জ্বলদর্চি

বিশু সাপুড়ে /শ্রীজিৎ জানা

বিশু সাপুড়ে

শ্রীজিৎ জানা


বুড়ো হোয়ে গ্যাছে তেঁতুলগাছটা। সেই কবে থেকে ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে ভিটের পুবদিকে। এত ঘন পাতার ছাউনি যে তার মাথা চুঁইয়ে রোদ গলতে পারে না সহজে। সারাদিন গাছতলাটার কোলে ছায়া হেউঢেউ খেলে।যদিবা ক'বছর গেল একটা মোটা ডাল হঠাৎ মুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। ঝড়ঝাপটা কোত্থাও নেই। পাড়াপড়শির কাছে  দারুণ সুখ্যাতি তার। সবার কাছে সে মিঠানি তেঁতুল নামে কদর পায়। সবাই ডাল ভাঙার খবর পেয়ে ছুটে আসে। দ্যাখে  পোকা লেগে ফোঁপরা হয়ে  গ্যাছে ভিতরে ভিতরে। বাইরে সবুজ পাতার ঝলমলে হাসিটুকু ধরে রেখেছে কোনক্রমে। অনেকটা বিশু দুলের মতো। বুকের খাঁচার ভিতরে ঘুন ধরেছে কবেই। রোগের পোকা নয় অভিমানের পোকায় কুরেকুরে খাচ্ছে তাকে। কঞ্চির চঁচ তুলে ঝুড়ি তৈরী করতে করতে নিজেই নিজে বকে যায,
---দিনকাল কী দেখিটি ভগমান। মানা গুনার কাল কী তবে কপ্পুরের মতো উবে গেল। গাঁয়ের মেইয়া শিকন নাকি। ভাল জিনিসের কদর দিল নি। সব শালা টিবির পোঁদে মুখ গুঁজে রইল। 
সামনেই গেঁড়িবুড়ির মেলা। বিশ্বকর্মা পুজাতে মেলা বসে মামুদপুরের গেঁড়িবুড়ির থানে।সাতদিনের মেলায় যেন কালো মাথার ঢেউ আছাড়ে পড়ে। আর পাঁচটা মেলার থেকে আলাদা ভাদ্রের গেঁড়িবুড়ির মেলা। এই মেলায় লোকজন আসে শুধু মাছধরার নানানিধি সরঞ্জাম কিনতে। কতরকমের জাল,ঘুনি,ঝেপা,মুগরি হালুক,  ঝুড়ি কোদাল কাটারি বঁটি আরো কতসব।সাথে গাছ কেনে ফলফুলের। বিশু দুলে এখন ফিবছর গেঁড়িবুড়ির জাতে ঝুড়ি নিয়ে যায়। ঝুড়ি বেচেই সংসার চলে তার। ছেলে সেভাবে এখনো রোজগারপাতি কিছু করে না। হালে একশ দিনের মাটি কাটার কাজে ঝুড়ির টান ভালোই আছে। মেলা বাদে সারাবছর হাটে হাটে ঝুড়িই বেচে সে। সেই কবেকার শেখা কাজ আজকে যে তার ভাত জোটাবার একমাত্র উপায় হবে ভাবতে পারেনি বিশু।

বিশ্বনাথ দুলে। পিতা শিবনাথ দুলে।ঠাকুরদা অবিনাশ দুলে।কয়েক পুরুষের সাপুড়ে তারা। আশেপাশের দশবিশ গাঁয়ে সাপের খেলা দেখিয়ে বেড়াত। বিশু তখন ছোট। বাপের পিছু পিছু হাঁটা দিত সে। পাড়ায পাড়ায় খেলা দেখাত শিবনাথ। ডুগডুগি বাজাত চ্যারেং। চ্যারেং মান্ডি। বিশু চাল- আলু- পয়সা নিয়ে  থলের ভিতর চালান দিত। কখনো বাপের গানে চ্যারেংয়ের সাথে সেও গলা মেলাত---অভিমান করেছো মাগো/বাঁচাও লখীন্দরে/অভিমান করেছো মাগো। হাঁটু মুড়ে উবু হয়ে বসে কোলের কাছে সাপ ছেড়ে দিত শিবনাথ। বিশুকে সাপের কাছে ঘেঁষতে দিত না। যদিও বিশু জানে তার কোমরে সাপের মুখ বন্ধের শেকড় সহ তাবিজ বাঁধা আছে। তার উপরে সব সাপেরই বিষ তোলা হয় নিয়ম করে। বিশুর তাই ভয় করত না মোটেই। তবু মাঝেসাঝে বেখেয়াল হলেই শিবনাথের লালচোখ পড়ত চ্যারেংয়ের উপর।
সেই ছোট থেকেই বিশু সাপ খেলানোর গান শিখেছে বাপের মুখ থেকে শুনে। ঠাকুরদা তাকে সাপ ধরতে শিখিয়েছে ছোটতেই। সাপ চিনিযেছে সাথে তাদের মতিগতি।একটু বড় হলে রোজ সন্ধ্যায় তার কাছে বিশুকে শিখতে হয়েছে ঝাড়ফুঁক, সাপের বিষ নামানোর মন্ত্র। কোন গাছের শিকড়ে কি রোগ সারে সবই জেনেছে দাদুর থেকেই। তবে বাপের মতো ওই ডুগডুগি বাজানো আর বাঁহাতের কব্জিতে বাঁধা ঘুঙুরের তালে গান সে কখনো গাইতে পারেনি। কতবার দাদু বিশুকে বলেছে,
---ধারাটা ফেলি দিসনি দাদু। মোর বাপ মোকে ডুগডুগি ধরিছিল। তোর বাপকে আমি ধরিছি। তুইও বাপকেই গুরু কোরবি। অঝার কাজটাও ছাড়িসিনি। দেখবি মা মনসা কুনু দিন ভাতের অভাব দিবেনি।

--দুলাদের ছ্যানা তার আবার লিখাপড়া!
বিশু এই কথা দাদুর মুখে হামেশাই শুনেছে। ওই নামমাত্র গাঁয়ের স্কুলে তার পড়াশুনা। বাপ মারা যাবার পর তার কাঁধে উঠে বাঁক।হাতে ডুগডুগি। বাঁকের একদিকে সাপের পিড়ি অন্যদিকে চালের বস্তা।বিশুর স্যাঙাত হয় চৈতন। তার বাপের সঙ্গেও বেশ কয়েকবার চৈতন সাপ খেলাতে বেরিয়েছিল।দু'য়েক দিন বেরিয়েই বিশু বোঝে বাপ-ঠাকুর্দার মতো সেকেলেপনা করে খেলা দেখালে চলবে না। আরো নজরকাড়া করতে হবে। দাদুকে কতবার বলতে শুনেছে সে,
---বুইলি শিবু দাদো মোদের চেযেও বড় সাপুড়া হবে দেকবিখন!
বিশু পণ করে বসে বড় সাপুড়িয়া সে হবেই। চৈতনকে ডেকে বলে,
---বইলু চৈতনা ভিকারি সাপুড়া হলে চলবেনি মোদের। এক বাটি শুদু চাল ধরি দিবে তা হবেনি। একটু চটকপটক দেকাতে হবে। সাপকে ভয করে সবাই। অই ভয়টাকে কাজে লাগাতে হবে মোদের।
---তাইলে কী করবে বিশাদো।
---তুই আরেক জন আন। তিনজনের দল করতে হবে। আর দু'তিনটা সাপ হলে হবেনি। সাপ আরো রাখতে হবে। 
---যেদি গানগুলা এট্টু বাইনা বাজিয়ে করি তাইলে জমে যাবে। আর তুমি বল্লে ভাঁটুকে দলে ডাকব।
---ভাঁটু বলে চাঁদপুরের? যে নাল বাজায়? তাইলে ত ভালোই হবে।
কথামতো চৈতন আর ভাঁটুকে নিয়ে সাপ খেলানো গানের মহড়া শুরু করে দেয় বিশু।আশেপাশে যেখানেই খবর পায় সাপ ধরতে ছুটে। বাপ-দাদুর কাছে শেখা সাপ ধরার কায়দা প্রযোগ করে সে। গর্তের কাছে গিয়ে নাক ঠেকিয়ে বলে দ্যায় তাতে সাপ আছে কিনা। এমনকি কি সাপের ডেরা তাও নিমিষে বলে দ্যায় সে। ঝড়ের মতো সুখ্যাতি ছড়িয়ে যায় চারদিকে বিশু সাপুড়িয়ার নামে।

শুধু সাপ ধরাই নয, সাপ নাচানো দেখে তো পাড়াগাঁর লোক থ বনে যায়। ডুগডুগি বেজে উঠলেই ভিড় জমে যায় পাড়ায়। নাল আর ঘুঙুরের তালে বিশু দরাজ গলায় গান ধরে -বেহুলা কেঁদোনা গো,লখাই ফিরবে না। অম্নি ভাঁটু তার নালে বোল বাজায়। পাশে চৈতন ঘুঙুরে ঝুমঝুমানি তাল দ্যায়।কোলের সামনে একসাথে ছেড়ে দ্যায় আট দশখানা খরিশ গোখরো গেঁড়িভাঙা কালো,চিতি শঙ্খচূড়। পিড়ির ঢাকনা সাপের ফণার কাছে ঘোরাতে থাকে বিশু। সাথে হাঁটু  নাড়াতে থাকে। সাপের ল্যাজ ধরে পাক দিলেই ফোঁস করে  খাড়া দাঁড়িয়ে উঠে গোখরো কিম্বা গেঁড়িভাঙা। কোনোটাকে কোলে তুলে নেয় । কোনটাকে আবার গলায় জড়িয়ে নেয়। কখনো ভিড়ের দিকে আচমকাই সাপ ছোঁড়ার ভঙ্গি করে সবাইকে চমকে দেয়।  সাপ নিযে বিশুর কেরামতি দেখতে ছোট থেকে বড়ো সবাই ঝেঁপে জড়ো হয়।কতরকম বাহবা কুড়োতে থাকে বিশু।অনেক পাড়ায় শেকড়বাকড় দিযেও রোজগার হয তার। বিশু সাপুড়ের নাম শুনলেই সকলেই তারিফ করে নানাভাবে।
সেই বিশুর আশ্চর্য সাপুড়েগিরিতেই মজে যায় রাইমণি। বাগ্দী ঘরের মেয়ে হলে কি হবে চোখের তারায় যেন আলো টলটল করে। চিকন গড়নের রাইমণিকে ভালো লেগে যায় বিশুরও। অনেকে বাধা দিলেও বিশুর হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে রাইমণি। বিশু যদিও অনেকবার তাকে বলে,
--জাতে দুলা তার উবরে সাপুড়া। ঘর করতে পারবে ত মোর সঙে।
---জাত লিয়ে কি ধুয়ে খাব। মানুষটাকে ত ভালবাসি। যেই কাজ কর ক্যানে সৎ পথের রোজগার হলেই হোলো।
কথা শুনে বিশুর চোখ ছলছলিয়ে উঠে। সেদিনই স্থির করে বিয়ে করলে ওই রাইমণিকেই করবে।

নতুন বৌ রাইমণি সাপকে ভীষণ ভয় করে। বিশু তাকেও সাপের মুখ বন্ধের তাবিজ পরিয়ে দ্যায়। ঘর থেকে কিছুটা দূরে সাপের পিড়ি রাখার চালা বানায়। চৈতন সাপেদের আধার দ্যায় সময় মতো।রাইমণি সেদিকে আদৌ ঘেঁষে না। তবে আশ্বিনের মনসা পুজোতে দারুন নিষ্ঠা ভরে পুজোর আযোজন করে রাইমণি। পাঁচদিন ধরে বাড়িতে লোক আসে। পুজো প্রসাদ বিলি সবই একাই সামলায় রাইমণি।বিশু মনে মনে রাইমণিকে নিয়ে গর্ব করে।বছর দুয়েক পরে রাইমণির কোলে ছেলে আসে। হেসে খেলেই বেশ কাটছিল তাদের জীবন।
কিন্তু সময় যেন দ্রুত বদলাতে থাকে।গাঁয়ে টিভির রমারমা বাড়ে। সকাল বিকেল টিভির কাছে আঠার মতো আটকে থাকে ছেলেমেয়ে বুড়োবুড়ি সবাই।বিশু ডুগডুগি বাজিয়েও লোক জোটাতে পারে না। আগে কোন পাড়ায় খেলা দেখাবে তা নিয়ে নিজেরাই চেঁচামিচি শুরু করে দিত। এখন যেন কারোর তেমন টানই নেই সাপের নাচ দেখায়। ছোটদের কাছে একসময় বিশু সাপুড়ে ছিল আশ্চর্য এক সাহসী লোক। সেই বিশুর সাহস ছোটদের চোখ থেকেও উবে গ্যাছে। রোজগারে টান পড়ে বিশুর। সরকারী জারিজুরিতে টুকিটাকি ওঝার কাজেও বন্ধ হয়ে গ্যাছে। ভাঁটু কবেই চলে গ্যাছে দল ছেড়ে। তাল বুঝে চৈতনও একদিন বলে বসে,
---বুজঝ বিশাদো আর এই কাজটা কোরবোনি। জমকাডে না লিখিছি। উটাই কোরবো। তুমিও ছেড়ে দাও।
ঝাঁঝিয়ে উঠে বিশু,
--ক্যানে এদ্দিন যেটা তোর ভাত জুটাল তাকে সম্মান কোরবিনি।বাপ-ঠাকুর্দার কাজ ছেড়ে দুব!
---সে তুমি যাই বল। সময়ের সঙে তাল দিয়ে চোলতে হবে। এখন এই সাপ লাচানা দেখে কেউ আনন্দ পাযনি। এর চেয়ে ঢের আনন্দ টিবি দেখে। তার উবরে সাপেদের নাকি ইভাবে ধরে রাখা যাবেনি। বন দপ্তরে জানালে কেস খেতে হবে।অঝাগিরিও করা যাবেনি।থানায় টেনে লিয়ে যাবে।
কথাগুলো শুনে বিশুর মাথায় রক্ত উঠে যায়।রেগে বলে,
--তুইও তবে টিবিতে মুক গুঁজে থাকনা। আর এসিসিনি মোর সঙে। আমি একাই খেলা দেখাবো।আর বন দপ্তরের লিকুচি করি।যত আইন ত অদের গরিবের উপর। শালা ঢ্যামনার দল।
--অত রাগলে হবেনি বিশাদো
---কেনে রাগবোনি? বানবন্যায় রাতবিরাতে এই বিশাদুলা কত সাপকাটি রুগীর বিষ নামিয়ে বাঁচিছে।তকন কুথায় ছিল তদের ডাক্তার পুলিশ? শালা নিমখারামের দল!
রাগ একটু থিতোলে মনে মনে ভাবে বিশু। সত্যিই তার ডুগডুগির বোল আর লোকের মন জয় করতে পারে না। মানুষের চোখ থেকে ভয় রহস্য সব মুছে যাচ্ছে দিন দিন। অন্য এক মায়াবী আলো গাঁগাওলির চোখে নেশা ধরিয়ে দিয়েছে। রাইমণিও তাকে বোঝায়,
---জানি তমার ইসব ছাড়তে কষ্ট হবে।কিন্তু এভাবে কদ্দিন চলবে বল দিখি। ছ্যানাটাও ত বড় হচ্চে। অবলা জীবগুলাকেও আর কষ্ট দিও নি। ছেড়ে দিয়ে আস কুথাও।
কদিন চুপচাপ থাকে বিশু। মাঝেমধ্যে ডুগডুগিটাতে হাত বুলায়। সাপের ঘরটাকে ঘনঘন যাতায়াত করে। রাইমণি মুখ খুলে কিছু বলতে পারে না।
তারপর একদিন চৈতনকে ডেকে পাঠায বিশু। খবর পেয়ে বাড়িতে আসে চৈতন। কথা না বাড়িয়ে চৈতনকে ইশারা করে পিড়িগুলো দেখিয়ে বলে,
--যা চৈতন জীবগুলাকেও অদের ঘরে ছেড়ে দিযে আয়। বিশু সাপুড়া আর ডুগডুগি ধরবেনি কুনুদিন।

রাইমণি দূরে দাঁড়িয়ে দেখে বিশুর চোখ থেকে ছলকে পড়ছে জল। শুধু চৈতন বুঝতে পারে ওটা চোখের জল নয় গেঁড়িভাঙার ভয়ানক বিষ!

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments