জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-২৩/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ২৩

কাঁথিতে আমার অনেক বন্ধু হয়ে যায়। জানিনা কী কারণে আমার সঙ্গে যারই আলাপ হয়, সে আর ভোলেনা। বকুলের সঙ্গে অর্পণের বন্ধুত্ব হয়ে গেলে অর্পণের মাকে আর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে হতনা। বকুলও দিদির কাছে বসার বায়না ছেড়ে  দিয়েছিল। ওদের সঙ্গে সন্দীপ নামে আর একটি ছেলে ভর্তি হয়েছিল। ওদের বাড়ি মেদিনীপুরে। ওর বাবা ছিলেন ‘এমপ্লয়মেন্ট  এক্সচেঞ্জ অফিসার। ওর মা নবনিতা, অর্পণের মা অঞ্জলি ও আমি খুব ভাল বন্ধু হয়ে উঠি। অর্পণদের বাড়ি  এগ্রাতে। ওর বাবা ছিলেন বড় কন্ট্রাক্টার। ওঁদের একটি মেয়ে হয়, নাম রিনু। একেবারে ছোট থেকে রিনু আমার কাছে অনেকটা সময় থাকত। স্নান করানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো সবই আমি করতাম। এই বাড়িতে আসার পর খান সাহেব একটা হাতে ঘোরানো সেলাই মেশিন কিনে দিয়ে ছিলেন। আমি বাবলির ফ্রক, সালোয়ার-কামিজ ইত্যাদি নিজেই সেলাই করতাম, তাতে এমব্রয়ডারি করে দিতাম। রিনুকেও নানারকম ডিজাইনের, ক্রুশের লেশ লাগানো ফ্রক বানিয়ে দিতাম। দুপুরবেলা দল বেঁধে সেলের বাজারে ঘুরতাম, নুন-শোতে সিনেমা দেখতাম। এরই ফাঁকে আচার বানাতাম ,ডাল বেটে বড়ি দিতাম। মেদিনীপুরের এ অঞ্চলের গয়নাবড়ি জগৎবিক্ষাত। অনেকে বলতেন বাবলির মা খুব গুণী মহিলা। এভাবেই দিনগুলো কাটছিল। লেখালিখির বিষয়ে মনে কোনও ভাবনা চিন্তা ছিলনা। তবে একটা সুপ্ত ইচ্ছা যে মনের মধ্যে লুকিয়ে ছিল, তা বহু পরে বুঝতে পেরে ছিলাম।


    বাবলির স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের প্রতিযোগিতা চলছিল। ও নাচ,গান, ড্রইং ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় নাম দেয়। বিতর্কের বিষয় ছিল ‘গ্রামীণ জীবন বনাম শহুরে জীবন’। পরিচিত ২/১ জনকে এবিষয়ে কিছু পয়েন্ট লিখে দিতে বলায়, তারা দিচ্ছি, দেব করেই সময় পার করে দিলেন। প্রতিযোগিতার আগের দিন রাতে নিজেই খাতা-পেন নিয়ে লিখতে বসলাম। গ্রামীণ জীবনের সুখ-সুবিধা বিষয়ে অনেকগুলো পয়েন্ট লিখলাম। শহুরে জীবন সম্বন্ধে বেশি কিছু লিখতে পারলাম না। সৌভাগ্য  বসত ওকে গ্রামীণ জীবন সম্বন্ধে বলতে বলা হয়। ও বলে, এবং প্রতিযোগিতায়  প্রথম হয়। বাকি তিনটি বিষয়েও দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অধিকার করে পুরস্কৃত হয়েছিল।

    পড়াশোনাতেও ভাইবোন খুব ভাল ছিল। বাবলি হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর প্রত্যেক বছর এক এক জনকে টপকাতে লাগল। বকুলের টপকানোর কেউ ছিলনা। ও খুবই ভাল স্টুডেন্ট ছিল। ওদের কোন গৃহশিক্ষক ছিল না।আমরাই পড়া দেখিয়ে দিতাম। নার্সারি স্কুলের পাশেই ছিল সুধাংশু পণ্ডার বাড়ি। উনি প্রভাতকুমার কলেজের গণিতের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তখন অবসর জীবন কাটাচ্ছিলে। ওনার ছোটছেলে এই বাড়ির বড়ছেলে সুদীপের সহপাঠী থাকায় এ বাড়িতে আসাযাওয়া ছিল। আমাদের সবার সঙ্গেই কথাবার্তা ছিল। ওদের বাড়িতেও বাবলি বকুলের যাতায়াত ছিল। তার আর একটা কারণ সুধাংশুকাকা আমার সেজকাকার বন্ধু ছিলেন। হিমানীদির বাবাও সেজকাকার চাকুরি সুত্রে বন্ধু ছিলেন। হিমানীদিও কাকাকে চিনতেন। এ পরিচয় অবশ্য পর পেয়েছি।


    সবার সব কথা লিখে উঠতে পারছিনা। মেদিনীপুর শহরের সিপাইবাজারে আমাদের কিছুটা জমি কেনা ছিল ভবিষ্যতে বাড়ি করার জন্য। হাউসবিলডিইং লোন নিয়ে সেখানে বাড়ি শুরু হল। আমার মেজদা দেখাশোনার দায়িত্ব নিলেও মিস্ত্রীরা নিজের মত নিজেরাই কাজ করত। খান সাহেব মাঝে মাঝে গিয়ে কাউকে না দেখতে পেয়ে ফিরে আসতেন। এভাবেই বাড়ির কাজ চলছিল। এদিকে খান সাহেবের নিয়ম মেনে বদলি হচ্ছে। ওনার ইচ্ছা বাড়িটা হয়ে গেলে  মেদিনীপুর নিয়ে এসে বাবলিকে মিসন গার্লস স্কুলে আর বকুলকে কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি করাবেন। তাই  বদলিগুলো কাঁথির আসেপাসে নিচ্ছিলেন। জুনপুট থেকে মুকুন্দপুর, এখান থেকে নাচিন্দা, আরও কোথাও একটা বদলি হয়েছিলেন, নাম মনে পড়ছে না। ছেলেমেয়র পড়াশোনার কথা ভেবেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

     বাবলি ষষ্ঠ শ্রেণিতে চতুর্থ স্থান অধিকার করে, সপ্তম শ্রেণিতে তৃতীয় স্থান, অষ্টম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান ও নবম শ্রেণিতে ৬টি বিষয়ে সর্বচ্চ নাম্বার পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে। বকুলকে হরিসভা স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল ষষ্ঠ শ্রেণিতে বৃত্তি পরিক্ষা দেওয়ানোর জন্য।এই সময় সায়েন্সের কী যেন পরীক্ষা হত, প্রায় সব পরীক্ষাতেই দুজনে এ+(A+) পেত।

      কাঁথিতে থাকার সুবাদে মাঝে মাঝেই কয়েক ঘণ্টার জন্য দিঘা ঘুরে আসতাম। প্রায়দিন জুনপুট যেতাম। বাস ছিল, তবুও আমরা ৫ টাকা দিয়ে ভ্যানরিক্সা ভাড়া করে সবাই মিলে যেতাম। এখানকার সমুদ্র খুব নোংরা। দড়িতে মাছ শুকনো হত। চিংড়িগুলোকে বালির ওপরেই শুকনো করা হত। তার ওপরেই কুকুর মলমুত্র ত্যাগ করত। এখানে প্রচুর চিংড়ি চাষ হত। ঝাউবন ছিল। এখন  হয়ত অনেক বদলে গেছে। একবার দারিয়াপুর গেছলাম এক ভদ্রলোকের বাড়ি নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে। যাওয়ার পথে কপালকুণ্ডলার মন্দির দেখলাম। জঙ্গলের মধ্যে বেশ কিছুটা পথ বালির ওপর দিয়ে হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়েছিল আমাদের অভ্যাস  নেই বলে। ফেরার পথে লাইট হাউসে চড়েছিলাম। এখান থেকে সমুদ্র দেখতে দারুণ লাগছিল। খেজুরির মসনদ-ই-আলা গেছলাম দুবার। অনেক কাহিনী শুনলাম যার বেশিরভাগটাই ইতিহাস।

       ১৯৮৯ এর এপ্রিলে মিশন গার্লস স্কুলে বাবলির ভর্তির পরীক্ষা থাকায় আমরা সবাই মেদিনীপুর এলাম। কী প্রচণ্ড গরম আর সেইসঙ্গে জলকষ্ট। অনেক কষ্ট করে খাবার জল সংগ্রহ করতে হত। একতলা তখন আমাদের কমপ্লিট হয়ে গেছে। কিন্তু পাড়াটা আমার মোটেও পছন্দ নয়। আশেপাশে মেলামেশা করার মত কোন পরিবার নেই। আজহারউদ্দীন খানের বাড়ি ছাড়া আর একটি বাড়ি আছে, শুনেছি, কোন এক ইঞ্জিনিয়ারের বাড়ি।

    খান সাহেব বাড়ির কাজ দেখতে আসতেন যখন সেই সময় মিশন স্কুলে খোঁজ নিতে গেলে ওনারা জানিয়েছিলেন, উঁচু ক্লাসে ভর্তি নিলে স্কুলের রেজাল্ট খারাপ হয়, তাই এখন আর নবম শ্রেণিতে ভর্তি নেওয়া হয় না। মাস কয়েক পর আবার খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন, নবম শ্রেণিতে ভর্তির পরীক্ষার নোটিশ টাঙ্গানো হয়েছে। তাই মেদিনীপুরে আসা। পরীক্ষার খাতায় কী একটা উত্তর ভুল লিখে আসায় বাপির কাছে বকা খেল। ওনার আফসোস বাড়ির কাছে ভাল স্কুলে ভর্তি হতে পারবেনা। কাঁথি ফিরে যাওয়ার সময় ওঁর মামাদের বলে এলো, কেউ যেন রেজাল্ট দেখতে না যায়।ও ভর্তির সুযোগ পাবে না। ইতিমধ্যে ভাইবোনের স্কুলের রেজাল্ট বের হয়েছে।বাবলি হিন্দু গার্লসে নবম শ্রেণিতে প্রথম এবং বকুল হরিসভা স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে দ্বিতীয় হয়েছে। ওকে গতবছর এই স্কুলে(পরীক্ষা দিয়ে) ভর্তি করা হয়েছিল বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। সেটা আর হবেনা।

     খান সাহেবের চিন্তা মেয়েকে কোথায় কীভাবে ভর্তি করবেন? একদিন অফিস ছুটি নিয়ে মেদিনীপুর এসে অলিগঞ্জ স্কুল গেলেন প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে দেখা করতে।তখন দায়িত্বে ছিলেন ওনার পরিচিত ছবিদি(পদবি জানিনা)। তাঁর সঙ্গে কথা বলার সময় উনি বলেন, আমার মেয়ে ওখানকার স্কুলে ফাস্ট হয়েছে। তিনি ওনার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে বলেন, আমাদের স্কুলে ওর কোনও মূল্য নেই। তবে আমি পরে জানাচ্ছি। উনি তখন ভাবলেন, এখানে অপেক্ষা না করে একবার মিশন স্কুল ঘুরে আসি। মিশন স্কুলে গিয়ে রেজাল্টের লিস্ট চেক করে দেখেন,বাবলি প্রথম হয়েছে। উনি যখন কাঁথি ফিরে একথা জানালেন, তখন আমি ওদের টিসির জন্য স্কুল ছুটলাম। বাবলি ৬টি বিষয়ে সর্বচ্চ নাম্বার পেয়ে ক্লাসে প্রথম হওয়ার কারণে স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা কিছুতেই ওকে টিসি দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। আমাকে বললেন,মেয়েকে স্কুল হস্টেলে রেখে যান। সেটা সম্ভভ ছিল না।

      আমরা মেদিনীপুর চলে যাচ্ছি শুনে পরিচিতদের সবার মন খারাপ। একের পর এক বাড়ি থেকে খাওয়ার নিমন্ত্রণ আসতে লাগল। সম্ভবত ১০ মে দিন ঠিক করে ট্রাক ভাড়া করা হল। আমার সেজভাই মনি এসেছে নিতে। আগের দিন সব জিনিসপত্র প্যাক করা হল। ওইদিন সন্ধ্যায় একজনদের বাড়িতে চায়ের নিমন্ত্রণ ছিল। কিন্তু আয়োজন ছিল রাতের খাবারের। অঞ্জলি ছেলে মেয়েকে নিয়ে বিকেল থেকে এসে বসে আছে। ওপরের বউদি চা আর চিপস পাঠালে সবাই মিলে খেলাম। বকুল আর অর্পণ বেরিয়ে রোল খেয়ে এসেছে বলল। ওদের কারুরই বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। অঞ্জলি অর্পণকে বলল, আজ আর রান্না করবনা, ফ্রিজে ভেজা ভাত আছে, ওটা খেয়ে নিবি। কাজেরবউ রহিমা রাতের জন্য ভাত রান্না করে রেখে গেছে। তাই আমি বল্লাম,ভেজাভাত কেন কাবে? আমার রান্নাকরা ভাত তো রয়েছে, ওটাই নিয়ে যেও। অনেক রাতে ছোট গামলায় করে ওই ভাত নিয়ে ওরা বাড়ি গেল। এমনই ছিল আমাদের বন্ধুত্ব। সকালে বৌদির পাঠানো চা খেয়ে আমরা রওনা হওয়ার জন্য তৈরি হলাম। বলতে গেলে সারা পাড়া ভেঙ্গে পড়েছে আমাদের বিদায় জানাতে। তখন আমার মন এত ভারাক্রান্ত যে কান্না চেপে রাখতে পারলাম না। আমাকে কাঁদতে দেখে অনেকের চোখ ভিজে উঠল। বউদি ও আরও অনেকে সান্তনা দিয়ে বললেন, মন খারাপ করবেন না। যোগাযোগ থাকবে, যখন খুশি এসে বেড়িয়ে যাবেন।
                                 ক্রমশ
জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments