জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-২২/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে
রোশেনারা খান
পর্ব ২২

একটা কথা মানতেই হবে, আমাদের সবারই বই পড়ার অভ্যাস ক্রমশ কমে যাচ্ছে। প্রথমে টিভিতে হিন্দি বাংলা বেসরকারি চ্যানেলের রকমারি বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আকর্ষণ গল্পের বইয়ের পাতা থেকে মনকে উড়িয়ে নিয়েছিল। আর স্মার্টফোন  আসার  পর আর কোন দিকে কারো মন নেই। গল্প পড়ার আগ্রহ এখন খুব কম মানুষের মধ্যে দেখা যায়, তা সে ছেলেই হোক বা বুড়োই হোক। 

    আমাদের সময় ঘুমনোর আগে বই না পড়লে চোখে ঘুমই আসত না। হিমানীদিদের বাড়িতে দেশি-বিদেশি, ছোটদের, বড়দের সবরকম বই পাওয় যেত। অ্যান্ডারসনের গল্প, গ্রীমভাইদের রচনাবলী, সেক্সপিয়রের রচনাবলি, ম্যাক্সিম  গোরকি, আরও অনেক লেখকের লেখা পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। সেই সময়ের বেশকিছু বাংলা ম্যাগাজিন নিয়মিত আসত ওঁদের বাড়িতে, অনেক সময় ওঁদের আগে আমরাই পড়ে ফেলতাম। বাচ্চাদের জন্য অমর চিত্রকথা, চাঁদমামা, টিনটিন অরন্যদেবের চমকপ্রদ গল্প ছোট বড় সমস্ত পাঠকের কাছে জনপ্রিয় ছিল।

    ধিরে ধিরে আমি ও হিমানীদি ভাল বন্ধু হয়ে উঠে ছিলাম। এখানে এসে তো  সেলাইয়ের দিদিমণি হয়ে গেলাম। আমার ভাড়াবাড়ির সামনের একচিলতে বারান্দায় মহিলারা ভিড় জমাতেন। এই তালিকায় হিমানীদিও ছিলেন। স্কুলে বাচ্চাদের ছেড়ে দিয়ে দলবেঁধে মায়েরা আমার কাছে চলে আসতেন। এনারা উল বুনতে পারতেন,  কিন্তু ফিটিংসে গোলমাল হয়ে যেত। এছাড়াও সোয়েটারের ডবল রিব কিভাবে বুনতে হয়? গিঁট না বেঁধে কীভাবে একটা উলের সঙ্গে আর একটা উল জোড়া  লাগানো যায়? এটাও হিমানীদি আমার কাছে শিখে ছিলেন। বাবলির জন্য উলের ফ্রক বুনেছিলাম। ২/৩ বার পরার পর মনে হল ওর বডিতে টাইট হচ্ছে। একদিন কথা প্রসঙ্গে মহিলামহলে বললাম, ফ্রকটা খুলে আবার বুনতে হবে। তাই শুনে প্রভাতকুমার কলেজের এক অধ্যাপকের স্ত্রী বললেন, এটা খুলবেন না, আমার মেয়ের গায়ে ভাল ফিট করবে। আমাকে দিয়ে দিন, আমি সম পরিমান উল আপনাকে কিনে দেব। আমার বোনার এতটাই কদর ছিল। বাবলি নার্সারি স্কুল থেকে পাশ করে পরীক্ষার মাধ্যমে ‘হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ এ ভর্তি হয়। এই  স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষক শিক্ষিকার বাড়ি এই পাড়াতেই। তাঁরা যাতায়াতের সময় লক্ষ্য করেছেন, আমি কিছু না কিছু সেলাই করছি। একদিন মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন, সাহিনের(মেয়ের স্কুলের নাম সাহিন পারভিন)সেলাই নিয়ে চিন্তা নেই, ওর মা ভাল সেলাই জানেন। এখানে হারমোনিয়াম আর ডিগি তবলা কিনে  বাবলির জন্য গানের মাস্টার রাখা হল। বকুলের জন্যও তবলার মাস্টার রেখে ছিলাম, কিন্তু ওর ইচ্ছে না থাকায় বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই।

      তখন স্কুলে মেয়েদের সেলাইয়ের ক্লাস ছিল। সব মেয়ের মা সেলাই জানতেন না, সেই মেয়েরা শুকনো মুখে আমার কাছে এসে বলত, কাকিমা একটু করে দাওনা গো। শুধু সেলাই নয়, অল্প বয়সি মেয়েরা আমার ফ্যান ছিল বলা যায়। সব বিষয়ে কাকিমার মতামত নিতে হবে, কারও চুল বেঁধে দিতে হবে, কারও চুল কেটে দিতে হবে, কারও সাড়ি চায়, কাউকে সাজিয়ে দিতে হবে। কোনো বাবা মা আমার কাছে মেয়েদের নামে নালিশ জানাতেন, মেয়েরা কোনও কাজ করে না। ওদের বকাবকিও করতাম। তখন ঘরদোর গুছিয়ে আমাকে দেখার জন্য ডাকতে আসত, কাকিমা চলনা দেখবে, কত সুন্দর করে ঘর গুছিয়েছি। 

    স্কুল থেকে টেবিলকলথ বানাতে দিলে, সেটা আমিই বানিয়ে দিলাম। এই বছরই নাচনকে হিমানীদি কলকাতায় একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করে দেন। তাই ওর টেবিলক্লথ বানানোর প্রয়োজন হয়নি। তবুও টেবিল ক্লথটি হিমানীদির এত পছন্দ হয়েছিল যে, উনি আমার কাছে শিখতে চাইলেন এবং  শিখলেন ও। আমার  কাছে সেমুই  রান্না শিখেছিলেন। আমিও কিছু শিখলাম, এভাবে দিনগুলো বেশ কাটছিল। সবাই খুব শ্রদ্ধাও করেন। মাসিমা বাবলি বকুলকে এতটাই স্নেহ করতেন যে মাঝে মাঝে বলতেন তোদের ডিম দেব বলে আঁচলে গিঁটমেরে রেখেছি। প্রচুর মুরগির ডিমের মধ্যে কিছু ডিম ফেটে যেত বা টোল খেয়ে যেত, সেগুলো ওনারা কমদামে বিক্রি করতেন। আমরা মাঝে মাঝে কিনতাম, কখনও মাসিমা বা  হিমানীদি দিয়ে পাঠাতেন। নাচন যখন এখানে পড়ত, তখন মাঝে মাঝে ও আর বাবলি পুতুলের বিয়ে দিত। আমাদের বাড়িতেই বিয়ের আসর বসত, টাকা দিতে হত হিমানীদিকে। আমরা মায়েরাও নিমন্ত্রণ পেতাম। একদিন হিমানীদি মজা করে  বাবলিকে বললেন, এক কাজ কর, একদিন তোর মা আর আমার মধ্যে বিউটি কনটেস্ট কর। এভাবে বেশ মজাতে দিনগুলো কাটত।

  মনীষা মাসিমা খুব সিনেমা দেখতে ভাল বাসতেন। আমাকেও মাঝে মাঝে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। পাছে সিনেমাহলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়, সে জন্য সবসময় হাতের ঘড়ি ১৫ মিনিট ফাস্ট করে রাখতেন। বলতেন, আমি পাপীতাপী মানুষ, আমার দ্বারা ধর্মকর্ম হয়না। মাঘ ও বৈশাখমাসে ওনাদের যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান হত, আমাদেরও আমন্ত্রণ জানানো হত। বাবলি বকুলকে নিয়ে আমিও যেতাম।

    একবার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কাঁথি এসেছিলেন। সেই জনসভায় প্রচুর ভিড় জমেছিল। বেশিরভাগ মানুষ ইন্দিরা গান্ধিকে দেখতে এসেছিলেন। আমরাও গেছলাম, কাছে পৌঁছাতে পারিনি। দূর থেকেই হলুদ রঙের শাড়িতে ওনাকে কী অপূর্ব লাগছিল। তখন এইসব প্রথম সারির নেতে-নেত্রী ও মন্ত্রীদের দেখা পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যপার ছিল। 

    এখানেও আমাদের ঘিরে মানুষের কৌতূহলের সীমা ছিল না, বিশেষকরে আমাকে নিয়ে। আমরা কী খাই? কী পরি? ইত্যাদি প্রশ্নের শেষ ছিলনা। ধিরে ধিরে ওঁরা বুঝলেন আমরাও ওদের মত মাছভাত, সুক্তো, ঝাল-ঝোল- অম্বল খেতে ভালবাসি। দইয়ের সঙ্গে রসগোল্লা, পানের সঙ্গে সুপুরি খাই। সাড়ি পরি, বাংলায় কথা বলি, হাত দিয়ে ভাত খাই।

    যাইহোক প্রতিবেশীরা সবাই আমাদের খুব ভালবাসতেন। এখানেও অনেকে অবিবাহিতা ভেবে আমার অভিভাবকের সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। আমি প্রথম প্রথম লজ্জা পেলেও এখন বেশ উপভোগ করি। অনেকে ভাবতেন আমি বাবলি বকুলের দিদি। বাবলিকে ওর বাপি পড়া বুঝিয়ে দিতেন,  বকুলকে আমি। ও ছোট  থেকেই বাপিকে এড়িয়ে চলত। ওর সব কথা মায়ের সাথে। তখন পাড়ায় ২/৩ টি বাড়িতে টিভি ছিল। এক বিহারি ভদ্রলোকের বাড়িতে রঙ্গিন টিভি ছিল। তাঁর ছেলের নাম ছিল খোকা। ভারত পাকিস্তানের ক্রিকেট ম্যাচ হচ্ছে। ওর থেকে সামান্য বড় কয়েকজন ছেলের সঙ্গে বকুলও ভদ্রলোকের বাড়ি খেলা দেখতে গেছে। ভারতের প্লেয়ার ছক্কা মারাতে সবাই যখন হাততালি দিয়ে ওঠে, তখন বকুলকে হাততালি দিতে দেখে ভদ্রলোক বলেন, তুই কেন হাততালি দিচ্ছিস? তুই তো পাকিস্তানের সাপোর্টার! ও শুকনো মুখে আমাকে এসে জিজ্ঞেস করে, মা আমি কেন পাকিস্তানের সাপোর্টার? আমি বলি, কে বলেছে একথা?- খোকার বাবা কাকু। পরবর্তী কালে ও পাকিস্তানেরই সাপোর্টার হয়ে যায়্‌, তবে সেটা খোকার বাবা ওই শিশুমনে বিদ্বেষের বিষ ভরে দিয়ে ছিল বলে এটাও যেমন একটা কারণ, তেমন  ওখানকার ইমরান, আক্রামসহ বেশকিছু ক্রিকেট প্লেয়ারদের পারফর্মেন্স ওকে মুগ্ধ করত। আমরা দুজনেই ক্রিকেট খেলা ভালবাসতাম। ও বলত, মা তুমি যা ক্রিকেট বোঝো, আমার অনেক বন্ধু তা বোঝে না। এসব অনেক পরের কথা।

    তখন রাজনীতি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতাম না। পেপারের হেড লাইনসগুলো মনে থাকত। গত শতাব্দীর ৮ এর দশকে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ  আলাদা দেশ খালিস্থানের দাবিতে বিদ্রোহ শুরু করে। ওদের নেতা ছিলেন জারলাইল সিং ভিন্দ্রানওয়ালে। তাঁদের বক্তব্য ছিল, হিন্দুরা হিন্দুস্থান পেল, মুসলিমরা পাকিস্তান পেল, আমরা কিছুই পেলাম না। আমাদের খালিস্থান চাই। পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দিরে পুলিশের ঢোকা নিষিদ্ধ ছিল। শিখ স্বাধীনতাকামী বা জঙ্গিরা এই স্বর্ণ মন্দির চত্তরটিকে নিরাপদ স্থান ভেবে নিয়ে এখান থেকেই তাদের কার্যকলাপ চালাতে থাকে। তখন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেন। স্বর্ণ মন্দিরে সেনাবাহিনীকে  অভিযান চালাতে নির্দেশ দেন। অভিযানের নাম  ছিল’ অপারেশন ব্লু স্টার’। অভিযান চলেছিল ১৯৮৪ সালের ১ জুন থেকে ৮ জুন পর্যন্ত। এই অপারেশনে প্রচুর শিখ নিহত হয়। এর বদলা নিতে এই বছরই ৩১ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধীর দুই দেহরক্ষী সৎবন্ত সিংহ ও বিয়ন্ত সিংহ তাঁকে হত্যা করেন। সারা দেশজুড়ে আগুন জ্বলে ওঠে। প্রচুর নিরিহ মানুষ প্রাণ হারান।

  এখানে, মানে কাঁথিতে রীতা সিং নামে আমার এক বন্ধু ছিল। ওর স্বামী  বাবলু সিং এর ‘পাঞ্জাবি দোকান’ নামে একটি রেডিমেড পোশাকের দোকান ছিল। কারা যেন কালি দিয়ে দোকানের নাম ঢেকে দিয়েছিল। 

                                  ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments