জ্বলদর্চি

সত্তায় শিল্পীর স্বকীয়তা ----- রামকিঙ্কর বেইজ /প্রসূন কাঞ্জিলাল

সত্তায় শিল্পীর স্বকীয়তা --রামকিঙ্কর বেইজ

প্রসূন কাঞ্জিলাল


শিল্পী জীবন সম্পর্কে রামকিঙ্কর একটা কথা বলতেন, “একজন শিল্পী হওয়া খুব কঠিন কিন্তু একজন শিল্পীকে বোঝা আরো কঠিন।”
 
 মানুষটির জন্ম ২৫ শে মে, ১৯০৬.       

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, রামকিঙ্কর বেইজকে এইভাবে দেখতেই শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, “যখন কিছু দেখবে বাঘের মতো ঘাড় মটকে ধরবে পিছনে আর তাকাবে না।”

বিখ্যাত ভাস্কর রাধাকৃষ্ণণের কথায়, “রামকিঙ্কর জীবনকে সুক্ষ্ম এবং খাঁটিভাবে তাঁর আঁকায় ফুটিয়ে তুলতেন। তিনি শুধু ভাস্কর নির্মাণ করতেন না বরং জীবনকে সমৃদ্ধ এবং ব্যাখ্যা করতেন তাঁর ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে।"

কে কার অন্তরে বাস করে?
কার দ্বারা কে বেশি সমৃদ্ধ?
কে যে কার অনুচর বোঝা দায়- শিল্প না শিল্পী বিদগ্ধ ?

এক কৃষ্ণকায় কিশোর যুগীপাড়ার দোলতলা বাজারে এক গাছের নীচে সামনে একটা কাঠের বাক্সের উপর খুর-কাচি-নরুন সাজিয়ে অপেক্ষা করছে খরিদ্দারের। অপেক্ষা করতে করতে নিজের অজান্তেই কখন যেন তুলে নিয়েছে সামনে রাখা নরুন, আর তা দিয়ে গাছের গায়ে আঁচড় কেটে শরীর দিচ্ছে তার কিশোর মনের কল্পনাদের। বাড়িতে তার ভীষণ অর্থাভাব। বাবা চণ্ডীচরণ সারাদিন যজমানদের বাড়ি খেউরি করেও পরিবারের সকলের দুবেলা দুমুঠোর নিশ্চিত সংস্থান করে উঠতে পারছিলেন না। উপায়ন্তর না দেখে একদিন তিনি স্ত্রী সম্পূর্ণার সাথে পরামর্শ করে ছেলেকে তাদের পারিবারিক এই ব্যবসায় নামতে বললেন। এদিকে সে বড় ষোলআনায় সুরেন পণ্ডিতের পাঠশালা থেকে চতুর্থটা পাশ দিয়ে বঙ্গ বিদ্যালয়ে ঢুকেছে অল্প কিছুদিন। এরমধ্যে বাবার এহেন আদেশে তাকে দিনের বেলায় খুর-কাচি নিয়ে দোলতলা বাজারে এই গাছের নীচে বসতে হচ্ছে। ফলে বন্ধ হয়েছে বঙ্গ বিদ্যালয় যাওয়া। অবশ্য তার বদলে সন্ধ্যাবেলা করে তাকে যেতে হচ্ছে যুগিপাড়া নৈশ বিদ্যালয়ে।

 যদিও এ নিয়ে মনে খুব বেশি আক্ষেপ নেই তার। কেননা লেখাপড়া কোনোদিনও তার পছন্দের বস্তু না। হামেশাই পড়তে বসে বেড়ার দেয়ালে টাঙানো দেবদেবীদের ছবি গুলোই কেমন করে যেন মন টেনে নেয়, আর শুরু হয়ে যায় সেইসব ছবি দেখে তার ছবি আঁকা। এই নিয়ে বকাঝকাও কম খেতে হয় না তাকে। কিন্তু কি করবে সে, পড়ার থেকে ছবি আঁকাতেই তার যে বেশি আগ্রহ। আর তার আগ্রহ অনন্ত জ্যাঠার মূর্তি গড়া দেখতে। একদৃষ্টে দেখতে দেখতে যেন ঘোর লেগে যায় তার। সেই ঘোরে মূর্তি গুলো তার সাথে যেন কথা বলে! বলে, “কিঙ্কর এসো তোমার হাতের স্পর্শে আমাদের নতুন জন্ম হোক।” রোজ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সে অনন্ত জ্যাঠার কাজ দেখে। দেখে দেখেই সে এরমধ্যেই শিখে নিয়েছে মূর্তি গড়ার অনেক কায়দা কৌশল। 

নিজে হাতেও শুরু করেছেন ছোটখাটো মূর্তি বানানো। কিন্তু পেটের দায় বড় দায় আর তাই বড় অনিচ্ছাতেও তাকে এই গাছতলায় খুর-কাচি নিয়ে বসতে হয়েছে। কিন্তু এসব থেকে সময় বাঁচিয়ে সে প্রত্যেকদিন নিজের হাতে তৈরী করা রং দিয়ে ছবি যেমন আঁকে তেমনি মনের মাধুরী মিশিয়ে মাটি দিয়ে তৈরী করে বিভিন্ন অবয়ব। পারিবারিক ব্যবসায় ছেলের অনীহা দেখে দুটো বাড়তি পয়সা উপার্জনের জন্য চণ্ডীচরণ অগত্যা ছেলের তৈরী মূর্তি নিয়েই যায় বিভিন্ন মেলায় মেলায়। এইভাবে মনের ভালোলাগাকে পুঁজি করে প্রতিটি প্রতিকূল পরিস্থিতিকে মুখোমুখি প্রতিহত করতে করতে বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত যুগীপাড়ার সেদিনের সেই কৃষ্ণকায় কিশোরের মধ্যে ঘুম ভেঙে জেগে ওঠে ভবিষ্যতের এক প্রথিতযশা শিল্পী যাঁর নাম রামকিঙ্কর বেইজ। 

সে সময় ভারতবর্ষ পরাধীনতার পাঁকে নিমজ্জিত। সারা দেশে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামের আগুন ছড়িয়ে পড়ছে কংগ্রেসের হাত ধরে। এর কিছুদিন পর অর্থাৎ রামকিঙ্করের মধ্য কৈশরে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। কিশোর বয়সে দেশের জন্য কিছু করার আবেগে তিনিও কংগ্রেসের কাজে যোগদান করেন। এই সময় তিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের আবক্ষ ছবি আঁকা শুরু করলেন। তার সাথে সাথে অর্থ রোজগারের জন্য এঁকেছেন সাইনবোর্ড, নাটকের মঞ্চসজ্জার ছবি। ততো দিনে তিনি নৈশ বিদ্যালয় ছেড়ে লালবাজারের জাতীয় বিদ্যালয়ের ছাত্র। কিন্তু পারিবারিক অনটন এবং লেখাপড়ায় অনীহা প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্রে তাঁকে দশম শ্রেণীর গণ্ডির মধ্যেই আটকে রেখেছিল। সেটা সম্ভবত ১৯২১ সাল ব্রাহ্ম সমাজের কাজে বাঁকুড়া এলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক, “প্রবাসী”, “মডার্ন রিভিউ” সহ আরও অন্যান্য পত্রিকার সম্পাদক তথা রবীন্দ্রনাথের বিশেষ ঘনিষ্ঠ রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। পারিবারিকসূত্রে রামকিঙ্করের বাবা চণ্ডীচরণের যজমান হওয়ার সুবাদে তিনি রামকিঙ্করকে আগে থেকেই চিনতেন। কিন্তু সেই সময়ে চণ্ডীচরণের কাছ থেকে ছেলের ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার আগ্রহের কথা শুনে তিনি তাঁকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর কাজ দেখে খুশি হন। যাবার আগে তিনি রামকিঙ্করকে শান্তিনিকেতনে চলে আসার পরামর্শ দেন এবং বলেন তিনি ফিরে গিয়ে চিঠি লিখে তাকে শান্তিনিকেতনে ডেকে পাঠাবেন। 

ফিরে গিয়ে কিছুদিন পর তিনি সত্যি চিঠিও পাঠালেন।প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনে যেতে। কিন্তু বাঁকুড়ার অজ গাঁয়ের উনিশ বছরের এই যুবক পথ ঘাট কিছুই চেনে না। পথ ভুল করে অনেক ঘুরতি পথ পেরিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছলেন তিনি শান্তিনিকেতনে। ১৯২৫ সালের কথা সেটা। সেদিন তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর আঁকা কয়েকটা ছবি আর হয়ত অনির্দিষ্ট কোন স্বপ্ন।

 ছবিগুলো দেখে আচার্য্য নন্দলাল বলেছিলেন "তুমি কি করতে এখানে এলে, এতো সব করে ফেলেছো। আর কি শিখবে? যাহোক যখন এসেই গেছো এখানে থাক কিছুদিন। তারপর যাহোক করা যাবে।" সেই সময় তাঁর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর চেষ্টায় কিছু বই অলঙ্করণের কাজ পান তিনি। এতে করে তাঁর মোটামুটি চলে যায়। ওই সময় তাঁর কিছু ছবিও বিক্রি হয়েছিল প্রদর্শনীতে।

 শান্তিনিকেতনে প্রথম দু‘বছর কাজ করার পর তিনি ছাত্রদের শেখাতে শুরু করেন। এভাবেই রামকিঙ্করের শান্তিনিকেতনে আসা আর শান্তিনিকেতনের শিল্পী রামকিঙ্কর হয়ে যাওয়া। বাকী সারা জীবনে শান্তিনিকেতন ছেড়ে তেমন কোথাও যাননি। দিল্লি, বোম্বে এমনকি কলকাতায়ও গেছেন খুব কম। শুধুমাত্র একবার গেছেন নেপাল। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণ পেলেও আর কখনো বিদেশ যাননি তিনি। 

রামকিঙ্করের শিল্পের চৌহদ্দি ছিল অনেক প্রশস্ত। তৈলরং, জলরঙ, ড্রইং, স্কেচ, ভাষ্কর্যসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্য দুটোকেই তিনি নিয়ে গেছেন শিল্পসৌকর্যের চুড়ায়। প্রথমদিকে ছবি আঁকার প্রতিই রামকিঙ্করের মনযোগ ছিল বেশি। পরবর্তীতে পূর্ণ্যােদ্দ্যমে শুরু করেন ভাস্কর্য। কখনোই গতানুগতিক, বাঁধাধরা নিয়মে শিল্পসৃষ্টির পক্ষপাতি ছিলেন না তিনি। নিজের তৈরি পথেই চলেছেন সবসময়। প্রতিনিয়তই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। গড়েছেন ভেঙেছেন আবার গড়েছেন; এভাবেই এগিয়ে গেছে তাঁর শিল্প সাধনার পথ। দৃশ্যশিল্পের নতুন শৈলী, টেকনিক অথবা মাধ্যমের সন্ধানে সবসময় খোলা থাকত তাঁর দৃষ্টি। 

রামকিঙ্করের কাজের একটি অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য গতিশীলতা । এটা তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্য উভয়ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাঁর ছবি এবং ভাস্কর্যের প্রায় সকল ফিগারই গতিশীল। কেউই থেমে নেই। তাঁর বড় ভাস্কর্যের বেশির ভাগই ওপেন স্পেসে করা। এটা তাঁর ভাস্কর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। খোলা আকাশের নিচে রোদ-বৃষ্টি, আলো হাওয়া গায়ে মেখে প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে ওগুলোর অবস্থান। অচিরেই তিনি হয়ে উঠলেন সেখানকার সকলের “কিঙ্কর”। ছেলেবেলা থেকে বাস্তবের শক্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে তিনি জীবনের যে উপলব্ধি করেছেন তা তাঁর কাজের মাধ্যমে বারবার প্রকাশ পেয়েছে। শান্তিনিকেতনে আসার পরও আর্থিক অনটন পিছু ছাড়েনি তাঁর। প্রদর্শনীতে কিছু ছবি বিক্রি করে এবং মাস্টারমশাই নন্দলাল বসুর সাহায্যে কিছু বইয়ের অলংকরণের কাজ জুটিয়ে তখনকার মতো চলতে হয়েছিল। চারুকলায় ডিপ্লোমা অর্জন করে তিনি শান্তিনিকেতনে নতুন ছাত্রদের শেখাতে শুরু করেন। মাস্টারমশাই নন্দলাল বসু প্রথম সাক্ষাতে রামকিঙ্করকে যে “কিছুদিন” শান্তিনিকেতনে থেকে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন সেই “কিছুদিন” তাঁর জীবনে আমৃত্যু প্রায় পাঁচ দশক ধরে চলেছিল।

এর আগেই উল্লেখ আছে রামকিঙ্কর জীবনকে বাস্তবের কঠিন মাটিতে দাঁড়িয়ে উপলব্ধি করেছিলেন এবং তাঁর সৃষ্টিকর্মে সেই উপলব্ধিই বারবার প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর কাজে তাই প্রকৃতি এবং প্রান্তিক মানুষদের ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। একটি দর্শনকে কেন্দ্র করে আবর্তন করত তাঁর শিল্পসত্তা। তিনি শিল্পচর্চাও করতেন বিশেষ একটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। তাঁর নির্মিত ভাস্কর্যগুলি সদা গতিময় আর প্রাণপ্রাচুর্যে পূর্ণ। জীবনে তিনি ভীষণ নির্মোহ ছিলেন। আশেপাশের খোয়াই, গোয়ালপাড়া, রজতপুর, বাহাদুরপুর, রায়পুর, রূপপুর, বল্লভপুর, ভাঙাপাড়া থেকে হাটে বাজারে কাজেকর্মে যাওয়া লোকজনদের জীবনযাপন, চলাফেরা, অভিব্যক্তি তিনি নিবিষ্ঠভাবে দেখতেন।  রবীন্দ্রনাথের প্রতি সবার মতোই তাঁরও প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল। কাজ করতে করতে তিনি উদাত্ত গলায় রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেন। স্থানীয় আদিবাসী সাঁওতাল সম্প্রদায়ের সাথে তাঁর এক নিবিড় যোগাযোগ ছিল। তাদের জীবন জীবিকাকেই তিনি তাঁর শিল্পের বিষয়বস্তু বানিয়েছেন প্রভূতভাবে। এই কারণে অনেকে তাঁকে ভুল করে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের একজন মনে করেন। তাঁর সৃষ্টকর্মে মানুষের অভিব্যক্তি, শারীরিক ভাষা শৈল্পিকভাবে প্রকাশ পেত। বিমূর্ততা নিয়ে তিনি পরীক্ষানিরীক্ষা করতে ভালবাসতেন। কলাভবনে তিনিই প্রথা ভেঙে প্রথম অয়েলের কাজ করেন।

 এছাড়াও জীবনে তিনি স্কেচ, জলরং, টেরাকোটা, রিলিফ, পাথর, খোদাই সব মাধ্যমেই কাজ করেছেন। তিনি যেন পাশ্চাত্যের শিল্পভাষায় রচনা করেছেন এদেশের মানুষের জীবনের মহাকাব্য। ভারতের প্রাচীন ও আধুনিক ধ্রুপদী চিত্রকর্মে তাঁর ভীষণ আগ্রহ ছিল। এছাড়াও বিষ্ণুপুরের কাদাকুলিতে মামাবাড়ি হওয়ার সুবাদে ছোট থেকেই বেশ কাছ থেকে বিষ্ণুপুর মন্দিরের টেরাকোটার ভাস্কর্য দেখার সুযোগ হয়েছিল তাই তাঁর কাজে সেই প্রভাবও বিশেষ লক্ষণীয়। যদিও তাঁর ননিজের শিল্পকর্মে পাশ্চাত্যের প্রভাব নিয়ে তিনি বলেছেন, “আমাকে অনেকে বলে, পশ্চিমের শিল্পীদের প্রভাবে আঁকি। কিন্তু আমার ধারাতো এদেশের ধারা। এদেশের শিল্প কখনও নকল করেনি। ছন্দ হলো তার ভেতরকার কথা। পুজোর ঠাকুর মূর্তির কথা যদি ছেড়ে দাও, আমাদের দেশের মূর্তির মোদ্দাকথা হচ্ছে স্ট্রাকচার, ছন্দময় রূপগঠন।” ভারতীয় শিল্পকলার আধুনিকতার পুরোধা মনে করা হয় তাকে। রামকিঙ্করের মাস্টারমশাই আচার্য্য নন্দলাল বসু জীবন্ত মডেলের ব্যবহারের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। 

তাঁর মত ছিল “ও সব এদেশে চলেনা।” রামকিঙ্কর কিন্তু তাঁর শিল্পকর্মে মডেল ব্যবহার করতেন। নিজের গুরুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকেও তিনি তাঁর পথ নিজের মতো করে গড়ে নিয়েছিলেন। তাঁর সৃষ্ট শিল্প বর্ণনামূলক, ছান্দিক এবং প্রকৃতির সাথে আত্মিক সম্পর্কে সম্পৃক্ত। তাঁর ভাস্কর্যরা খোলা আকাশের নীচে প্রকৃতির জল আলোবাতাস মেখে তারই এক অংশ হয়ে গেছে। খোলা বা উন্মুক্ত ভাস্কর্য নির্মাণে সেই সময় সিমেন্টের ব্যবহারে তিনি ছিলেন অন্যতম। শুনতে অবাক লাগলেও আসলে আর্থিক অসংগতির কারণেই তিনি সেই পদ্ধতি চিন্তা করে বের করেছিলেন। তিনি ১৯৩৪ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত কলাভবনের শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৫ সালে দক্ষিণী ছাত্রী জয়ন্তী জয়াপ্পাআস্বামীর (জয়া) মাথায় ভাঁড় বসিয়ে তৈরী করেন ১১ফুট উচ্চতার এক নারীমূর্তি। পরবর্তীতে যাকে “সুজাতা” নাম দেওয়া হয়। শোনা যায় রামকিঙ্করের এই সুজাতাকে দেখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে সমস্ত আশ্রম ভাস্কর্য দিয়ে ভরে দিতে বলেছিলেন। 

এরপর তিনি ১৯৩৮ সালে তৈরী করেন “সাওতাল পরিবার”। এই বিশেষ ভাস্কর্যটিতে তিনি দেখিয়েছেন কাজশেষে একটি সাঁওতাল দম্পতি বাড়ি ফিরছেন পুরুষের কাঁধের বাঁকে ঝোলানো রয়েছে শিশু। মহিলার মাথায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি। আর তাদের সাথে তাদের পোষা কুকুর। 

১৯৩৯ থেকে ১৯৪২ এই সময়কালে তিনি তৈরী করেন সিমেন্টের “বাতিদান”, “হেড অফ এ উওম্যান”, প্লাস্টারের রবীন্দ্র প্রতিকৃতি “পোয়েটস হেড”। ১৯৫৮ সালে সিমেন্ট দিয়ে করেন “কলের বাঁশি”। যেখানে তিনি সাঁওতাল রমণীদের বিকাশের গল্প বলেছেন। তারা এখন কলকারখানায় কাজ করে। সেই কারখানার বাঁশি শুনে তারা কাজে ছুটে চলেছেন পিছু নিয়েছে শিশু। যাওয়ার পথে তারা ভেজা কাপড় উড়িয়ে শুকিয়ে নিচ্ছেন। সারা জীবন অকৃতদার থাকলেও তাঁর মডেলদের সাথে জীবনযাপন নিয়ে শান্তিনিকেতনে বেশ চর্চা ছিল এক সময়ে। তবে জীবনে তিনি রাধারানীকে বড় ভালবাসতেন। আর এই রাধারানীই রামকিঙ্করের জীবনের শেষদিন পর্যন্ত পাশে ছিলেন।  ১৯৮০ সালে রামকিঙ্করের মৃত্যুর পর তার শিল্পকর্ম গুলিকে “জাতীয় সম্পদ” ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। এরপর “দ্য ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্টস” দিল্লীতে তার বেশিরভাগ শিল্পকর্ম নিয়ে যায়। যদিও শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্করের ছয়টি উন্মুক্ত ভাস্কর্য এখনও রয়েছে।
অবিন্যস্ত চুল পুরু চশমার কাঁচ আর মুখে অদন্ত হাসির এক সুউচ্চ ব্যাক্তিত্ব কি পেয়েছিলেন জীবনে ?

 বিশ্বভারতীর “দেশিকোত্তম”, রবীন্দ্রভারতীর “ডি. লিট” আর ভারতের রাষ্ট্রীয় খেতাব “পদ্মভূষণ”। ব্যাস এইটুকুই! হ্যাঁ আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে তার মতো শিল্প ব্যাক্তিত্বের প্রতি যা নিতান্তই কম। কিন্তু জীবনে তিনি আদৌ কী চেয়েছিলেন কিছু তাঁর শিল্পের পরিবর্তে? এর উত্তরে তিনি মজা করে বলেছিলেন শিল্প না করলে তাঁর পেটের ভাত হজম হয়না। শুধু পেটের ভাতই নয় তার মধ্যে আরো অনেককিছু আছে যা ভাষায় অপ্রকাশ্য। তিনি বলেছিলেন শিল্পের শুরু শেষ বলে কিছু হয়না। তিনি কোনো হেতু ছাড়াই এই কাজ করেন। এর থেকে তাঁর চাওয়া পাওয়া কিছুই নেই।

 তিনি মাস্টারমশাই আচার্য্য নন্দলাল বসুর পদাঙ্ক অনুসরণ না করে নিজের কাজের মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন কিউবিজম, এক্সপ্রেশনিজম। তাঁদের দুজনের মতের অনেক অমিল ছিল। তবুও তিনি তাঁর মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে একটা জিনিস তাঁর চেতনার সবটুকু দিয়ে শিখেছিলেন আর তা হলো স্বপ্ন আঁকা আর স্বপ্ন গড়া ।।


তথ্যসূত্র:-

১. মাটির মানুষের জীবন আঁকার চিত্রী- রাধামাধব মণ্ডল । 
২. ভুবনডাঙার কিঙ্কর- আবীর মুখোপাধ্যায়, 
৩. রামকিঙ্কর বেইজের সৃজন জগৎ- শরীফ জামান, ভোরের কাগজ
৪. আ রেয়ার ফিল্ম, কমপ্লিটেড ৩২ ইয়ারস আফটার ইট ওয়াজ ফ্রাস্ট শট, ব্রিংস টু ফোর দ্য ক্রিয়েটিভিটি অফ টু মাস্টারস অফ আর্ট- বিনীতা সেন, বিজনেস লাইন
৫. নেগলেক্টেড ট্রেজার্স- রক্তিমা বোস, দ্য হিন্দু. 
৬. রামকিঙ্কর বেইজের শিল্পচরিত- সিলভিয়া নাজনীন, সমকাল
৭. আছো আপন মহিমা লয়ে- নাসির আহমেদ, মৃণাল এন্ড উদ্ভাস
৮. রামকিঙ্কর বেইজ, অ্যান ইনকমপ্লিট পারসোনালিটি স্টাডি বাই ঋত্ত্বিক ঘটক, ১৯৭৫
৯. সার্ধশত জন্মবর্ষে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়- পারমিতা দাশশর্মা, অন্যপত্র
১০. ইন্টারনেট ও অন্যান্য।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments