জ্বলদর্চি

অভিজিৎ সেন / বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

বাংলা গল্পের পালাবদল—৪ 

অভিজিৎ সেন 

বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

অভিজিৎ সেন (জন্ম-১৯৪৫)-এর জন্ম পূর্ববঙ্গের বরিশালে। শৈশব কেটেছে সেখানেই। পরে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন। যৌবনে নকশালপন্থী আন্দোলনের শরিক ছিলেন। সত্তরের দশকে রাজনীতি ত্যাগ করে ব্যাংকের চাকরিতে যোগ দেন। ছোটোবেলা থেকে গল্প-কবিতা লিখেছেন। সত্তরের বছরগুলি থেকেই নিয়মিত গল্প-উপন্যাস লিখে চলেছেন। চাকরি-সূত্রে তাঁকে উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চলে— সীমান্ত অঞ্চলে ঘুরতে হয়েছে। তাঁর গল্পে পূর্ব বঙ্গ, উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ অঞ্চল, সীমান্ত অঞ্চল বারবার এসেছে। 

গ্রামীণ অঞ্চল-সীমান্ত অঞ্চলকে তিনি দেখেছেন আতস কাঁচের মধ্য দিয়ে। সেই অধীত অভিজ্ঞতা এবং সাহিত্য সচেতনতা অভিজিৎ সেনকে গল্প লেখায় প্রণোদিত করেছে। তাঁর গল্পের পটভূমি এবং মানুষেরা একটু অন্যরকম। বাংলা গল্পের প্রচলিত ধারায় কিছুটা নতুনও বটে। বাংলা গল্পের পটভূমি ও চরিত্রকে ব্যাপ্ত করেছেন তিনি। সীমান্ত চঞ্চল স্বমহিমায় উঠে এসেছে তাঁর গল্পে। 

নর-নারীর প্রেম-চেতনাকে নানাভাবে পরীক্ষা করেছেন অভিজিৎ সেন। তাঁর বহু গল্পে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে প্রবৃত্তি। ‘বিদলি জোয়ানের বিবি’ (‘বর্ষা’, ১৩৯৫) ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত অঞ্চলের পটভূমিতে রচিত। বিএসএফ জোয়ান নিহাল জানকীকে বিয়ে করে। একটি বাচ্চাও হয়। তারা দুজনে মিলে সরকারি জায়গায় একটি বাড়ি তৈরি করেছিল। তিন বছরের সংসার জীবনের পরে নিহাল বদলি হয়ে চলে যায়। মেয়েকে নিয়ে পড়ে থাকে জানকী। 

অসম্ভব প্রেমিক ছিল নিহাল। প্রেমিকরা প্রতারকও হয়। অসম্ভব প্রেমিক। অসম্ভব প্রতারক। “নিহাল যেমন উদ্দাম প্রেমিক, তেমনি কপট ও ক্রোধী ছিল সে।” তিন বছর ঘর করে পালিয়ে গেল। যে লোকটা ভয়ানক ভালোবাসতে পারত, সে চলে যাওয়ার সময় জানকীর ফুঁপিয়ে ওঠা মুখের চিবুক দু-আঙুলে তুলে হাহা করে হেসে উঠেছিল। তার দেশ কোথায় জানত না জানকী। নিহাল চলে যাওয়ার পরে সরকারি নির্দেশে বাড়ি ছেড়ে দেয় জানকী।  

সেই ঘরে আসে আরেক জোয়ান, চিরঞ্জীলাল। মধ্য বয়সী সংসারী মানুষ। নিরুপায় জানকী তিনমাস অপেক্ষার পরে চিরঞ্জীলালের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জানকীর অতি যত্নে লেপাপোঁছা করা দেওয়াল, দুরমুশ করা মেঝের সেই ঘর। চিরঞ্জীলাল ফিরিয়ে দেয় না। দু-বছর ঘর করে চলে যায় চিরঞ্জীলাল। ভালো ব্যবহার করত সে। ভদ্র, বিচক্ষণ মানুষ। কিন্তু সে বড়ো সতর্ক। জানকীকে কোনো সন্তান দেয়নি। অন্যত্র তার সন্তান ছিল। সে জানকীকেও সতর্ক হতে শিখিয়েছিল।       

জানকী বদলি জোয়ানের বউ হয়ে থেকে গেল। নিহাল এবং চিরঞ্জীলাল বিশিষ্ট মানুষ তার কাছে। পরের পাঁচ বছরে আসা নামদেও, সুরয, মানুয়ালের মতো মানুষেরা যা দিয়েছে তার থেকে নিয়েছে বেশি। তার সম্পর্ক এখন দেনা-পাওনার। সে এখন অনেক বুঝদার। বাড়ি ছেড়ে যায় না। বাড়ি এখন তার। সেই বাড়িতে থাকতে হলে তাকে নিয়ে থাকতে হবে। ক্যাম্পের লোকেরাও তার অধিকার মেনে নিয়েছে।  

দুমাস প্রায় মেয়েকে নিয়ে একা। কবে আবার জোয়ান আসবে তার অপেক্ষায় জানকী। তাকিয়ে থাকে দূর থেকে আসা জিপের দিকে। দেখে জিপ থেকে নামে প্রৌঢ় চিরঞ্জীলাল। দুজন-দুজনকে দেখে খুশি হয়। জানকী এগিয়ে গিয়ে তার হোল্ডঅল হাতে নেয়। আর তারপর বিস্ময়ে দেখে গাড়ির পিছন থেকে লাফ দিয়ে নামছে নিহাল। “কী সুন্দর মানুষটা! নিহালের উজ্জ্বল চেহারা আরও বীরত্বব্যঞ্জক হয়েছে। ঢেউয়ের মত বারান্দাওয়ালা টুপির কানাতে কপাল ঢাকা তার। বাজপাখির মত তীক্ষ্ণ চোখ আর নাকের নিচে একজোড়া প্রমাণ মাপের শৌখিন ডাঙা তোলা গোঁফ। কাঁধে ঝোলানো নিকষ কালো জাফরিকাটা টমসন। ভারি দাম্ভিক সুন্দর মানুষ সে।” জানকীর বাহ্যজ্ঞান হারিয়ে যায়। “জ্বলন্ত তরল রক্ত এখন তার ধমনীতে। অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিটি বিন্দু স্পর্শ এবং প্রবল বেষ্টনের আশ্লেষে একেবারেই নির্লজ্জ ও বেপথু। সব কিছু এই মুহূর্তেই চাই, এমন একটা জানোয়ারি হর্ষ যেন তার স্নায়ুতে, ধমনীতে, সর্বাঙ্গে।”    
   

চিরঞ্জীলাল বিমূঢ় জানকীকে বলে, নিহাল দুচারদিনের জন্য কাজে এসেছে। থাকবে না সে। ছ-বছর এখানে থাকবে চিরঞ্জীলাল। তারা ঘরে যায়। পরদিন দুপুরে নিহাল আসে জানকীর ঘরের সামনে। হাসে সে। লেখকের মন্তব্য— “নির্লজ্জ পুরুষ, সর্বস্বলুণ্ঠনকারী তস্কর! হাসতে লজ্জা হয় না নিহালের ? জানকীকে বদলি জোয়ানের রেণ্ডি বানিয়ে হাসতে লজ্জা হচ্ছে না নিহালের।” 

জানকী মেয়েকে বার করে এনে বলে— “দেখে নে, এই কুত্তাকে আউলাদ তোর বাপ।” আবারও হেসে নিহাল চলে যায়। রাতে চিরঞ্জীলাল বলে লাফাঙ্গা নিহাল যেখানে যায় সেখানেই কমপ্লেন। ছ-বছর পরে রিটায়ার করে চলে যাওয়ার সময় জানকীর একটা ব্যবস্থা করে যাবে বলে। সঙ্গে নিয়েও যেতে পারে। কারণ হরিয়ানায় কাজের লোকের খুব চাহিদা। জানকী জানায় এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাবে না। 

পরদিন মাইল তিনেক যাওয়ার পরে নিহাল দূর থেকে ঝোপের আড়ালে একটা শাড়ির আভাস দেখতে পেয়ে গাড়ি থামায়। আড়াল থেকে জানকী বেরিয়ে এসে গাড়ির পিছনে উঠে পড়ে। “নিহাল আশ্চর্য হয় না। শুধু সামান্য সংশয় তার ছিল যে, মেয়েটাকে কী করবে জানকী। নিশ্চয়ই কোনো একটা ব্যবস্থা করেছে সে।”

জানকীর পেশাই যেন হয়ে গিয়েছিল বদলি জোয়ানের বউ। এরকম বিষয় নিয়ে গল্প এর আগে আমাদের চোখে পড়েনি। পাঠকের সামনে একটা অচেনা অথচ বাস্তব জগতকে মেলে ধরলেন লেখক। এভাবে অভিজিৎ সেনের গল্প আমাদের অভিজ্ঞতাকে বারবার বিস্তৃত করেছে। 

প্রবৃত্তি জানকীকে অমোঘ নির্দেশে টেনে নিয়ে গেছে। গল্পটিকে লেখক এক শিল্পসম্মত ও মনস্তাত্ত্বিক পরিণতিতে পৌঁছে দিয়েছেন। প্রেমের গল্প কত উপভোগ্য হতে পারে, প্রেমের স্বরূপ কত বিচিত্র হতে পারে তা বারবার দেখিয়েছেন লেখক। 

নদীর প্রতি প্রবল আগ্রহ লেখকের। নদীমাতৃক বরিশালে প্রত্যেকটি গ্রামে একটি করে নদী আছে। সেখানে আজও ট্রেন লাইন হয়নি। পাশের পাড়ায় যেতে হলেও নৌকো করে যেতে হয়। উত্তরবঙ্গে থাকার সময়েও তিনি নদীকে দেখেছেন। নদীগুলো বিভিন্ন সময়ে খাত পরিবর্তন করেছে। বহু উপন্যাস-গল্পগ্রন্থের নামকরণেও এসেছে নদীর অনুষঙ্গ। যেমন ‘অন্ধকারের নদী’, ‘নক্ষত্র নদী ও নারী’, ‘নিম্নগতির নদী’, ‘মেঘের নদী’ ইত্যাদি। তাঁর সাহিত্যে নদী অনিবার্যভাবে প্রভাব ফেলেছে।

নদীর দেশের অনুষঙ্গে, পূর্ব বঙ্গের অনুষঙ্গে বহু গল্প লিখেছেন অভিজিৎ। যেমন ‘অন্নপূর্ণা’ (‘দশটি গল্প’, পরশপাথর প্রকাশন, ২০০৮)। এই গল্পে অন্নপূর্ণাকে আমরা দেখেছি তোফাজ্জেলের চোখ দিয়ে। তোফাজ্জেল একজন হতভাগ্য প্রেমিক। পঞ্চান্ন-ছাপান্ন বছরের সুপুরুষ তোফাজ্জেল গল্পের কথককে অন্নপূর্ণার কথা শুনিয়েছে, এক সন্ধ্যায় মোটরচালিত ভটভটি করে যাওয়ার সময়। হিন্দুর মেয়ে অন্নপূর্ণা প্রার্থনা করেছিল মোকছেদ এবং তোফাজ্জেল। কিন্তু দুজনকেই হতাশ করে অন্নপূর্ণা অনন্ত দাস নামের একজনকে বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। তিন মাস পরে ফিরে এল একা। অনন্ত দাস বর্ডার পার করার পর অন্নপূর্ণাকে এক দালালের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। “অন্নপূর্ণা শেষে মেয়েমানুষরা যা দিয়ে অহংকার করে তার সবটুকু হারিয়ে অনেক বিপদআপদ পার করে বাপের ঘরে ফিরে এল।”

মোকছেদ ততদিনে বিয়ে করেছে। কিন্তু অন্নপূর্ণা ফিরে আসার পরে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করে মোকছেদ। তা নিয়ে অনন্ত দাসের পরিবার এবং মুসলিমদের মধ্যে মারামারিও হয়। তোফাজ্জেলের মনে হয় অন্নপূর্ণাও মনে মনে মোকছেদকেই চাইত। যদিও তাদের জীবন সুখের ছিল না। মোকছেদের স্ত্রী ছাড়াও ছেলে ছিল। একবার সমুদ্রে গিয়ে আর ফিরে এলো না মোকছেদ। 

এবার তোফাজ্জেল অন্নপূর্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এতদিন পরে অন্নপূর্ণাকে বিয়ের সুযোগ এল তার। সেই বিয়ের খবর সে জানিয়েছে কথককে। তার প্রোস্টেটের সমস্যা সম্পর্কে লেখকের মন্তব্য—“অন্নপূর্ণার দীর্ঘকালীন নিষ্ফলা নৈকট্য কি তোফাজ্জেলের এত অল্প বয়সে প্রস্টেট সমস্যার কারণ ?” কথকের ভাই ডাক্তার তার কাছে যাওয়ার পরামর্শ দিলেন কথক। 

গল্পের শেষে দেখলাম অন্নপূর্ণা হতাশ করেছে তোফাজ্জেলকে। “অন্নপূর্ণা সম্ভবত একটা ধাঁধার জগতে বাস করত। দুইজন পুরুষের মাঝখানে একটা বিস্ময়ের জগৎ ছিল তার। ত্রিভূজের একটি বাহু হয়েই ছিল তার পূর্ণতা। ত্রিভূজের কোনো বাহুর তো স্বাধীন হবার উপায় নেই। সারাজীবন ধরেই মানুষের জন্য বিস্ময় অপেক্ষা করে থাকে। তোফাজ্জেল নিকারি কি ভাবতে পেরেছিল যে এরকম অর্থহীন তুচ্ছ কারণে তার সারাজীবনের স্বপ্ন নিষ্ফল হয়ে যাবে ? অন্নপূর্ণা তাকে ফিরিয়ে দিল।”

মোকছেদের ছেলে, যার নিজেরও বিয়ের বয়স হয়ে গিয়েছে, সে হুমকি দেয়, “অন্নপূর্ণা যদি ফের বিয়ে করে, সে সমুদ্রে চলে যাবে।” তাই সে তোফাজ্জেলকে বলে— “না, মেয়াঁ, আমারে মাপ কইরা দিও,...পোলারে ছাইড়া আমি বেহেস্তেও যাইতে পারুম না!” 

কথকের প্রশ্ন— “মোকছেদের সঙ্গে দীর্ঘ সহবাসেও সে একটি সন্তানের জননী হতে পারেনি। সে কথাও কি সে ভেবেছিল ?” 

দাম্পত্য-প্রেমের আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রেমের বিচিত্র অন্ধকার চোরাগলি এবং তার জটিল মনস্তাত্ত্বিক শিল্পরূপ অভিজিৎ সেনের গল্প।   

অভিজিৎ সেনের গল্পে কল্পনার জায়গাটা বেশ কম। তাঁর অধিকাংশ লেখায় গুরুত্ব পেয়েছে মানবিক আবেগ। সেই আবেগকে কাল্পনিক গল্পে দেখানো সম্ভব নয়। মনুষ্যেতর প্রাণী-জীব-জন্তুদের নিয়ে লেখা গল্পেও মানবিক আবেদন ম্লান হয়ে যায়নি। তাঁর একটি গল্পের নাম ‘শেয়াল’ (‘দশটি গল্প’, পরশপাথর প্রকাশন, ২০০৮)। এই গল্পটিও সীমান্ত অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে রচিত। ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে জঙ্গলের জীবজন্তুরা। মানুষের লোভ থাবা বসিয়েছে পশুর এলাকায়ও। জোর যার মুলুক তার— এই প্রবাদ আজও সমানভাবে প্রযোজ্য। এই গল্পে লেখক বলেছেন— “মানুষকে স্থান ছেড়ে দিতে দিতে জানোয়ার একসময় বোধহয় নিঃশেষই হয় যাবে পৃথিবী থেকে।” দুর্বলদের স্থান ছেড়ে দিতে হয়। লড়াই করে পেরে ওঠে না তারা। সবলের কাছে মাথা নোয়াতে হয়। এখানেও মানুষের কাছে লড়াইয়ে পরাজিত হয়ে জমি ছেড়ে দিতে হয়েছে শেয়ালকে।

সহদেব সরকারের কাছে থেকে জমির পাট্টা পেয়েছে। অনুর্বর-পাথুরে-জংলা জমি। সেই জমির দখল নিতে গিয়ে শেয়ালের মুখোমুখি হয়। কোদাল নিয়ে মাটিতে কোপ মারার সঙ্গে সঙ্গে বিন্নার জঙ্গলের একছত্র অধিপতি একটা বিরাট বড় শেয়াল আক্রমণ করে তাকে। গরগর করে, মুখব্যাদন করে, দাঁত খিঁচিয়ে এগিয়ে এসে প্রতিবাদ করে, “এ জায়গা আমার, খবরদার!” সহদেব অন্তরঙ্গ ভঙ্গিতে কথা বলে— “না ভাই, এ জমি আমার” বলে মাটির উপরে সজোরে কোদালের একটা কোপ বসিয়ে নিজের দাবি প্রতিষ্ঠা করে। সেই সুযোগে শেয়াল ঝাঁপিয়ে পড়ে তার উপর। কোদাল ছিটকে যায়। ঘাড়ে শেয়ালের দাঁত বসে যায়। গর্তের ভিতর থেকে আরও কয়েকটা শেয়াল বেরিয়ে ঘিরে ধরে তাকে। এবার সে প্রতি আক্রমণ করে সামনের শেয়ালের মাথাটা কোদাল চালিয়ে দু-ফাঁক করে দেয়। তারপর ডাইনে-বাঁয়ে-সামনে–পিছনে পাগলের মতো হাত-পা চালায়। মৃত-অর্ধমৃত পাঁচ-ছটা জানোয়ারকে ফেলে বাকিগুলো পালায়। দেশলাই জ্বালিয়ে ঘাসের জঙ্গলে ছুঁড়ে দেয় সে। 

শেয়ালদের পালাতে দেখে মনটা বিষণ্ণ হয়ে গেল তার। “বুকের মধ্যে হু হু করে উঠল। অনধিকার দখলদারী মনে করতে লাগল সে নিজেকে। কোনো একটা জায়গায় তার খটকা লাগতে লাগল। এই শেয়ালগুলো আরও একটু সাহসী হলে খতম করে ফেলতে পারত তাকে আজ। ফিরে আয় রে শেগল! খতম কর আমাকে।”  
     
এখানে শেয়াল আর সহদেব একাকার হয়ে গেছে। সহদেব এখানে উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধি। সমগ্র বাস্তুহারারা শেয়ালের মতোই। 

ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই তাঁর লেখায় গুরুত্ব পায়। উপন্যাসে তো বটেই, গল্পেও। তাঁর গল্পের চরিত্ররা কোনও-না-কোনও ভাবে একটা বৃহত্তর সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে।  

মানসিক কারণে কখনো কখনো সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে মানুষ। সবকিছুর মধ্যে সন্ত্রাস দ্যাখে। ভয় পায়। আতঙ্কিত হয়ে থাকে। কখনো হয়তো যথেষ্ট কারণ থাকে। আবার কখনো সন্ত্রস্ত হওয়ার প্রত্যক্ষ কোনো কারণই থাকে না। ‘সন্ত্রাস’ (‘দশটি গল্প’, পরশপাথর প্রকাশন, ২০০৮) গল্পে বরুণের আতঙ্কিত-সন্ত্রস্ত যাত্রার কথা আছে। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির সেলস ম্যানেজার। “কাজের কোনো সময়-অসময় নেই, সকাল-সন্ধ্যা নেই, শনিবার-রবিবার নেই।” সপ্তাহে একটা রাত হয়তো স্ত্রী-পুত্রের সঙ্গে দ্যাখা করতে পারে। কোনও সপ্তাহে হয়তো পারে না। তা নিয়ে দুশ্চিন্তা-হতাশা-অসন্তোষ লেগেই আছে।

এহেন বরুণের একটি সন্ধ্যার ট্রেন-যাত্রার বর্ণনা এই গল্প। শেষ লোকালে ব্যান্ডেল থেকে তার বাসা কাটোয়া যাচ্ছে সে। রাতের লোকালে এমনিতে লোক কম থাকে। ত্রিবেণী ষ্টেশনে দুটি তরুণ উঠল। তার একজন গান শুরু করে দিল। একটার পর একটা গান, সঙ্গে মুখে ওইরকম মিউজিক। আবারও একটা গোয়ালাদের দল উঠল। তারা উল্টোদিকে বসে গান শুরু করল। “দুই যুবক প্রাণপণে চিৎকার করে নিজের নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা করতে লাগল। কী আশ্চর্য শিক্ষা! দুইজনে দুই পৃথক গান পুরো গেয়ে শেষ করে অন্য গান ধরছে। একের পর এক স্টেশন পার হয়ে যাচ্ছে, তাদের গান থামে না।” 

বরুণের অস্বস্তি হয়। ভয় হয়। তারপর একজন পাগল উঠে ছুটোছুটি করে, হ্যাঙ্গারগুলো ধরে ঝুলে পড়ে। বরুণ আতঙ্কিত হয়ে দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকে। পাগলটা নেমে যায় পরের স্টেশনে। গান গাওয়া যুবকেরাও। তারপর তার চোখে পড়ে একটা বাচ্চা ছেলেকে। ছোট একটা ঝাঁটা দিয়ে কামরাগুলো ঝাঁট দেওয়ার পরিষেবার বদলে পয়সা ভিক্ষা চায়। তাকে অনেকবার দেখেছে বরুণ। আজ দেখল— তাকে সিটের এক কোণে প্রায় ঠেসে ধরে বসে আছে ষণ্ড চেহারার একটি লোক। “ছেলেটা ‘মুঝে ছোড় দো’ বলে উঠতে চেষ্টা করতে লোকটা ডান পায়ের দাবনা দিয়ে তাকে প্রায় ঠেসে ধরে হিংস্র চোখে বরুণের দিকে তাকাল। সত্যিই কামার্ত ক্রুদ্ধ ষাঁড়ের মতোই চোখ তার, আবার আতঙ্ক হতে শুরু হল তার।”

কাটোয়া ষ্টেশনে পুরোপুরি ট্রেন থামার আগে চলন্ত ট্রেন থেকে নামে পড়ল বরুণ। বৃষ্টি হচ্ছে। সিঁড়ির ধাপগুলোতে থিকথিক করছে ধান কাটার কাজে আসা মানুষেরা। “সে সন্তর্পণে ফাঁকা জায়গা খুঁজে খুঁজে পা ফেলছিল। ভয় লাগছিল। আতঙ্ক হচ্ছিল। ভেজা হিমেল হাওয়ার মধ্যে মানুষগুলোর চোখের সাদা অংশই যেন বেশি চোখে পড়ছিল তার।” 

বরুণের বাসা হেঁটে মিনিট তিন-চারেকের পথ। রিকশাওয়ালারা “যাবেন ? যাবেন ?” বলে। সে উত্তর দেয় না। “ভয় হয়। আতঙ্ক হয়। যদি রিকশা থামিয়ে কেউ বলে, যাবি না তো এই বৃষ্টি আর শীতের মধ্যে এত রাত অবধি দাঁড়িয়ে আছি কেন রে, শুয়োরের বাচ্চা!” যদিও এসব কেউ বলে না। শুধু বলে, “যাবেন ? যাবেন ?” আর বরুণের “কেমন সন্ত্রস্ত লাগে সব কিছুতে।”

এই সন্ত্রাস সময়-সমাজ-রজানীতির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। এর কোনও নিরাময়ও নেই বোধহয়। এই অ-চিকিৎস্য বোধ, বিপন্ন বিস্ময় এই গল্পটিকে অতি বিশিষ্ট করেছে। বরুণ যেন নির্বাসিত নায়কের মতো। কাজের চাপে কোণঠাসা হতে হতে সে তার স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছে। বিশ্বায়ন-পরবর্তী সময়ের আগ্রাসনে বিপর্যস্ত এক যুবকের মনস্তত্ত্বকে লেখক উপস্থাপিত করেছেন নির্মোহ বাস্তব দৃষ্টিতে।     

সাহিত্য জীবনের প্রায় প্রথম থেকেই মহাশ্বেতাদেবীর সাহচর্য এবং উৎসাহ পেয়েছিলেন অভিজিৎ। সেই সান্নিধ্যের অনিবার্য প্রভাবও ছিল অভিজিতের লেখক-জীবনে। মানুষের জীবনের অন্তহীন সমস্যা। সেই অবর্ণনীয় সমস্যার মনস্তাত্ত্বিক বয়ান অভিজিৎ সেনের গল্প। তিনি অদ্ভুত এক পরিবেশ রচনা করেন গল্পে। আর এভাবেই তুলে ধরেন একা আর অসহায় মানুষদের জগৎ। তাঁর গল্পের অধিকাংশ চরিত্রই কোনও না কোনও দিক থেকে স্বতন্ত্র এবং বিচ্ছিন্ন। আমাদের চেনা পৃথিবী থেকে অনেক দূরের পরিবেশ এবং তার মানুষদের অভিনব মুখ ধরা পড়ে তাঁর গল্পে। সেই মুখগুলি সহজে ভোলা যায় না।

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

3 Comments

  1. চমতকার বিশ্লেষণ।
    অন্য ধারার লেখক অভিজিৎ সেনের গল্প বহুমাত্রিক। সাধারণ ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজ,মানুষের বিপর্যয়তা দেখে আমরা হাসি বা কাদি না,কল্পনাপ্রবণ হয়ে উঠি..আবার নতুন করে ভাবতে থাকি গল্প নিয়ে..এখানেই তাঁর জাদু।

    ReplyDelete
  2. খুব ভাল লাগল।

    ReplyDelete