জ্বলদর্চি

ড. অসীম কুমার মান্না, অধ্যক্ষ, খেজুরী মহাবিদ্যালয় (লোক গবেষক / পরিবেশ প্রেমী)/ ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ৫

ড. অসীম কুমার মান্না, অধ্যক্ষ, খেজুরী মহাবিদ্যালয় (লোক গবেষক / পরিবেশ প্রেমী) 

ভাস্করব্রত পতি

"কুটু উউউউউ" -- হাঁক পাড়তেই হাজির 'কুটু'! সে এক অপরূপা সুন্দরী। আদুরে মেয়ে 'কুটু' হাজির পালক পিতার কাছে। না, কোনো ফ্যাশন শো'র উদ্ভিন্নযৌবনা মডেল নয়। এই কুটু একটা মিস্টি কাঠবেড়ালি। পালক পিতার স্নেহে লালিত পালিত এরকম মোট ৭৪ টি কাঠবেড়ালি! রয়েছে ২ টি করে শালিক, বনকাক, ঘুঘু, ৪ টি করে কাঠবাবুই, ফিঙে, লেজঝোলা, ৬ টি করে ডাহুক, দোয়েল সহ অনেক তুলাফুড়কি, মৌটুসীদের দল। গাছগাছালি ঘেরা পালক পিতার আস্তানায় নিরাপদেই রয়েছে কেউটে, বেতআছড়া, চিতিবোড়া, ধোঁড়া, লাউডগারাও। আছে দুখানা গন্ধগোকুল এবং ৬ খানা গিরগিটি। গাছগাছালি পাখপাখালি ভরা এক অনন্য আনন্দনিকেতনে যেন মিনি চিড়িয়াখানা। আর রয়েছে প্রায় এক হাজার প্রজাতির উদ্ভিদে ঘেরা এক রহস্যাবৃত বোটানিক্যাল গার্ডেন। বরুণ, কেওড়া, হিজল, আঙুর, কুড়চি, টুনিফুল, সাদা কুঁচ, কৃষ্ণবট, লাল কুঁচ, রঙিন বট, গুগগুল, তমালের মতো বিরল প্রজাতির অবাধ বেড়ে ওঠা এখানেই। পাশের পুকুরে বাঘাবেলে (মৌবেলে), জেব্রা (হামানি), ক্ষুদে গাঙতাড়া, কালকই, নয়না, সরপুঁটি, তুর, কুঁচে, পাঁকালদের ভরাট সংসার।

 
 তিনি ড. অসীমকুমার মান্না। কুটুদের 'পালক পিতা'! পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির কুঞ্জপুরেই ১৯৫৭ এর ৬ ই ডিসেম্বর তাঁর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। মাটির সঙ্গে টান শুরু থেকেই। এখানকার গাছপালা, পশুপাখি, মানুষজন, কাজকর্ম, ভাষা, উৎসব, শিল্প স্থান পায় তাঁর গবেষণায়। 


 গরিব মৎস্যজীবীদের জন্য স্বাস্থ্যসম্মতভাবে মাছ শুষ্ককরনের জন্য কম খরচে সোলার ড্রায়ার 'এস ডি ৫০' বানিয়েছেন তিনি। সাধারণত উপকূলবর্তী এলাকায় চিরাচরিত প্রথায় সামুদ্রিক মাছ শুকনো করা হয়। সেই মাছ শুকনো করার পদ্ধতিতেই এনেছেন পরিবর্তন। ইণ্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চ এর প্রোজেক্ট নিয়ে তাঁর এই ‘সোলার ড্রায়ার' তৈরি। যাতে কম খরচে স্বাস্থ্য সম্পন্ন খাদ্যগুণ বজায় রেখে দীর্ঘদিন (২ বছর) ভালো থাকে শুকনো মাছ।



ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে তাঁর পদবী 'মান্না' অনুসারে Anina mannai নামে চিংড়ির একটি পরজীবী আবিষ্কার তাঁর। গঙ্গার বুক থেকে এটির খোঁজ পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৯২ সালে আবিষ্কৃত এই প্যারাসাইটটি ক্রাস্টেসান জাতীয়। নিজের এলাকায় তিনি মাছের শংকরায়ণ করতেও সচেষ্ট ছিলেন। মাছের উৎপাদন কিভাবে বাড়ানো যায় বিশেষ ধরনের খাদ্য এবং হরমোন প্রয়োগ করে তাতে সফল হয়েছিলেন তিনি। বিশেষ ধরনের হরমোন প্রয়োগ করে একটি মাছকে (Oryzias melastigma) বছরে প্রতিদিনই ব্রিড করাতে সক্ষম হয়েছিলেন অসীমবাবু। সেই মাছের নামকরণ করা হয় 'প্রান্তিকা'। মাছের প্রতি তাঁর অকল্পনীয় ভালোবাসা এবং মেতে থাকা দেখে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন 'মাছ দা' নামে!


এহেন এই মেছো মানুষটির কর্মজীবন শুরু স্কুলে। একসময় ইউনিয়ন কার্বাইডের ফিসারিতেও বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন কিছুদিন। স্টেট ফিসারী ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনেও যুক্ত ছিলেন। মুর্শিদাবাদের শ্রীপৎ সিং কলেজে বিভাগীয় প্রধান থাকার পর ২০০১-এ খেজুরি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। এ পর্যন্ত মোট ৫৬ টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও জার্নালে।


দক্ষিণবঙ্গের সংস্কৃতি তাঁর প্রিয়। এখানকার লোকসংস্কৃতি, লোকজ প্রথা, লোকভাষা, লোকশিল্প, জনজাতির জীবন প্রণালী সবই মূর্ত হয়ে ওঠে তাঁর গবেষণাসিদ্ধ লেখনীতে। অথচ তিনি সম্পূর্ণভাবে প্রাণীবিদ্যার কৃতি মানুষ। ১৯৯০ তে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক জে জে ঘোষের অধীনে ডক্টরেট করেছেন ‘এফেক্টস অব পেস্টিসাইডস্ অন ফিসেস’ বিষয়ে। আজ তিনি শুধু মেদিনীপুরের নয়, গোটা রাজ্যের এক অন্যতম লোকগবেষক। তবে খেজুরি নিয়ে আন্তরিকতা যেন একটু বেশিই। তাঁর গবেষণার এবং লেখনীর ক্ষেত্রভুমির অনেকাংশ জুড়ে রাজা রামমোহনের বিলেত যাত্রার জাহাজভূমি -- খেজুরী।



এ পর্যন্ত বই লিখেছেন প্রায় ৪০ টি। গবেষণাধর্মী প্রবন্ধের সংখ্যা অগুণতি। প্রাণী জগতের পূর্বরাগ প্রেম ও মিলন, সংস্কার - প্রসঙ্গ মাছ, সংস্কার - প্রসঙ্গ নারী, বাংলার সাপ, বাংলার মাছ, পুরুষ নির্যাতনের নেপথ্যে উপকূলবর্তী দক্ষিণবঙ্গের প্রবাদ প্রবচন, উপকূলবর্তী দক্ষিণবঙ্গের ভাষা ও সংস্কৃতি, বঙ্গ সংস্কৃতিতে মাছ, বাংলার পাখি ইত্যাদি বই পাঠক সমাজে বেশ সমীহ পেয়েছে। সাহিত্যের আঙিনা ছেড়ে বিজ্ঞান গবেষণার জগতেও তিনি সফল বলীয়ান। আর পাশে পেয়েছেন স্ত্রী বিপাশা এবং দুই ডাক্তার পুত্র অর্পণ এবং অয়নকে।



শুধু চাকরি নয়। পরিবেশ বাঁচাতেও তিনি হয়ে উঠেছেন অনন্য। পরিবেশ সংরক্ষণে লাগিয়েছেন কত সব গাছ। লুপ্তপ্রায় বহু মাছকে ফের পরিবেশে বহুল পরিমাণে ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট তিনি। ভালোবাসেন বোহেমিয়ান হয়ে আদিবাসী এলাকায় ঘুরে বেড়াতে। দেশ বিদেশের ৩৫ - ৪০ রকমের বনসাই করেছেন নিজের বাগিচায়। বাড়িতেই রয়েছে উপকুলীয় এলাকার সামগ্রী নিয়ে বিশেষ সংগ্রহশালা। ৩ হাজারের বেশি জিনিস রয়েছে। এখানে রয়েছে কুঁড়ি, ডে লাইট, সিঁদ কাঠি, ইংরেজদের ব্যবহৃত মদের বোতল, স্টোন ওয়ার বোতল, গিলা ফল, তালপাতার পুঁথি, ঢ্যারা, চাল রাখার কলা, তেল মাপার ছোটাঙ্গি, টাঁউক, পিগি ব্যাঙ্ক, পর্তুগালের বাসন, দুধ মাপার কানুয়া, জীবাশ্ম, বিভিন্ন প্রাচীন মুদ্রা, পশু শিকারের পোড়ামাটির বল ইত্যাদি। দক্ষিণবঙ্গের সংস্কৃতিকে তুলে ধরার এক অগ্রণী পথিক তিনি। পাঠক সমাজে এবং বোদ্ধা মহলে তিনি এখন 'মানুষ রতন'।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments