জ্বলদর্চি

চেয়ার/শ্রীজিৎ জানা


চেয়ার

শ্রীজিৎ জানা

প্রাণহীন নিঃসাড় একটা শরীর।মানুষের মতো চেহারা নয় তার। কবন্ধ একটা কাঠামো।  হাত-পা যদিবা আছে কিন্তু তারা চলচ্ছক্তি হীন। শিরা উপশিরা ধমনী নেই। রক্তপ্রবাহ নেই। শরীরে কোন তাপ নেই, চাপ নেই, উত্তেজনা নেই!ক্ষুধার হাহাকার কিম্বা যৌনতার অগ্নুৎপাত চোখে পড়ে না। প্রতিবাদে চিৎকার বলুন অথবা আনন্দ উদাযাপন কোনকিছুতেই তার সাড়া মেলে না।হাড়-পাঁজরার ভিতর কোন হৃদযন্ত্র নেই বলেই প্রেমের তরঙ্গে স্পন্দিত হয় না। মন নেই তো মানসিক যন্ত্রণা অথবা মনুষ্যত্ব প্রকাশের দায় নেই।মস্তিষ্কশূন্য শরীরে বুদ্ধির মারপ্যাঁচের হিসেবনিকেশ নেই।মোক্ষ তার ধারণার বাইরে।

  অথচ মুহুর্তে সে হোয়ে উঠতে পারে শক্তিমান। সমাজ নিয়ন্ত্রক। লোভী হায়নার মতো লালা ঝরতে পারে তার মুখ থেকে। হিংস্র নেকড়ের মতো ক্রূরতার বহ্নি ঠিকরে বেরোতে পারে চোখ থেকে।নিমেষে হতে পারে অফিসের হোমরাচোমরা বস। আদর্শ শিক্ষক। সমাজ হিতৈষী। সদগুরু। আবার পরক্ষণেই দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা। ঠগ-জোচ্চর। ভন্ড সাধু--বকধার্মিক।তার ভিতরেই বাস করে জীবনদাতা একজন মহান ডাক্তার। অথবা ন্যায় বিচারক। কিম্বা তারই ইশারায় ঘটে যেতে পারে ভয়ানক অনাচার।বিভৎস ধ্বংসলীলা। নারকীয় তান্ডব।
এমন আশ্চর্য কাঠামো দিনরাত তৈরি করে চলেছে মতিলাল মিস্ত্রি। তিন প্রজন্ম ধরে  এই কাজ করে আসছে তারা। বাবা হীরালাল মারা যাওয়ার পর কাজের পুরো চাপ পড়েছে মতিলালের কাঁধে। হীরালালের ইচ্ছা ছিল ছেলে লেখাপড়া শিখে চাকরীবাকরি করুক। তাদের মতো রেঁদা ঠেলার কাজ না করুক। কিন্তু ভাগ্যরেখা ডিঙোনো কি সহজ কথা! চুনিলাল মানে হীরালালের বাবা বেঁচে থাকতে একদিন ছেলেকে ডেকে বলে,
--লিখাপড়ায় যা দেখিঠি মতির মাথা তেমনতর নয়। অকে সময়বুঝে কাজে লাগি দিবি।নইলে বারফটকা হোয়ে যাবে।

  হীরালাল বাপের কথা অমান্য করে নি।মাধ্যমিকে যেই ফেল করল অম্নি মতিলালের হাতে ধরিয়ে দিল বাটলি আর হাতুড়ি। চুনিলাল নাতির কাঠ পালিশের ঘষর ঘষর শব্দ শুনে নিশ্চিন্তে চোখ বুজিয়েছিল। হীরালাল চোখের সামনে দেখে গ্যাছে ছেলের খাটুনি।দোকানের পসার। মতিলাল বাপ-ঠাকুর্দার দোকানের খোলনলচে পুরো বদলে দ্যায়। বছর দু'য়েক ভিন রাজ্যে গিয়ে ফার্ণিচার তৈরির নিত্যনতুন কৌশল শিখেও এসেছে সে। তাদের দোকানের ফার্ণিচার মানে টেকসই আর স্টাইলে সবার সেরা। মা তারা ফার্ণিচারের নাম ফেরে সকলের মুখে মুখে।আশেপাশের বিশ-পঁচিশটা গ্রামে,স্কুলে, অফিসে মতিলালদের দোকানের তৈরি কাঠের কোন না কোন আসবাব আছেই। এমন কি দুরদুরান্তেও মা তারা ফার্ণিচারের আসবাব ডেলিভারি দেওযা হয়।

    মতিলালের দোকানের সব আসবাব জবরদস্ত হলেও চেয়ার তৈরিতে তার জুড়ি মেলা ভার। কত ধরনের চেয়ার তৈরি করতে পারে তারা। আর সেই চেয়ারে যে একবার বসেছে সে ছাড়া তার আরাম আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। অনেকে বলে মতিলালের হাতে বানানো চেয়ারে বসামাত্রই আলাদা একটা আমেজ,আলাদা একটা মেজাজ তৈরি হযে যায় সাথেসাথেই। মতিলাল হাতে যন্ত্র ধরা মাত্রই এক আলাদা মানুষ হয়ে যায়। শুকনো খটখটে কাঠের গায়ে কত ধরেনের বাটালি ঠুকে,রেঁদা ঘষে, প্যানা মেরে একটা অবয়ব দাঁড় করায়। ঠিক যেভাবে পাথর কেটে কেটে নির্মিত হয় ভাস্কর্য। তারপর হাতের কোমল স্পর্শে রঙে রাঙিয়ে দ্যায় কেঠো শরীর। তখনো কাজ শেষ হয় না। এবার পালিশের আদরে শরীরের রূপকে আরো খোলতাই করে তুলে। মতিলাল তার দাদু চুনিলালের কথা ভুলে না কখনো,
---একটা কথা মনে রাখবি মতি আমরা কাঠের মিস্ত্রি নয়,আমরা হলাম শিল্পী। যদ্দিন এই মেজাজ মনে ধরে রাখবি তদ্দিন কাজের অভাব হবেনি। আর যেই তোর মন থেকে শিল্পীটা পালাবে,জানবি তোর দোকানে ঝাঁপ ফ্যালার টাইম এসে গ্যাছে।

  কিন্তু এই মতিলাল মাঝে মাঝেই উদাস হোয়ে যায়। হাতে হাতুড়ি ধরে গভীর ভাবনায় যেন কোথায় হারিয়ে যায় সে। তার হাতের কাজ নিয়ে,দোকানের সুনাম নিয়ে কোন চিন্তা নেই তার। বরং গর্বই হয় যখন লোকে প্রশংসা করে। কিন্তু তবুও কোথাও একটা অপ্রাপ্তির বেদনা তার শরীরে- মনে আলপিন ফুটায়। ভাবে সে তো চেয়ারই তৈরী করে,নিষ্প্রাণ একটা বসার আসন। কিন্তু তাতে তো প্রাণ সঞ্চার করতে পারে না। মানে হোলো তার দোকানে যতক্ষণ থাকে ওই চারপায়া তখন শুধুমাত্র সে কটা টাকা মূল্যের একটা বসার চেয়ার মাত্র। আর যেই না অফিসে,আদালতে,স্কুলে,কলেজে ঢুকল অম্নি সে হোয়ে উঠল রাজার রাজা। যেন প্রাণ পেল সে। মতিলাল বোঝে চেয়ারের  প্রকৃত মর্যাদা তার দোকানে নয়।
তার বেশ মনে আছে সে তখন ক্লাস এইটে। খুব কম নম্বর পেয়েছে ইংরেজিতে। স্কুলে ডাক পড়েছে বাবার। হেড স্যারের রুমে বাপ-ছেলে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। তার দোষত্রুটির ফিরিস্তি শোনাচ্ছেন রাশভারী হেডস্যার বলাইবাবু। চেয়ারে জাঁকিয়ে বসে নাকের উপর মোটা চশমা রেখে সে কি কথা শুনানো! সামনে কটা চেয়ার থালি থাকলেও বাবাকে বসতে পর্যন্ত বলেনা বলাইচাঁদস্যার। মতিলাল জানে অফিসের কেন স্কুলের সবকটা চেয়ার টেবিলই তার বাপ-দাদুর হাতে তৈরী। কিন্তু তাতে কি! চেয়ারে বসতে গেলে যোগত্যা লাগে। চেয়ারে যে কেউ বসতে লাগে না। অওকাদ বলে একটা কথার চল আছে। সেই অওকাদ সবার হয় না
সেদিন স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে হীরালাল ছেলেকে ধমকের সুরে বলে,
--দ্যাখলি চিয়ারে বসার গুণ?পারু ত লিখাপড়া শিকে একটা চিয়ারে বোস্।দাঁড়ি দাঁড়ি সব হজম কত্তে হোল তোর জন্নে।

  মতিলালের মনে শুধু এই দৃশ্যটাই নয় আরো একটা দৃশ্য ভাসে। পাড়ুইদের বড়কত্তা আরামচেয়ারে হেলান দিয়ে গ্রামসালিশে বোসতো। তার জন্যেই সেই চেয়ার নির্দিষ্ট ছিল। এককালের জমিদার তারা। এখন সেই হাঁকডাকের ছিটেফোঁটা নাই।কিন্তু গলার দবদবানি একইরকম রয়ে গ্যাছে। যখন চেয়ারে বসে রায় শুনাবে যেন হাইকোর্টের জজ্! সেই চেয়ারখানাও মতিলালের ঠাকুর্দার হাতে গড়া। কিন্তু ওই বসার জন্যে যোগত্যা লাগে। মতিলালের ঠাকুর্দার  তা ছিল না,বাবারও ছিল না এমনকি তারও নেই। এই আক্ষেপ তাকে কুরে কুরে খায়। মনে মনে পণ করে রেখেছে ছেলে মেয়েকে কোন একটা চেয়ারে সে বসাবেই বসাবে। তবেই সেদিন তাদের বংশের চেয়ার তৈরী হাতযশ সার্থকতা পাবে।
মনের ভিতরের যন্ত্রণা আর ইচ্ছে নিয়ে  মতিলাল দোকানেই ব্যস্ত রাখে নিজেকে। হঠাৎ তার বাড়ির সামনের রাস্তা ঢালাইকে কেন্দ্র করে ঝামেলা বাধে। গ্রামের পঞ্চায়েত অক্ষয় সাঁতরা। মতিলালের এক ক্লাসের বন্ধু সে। সেই কবে থেকে অক্ষয়কে মতিলাল ভুটকা বলে ডাকে। আর অক্ষয় তাকে ডাকে মাতাল বলে। কিন্তু সেই ভুটকার সঙ্গেই তুমুল ঝগড়াফসাদ শুরু হয়। মতিলাল ঢালাইয়ের কাজে বাধা দ্যায়!রাফসাফ বলে,
-- ঢালাই সরকারি অডার মতে হলে হউ,নাইলে থাক। আটফুট চেওড়া আর চার ইঞ্চি মটা ঢালাই হবে বলে ক্যানে ছফুট বাই তিন ইঞ্চি হবে?
অক্ষয় গলা ঝাঁঝিয়ে বলে,
--তুই এসব কিছু বুঝুনু মাতাল। চুপমেরে যা।
--ক্যানে চুপ মারবো? তার মানে কনটাকটারের সঙ্গে তদের সাটা আছে। কমিশন খেইচু তাই কিচ্ছুটি বলুনু?
একপাড়া লোকের কাছে মতিলালের এই কথা হজম করতে পারেনা অক্ষয়। রাগে মুখ লাল করে তখনকার মতো চলে যায় সে।

  পরের দিন অঞ্চল অফিসে তলব হয় মতিলালের। অফিসে গিয়ে দেখে প্রধানের পাশেই চেয়ারে ঠেস দিয়ে মেজাজে বসে আছে ভুটকা মানে পঞ্চায়েত অক্ষয়। মতিলালকে দেখেও না দেখার ভান করে সে। অফিসে অনেকেই আছে,যাদেরকে মতিলাল তেমন করে চেনে না। প্রধান পরেশ মল্লিক চোখ ইশারা করে মতিলালকে বসতে বলে। দোকান থেকে সোজা অঞ্চলে চলে আসে মতিলাল। সেদিন থেকেই গাঁয়ে একটা ফিসফিসানি ভেসে বেড়ায়। সবাই ভেবে নেয় মতিলালের কপালে এবার একটা দুর্ভোগ নেমে এলো বলে। দোকানও তুলে দিতে পারে। আসার সময় তার গিন্নি পইপই করে বলেছে মাথা গরম না করতে। মতিলাল সহজভাবেই জিগ্যেস করে,
--পধানবাবু আমাকে ক্যানে ডেকে পাঠিছ্যান একটু বলবেন।
---তা তুমি নাকি রাস্তা ঢালাইয়ের কাজে আপত্তি দিয়েছো শুনছি?
---উটা কি আপত্তি বলে পধানবাবু!ভুটকা মানে অক্ষয় মোর সেই কবেকারের বন্ধু,অকেই বোল্লম সরকার যেমন অডার দিছে তেমনই যেন কাজ হয়,তুই দেখবি। এটা কি আপত্তি হোলো বলুন।
মুখে একটু হাসি মেখে মতিলাল কথা গুলো বলতে থাকে।তবে তার কথা শেষ না হোতেই যেন ঝাঁপ খেয়ে পড়ে অক্ষয়,
--একপাল লোকের সামনে উ বোলেছে আমরা নাকি কমিশন খেয়ে কাজ করাচ্ছি। ইটা কি পার্টিকে অপমান করা নয়?
কথা শুনে দু'চারজন মতিলালের উপর রে রে করে পড়ে। পরেশবাবু শান্ত হোয়ে বসতে বলে তাদের। আর বলে,
---এটা বলা কি তোমার আদৌ  ঠিক হয়েছে? এটা তো পার্টিকে এবং আমাদের পঞ্চাতকে ঘোরতর অপমান করা।
মতিলাল কথার ঝাঁজে কিছুটা দমে যায়। তখনো নরম গলায় বলে,
--ভুটকা তুই এটা লিয়ে এতো তালগোল পাকাউঠু ক্যানে। ইয়ার্কি করে কি তোকে বোলতে নাই ভাই?
--তুই ভুটকা ভুটকা করুসুনু ত। অফিসে এসছু, অফিসের মত কথা বল।
এবার পরেশবাবু আবার স্বর ভারী করে বলে উঠে,
---দ্যাখ বিষয়টা লিয়ে অনেককিছু করা যায়। কিন্তু কচ্ছিনি। তমরা আমাদের পরিচিত। তমার বন্ধু হলেও সে তো একজন পঞ্চাত। আমাদের পার্টির কর্মী একজন। তমার উপরেই ছাড়ছি তুমি কীকরে সমাধান করবে কর। চেয়ারের তো একটা সম্মান আছে না কি?
মতিলাল দেখে ভুটকা তখনো মেজাজ ধরে রেখেছে। প্রধান সহ অন্যেরাও যে তার উপর বিরক্ত তা সবার চোখেমুখ থেকে ঠিকরে বেরোচ্ছে । দোকানের উপর কিছু করতেও পারে এদের মন চাইলে। 
রাগে গর্জাতে চাইলেও তা করতে পারছে না। বাধ্য হোয়ে অক্ষয়ের কাছে গিয়ে তার হাতটা খপ করে ধরে ফ্যালে মতিলাল বলে,
---কিছু মনে কোরো নি অক্ষয়বাবু।কথাটা বলা আমার ঠিক হয় নি।

  ক্ষোভে,লজ্জায় গরগর করতে করতে দোকানের পথে হাোটা দ্যায় মতিলাল। চোখের সঙ্গে যেন সেঁটে আছে অক্ষয়ের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসা,তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকানো আর পিটপিটে হাসি।চেয়ার তৈরীর সময় মতিলাল পায়ে -হাতে করে বহু্বার ওই চেয়ারগুলোকে মাড়ায়। দমাদ্দম করে প্যানা ঠুকে।রেঁদা চালায় সজোরে। অথচ আজ সেই চেয়ার তাকে নত করালো উচিত কথা বলবার অপরাধে।

  মতিলাল কিচ্ছু করতে পারছে না। নিজেকে অসহায় লাগছে তার।
 
  ভেতরে ফুঁসতে থাকা একটা চাপা রাগ গনগনে আঁচের মতো দীর্ঘ নিশ্বাস হোয়ে অফিসের বাইরে আছড়ে পড়ে। হনহনিয়ে দোকানে ফিরে আসে মতিলাল।কাজের ছেলেটার হাত থেকে মুগরটা ছাড়িয়ে বসে পড়ে চেয়ারে প্যানা মারতে। দমাদ্দম করে মুগর চালাতে থাকে।
 একটা গোঙানির শব্দ শোনার জন্য মতিলাল যেন মরিয়া হোয়ে উঠেছে।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments