জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি
পর্ব - ২৭
কুড়কুড়ে ছাতু বা পুটকা ছাতু
সূর্যকান্ত মাহাতো
তখনও ভালো করে প্রকৃতির ঘুম ভাঙেনি। বেশ ঝুঁঝলো অন্ধকার। একটু একটু করে আলো মেখে সবেমাত্র ফরসা হচ্ছে। শিশির মেখে গাছের পাতা ও ঘাসগুলো তখনও ঝিমিয়ে আছে। এমন কাকভোরেই উঠে পড়েছে রতনের বউ। তিন বছরের ছেলের মুখ থেকে স্তনবৃন্তটা সরিয়ে কোমর পর্যন্ত কাঁথাটা ঢাকা দিয়ে সে উঠে পড়ল।
হাতে একটা লম্বা বাঁশের কঞ্চি নিয়ে এমন আলো আঁধারী ভোরেই বেরিয়ে পড়ল রতনের বউ। প্রায় দু কিমি পথ ওকে হেঁটে যেতে হবে। তবেই মিলবে সামনের জঙ্গল। হেঁটে যেতে যেতেই আকাশ আরও বেশি পরিষ্কার হয়ে উঠবে। অনেকে তো তারও আগে জঙ্গলে পৌঁছে যায়। তাই আর দেরি করা যাবে না। না হলে তখন আর বেশি বেশি করে ছাতু পাওয়া যাবে না। অন্যেরা কুড়িয়ে নেবে। তাই দ্রুত পা চালালো রতনের বউ।
হ্যাঁ, "কুড়কুড়ে" ছাতুর কথা বলছিলাম। রতনের বউ কুড়কুড়ে ছাতু কুড়োতেই জঙ্গলে চলেছে। বর্ষা এলেই বাঙালির পাতে এখন ইলিশের ঝোল। নয় তো সরষে ইলিশ। আর জঙ্গলমহলে? বর্ষা মানেই নানান ধরনের ছাতুর ছড়াছড়ি। এইতো সবে বর্ষার সূচনা। ইতিমধ্যেই ফুটতে শুরু করেছে "কুড়কুড়ে" বা "পুটকা" ছাতু। এই ছাতুর বিজ্ঞানসম্মত নাম হল---Astraeus Hygrometricus(Pors.) Morg.
এখন 'কুড়কুড়ে' বা 'পুটকা' ছাতুর মরসুম। জঙ্গলের এখানে ওখানে মাটিচাপা হয়ে ওরা ফুটে ওঠে। বেশি বেশি করে কুড়োতে পারলে বাজারে চড়া দামে বিক্রি করা যায়। প্রথম প্রথম তো ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত কিলো দরে বিক্রি করা যায়। রতনের বউ গতকালও সাতশ টাকা দরে দু কিলো ছাতু বিক্রি করেছে।
রতনের বউয়ের মতো জঙ্গলমহলে এমন একাধিক অভাবী পরিবার আছে। এই সময়টায় ছাতু বিক্রি করেই ওদের হাতে দুটো বাড়তি টাকা আসে। সংসার কিছুটা সচ্ছল হয়। সেই সঙ্গে নিজেদেরও খাওয়ার চিন্তা করতে হয় না। তাই কুড়কুড়ে ছাতুকে একটি অর্থকরী ছাতুও বলা যেতে পারে।
'কুড়কুড়ে' ছাতু নামটাও বেশ অদ্ভুত না! ভাবছেন, আরে এরকম নামে তো বাচ্চাদের চিপসের প্যাকেট হয়। ছাতুর নাম হয় নাকি! হ্যাঁ হয়। জঙ্গলমহলের বাজারে "কুড়কুড়ে ছাতু" আর "কুরকুরে চিপসের প্যাকেট" একই সঙ্গে বিক্রি হয়। কুরকুরে চিপসের মতোই কুড়কুড়ে ছাতুও খাওয়ার সময় 'কুড়কুড়' শব্দ হয়। কুরকুরে চিপসগুলো হয় লম্বা লম্বা। আর কুড়কুড়ে ছাতুগুলো হয় একেবারে গোল গোল। মার্বেলের মতো। সাদা ধবধবে। উপরের শক্ত খোলটা খাওয়ার সময় বেশ কুড়কুড় শব্দ হয় এবং সহজেই ভেঙে যায় বলেই কী এমন নামকরণ?
একে আবার "পুটকা" ছাতুও বলে। 'পুটকা' মানে হল ছোট। আসলেই তাই। কাঁচের মার্বেলের মতো হয় এদের গড় আকার। কিছু কিছু যে গুলতির মতো একটু বড় আকারের হয় না তা নয়। তবে বেশি বড় হলে সাধারণত সেগুলো বুড়িয়ে যায়। আবার এর থেকে ছোট ছোট আকারেরও হয়। সেগুলো তখন কিছুটা অপরিণত থাকে।
বর্ষার শুরু শুরুতেই আবহাওয়া বেশ মনোরম থাকে। একদিন বৃষ্টি, আবার দুদিন রোদ। আবার একদিন বৃষ্টি, আবার কিছুদিন রোদ। আষাঢ়ের গরমটাও আবার বেশ গুমোট। এমন রোদ বৃষ্টির লুকোচুরি আবহাওয়াই হল কুড়কুড়ে ছাতু ফোটার অনুকূল পরিবেশ। বৃষ্টিতে গাছের পাতাগুলো পচে গিয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। তারপর রোদ বৃষ্টি মেখে সেই মাটি ছাতু জন্মানোর মাতৃজঠরে পরিণত হয়। তবে জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিলে কিংবা দাবানলে জ্বলে উঠলে, অথবা প্রবল অনাবৃষ্টি হলে এই ছাতু জন্মানোয় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়।
জন্মকালে বা ছোট অবস্থায় এদের অস্তিত্ব কোনও ভাবেই বোঝা সম্ভব নয়। এরপর একটু একটু করে এরা বাড়তে থাকে। তখন মাটির উপরিভাগ বাড়তে থাকা ছাতুদের চাপে ফেটে যায়। সেই ফাটল দেখেই অনুমান করতে হয় ভিতরে ছাতু ফুটে আছে। সরু শক্ত কাঠি দিয়ে ফাটলের ভিতর থেকে ছাতুগুলোকে বের করে আনতে হয়। জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে এই ফাটলেরই অনুসন্ধান করে চলতে হয়। তবেই ছাতু মেলে। ক্ষুরধার দৃষ্টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে হয়। একেবারেই আনাড়ি হলে জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও এই ছাতুর কোনও সন্ধান করতে পারবে না। ছাতু ফোটার এই ফাটল সঠিক ভাবে চিনতে শিখতে হয়। না হলে বৃথাই হবে অনুসন্ধান। যারা দীর্ঘদিন ধরে এই ছাতু কুড়িয়ে চলেছেন তাদের এমনই অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে যে, উপর থেকে মাটিটা দেখেই তারা বুঝে যায় নিচে ছাতু আছে কিনা। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ধরে ছাতু কুড়ানো সত্তর বছরের বৃদ্ধা শ্যামলী মাহাত তেমনটাই জানালেন। অনেক সময় মাটি আলগা থাকলে হাতের কিংবা পায়ের আঙুলেও মাটি সরিয়ে ছাতু কুড়ানো যায়।
ছোট বড় মিলে একাধিক ছাতু একত্রে অবস্থান করে। প্রথমে গায়ে মাটি মাখা অবস্থাতেই ছাতুগুলো কুড়িয়ে আনতে হয়। কেউ ব্যাগে ভরে আনে, কেউ পলিথিনের প্যাকেটে, কেউ বা শাড়ির আঁচলে বেঁধে আনে। আবার কেউ শাল পাতার ঠোঙা বানিয়েও নিয়ে আসে।
গায়ের মাটিগুলো ভালো করে জলে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করতে হয়। ছোট ছোট ঝুড়িতে এ কাজটা করলে অনেক সহজ হয়। গায়ের মাটিগুলো ধুয়ে পরিষ্কার করে দিলেই সাদা ধবধবে হয়ে ওঠে ছাতুগুলো। তখন উপরটা বেশ চকচকে ও মসৃণ হয়ে ওঠে।
এই ছাতুর দুটি অংশ। বাইরের অংশটা হল একটু শক্ত। পুরু আবরণের একটি খোল বলা যেতে পারে। আর খোলের ভিতরের অংশটা হল মাংসল। একেবারে তুলতুলে নরম। ওই শাঁসযুক্ত অংশটাই সবথেকে বেশি স্বাদের। রঙ একেবারে ফুটফুটে সাদা। জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে এনে ভালো করে ধোয়ার পর এদের দু টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। যাতে ভিতরের শাঁসযুক্ত অংশটাও তেল নুন পায়। ভিতরের শাঁস যুক্ত অংশটা যদি কালো হয়ে উঠে, তাহলে বুঝতে হবে ওটা নষ্ট হয়ে গেছে। তখন আর ওটা খাওয়া যায় না। আবার বাইরের খোলটা অনেক বেশি শক্ত হলেও খেতে ভালো লাগে না। তাই কচি কচি নরম ছাতুগুলোই সব থেকে বেশি স্বাদের।
এই ছাতুকে সচরাচর ঝোল হিসাবেই রান্না করা হয়। তবে আলু কুন্দরী প্রভৃতি অন্যান্য সবজির সঙ্গেও যে রান্না করা যায় না তা নয়, তবে ঝোলেই এর বেশি স্বাদ। প্রথমে একটু তেলে ভেজে তারপর রান্না করতে হয়। মাছ মাংস রান্নার মতোই মসলা দিয়ে এ ছাতু রান্না করা হয়। স্বাদে তাই মাছ মাংসকেও হার মানিয়ে দেবে।
যারা জঙ্গলমহল বেড়াতে আসেন তারা যেন শীতের বদলে বর্ষাকালে আসেন। কারণ এ সময় প্রকৃতিও অপরূপ সাজে সেজে উঠে। পাহাড়গুলোর চূড়া থেকে সমতল ভূমিতে গাছ গাছালি ও সবুজ ধান ক্ষেত দেখলেই মনে হবে একটা সবুজের বিছানা যেন পাহাড় থেকে সমতলে গড়িয়ে নেমেছে। বেলপাহাড়ীর ন্যাড়া পাহাড়গুলো এই বর্ষায় সবুজ হয়ে ওঠে। মুকুটমনিপুর ড্যাম বর্ষার জলে কানায় কানায় ভরে ওঠে। নির্জন তীরে বসে তার ছলাৎ ছলাৎ জলের শব্দ শুনতে শুনতে আপনার মন বারে বারেই যেন কোথায় হারিয়ে যাবে। তারপর খাবারের পাতে তো অবশ্যই থাকবে কুড়কুড়ে ছাতুর ঝোল। আপনার শরীর ও মনকে আরও বেশি চাঙ্গা করে তুলবে।
এই ছাতুর খাদ্য গুণাগুণও অসাধারণ। বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন, খনিজ লবণ তো আছেই। সেইসঙ্গে কুড়কুড়ে ছাতু পুষ্টিগুণেও ভরপুর। তাই একাধিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও গড়ে তুলে এই ছাতু।
জঙ্গল লাগোয়া গ্রামগুলোতে চোখ রাখলেই দেখা যায় সকালে ও বিকালে মহিলারা দল বেঁধে চলেছে জঙ্গলের উদ্যেশ্যে। ছাতু কুড়াতে। পরস্পরকে তারা ডাকছে,"কই লো, চল। তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়। সন্ধ্যে হওয়ার আগেই বাড়ি ফিরতে হবে।"
পথ হাঁটতে হাঁটতে ওদের মুখে সর্বক্ষণ চলে পি এন পি সি। সংসারের কত সব নিন্দা ও স্তুতির গল্প। সেই গল্প বলতে বলতেই চলে ছাতু কুড়ানো। তবু ছাতু কুড়ানোর রোমাঞ্চই আলাদা। যত না খেতে মজা। তার তুলনাই কুড়িয়ে মজা।
1 Comments
Darun dekhe to khete mon ja66e
ReplyDelete