মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৭
ঋষি দাস (সাহিত্যিক, অনুবাদক, গল্পকার, তমলুক)
ভাস্করব্রত পতি
তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাহিত্যপ্রেমী। অসাধারণ সাহিত্যরসিক। নিরলস সাহিত্যানুরাগী। অথচ এমন এক মানুষকে চেনেনা দুই মেদিনীপুরের বেশিরভাগ বিদগ্ধ মানুষই। নামই শোনেনি অনেকেই। অনেকটা প্রচারের অন্তরালে থাকা সাহিত্যিক ঋষি দাসকে চেনা দরকার। জানা দরকার।
১৯৫০ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি লিখেছিলেন উইলিয়াম শেক্সপীয়রকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ জীবনী বিষয়ক বই ‘শেক্সপীয়র’। ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানীর প্রহ্লাদ প্রামানিক ছিলেন প্রকাশক। অধ্যাপক নীরেন্দ্রনাথ রায় পুস্তকটির সুদীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন। ৩৮৪ পাতার এই বই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হত। পরবর্তীতে বইটির তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ১৯৫০, ১৯৬০ এবং ১৯৮০ সালে। মেদিনীপুরের ঋষি দাস ছিলেন সে সময়কার খ্যাতনামা লেখক। অথচ আজ অনেকেরই মনে নেই তাঁর নাম এবং কাজ।
১৯৫২ সালে বাংলাতে ব্রিটিশ সাহিত্যিক শেক্সপীয়ারের চর্চার জন্য গড়ে উঠেছিল ‘শেক্সপীয়র সোসাইটি’। তৎকালীন রাজ্যপাল আচার্য হরেন্দ্রকুমার মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে গঠিত হয় তা। সেই সোসাইটির সভ্য হয়েছিলেন উৎপল দত্ত, লীলা মজুমদার, সুবোধ সেনগুপ্ত, নীরেন্দ্রনাথ রায়দের সঙ্গে এই ঋষি দাসও।
তিনি এ রাজ্যের মধ্যে প্রথম শেক্সপীয়ারের জীবনীলেখক। কিন্তু চরম উপেক্ষার শিকার মুখলাজুক তথা প্রচারবিমুখ ছিলেন এই মানুষটি। ১৯৪১-৪৩ সালে দু'বছর ধরে দৈনিক ‘বসুমতী' পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তরে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন। সাহিত্যিক হিসাবে পরিচিত হয়েছিলেন। উপন্যাস, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, জীবনী সাহিত্য, অনুবাদ, লোককথা ইত্যাদি রচনায় তিনি দেখিয়েছিলেন মুন্সিয়ানা।
১৯১৮ র ২৭ শে এপ্রিল পূর্ব মেদিনীপুরের পুয়্যাদা গ্রামে জন্মেছিলেন তিনি। ছোট থেকেই সাহিত্যের প্রতি প্রেম ছিল অপার। সেই প্রেমই তাঁকে সাহিত্যসেবাতে অনুরক্ত করে তোলে পরবর্তীতে। দাদু নাম রেখেছিলেন 'ঋষভ'। কিন্তু নিজেই নাম পরিবর্তন করে রাখেন 'ঋষি'। ছোটবেলাতেই মা শৈলবালা দেবীর মৃত্যু হয় সাপের কামড়ে। বাবা বিনোদবিহারী দাস ছিলেন আমিন এবং জেঠু কুঞ্জবিহারী দাস ছিলেন সংস্কৃত বিশারদ। জেঠাইমা হরিপ্রিয়া দেবীর কাছেই বড় হওয়া ঋষির। প্রথমে হ্যামিল্টন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে বিদ্যাসাগর কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু স্নাতক হন রিপন কলেজ থেকে।
প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় 'দেশ' পত্রিকায়। ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৩ পর্যন্ত প্রচুর লেখা দেশ ছেপেছিল ঋষি দাসের। এখানে তাঁর প্রকাশিত গল্পগুলো ছিল মেঘছায়া (১৯৩৬), যেখানে এর যবনিকা (১৯৩৬), সারাদিনের ইতিহাস (১৯৩৭), বালুচর (১৯৩৭), পৃথিবীর হাওয়া (১৯৩৭), দিন ও রাত (১৯৩৭), অন্তরাল (১৯৩৮), পৃথিবীর হাওয়া (১৯৩৭), বহ্নুৎসব (১৯৩৮), বিভিন্ন সমাজ ও বিবাহ (১৯৩৮), দেবী (১৯৩৮), পুনরায় (১৯৩৮), যক্ষকন্যা (১৯৩৮) রক্তপ্রভাত (১৯৩৮), সৃষ্টিধর (১৯৩৮), ঐতিহাসিক (১৯৪২) এবং বদনের বউ (১৯৪০)। স্বাভাবিক ভাবেই অনুমেয় কি বিরাট মাপের গল্পকার ছিলেন তিনি সেসময়ে।
প্রথম জীবনে তিনি গল্প, নাটক, উপন্যাস লিখতে শুরু করলেও পরবর্তীতে তিনি নিমগ্ন হন অনুবাদ সাহিত্য এবং জীবনী সাহিত্য লেখার দিকে। হাঁটতে হাঁটতে বই পড়ার অভ্যাস তিনি রপ্ত করেছিলেন। ঋষি দাস কলকাতায় থাকতেন মৌলালীতে। আর খেতে যেতেন অখিল মিস্ত্রি লেনে এক বন্ধুর বাড়িতে। পুরো রাস্তাই যেতেন কিছু না কিছু পড়তে পড়তে!
মার্কসবাদী দর্শন তাঁর ভালো লাগতো। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেয়েছিলেন। সংগঠনের কাজে তিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরতেন। ১৯৭৭ এর নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, "আমি লেখক, লেখা নিয়েই থাকতে চাই"। আসলে রাজনীতির পঙ্কিল আবর্তে তিনি নিজের লেখক সত্বাকে বিকিয়ে দিতে গররাজি ছিলেন।
১৯৪০ সালে ঋষি দাসের লেখা নাটক 'দুয়ে দুয়ে বাইশ' প্রকাশিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক ছাত্রীদের জন্য ভাষা বিচিত্রা, বাংলা ব্যাকরণ বইয়ের লেখক তিনি। সে সব বই পড়ানো হ'ত বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। আধুনিক বাংলা অভিধান (১৯৬২), বাংলা উচ্চারণ যুক্ত অভিধান (১৯৯২) এবং বাংলা ইংরাজি অভিধান (১৯৯০)ও তিনি রচনা করেছিলেন। লিখেছেন উপন্যাস জেলেডিঙি (১৯৪২)।
মূলতঃ বিভিন্ন মহাপুরুষের জীবনচরিত লিখেছিলেন সাহিত্যের বেড়াজালে। কাজী নজরুল ইসলাম, গিরিশচন্দ্র, শরৎচন্দ্র, অরবিন্দ, গান্ধীজী, সুভাষচন্দ্র, বাল গঙ্গাধর তিলকদের তিনি পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালি পাঠকদের সাথে। বাংলা জীবনী সাহিত্য রচনায় তিনি আজও তাই অদ্বিতীয় ব্যক্তি। বিভিন্ন সময়ে তিনি জীবনীগ্রন্থ হিসেবে লিখেছেন বার্নাড শ (১৯৪৬), বিদ্যাসাগর (সেপ্টেম্বর, ১৯৭১), রাজা রামমোহন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, গান্ধীচরিত (চৈত্র, ১৩৭৬), শেক্সপীয়ার (১৯৫০), দেশনায়ক সুভাষচন্দ্র, শরৎচন্দ্র (১লা বৈশাখ, ১৩৯৪), বাদশা খান, শ্রীরামকৃষ্ণ, স্বামী বিবেকানন্দ, মাদাম কুরি, পাভলভ, ম্যাক্সিম গোর্কি, সিস্টার নিবেদিতা, স্যার আইজ্যাক নিউটনদের নিয়ে নানা মহামূল্যবান গ্রন্থ। ঋষি দাসের লেখনীর গুণে বহু অনুবাদ গ্রন্থ পেয়েছিল পাঠক সমাজের সমীহ। অশোক প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘বিদ্যাসাগর' বইটির প্রচ্ছদ শিল্পী ছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। লিও টলস্টয়ের লেখা 'টুয়েন্টি টেলস' থেকে নির্বাচিত গল্প অবলম্বনে তিনি অনুবাদ করে লেখেন 'করেশাসের বন্দী' বই। তেমনি জিম করবেটের আত্মজীবনীর অংশ লেখেন 'মৃত্যুর মুখোমুখি'। তাঁর লিখিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রয়েছে লেনিনের সঙ্গে গোর্কি, আরব্য রজনীর গল্প, গ্রীসের রূপকথা (১৯৭৭) ইত্যাদি। ১৯৬১ তে 'সোভিয়েত দেশের ইতিহাস' লিখেছেন। তিনি ভালোবাসতেন রাশিয়ান সাহিত্য। তাই রুশ ভাষা শিখেছিলেন। ১৯২৬ এ নোবেল জয়ী সাহিত্যিক গ্রাতসিয়া দেলেদ্দার লেখা থেকে শুরু করে ম্যাক্সিম গোর্কির বাইস্ট্যাণ্ডার (প্রথম খণ্ড), আলেকজান্ডার কুপরিনের 'ইয়ামা দ্যা পিট' অনুবাদ করেছিলেন তিনি।
২০০২ এর ১৭ ই সেপ্টেম্বর শরৎ সমিতির পক্ষ থেকে ঋষি দাসকে "শরৎ পুরস্কার" বাবদ ১০ হাজার টাকা এবং মানপত্র তুলে দেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। ‘শরৎচন্দ্র' নামে তাঁর লেখা বই ১৯৭০ এ প্রকাশিত হয় অশোক প্রকাশন থেকে। দাম ছিল কুড়ি টাকা।
শেষ জীবনে তিনি পড়তে পারতেননা, শুনতেও পেতেননা। দেখতেও পেতেননা ঠিকমতো। কিন্তু উপলব্ধি করতে পারতেন। চিনতে পারতেন মানুষের মন। অথচ ‘বাক্ দেবী” সদয় না হওয়ায় বয়ঃভারে নুজ মানুষটি হাতে তুলে নিতে পারেননি কলম। অবশেষে ২০১৩ এর ২১ শে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ দিবসের দিন এই ভাষা কারিগর চিরতরে হারিয়ে গিয়েছেন এই মানববিশ্ব থেকে।
ঋষি দাসকে নিয়ে আরও কাজ আমাদের করা উচিত ছিল। তাঁর রচনাসমগ্র নতুন করে প্রকাশিত হলে বর্তমান প্রজন্ম ঋষি দাসকে চিনতে পারতো। কিন্তু হয়ে ওঠেনি আজও। ঋষি দাস আজ আমাদের লোকচক্ষুর অন্তরালেই রয়ে গিয়েছেন। মেদিনীপুরের মানুষ রতন হয়েও তাঁর জন্য জোটেনি এইটুকু সম্মান।
1 Comments
একটা জরুরি কাজ করলেন।
ReplyDelete