জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-২৯/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ২৯

২০০২ আর ১৯ মে ‘শরিয়তি আইনের সংস্কার হলেই ইসলাম বিপন্ন হয় না’ শিরোনামে আজকাল এ একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। এর কয়েকদিন পর, বাম ফ্রন্টের পার্টি অফিস থেকে বিজয় পালের ফোন আসে। আমাকে বলেন, চিনতে পারছেন? আমি বিজয় পাল। লেখার সূত্রেই ওনার সঙ্গে আলাপ। বললাম, আপনাদের মত নামী মানুষদের চিনব না? – আমি কোথায় নামী মানুষ? নামী তো আপনি। নাহলে কমরেড কেন আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন? তারপর আসল কথায় এলেন। বল্লেন, আমাদের কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী ফোন করে জানতে চাইলেন আপনাকে চিনি কি না, উনি আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান। তাই জিজ্ঞেস করছি, আপনার নাম্বারটা কি ওনাকে দেওয়া যাবে? আমি হ্যাঁ বলার কিছুক্ষণ পর আলিমুদ্দিন থেকে ফোন আসে। উনি বললেন, আজকালে আপনার ১৯ মের চিঠিটা খুব ভাল লেখা হয়েছে। ওটা যদি প্রবন্ধ আকারে লিখে পাঠান তাহলে ন্যাশানাল বুক এজেন্সি থেকে ‘মুসলিম সমাজ ও এই সময়’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ হতে চলেছে। আপনার লেখাটিও বিশ্বের নানা দেশের জ্ঞানীগুণীদের লেখার সঙ্গে প্রকাশিত হবে।

            আমি রাজি হই। উনি তার পরেও  লেখা চেয়ে চিঠি পাঠান। লেখা পাওয়ার পরও প্রাপ্তি স্বীকারও করেন। তারপর ৬ মাস কেটে গেছে। ব্যাপারটা  প্রায় ভুলেই গেছলাম, সেবার ৬ ডিসেম্বর ঈদ ছিল। বিজয় পাল ফোন করে বললেন, আপনার লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে।– কোন লেখা? অবাক হয়ে জিগেস করলাম।– যে লেখাটা শ্যামলদা চেয়েছিলেন। আপনি বই পাননি? আমি না বলাতে বললেন, আপনি শ্যামলদাকে ফোন করবেন। শ্যামলবাবুকে ফোন করতে বললেন,  মইনুল আপনাকে বই পাঠায়নি? আপনি কাল বারোটার দিকে আলিমুদ্দিনে ফোন  করবেন, ওর সঙ্গে কথা বলিয়ে দেব। পরদিন ফোন করে মইনুল হাসানকেই পেলেম। উনি বললেন, আপনাকে দু’বার ফোন করেছিলাম। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রিং হয়েছিল? -হ্যাঁ, আজহার সাহেব কথা বলেছিলেন। আমি বললাম, আমি তো ওই বাড়ির কেউ না! তখন উনি কিছু না বলে ঠিকানা পাঠাতে বললেন। পরে সেদিন রাতেই আমাকে ফোন করে দুঃখপ্রকাশ করে বললেন, আমি খুবই দুঃখিত, ভেবেছিলাম, রোশেনারা খান আজহারউদ্দীন খানেরই কেউ হবেন। তাই ওনাকেই ফোন করেছিলাম। আমি না জেনে করেছিলাম, উনি জেনেও কেন সত্যিটা না জানিয়ে নিজেই কথা বললেন! ওনার কাছে এটা আশা করিনি। পরিচিতি কী  লিখব? জিজ্ঞেস করতে বলেছিলেন, লিখে দিন না হাউস ওয়াইফ। কথাটা আমার পছন্দ হয়নি, তাই আপনার লেখা পড়ে যা মনে হয়েছে্‌, সেরকম পরিচিতি লিখেছি। সেই দিনই বুঝেছিলাম আমার লড়াইটা কতটা কঠিন।

কয়েকদিন পরেই  কুরিয়ারে মইনুল হাসান সম্পাদিত ‘মুসলিম সমাজ ও এসময়’এর  প্রথম খণ্ড এসে পৌঁছায়। পাতা উল্টে দেখি প্রকাশকাল ০১/১০/২০০২ । সূচীপত্রে চোখ রেখে দেখি, লেখকের তালিকায় দেশবিদেশের বহু  স্বনামধন্য মানুষের নাম রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ মুজতবা আলি, ইরফান হাবিব, ফলি এস নরিম্যান, জন ও ভল, পারভেজ হুডবয়, ড. আসগর আলি ইঞ্জিনিয়ার, ড.ওসমান গনী, অতীশ দাশগুপ্ত, মইনুল হাসান ও আরও অনেকের। মহিলা লেখক দুজন, আমি আর মিরাতুন নাহার। আমার প্রবন্ধের শিরোনাম ‘মুসলিম নারী ও আইন’। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয়েছিল ১৫/০৯/২০০৩ সালে। এই খণ্ডেও আমার  আরও একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম ‘মুসলিম সমাজ ও নারীর অধিকার। প্রথম খণ্ডের ২০টি প্রবন্ধ নিয়ে আলিগড় থেকে একটি উর্দু ভাষায় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। ২০ টির মধ্যে আমার প্রবন্ধটিও স্থান করে নিয়েছিল। এটা  আমাকে মইনুল হাসান জানিয়ে ছিলেন। আমার ‘মুসলিম নারী ও আইন’ প্রবন্ধটি যে দুই বাংলার বহু পাঠকের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে্‌, বহু পরে ধিরে ধিরে জানতে পারছি।

              এই ২০০২ সালে আমার জীবনে আরও কিছু চমকপ্রদ (আমার কাছে) ঘটনা ঘটে। বাংলা ১৪০৯(২০০২)চৈত্র(মার্চ) সংখ্যার নবকল্লোলে আমার চিঠি সেরা চিঠি নির্বাচিত হয়। তখন আমার নিজের ওপর এতটাই আস্থা জন্মেছে যে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমার চিঠি পুরস্কৃত হবে। ২০০ টাকা পুরষ্কার ছিল। আমার চিঠি ‘সেরা চিঠি’ হিসেবে নির্বাচিত হওয়াটাই আনন্দের ছিল। তাই টাকা নেওয়ার চেষ্টা করিনি। রতনতনু ঘাটি বললেন, কেন টাকা নেবেন না? এটা আপনার সাম্মানিক। তখন আমি নবকল্লোলের অফিসে যোগাযোগ করে ওরা ডাকযোগে যে পত্রিকা পাঠিয়ে ছিল, তার কভারটি আর একটি অথারাইজ লেটার লিখে একজন পরিচিতর মারফৎ পাঠালে ‘দেবসাহিত্য কুটির’ থেকে খামে ভরে  টাকাটি ওঁর হাতে দিয়েছিল।

            ১০/০৪/২০০২ এ আনন্দমেলায় ‘জয়েন্ট এন্ট্রান্স না পেলেও চিন্তার কারণ নেই’ একটি সাক্ষাৎকার মূলক নিবন্ধে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের সাথে অভিভাবক হিসেবে একমাত্র আমার সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। আমার বকুল তখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র। এই বছরই ‘আকাশ বাংলা’ টিভি চ্যানেলে ‘আমার আকাশ’ নামে একটি নতুন অনুষ্ঠান শুরু হয়। দর্শকদের এই অনুষ্ঠানের বিষয়ে চিঠি পাঠাতে বলা হয়। আমার চিঠি সেরা নির্বাচিত হয়। আমাকে ফোন করে ওই অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ  জানানো হয়। নির্দিষ্ট দিনে শুটিং শুরু হয় আমার কবিতা ও কথা দিয়ে। সঞ্চালনার দায়িত্বে ছিলেন অপরাজিতা। তখন সবে মুঠোফোন হাতে এসেছে। শুটিং চলছে, অপরাজিতার ফোনে বার বার ওর ছেলের ফোন আসছে। ফলে বার বার শুটিং কাট হচ্ছে, আবার নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে। তবুও অপরাজিতা ফোনের সুইচ অফ করছে না। কেই কিছু বলতেও ্পারছেনা। এদিকে আমি তো কোনো স্ক্রিপ্ট দেখে বলছি না। তাই বার বার আমার কথা বদলে যেতে লাগল। এভাবেই শুটিং শেষ হল। আমাকে বেশ কয়েকটা গিফট কুপন দেওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়েছিল ০৩/০৪/২০০২ তারিখে।

          ২০০৩ সালে আমার সামনে আরও কিছু নতুন দিক একে একে উন্মোচিত হতে থাকে। এই ২০০৩ এ মেয়ে বাবলি এক বছরের কন্ট্রাক্টে সরকারি চাকরি নিয়ে  সিঙ্গুরে আসে। এতদিন ওরা বাঁকুড়াতে থাকত। দীপ স্ত্রীরোগের ওপর ডিপ্লোমা করছিল। বাবলি এখানে বড় কোয়াটার  পেয়ে বাকুড়ার ভাড়াবাড়ি ছেড়ে চলে আসে। দীপের কোর্স শেষ হতে অল্প কিছুদিন বাকি আছে। হাসপাতালেই ওদের থাকার ব্যবস্থা থাকায় ওখানেই থেকে যায়। কোর্স শেষ হতে দীপ কোঠারিতে সপ্তাহে তিনদিনের কাজ নেয়। বাকি দিনগুলো সিঙ্গুরে থেকে বিদেশ যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। প্রথম দিকে ওর বিদেশ যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। সরকারি চাকরি না পাওয়াতে রাগে সিদ্ধান্ত নেয় দেশে থাকবেনা।

              ফেব্রুয়ারি মাসে আজকালের অফিস থেকে ফোন করে জানানো হল, আজকাল এর ২৫ বছর পূর্তিতে ১২ জন পত্র লেখককে পত্রনক্ষত্র সম্মান জানানো হবে। এই ১২ জনের মধ্যে আমিও রয়েছি। আজকাল এর সাংবাদিক(মেদিনীপুর) বুদ্ধদেব দাস আমার সাক্ষাৎকার নিতে আসবে। বুদ্ধদেবের সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল। মেদিনীপুরে ২ বার ‘আজকাল’ এর পাঠকসভা হয়েছে। আমি সেখানে উপস্থিত থেকেছি। দ্বিতীয়বার  অশোকদা(সম্পাদক) নিজে এসেছিলেন। আমার নাম ধরে ডেকেই জানতে চেয়েছিলেন, আজকাল এর পাঠকদের জন্য আর কী কী করা যেতে পারে? আমাকে অলোকদা আগেই বলেছিলেন, আমাদের অফিসে তোমাকে সবাই নামে চেনে। কথাটা যে মিথ্যে নয় অশোকদার কথায় আজ তা বুঝলাম।

            বুদ্ধদেব ফোন করে একদিন এসে আমার সঙ্গে কথা বলে যায়। ৩ জুলাই  ২০০৫ এ ‘কেন চিঠি লিখি’? এবিষয়ে ছবিসহ আমাদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এটাকেও আমি আমার বড় পাওয়া বলে মনে করি। তখন তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিলনা।তবুও ধিরে ধিরে আমি মানুষের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছিলাম। বইদ্যুতিন মিডিয়া বেশি করে আমাকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পরিচিত করে তোলে।   

    এই সালের অগাস্টে রেনবো প্রোডাকশন থেকে ডাক পেলাম মহিলাদের ‘অঙ্গনা লাইভ’ প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করার জন্য। এই অনুষ্ঠানটি সরাসরি তারা বাংলা থেকে দুপুরে দেখানো হত। নির্দিষ্ট দিনে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে স্টুডিওতে হাজির হলাম। সামান্য মেকাপের পর গিয়ে বসলাম। সঞ্চালিকা শর্মিষ্ঠা গোস্বামী চট্টোপাধ্যায়। . আগেই আমার সঙ্গে ফোনে আলোচনা করেছেন। আজকের বিষয়’ ‘মুসলিম আইনে  নারীর অধিকার’। ফোন ইন প্রোগ্রাম হওয়াতে প্রচুর মহিলাদের প্রশ্ন এলো এবং তাঁদের সমর্থনও পেলাম।

          ২০০৩ এই তারা বংলার নিজস্ব রান্নার অনুষ্ঠান ‘হাঁড়ির খাবার’ এ রান্নার ডাক পেলাম। এবার শুটিং এর আগারদিন বেহালায় ভারতীদির (ভট্টাচার্য) বাড়িতে উঠলাম। রান্নার উপকরণ নিজেদের নিয়ে যেতে হত। আমি ছোলার  ডালের হালুয়া বানাব ঠিক করে ছিলাম। এরজন্য যা যা প্রয়োজন, ভারতীদি সবই কিনে রেখেছিলেন। দিদি আমাকে মেয়ের মত স্নেহ করেন। আমি যাব বললে, আমার জন্য নানারকম নতুন নতুন রান্না করে রাখতেন। এখানে এলে আমি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। মনেই হয়না অন্যের বাড়িতে এসেছি। দাদা ব্যাঙ্কে চাকরি করতেন, তখন অবসর জীবন কাটাচ্ছিলেন। দাদাও আমাদের গল্পে যোগ দিতেন। একমাত্র ছেলে কৌশিক কাজের সুবাদে বেশি সময় বাইরেই থাকত।

              শুটিং ছিল দুপুরে, আমি আর ভারতীদি স্টুডিও পৌঁছালাম। মেকআপের পর সাড়ি নিয়ে ঝামেলা বাধল। একটি তাঁতের সাড়ি পরে গেছলাম, ওখানে পরার জন্য রয়েলব্লু রঙের বোমকাই সিল্ক নিয়ে গেছলাম। কিন্তু ব্যাক গ্রাউণ্ডে ব্লু রঙ থাকায় আমাকে তাঁতের সাড়িটি পরেই রান্না করতে হল। শুটিং শেষ হতেই সবাই খেতে শুরু করে দিলেন। পাশের রুমে অমিতদা(চক্রবর্তী)কম্পিউটারে কাজ করছিলেন,  হালুয়া খেতে খেতে বললেন, আপনি তো খুব ভাল কথা বলেন। আপনাকে দিয়ে সঞ্চালনা করাতে পারলে ভাল হত। আমি বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কেন নয়, সেটাও বললাম। কলকাতা থেকে দূরে থাকার জন্য পরবর্তী কালেও অনেক সুযোগ হারিয়েছি। যাইহোক এখান থেকেও একাধিক গিফট ও কুপন পেয়েছিলাম। এই পাওয়াগুলো আমার কাছে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। এখানে পৌঁছাতে পারাটাই আমার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পরবর্তী কালে এই অনুষ্ঠানে আমার চিঠি পড়া হয়েছে। এখানে চিঠি পড়া হতনা। এই অনুষ্ঠান সম্বন্ধে আমাকে লিখতে বলা হয়েছিল। তাই আমার চিঠিটি পড়া হয়েছিল।‘হাঁড়ির খাবার’ অনুষ্ঠানে আমার  পাঠানো ‘রেসিপি’ সেরা হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছিল।     

          সাল তারিখ মনে নেই, সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় নামে এক লেখক ভদ্রলোক আমাকে বেশকিছু পুরনো পত্রিকা দিয়েছিলেন। তারমধ্যে এবং মুশাইরা, অমৃতলোক এর মত, পত্রিকাও ছিল। অমৃতলোক পত্রিকার লেখা পড়ে ও লেখকদের নাম দেখে মনে মনে ভেবেছিলাম, আমি যদি এই পত্রিকায় লেখার সুযোগ পেতাম! কিন্তু তা কী করে সম্ভব? আমি তো কাউকে চিনিনা, তাছাড়া আমার লেখা সম্পাদকের পছন্দ নাও হতে পারে। সবথেকে বড়কথা আমি এই বয়সে কাউকে আমার লেখা ছাপানোর জন্য অনুরোধ করতে পারব না।

ক্রমশ

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

1 Comments

  1. খুব ভালো লাগল ( মিলি ঘোষ )

    ReplyDelete