জ্বলদর্চি

রবীন্দ্রনাথ কখনো ভোট দ্যাননি /শ্রীজিৎ জানা

রবীন্দ্রনাথ কখনো ভোট দ্যাননি

শ্রীজিৎ জানা



রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভোট দিয়েছেন গত পৌরভোটে জোড়াসাঁকোর ১২৬নম্বর ওয়ার্ডে।খবরটা চাউর হতেই ভয়ানক হুলুস্থুল কান্ড। মিডিযা হাুউসগুলো নিজেদের মধ্যে শুরু করে দিযেছে টাগ অফ ওয়ার।কারা আগে ব্রেকিং নিউজ করে দেশকে চমকে দেবে। ইলেকট্রনিক থেকে প্রিন্ট মিডিয়া,জেলায় জেলায় ছাতার মতো গজিয়ে উঠা মিডিয়া চ্যানেল বুম-ক্যামেরা হাতে যেন থুড়িলাফ খাচ্ছে। মহানগর উত্তাল। ইলেকশন কমিশনের তো মাথায় হাত। পুলিশ-প্রশাসন নিজেই নিজের চুল ছিঁড়ছেন।রাজ্যের বুদ্ধিজীবীরা ভিড় করেছেন মেডিক্যাল স্টোরে। গুচ্ছের স্লিপিং পিল কিনছেন তারা। খবরটা শোনার পর থেকে তাঁরা ঘুমোতে পারছেন না।শাসক-বিরোধী  রক্তমুখ করে পরস্পরকে  ছিঁড়ে খেতে মরিয়া!

এরকম অদ্ভূত কান্ড ঘটল কীভাবে! ভোটার লিস্টে নামই বা  এলো কী করে!ছবি,বাবা-মার নাম,ডেট অব বার্থ সবই হুবহু মিল গ্যাছে! কারো কাছে এর কোনরকম ব্যাখ্যা নেই। ইলেকশন কমিশনের মুখের কাছে বুম ধরা হোলো,
---আমরা বিষয়টা খতিয়ে দেখছি। আফটার স্ক্রুটিনি আপনাদের ইনফর্ম করে দেবো।
এবার পাকড়াও করা হোলো পুলিশ কমিশনারকে। চোখের সামনে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ গটগট করে হেঁটে ভোট দিয়ে চলে গেলেন! অথচ কারো চোখে পোড়লো না! গাঁজাখুরি গপ্প! এই সমন্ধে আপনি বলুন কিছু। পুলিশ কী ঘুমোচ্ছিল?

---ইনভেস্টিগেশন চলছে। বাদ মে সবে ক্লিয়ার করবে।
দপ্তরের বড় মেজ সেজো কর্তা সবার তো বিপি হাই হবার জোগাড়! ইলেকট্রিক বিভাগের কর্মী যিনি ভোটের কদ্দিন অবজার্ভার সেজে গলায় আইকার্ড ঝুলিয়ে রোয়াব দেখাচ্ছিলেন।সুযোগ মতো অফিসের গাড়ি করে বারকয়েক শ্বশুরবাড়ি,শালীবাড়ি চর্কিপাক খেয়েছেন তিনি তো কেস চাউর হতেই চিৎপটাং! নাকে মুখে নল গুঁজে নার্সিংহোমের বেডে শয্যাশায়ী। আর প্রতিবারের মতো যত দোষ সব নন্দ ঘোষ ধরে নিয়ে পোলিং পার্টিকে আগেই শোকজ নোটিস ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। চাকরী হারানোর ভয়ে তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
কলেজ ক্যাম্পাস আড়াআড়ি ভাগ হোয়ে গ্যাছে এই ইস্যুতে। ইউটিউবাররা এই ঘটনা নিয়ে কনটেন্ট তৈরী করে ভিউয়ার্স বাড়াতে ব্যস্ত।  মোবাইলে এই নিয়ে মিমের ছড়াছড়ি। খিস্তি-খেউড় শাসক বিরোধী উভয় পক্ষকেই। 

টিভির টক শোতে বসে গ্যাছে মাছের বাজার। প্যানেলে নেতা,মন্ত্রী, প্রাক্তন আমলা,গায়ক,নায়ক,আঁকিয়ে,লিখিয়ে,অধ্যাপক সবাই হাজির। পরনে সবার মাঞ্জা দেওয়া পোশাক।চাঁদপানা মুখ যেন কার্তিক ঠাকুর! সঞ্চালক তাঁর অভ্যেসমতো সুঁচ ফোটানো শুরু করলেন। নারদের সেকেন্ড ভার্সান তিনি। অধ্যাপক যাঁর ক্লাসে জম্মে গলা শুনতে পায় না ছাত্রছাত্রীরা, তিনি তো রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে অস্থির। গায়ক দু'কলি এইনিয়ে গান শোনালেন। নায়ক জানালেন খুব শিগগিরি এনিয়ে তাঁরই অভিনীত একটা ছবি বেরুচ্ছে। ওদিকে আঁকিয়ে বড় ক্যানভাসে ছবি এঁকে চলেছেন। সঞ্চালক তখনো তাঁকে ডাকছেন না। শাসক দলের নেতা স্পষ্ট জানালেন,
----উন্নয়নের জোয়ার চলছে রাজ্যে। রবি ঠাকুর সেই উন্নয়নকে তরান্বিত করতেই এই পদক্ষেপ নিয়েছেন হয়তো। এতে দোষ কোথায়? ভোটদান  সবার গণতান্ত্রিক অধিকার। সে ভূত হোক আর ভবিষ্যৎ। 
---তার মানে যে মানুষটা এতবছর আগে মারা গ্যাছেন তিনি হঠাৎ জীবিত হোয়ে ভোট দিয়ে গেলেন? এটা মানা যায়? মামদোবাজি নাকি!
---আপনাদের সাড়ে তিন দশকে অমন অনেক ঘটেছে। আপনারা এখন শূন্য। আপনারা চুপ থাকুন।
----তাহলে কাল আমাদের বাজপেয়ী জী যদি ভোট দ্যান আপনারা মেনে নেবেন তো?
----রবীন্দ্রনাথ কক্ষনো আপনাদের যে ভোট দেবেন না তা আগেই জানাছিল। তিনি বাঙালী।বহিরাগতদের পাত্তা দ্যায় না।
---কিন্তু আপনাদেরই যে ভোট দিযেছেন তার কী কোন প্রমাণ আছে?
---তা নেই। তবে আপনাদের কাছে তো তিনি বুর্জোয়া কবি। তাঁর ভোটের আশা করছেন কেন?
---ভোটের আশা বড় কথা নয়। বিষয় হোলো ভুয়ো ভোটার দিয়ে জিতে বেশি ফুটুনি করে লাভ নেই
---আগেই জানতুম হাত ধরবে কাস্তে। শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল।
---আর সিবিআই ডাকলেই হাসপাতাল। যত গোঁজামিলের দল কোথাকার।

পরিস্থিতি যখন হাতের বাইরে যাচ্ছে অম্নি সঞ্চালকের তড়িঘড়ি উচ্চারণ--"  ফিরে আসছি বিজ্ঞাপন বিরতি পর"। অম্নি বিজ্ঞাপন শুরু-
"ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে…"!না আর চাবি ভাঙা সহজ নয়। এবার এসে গ্যাছে হাতিমার্কা তালাচাবি। "শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…"! ভয় নেই সঙ্গে আছে পি কে পালের ছাতা। "ও সে যতই কালো হোক দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ…"! চিন্তা কী?সাতদিনে ফর্সা কোরবো আমরা।

বিজ্ঞাপন পর্ব চুকতেই আবার চিলচিৎকার শুরু।এবার বুদ্ধিজীবীর পালা। তিনি এতক্ষণ চুপ করে শুনছিলেন। বোধহয় মনে মনে একটা ক্যালকুলেশন করছিলেন। সত্যিই যদি এমনটা হয় আর সরকার পক্ষে রবীন্দ্রনাথের ভোট পড়ে তবে বেশি ঘেঁটে লাভ নেই। এদিকে চটালে ওদিকে চটকে যাবে। জলপানি বন্ধ হওয়া স্বাভাবিক । আবার বিরোধী হাওয়াও বেশ গরম।  অতএব সেফ খেলাই ভালো।

---আসলে রবীন্দ্রনাথের এই ঘটনা যদি সত্যিই ধরে নিই তবে তিনি সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষেই রায় দেবেন বলে আমার বিশ্বাস।
মন্ত্রী তো চুপই ছিলেন। কারণ তাদের দলের চারা নেতা একাই দুশো। আবার না বল্লেও ক্যামন দেখায়। তাই নরম গলায় বললেন,
---চিন্তা নেই। দেশে আইন আছে। আইন আইনের পথে চলবে।
টক শোতে ছিলেন একজন দলবদলু নেতা। যার কাজই হোলো বাঁদরের মতো সুযোগ বুঝে এডাল-সেডাল লাফ দিয়ে ধরা। আগে ছিলেন দক্ষিণপন্থী। তারপর হলেন বাম থুড়ি অতি বামপন্থী। বর্তমানে ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে। তবে কখন কোন ফুলে থাকবেন নিজেও বোধকরি জানেন না। তিনি এবার কোলাব্যাঙের মতো গলা ফুলিয়ে চিৎকার ফেলে দিলেন,
---বেশ করেছেন রবী ঠাকুর ভোট দিয়েছেন। অবশ্যই দেবেন। যাকে ভালো লাগবে তাকেই দেবেন।
---ঘন্টায় ঘন্টায় জার্সি বদলানো নেতা আপনি থামুন।
---আপনি থামুন। খাতা তো খুলতে পারেন নি।
---খাতা যেদিন খুলবো,সেদিন আপনার প্রোপার্টির খাতাও খুলবো মনে রাখুন।

দর্শক এতক্ষণ ধরে সব শুনে দেখে দু'চারটে খিস্তি দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে গভীর ঘুমে ঢলে পড়লেন। কেউ কেউ ঘুমোবার আগে টিভির রাগ উগরে দিলেন বিছানায় স্ত্রীর উপর তুমুল যৌন শীৎকারে।
পরদিন রেজাল্ট বেরুলো। শাসক জিতেছে মাত্র এক ভোটে। আর একটি ভোট পড়েছে নোটায়। আবার শুরু চাপানউতোর। এবার ইস্যু রবীন্দ্রনাথের ভোট দেওয়া নয়। তারচে বড় বিষয় ভোট দিয়েছে কাকে! শাসকের দৃঢ় ধারণা ওই একটি ভোট তাঁরই আশীর্বাদ। তুরিতে ঘোষণা টানা সাতদিন সারা মহানগরে রবীন্দ্রসংগীত বাজবে। ওদিকে শান্তিনিকেতনে শাসকদলের এক নেতা চড়ামচড়াম করে ঢাক বাজিয়ে অকাল রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন করবেন বলে ঘোষণা করেছেন। সব বিরোধী পক্ষ একজোট হোয়ে দাবী করছেন সিবিআইয়ের। এর পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দরকার। কক্ষনো রবীন্দ্রনাথ ভোট দিতে পারেন না। এমন ঘটনা গণতন্ত্রের লজ্জা। তবে যদি ঘটেও থাকে সেক্ষেত্রে ওই একটি নোটায় পড়া ভোটটিই হল তাঁর। দেশে ও রাজ্যে যেরকম অরাজকতা চলছে,মানবতা লাঞ্ছিত হচ্ছে সেখানে তিনি বিরুদ্ধ মত প্রকাশ করবেন, সেটাই সকলের বিশ্বাস।
 যদি ঘটনার সত্যাসত্য বেরিয়ে না আসে তবে আগামীদিনে বিরোধীরা পথে নামার হুমকি দিচ্ছেন। কেউ আবার দিন ঘোষণা করে দিয়েছেন হরতালের। গতিক বুঝে সরকার সব দোকানের  মোমবাতি বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।যাতে কারাও যেন মোমবাতি মিছিল করতে না পারে। এতে বুদ্ধিজীবীরা কিছুটা নিশ্চিন্ত।

এমন অদ্ভুতুড়ে ঘটনা নিয়ে যখন রাজ্য রাজনীতি তোলপাড়। রাজ্যে তখনো গাড়ি ছুটছে। ট্রেনে হকার ফেরি করছে। প্ল্যাটফর্মে ভিখিরিরা বাটি নাড়ছে। কৃষক ঋণের দায়ে গলায় ফাঁস পরছে। মজদুর রাস্তায় ধূলো মাখছে। বেকাররা কাজের দাবীতে ধর্ণায় বসেছে। 
হাওয়া বইছে। রোদের পিওন বলে যাচ্ছে দিনের পরমায়ু। গঙ্গার ঘাটে মাথা ঠুকছে ঢেউ বাতাসের শাসনে। অটোর সাথে যাত্রীর বেঁধেছে তুমুল বচসা। বাজারদর ছ্যাঁকা দিচ্ছে মধ্যবিত্তের নোলায়। তখনো প্রিন্সেপ ঘাটে যুগলে চুমুচুমিতে ব্যস্ত। আইপিএলের খেলা হচ্ছে। অ্যাকাডেমিতে কবিতা উৎসব,এগজিবিশন। কাপড়ের দোকানে আগুন। ছাত্রীর শ্লীলতাহানব। চিটফান্ডের মামলা। টলিউডে হিরো-হিরোইনের ব্রেক আপ। সিরিয়ালে শ্বাশুড়ি-বৌমার কূটকচাল। 
ক্রমেই তলানিতে ঠেকছে রবীন্দ্রনাথের ভোটদান ইস্যু।  উত্তেজনা। কৌতুহল। সমর্থকরা হল্লাবাজিতে তুলেছে বোল,
---জো জিতা ওহি সিকান্দর। এভরি থিং ইজ ফেয়ার। মানুষ আমাদের পাশে আছে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাহলে কীহবে এবার?এমন ঘটনা কী বিনা প্রশ্নে মেনে নিতে হবে সকলকে?কবে তদন্ত হবে? রায় বেরোবে কবে? যদি রবীন্দ্রনাথ না হোয়ে অন্য কেউ হোতো তাহলেও কী এমন তোলপাড় হোতো? রাজীতিতে হার-জিতের মাঝে নীতি নৈতিকতা বলে কী কিছু থাকতে নেই? কত সব জিজ্ঞাসা উড়ে বেড়ায়! কোনো বাক্যের শেষে পূর্ণছেদ বসছে না! সবই তারা বিস্ময় চিহ্ন অথবা আরো কৌতুহল নিয়ে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হোয়ে সটান দাঁড়াচ্ছে।

হঠাৎ বিকট শব্দ। ঘুম ভেঙে যায় বিপ্লবের। কীসব আজেবাজে স্বপ্ন মাথায় এতক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছিল তার।বিছানা ছেড়ে জানালা দিয়ে সে দেখে জয়ী দলের বিজয় মিছিল বেরিয়েছে। বিপ্লব হাত দিয়ে চোখদুটো কচলে ফোনটা হাতে নেয়। বিবেককে এখুনি একটা কল করা দরকার। ওকে আজকের স্বপ্নের ব্যাপারটা বলতে খুব ইচ্ছে করছে তার। মনে মনে হাসি পায় বিপ্লবের।শেষে কিনা এত বছর পর রবীন্দ্রনাথ এসেছেন ভোট দিতে! উদ্ভট এক স্বপ্ন! কদিন এলাকায় ভোট নিয়ে যা চলছে,সাবকনসাস্ মাইন্ডে তারই এফেক্ট হবে বোধহয়। এদিকে  রিং হচ্ছে বিবেকের ফোনে।
 বিপ্লব অপেক্ষা করে কখন বিবেক সাড়া দ্যায়?

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments