হয়ে রোদ আসছে। কত মানুষ! পালে পালে মানুষ! গাড়ি-ঘোড়ার দল! সব আলাদা আলাদা মানুষ। কেউ সুখী, কেউ অশান্ত। সবারই আলাদা আলাদা গন্তব্য, আলাদা আলাদা চিন্তা। কত মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। তাদের উদ্ধত বুক, ততোধিক উদ্ধত নিতম্ব। পায়ের গোছে ফরসা, শ্যামলা রঙ। অনেকেই অনিন্দিতার থেকে সুন্দরী, অনেকে অনিন্দিতার থেকে কুৎসিত। ওদের গায়ে ফেরতা দেওয়া শাড়ি, জামাকাপড়ের আড়ালে কেমন গন্ধ আছে? অনিন্দিতার অভ্যন্তর থেকে যে নীল নীল উদার সমুদ্রের মতো গন্ধ আসে- সেরকম? ওদের স্তনে কি হাত দিলে দেখব সেগুলো শক্ত কাঠে তৈরি? আর চৌকোনা ত্রিমুখী সব বড়ো বড়ো বাড়িগুলি, যাদের গা থেকে নির্গত হয়ে ঝাড়বাতির মতো বিত্তের সুখের পাপ ও পুণ্যের মিলিত এক আলোকগঙ্গা কেবলই ঊর্দ্ধের দিকে উড়ে যাচ্ছে। এমন আরেকদিন হয়েছিল। আমি আর আশু মদ খেয়ে সেদিন রেললাইন টপকে আরো দূরে কোথাও হেঁটে যাচ্ছি। চারপাশে ভীষণ গাঢ় অলৌকিক জ্যোৎস্না। আমার পদক্ষেপ তখন বাতাসে। আশু বলছে ‘ব্যবসাটা দাঁড়িয়ে গেলি দেখিস টাকাপয়সার কোনো অভাব থাকবে না। প্রেমটেম কিছু নয় রে, টাকাপয়সাই সব। তখন দেখিস তোর ওই বিটি বউয়ের থেকেও সুন্দরী মেয়েরা এসে তোর সাথে শোবার জন্য লাইন দেবে।‘ আমিও বাতাসে হাঁটছি, আশুও বাতাসে হাঁটছে। বাতাসের পথটা যেন ক্রমে ঘরবাড়ি, গাছপালা ছাড়িয়ে ঐরকমই ঊর্দ্ধে উঠে গেছে। 

৪.
অফিসে এসে দেখলাম বড় লম্বা নাটমণ্ডপের মতো শেডটার নীচে বসে অর্জুন একটা দাঁ দিয়ে বাঁশ চাঁছছে। অর্জুন জাতিতে তুরি। বাঁশের কাজ ওদের বংশানুক্রমিক কাজ। ওদের আত্মীয়স্বজন যে কয়টা পরিবার এখানে থাকে, সবাই চমৎকার বাঁশের জিনিসপত্র বানায়। এবারের প্রোজেক্টে ওদের নিয়ে একটা স্বনির্ভর দল তৈরির প্রস্তাবনা আছে। 

  আমাকে দেখে অর্জুন হাসল। ওর হাসিটা বড়োই সুন্দর, নির্মল। বড়ো বড়ো সাদা দাঁতে ও হাসে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম ‘কেউ আসেনি?’ মানে আমি আমার অন্য বন্ধুদের কথা জানতে চাইছিলাম। যারা এই সোসাইটিটা চালাই। কৃশাণু, অরিন্দম আর ছোটেলাল। 
অর্জুন ওর দেহাতি ভাষায় বলল যে ছোটেলাল আর কৃশাণু এসেছিল। খানিকক্ষণ আগেই ওরা বাইকে চেপে কোথাও বেরিয়ে গেছে। 

  আমি চাটাই আর টিনে মোড়া খুপরি অফিসঘরটিতে গিয়ে বসলাম। এই ঘরে একটা পাখা আছে, সেটা চালিয়ে দিলাম। এলোমেলো মনে হাঁটতে হাঁটতে একটু হাঁপিয়েও উঠেছিলাম। চেয়ারে গা ঢেলে বসে আরাম পেলাম। 

  অর্জুন এক বোতল জল এনে আমায় দিল। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল ‘চা খাবেন?’
খুব আন্তরিক গলার স্বর অর্জুনের। এই বস্তিটায় কুড়ি-বাইশটি পরিবার আছে। সবাই তপশিলী জাতিভূক্ত, আদিবাসী সম্প্রদায়ের। কয়েকটি ঘর নেপালি সম্প্রদায়েরও আছে। জংগলই ওদের জীবিকার উৎস। কঠোর সংগ্রাম করে ওরা টিকে আছে। কয়েকপ্রস্থ জমিতে মরসুমে ধান বা মকাইয়ের চাষ করে কেউ কেউ। হাতির দঙ্গল এসে সেই আবাদ তছনছ করে চলে যায়। বাড়িও ভাঙা পড়ে কখনো কখনো। ভেতরে ভেতরে কেমন ছত্রখান হয়েছিলাম আমি, অর্জুনের এই আন্তরিক কণ্ঠস্বরে যেন সান্ত্বনা পেলাম। বললাম ‘নিয়ে আয়, একটু চা খাই।চিনি কম দিবি।‘
অর্জুন চলে যেতেই শান্ত একটা নির্জনতা চারপাশ থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল। 
এই এলাকাটা খুব চুপচাপ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিলাম। চতুর্দিকে নানা গাছগাছালির ভীড়। ফুরোনো বসন্তের রঙ এখনো ওদের গায়ে লেগে। কী একটা গাছের বেড়িয়ে আসা ডালের সব খুদে খুদে পাতা তীব্র হলুদ রঙের। পাশেই আরেকটি গাছে মেরুনের পোচ। একটা ধুলো-পাথরে সাদা রাস্তা বস্তি থেকে বেরিয়ে আলস্যে এঁকেবেঁকে বাসরাস্তার দিকে গেছে। তারই একখানে সেই খুদে খুদে হলুদ পাতাগুলো খসে খসে পড়েছে। দেখলে মনে হচ্ছে হলুদ রঙ ঢিপ করে ছড়িয়ে রেখেছে কেউ। পরের বস্তিতে একটা প্রাইমারি ইস্কুল আছে। সেখান থেকে ব্যাগের ঝোলা পিঠে নিয়ে ঘরে ফিরছে কতগুলি দেহাতি ছেলেমেয়ে। কখনো কখনো ওরা রাস্তা থেকে ঢিল কুড়িয়ে মাঠে বসা কোনো পাখিটাখির দিকে ছুড়ে মারছে আর হেসে উঠছে। একটা কালো জীর্ণ নড়বড়ে লোক একটা গরুকে তাড়া দিতে দিতে ফিরছে। আর চারপাশে বহুদূর অবধি মাঠ। এমন মাঠের শেষে যখন বিকেল হয়, মনে হয় পৃথিবীর বুঝি মনখারাপ হয়েছে।  
 
  আমি ভাবলাম অনিন্দিতাকে নিয়ে পালিয়ে এসে এমন একটা জায়গায় যদি থাকতাম? ওকে পৌরুষ দেখিয়ে সেদিন বলেছিলাম জীবনটা সিনেমার পর্দা নয়। কেনই-বা নয়? সিনেমার পর্দাটাও তো জীবনেরই মতো? জীবন বহির্ভূত কিছু সেখানে প্রতিফলিত হয় কি? স্তুপ করে রাখা বালু-বজরি, ইট বা সিমেন্টের ডাঁই তো সেখানে দেখানো হয় না? অনিন্দিতার গলায় সেদিন যে তীব্র আকুতি ছিল, তার সম্মান আমি দিতে পারিনি। না পারিনি। যা তখন আমার পৌরুষ বলে মনে হয়েছিল, তা আসলে ছিল একধরণের নির্মমতা। আমি তার ছদ্মরূপটা ধরতে পারিনি। ‘শোনো অনিন্দিতা শোনো, আমি সেদিন এর ছদ্মরূপটা ধরতে পারিনি।‘ 
এইসময়ে পকেটের ছোট্ট ফোনটা তিড়িক তিড়িক করে বেজে উঠল। ওপারে কৃশাণু। বলল ‘শোন না, বিডিও অফিসে এসেছি। ওরা আগামীকাল আমাদের সঙ্গে মিলে একটা অতিমারি এবং স্বাস্থ্যবিধির ওপর অ্যাওয়ানেস ক্যাম্প করতে চায়। কাল এমএলএ আসছেন। ওনাকে বেস করেই ক্যাম্পটা করতে হবে। এই বেলা তিনটে নাগাদ। যেটুকু খরচ হবে, এই মানে চা-বিস্কুট একটা ছোটো টিফিনের প্যাকেট- তার খরচা এরাই দিয়ে দেবে। তাই তোকে ফোন করলাম। তুই এখন কোথায়?’
-‘অফিসে।‘
-‘শোন না, তাহলে আগামীকাল কি অ্যারেঞ্জ করা সম্ভব?’
-‘সবই সম্ভব। পা না চাটলে তো হবে না।‘
-‘ওকে, তাহলে আমরা রাজি হয়ে যাচ্ছি। ও, একটা ব্যানার বানাতে হবে। তুই আর্ট কর্নারকে বলে দে।‘
অর্জুন একটা গ্লাসে করে চা নিয়ে এল আর চালের তৈরি একরকমের গোল পিঠে। দেহাতি এই পিঠেগুলির স্বাদ খুব ভাল। আমি অর্জুনকে দেখলাম। পাথরে কুঁদানো সুঠাম একটি ছেলে। নাগরিক কলুষ থেকে এখনো ওর আত্মা মুক্ত। এই অ্যাওয়ারনেস ক্যাম্প কী, তা এই ক’দিনে আমি ভালভাবেই বুঝে গেছি। এও এক ছদ্মরূপ। এই সরল, কলুষমুক্ত মানুষগুলোর আত্মা দূষিত করে দেবার খেলা। হা! অতিমারি আর স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে বিধায়ক বলবেন! বলবেন তো তরজার কথা। এই পার্টির হয়ে আরেক পার্টির হাজারো বদনাম। বাবা যখন অসুস্থ, তখন একটি মেয়ে এসে বাবাকে দুইবেলা কোমরে ইঞ্জেকশান দিয়ে যেত। এও যেন তেমনই। ধীরে ধীরে মানুষগুলোকে দুষিত, কলুষিত করে ফেলা। 
অর্জুন বেরিয়ে যাচ্ছিল। আমি ওকে ডেকে বললাম ‘শোন।কালকে একটা প্রোগ্রাম আছে। তুই বস্তির সবাইকে খবর দিয়ে রাখবি। এমএলএ আসবে, বিডিও অফিস থেকে লোকজন আসবে। বেলা তিনটেয়। এই শেডেই হবে প্রোগ্রামটা। বিনোদকে বলে কয়েকটা চেয়ার-টেবিল এনে পাতবি। সেগুলোয় কভার যেন থাকে। আর কয়েকটি মেয়েকে রেডি করবি। ওরা অতিথিদের কপালে তোদের নিয়মে ফোঁটা দিয়ে স্বাগত জানাবে। আর কাঞ্ছি-মাগদালিদের বলবি ওরা যেন চা-বিস্কুটের ব্যবস্থা করে রাখে। আর সবাই জড়ো হলে একটা খাতায় সবার সই নিয়ে রাখবি। অতিথিদের সই নেবার দরকার নেই।‘
অর্জুন কেমনভাবে হেসে যেন বলল ‘সামনে ইলেকশন, না?’
আমি ওর চোখের দৃষ্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলাম। যেমন অনিন্দিতার দৃষ্টি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতাম। আজ যেমন অটোয় ওর মুখের দিকে ভাল করে তাকাতে অবধি পারিনি। 
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললাম ‘সবকিছু সময়ে রেডি করে ফেলবি। পরে যেন না দেখি এটা হয়নি, ওটা হয়নি।‘
শেষ কথাটুকু বলার সময় কণ্ঠস্বরটা কেমন যেন কেঁপে উঠেছিল আমার। অনিন্দিতার মতোই আমিও কি এই মানুষগুলোর সঙ্গে নির্মম আচরণ করছি না? ওই এমএলএ-র মতো আমি বা আমরাও কি এদের নিয়ে খেলা করছি না? জানালা দিয়ে ধুলো-পাথরে ভরা রাস্তার সেই অংশটি দেখছিলাম, যেখানে খুদে খুদে হলুদ পাতাগুলো খসে পড়ে পাউডারের মতো ছড়িয়ে আছে। 
মানুষের মস্তিষ্ক, হৃদয় বিকল হয়ে পড়লে অনেক অদ্ভুত, বিপরীত ঘটনা ঘটে। আমার তেমনই মনে হল যেন উষ্ণ, নরম নাল-ঝোলে মাখা আমারই একটি অবয়ব আমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এল, বেরিয়ে অনেকটা অতিমানবিক কায়দায় জানালার গোবরাটে হাত-পা রেখে টপকে বাইরে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গেল হয়তো বাস রাস্তার দিকে। যেখানে ফিরতি অটোয় অনিন্দিতা ওর উদার প্রশান্তিময় নীল নীল সমুদ্রটার গন্ধ শরীরের কোনো পাত্রে নিয়ে ফিরবে। 
ফিরবে?

  হঠাৎ কেন জানি মায়ের কথা মনে হল। বাবার কথাও মনে হল। আমাদের একটু গ্রামের দিকে যে দোতলাবাড়িটি ছিল, তার কথা। উঠোনে যে রোদ পড়ে ঢলঢল করত বা বাবা যে স্নান করে উঠে ভিজে গামছা নিংড়ে তিনবার ঝাড়া দিতেন- সেসব। সেই শব্দে ভয় পেয়ে উঠোনে ধান খুঁটতে-থাকা পায়রাগুলি ডানা চটপটিয়ে উড়ে যেত। 

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments