জ্বলদর্চি

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। একত্রিশ /শুভঙ্কর দাস

মাটিমাখা মহাপ্রাণ। একত্রিশ

শুভঙ্কর দাস 

"নির্ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে পড় অজানিতের পথে
জাগাবে ততই শক্তি যতই হানবে তোরে মানা
অজানাকে বশ করে তুই করবি আপন জানা।
চলায় চলায় বাজবে জয়ের ভেরী---
পায়ের বেগেই পথ কেটে যাবে,করিস না দেরি।"


জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে আছেন রাসবিহারী।
সঙ্গে উপস্থিত একদল সেবাকর্মী।
এছাড়াও সেবাজনিত কাজের জন্য জিনিসপত্র,ঔষধ এবং কিছু খাবারদাবারের রেশন।
একটু পরে হোরমিলার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির জাহাজ ছাড়বে।
গন্তব্য গঙ্গাসাগর।
এই স্বেচ্ছাসেবকদলের নেতা কুমারচন্দ্র জানা এখনও উপস্থিত হয়নি।তার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে। 
একটু পরে দেখা গেল,একটি বয়স্ক লোক কুমারচন্দ্রের কাঁধে হাত দিয়ে ধীরেসুস্থে হেঁটে হেঁটে আসছেন,সঙ্গে দুটি স্ত্রীলোক এবং একটি শিশু।
অর্থাৎ সেই কলেরা থেকে বেঁচে ফেরা রোগীও এই জাহাজে তীর্থ করতে যাবে।
শরদিন্দু জিজ্ঞেস করলেন,আচ্ছা,এদের যাওয়ার কি পারমিশন পাওয়া যাবে?
রাসবিহারী বলে উঠলেন, তা জানি না,তবে কুমারবাবু যেখানে আছেন,সেখানে এদের আটকায় কার সাধ্যি?

আচ্ছা, এঁরা কে হন কুমারবাবুর?

কেউ নয়।

মানে?

মানে কিছুই নয়, তুমি কি ঘটনাটি জানো না?

না,বলো শুনি 

শোনো তবে

কুমারবাবু শ্রদ্ধানন্দ পার্কে একটি মিষ্টির দোকান দিয়েছিলেন। যাতে এই ব্যবসা করে কিছু অর্থের মুখ দেখা যায়। শ্রদ্ধানন্দ পার্ক চেনো তো?  ঐ যে ঐখানে সুভাষ বসুর সভাপতিত্বে গান্ধিজি বিলাতি কাপড়ের স্তূপে আগুন ধরিয়েছিলেন।

হ্যাঁ,চিনি, চিনি, তারপর

তারপর আর কী? সেই আন্দোলনের সভায় কুমারবাবুও ছুটে যান

আর মিষ্টিদোকান?

সে রইল পড়ে,এরপর এক সপ্তাহ সেই আন্দোলনে যুক্ত হয়ে মিষ্টি ব্যবসা মাথায় উঠল।

তারপর? 

তারপর আবার এসে ব্যবসা শুরু, বেশ চলছিল,একদিন বিকেলবেলা একজন বয়স্ক লোক ঠিক মিষ্টি দোকানের সামনে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ল। লোকটি ফুটপাত থেকে গড়িয়ে রাস্তায় চলে গেল।কুমারবাবু সেই সময় দোকানের ভেতরে খদ্দেরদের এঁটো থালাবাসন ধুয়ে রাখছিলেন। তিনি শব্দ শুনে ঘুরে পড়েন, এই অবস্থা দেখে বাসন ফেলে ছুটে এলেন।লোকটিকে ধরাধরি করে মিষ্টিদোকানের বেঞ্চিতে বসালেন।লোকটির থুতনি ও ডানহাতের সামনর অংশ কেটে গেছে।রক্ত পড়ছে। কুমারবাবু দোকানের মধ্যে সর্বদা একটা ফাস্টএইড বক্স রাখতেন। তা থেকে তুলো ও ঔষধ  বের করে এনে নিজেই সেবা করতে লাগলেন।
শেষে আমাকে ডেকে পাঠালেন।
আমি গিয়ে চিকিৎসা করি।
লোকটির ক্ষয়রোগ আছে। যতটা না বয়স,তার বেশি বুড়িয়ে গেছে।
কথায় কথায় জানা গেল,তার আসল বাড়ি কাকদ্বীপ। গঙ্গাসাগরের কাছেই। দীর্ঘদিন কলকাতায় কাজের সূত্রে আছেন। সঙ্গে এসেছিল৷ নিজের ভাই। সে মহানগরের এসে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, একটু চোখটোখ খুলতেই একেবারে বদলে যায়। দাদাটি মানে অসুস্থ লোকটি কলকাতায় কাজের সঙ্গে সঙ্গে নানা সামাজিক কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। গোরক্ষা সভার সদস্যও ছিল। কিন্তু তাঁর লায়েক ভাইটি সব সম্পত্তি নিজের নামে চালাকি করে লিখে নিয়ে নিজের মা,দাদা,দাদার স্ত্রী, একমাত্র পুত্রকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে।
তারপর বাস করত ফুটপাতে।একদিন ছোট্ট ছেলেটি জ্বর হয়।তখন লোকটি ছেলেটার জন্য ঔষধ নিতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যান কুমারবাবুর দোকানের সামনে।

তারপর? 

তারপর সেই ছেলেসহ পরিবারকে কুমারবাবু যে বোডিং হাউস খুলে ছিলেন,সেখানেই একটি ঘরে থাকার বন্দোবস্ত করে দেন।ছেলেটা সুস্থ হতে পিতাটি কুমারবাবুর হাতে ধরে বললেন,আপনারা শুনলাম গঙ্গাসাগর যাচ্ছেন,আমাদের সঙ্গে নিন,বহুদিন দেশবাড়ি যাইনি,একটিবার যেতে পারলে বেঁচে যেতাম। বয়স্ক মার শেষ ইচ্ছে ভিটেমাটি ছুঁয়ে শেষকটা দিন বাঁচবেন।

তাতে কুমারবাবু রাজি হলেন।

কেন রাজি হলেন কুমারবাবু? রাসবিহারী ও শরদিন্দু একসঙ্গে জিজ্ঞেস না করে পারে না! মানুষ তো তার নিজের রক্তের আত্মীয়ের জন্য এমন সেবা, এমন ব্যবস্থা কি করতে পারে? করে না! তাহলে কুমারবাবু কী ধাতুতে গড়া!

কুমারবাবু নীরব।

না,না,চুপ থাকলে হবে না,বলুন, এদের জন্য কেন আপনি এতো মরিয়া হয়েছেন?

তারপর কুমারচন্দ্র মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,

"যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন
সেইখানে যে চরণ তোমার বাজে
সবার পিছে, সবার নিচে
সব-হারাদের মাঝে 
যখন তোমায় প্রণাম করি আমি
প্রণাম আমার কোনখানে যায় থামি।
তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে
সেথায় আমার প্রণাম নামে না যে
সবার পিছে,সবার নীচে
সব হারাদের মাঝে"

তাঁর বলার ধরণ অভিভূত করে দিল রাসবিহারী ও শরদিন্দুকে।
শরদিন্দু বলে উঠলেন, এতো গীতাঞ্জলি।

ঠিক, এই গীতাঞ্জলি কিনে পড়ার পয়সা একদিন ছিল না,তখন এই বয়স্ক লোকটি কলেজ স্টিটে কিনে আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন,আমি আজও তা ভুলিনি!  বলতে পারিস,এ এক অঞ্জলি,কৃতজ্ঞতা অঞ্জলি। 

রাসবিহারী ও শরদিন্দু কোনো শব্দ উচ্চারণ করলেন না।

শরদিন্দু কুমারচন্দ্রকে যত দেখছেন,ততবেশি অবাক হচ্ছেন। এ কী ধরণের স্বাধীনতা সংগ্রামী! এই সময় দেশে একটা বেশ ডামাডোল তৈরি হয়েছে। একদিকে নরমপন্থী কংগ্রেসী দল, অপরদিকে চরমপন্থী কংগ্রেসী দল। একদিকে গান্ধিজি, অপর দিকে চিত্তরঞ্জন দাশ। অবশ্য আরও একটি দল আছে,যাঁরা বন্দুক, বোম এবং সরাসরি প্রতিশোধের জন্য প্রস্তুত। শুধু অন্যের প্রাণ নেওয়া নয়, নিজের প্রাণ বিসর্জন করতে পিছপা নয়! ফাঁসির মঞ্চে এমন হাসিমুখে উঠে যাচ্ছে, যেন এই স্থান স্বর্গের চেয়েও সুন্দর এবং আকাঙ্ক্ষিত। এঁদের পাশে অদ্ভুত কুমারচন্দ্র জানা। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের মেধাবী ছাত্র,অথচ কথাবার্তা আচার-আচরণ সবই যেন অজপাড়াগাঁয়ের ধুলোমাটি লেগে আছে। 
তাঁর চোখে স্বাধীনতা আন্দোলন একেবারে অন্যরকমের।তিনি যেন সেবাসৈনিক। যেখানে মানুষের দরকার,মানুষের প্রয়োজন, সেখানে তিনি ছুটে যান নিঃস্বার্থ, নিরলস কর্মী হিসেবে।অসহায়,দরিদ্র, নিঃসম্বল মানুষের জন্য কাজ করতে পারলে যেন প্রাণে মুক্তির স্বাদ পান। এমন নয় যে শুধু কলকাতার কোনো স্থান,দূরে কোনো মফস্বলি গ্রামের মানুষের জন্য অসুখে-বিসুখে, আপদে-বিপদে ছুটে চলে যাচ্ছেন কুমারচন্দ্র। শরদিন্দু বুঝে উঠে পারেন না,এ কেমন স্বাধীনতা সংগ্রাম?  এ কেমন ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়াই!
অন্য নেতারা যেখানে সারাদিন কোট-সুট-বুট পরিধান করে, কিন্তু কংগ্রেসী সম্মেলনের মঞ্চে উঠলেই পোশাক পরিবর্তন হয়ে যায়,তখন খদ্দেরের ফতুয়া-ধুতি ও মাথায় টুপি পরে বক্তব্য দেয়,প্রস্তাব রাখে,বেশির ভাগ কথা ইংরেজিতে বলার চেষ্টা করেন এবং সাংবাদিকরা যেদিকটায় বসে থাকে,সেই দিকে লাফালাফি বেশি মাত্রায় করে থাকেন।
অথচ কুমারবাবু কী মাটিতে, কী মঞ্চে, কী গুরুত্বপূর্ণ কংগ্রেসী মিটিং-এ অতি অল্পদামের ফতুয়া-ধুতি এবং পায়ে চপ্পল।হাতে একটি ছোট্ট পকেট সাইজের গীতা। এই সময় আবার দেখা যায়,তকলি। 
সময়ে সময়ে সুতো কাটছেন।
কেউ জিজ্ঞেস করলে,কী কুমারদা, দেশের কী কাজ এখন হচ্ছে? 
কুমারচন্দ্র মৃদুহেসে উত্তর দিতেন,এই গতরাতে হাসপাতালে রাত জেগেছি,দুজন কলেরা রোগীর জন্য, এখন একটু ঘুমিয়ে নেব।
এ আবার কী ধরণের স্বাধীনতা সংগ্রাম?
তারপর নদীতে স্নান সেরে এসে স্থির হয়ে গীতা পাঠ করতেন।
সহসা পাঠের মাঝখানে বলে উঠতেন,ভাইরে,যে দেশে রেস্তোরাঁর বাইরে নোটিশ ঝোলানো থাকে, কালো চামড়া আর কুকুরের প্রবেশ নিষেধ। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি, সেই দেশের কালো চামড়াগুলো মানুষের সম্মান দিতে,সেবা ও সহযোগিতার মাধ্যমে, যাতে কুকুরের সঙ্গে তাদের পার্থক্য কী, তারা নিজেরাই বুঝতে পারে।
এমন বিস্ময়কর কথা শুনে শরদিন্দুসহ সকলেই স্তব্ধ হয়ে যেতেন। তাঁরা এটুকু বুঝতে পেরেছেন,কুমারচন্দ্রের কর্মপ্রণালী যতখানি তাঁরা ছোট ও অতি সাধারণ ভেবেছিল,তা আসলে নয়। তাঁর প্রতিটি কর্মধারায় সুগভীর বোধ, শিক্ষা এবং নির্মাণ কাজ করছে।
এতো সন্নাসীর কর্মযোগ।
এ যেন স্বামী বিবেকানন্দের সেই আলোকময় ভাবনা,"
" বহুজনহিতায় বহুজনসুখায় সন্ন্যাসীর জন্ম।পরের জন্য প্রাণ দিতে,জীবের গগনভেদী ক্রন্দন নিবারণ করতে, বিধবার অশ্রু মুছাতে,পুত্র-বিয়োগ-বিধাবার প্রাণে শান্তিদান করতে,অজ্ঞ ইতরসাধারণকে জীবনসংগ্রামের উপযোগী করতে,সকলের ঐহিক ও পারমার্থিক মঙ্গল করতে এবং জ্ঞানালোক দিয়ে সকলের মধ্যে প্রসুপ্ত ব্রহ্মসিংহকে জাগরিত করতে জগতে সন্নাসীর জন্ম হয়েছে। "
এই কথাই তো নীরবে দৃঢ়তায় কুমারচন্দ্র পালন করে চলেছেন।

একদিন মিষ্টিদোকানে কাজ করতে করতে হাতে আসে একটি দৈনিক পত্রিকা। তাতে বর্ণিত গঙ্গাসাগরে তীর্থাভিলাষী  মানুষজনের কী কষ্ট, কী দুঃখ এবং কী অপরিমাণ অসহায়তা।এবং তাদের সেই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে কতিপয় বদমাস-ইতর-শয়তান নানারকমভাবে ঠকিয়ে এবং লুটপাট করে একেবারে নরকগামী করে দিচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন,একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুত্র,  তার মায়ের কলেরা হয়েছে বলে, সেই বালির তটের ওপর ফেলে দিয়ে চলে গেছে। লোকটির মা কখন মারা গেছে, কেউ জানে না! রাতে কুকুর-শেয়াল টানা হিঁচড়ে করে তার একটি হাত কেটে নিয়ে গেছে।
তারপর পথকষ্টে সদ্য মৃত মাতৃহীন শিশুকন্যাকে দুষ্টরা তুলে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিয়েছে এবং রাতের বেলায় একটি নৌকার খোলের ভেতর একটি কিশোরীকে তিনজন পুরুষ ইতর তার সঙ্গে এমন নোংরা আচরণ করেছে,তার জ্ঞান পর্যন্ত ছিল না। সকালে সেই কিশোরকে নদীর জলে ভাসতে দেখা যায়!
এরপর আছে যাতায়াতের নিদারুণ কষ্ট ও যন্ত্রণা। 
এমন হয়েছে অসংখ্য তীর্থযাত্রী পথকষ্টে, চোর-ডাকাত-ঠগীদের আক্রমণ, নদীতে নৌকাডুবি প্রভৃতি কারণে গঙ্গাসাগরে পৌঁছাতে পারে না।
তাই লোকে বলে, "সব তীর্থ বার বার, গঙ্গাসাগর একবার"
সেই সঙ্গে এও বলে,তীর্থ তীর্থ মাথায় থাকুক,বাঁচা-মরার ধার!
গঙ্গাসাগরে পা দিলেই প্রাণটি পগারপার! 
 
এইসব পড়ে কুমারচন্দ্রের চোখে জল এসে গেল।মানুষের নীচতা ও কুশ্রীতা অপর মানুষের জীবন কতখানি বিপদ-কষ্ট ডেকে আনে,তা কি মানুষ বোঝে না! তিনি মুখে শুধু উচ্চারণ করলেন,

"আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন
সুখং বা যদি দুঃখং স যোগী প্রমো মতঃ "

( হে অর্জুন,যিনি সমস্ত জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখ বলে সমানভাবে দেখতে জানেন,আমার মতে তিনিই শ্রেষ্ঠ যোগী।)

তিনি এক সপ্তাহের মধ্যে একটি স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করে গঙ্গাসাগরের উদ্দেশ্য রওনা দিচ্ছেন।

গঙ্গাসাগর।
স্কন্দপুরাণ অনুসারে দান,ধ্যান,পূজার্চনা, তীর্থভ্রমণ,কঠোর তপস্যা ও যাগযজ্ঞ --- সবকটির মিলিত পুণ্যফল একবার গঙ্গাসাগরের অবগাহনের সমান।মহাভারতে দেবর্ষি নারদ যুধিষ্ঠিরকে বলেছেন,দশটি অশ্বমেধ যজ্ঞের সমান পুণ্য একটিবার মাত্র গঙ্গাসাগর স্নান।
গঙ্গা পতিতোদ্ধারিণী।
কাশীর গঙ্গার জলে ও স্থলে মোক্ষ।
কিন্তু গঙ্গাসাগরে মোক্ষ জল-স্থলে-অন্তরীক্ষের সর্বত্র। 
সেই পরম পুণ্যতোয়া জলের তীরে এমন নোংরামি ও অসভ্যতা কেন? 
মানুষের মধ্যে লালসা-রিরংসা, লোভ-প্রতিহিংসা আছে সত্যি, কিন্তু তীর্থভূমিতে কেন তা জাগ্রত হবে?

আচ্ছা, কুমারবাবু,গঙ্গাসাগরের মাহাত্ম্য কী?
প্রশ্ন করলেন রাসবিহারী। 
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে কথোপকথন চলছে কুমারচন্দ্রকে ঘিরে। 
সঙ্গে আছেন,শরদিন্দু, শিশির,নিকুঞ্জবিহারী প্রমুখ। 

কুমারচন্দ্র বলে উঠলেন, 

সে তো সগররাজার কাহিনি।
অধোয্যার ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজা সগর। সগর শব্দটি অর্থ কী জানো? 'গর' মানে বিষ, বিষযুক্ত।সগর যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁকে বিষ দিয়ে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়।কিন্তু তিনি বেঁচে যান।সেই সগরের দুই পত্নী।কৈশনী ও সুমিতা।
কৈশনীর গর্ভে জন্মায় একটি অপদার্থ পুত্র অসমঞ্জ। আর সুমতির গর্ভে ষাট হাজার সন্তান।
প্রজাপীড়ক, অত্যাচারী অসমঞ্জ কুখ্যাত। তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন।
কিন্তু অসমঞ্জের পুত্র অংশুমান ধীর স্থির এবং শক্তিশালী। 
সগর রাজা অশ্বমেধ যজ্ঞের আয়োজন করেন।এই যজ্ঞ সুসম্পন্ন হলে সগরের জন্য স্বর্গদ্বার হবে উন্মুক্ত। এবং দেবতাদের সঙ্গে একাসনে বসতে পারবেন।এই কথাটি ইন্দ্রের সহ্য হল না।তাঁর মনে হল,একটা পুঁচকে সাধারণ মানুষের এতোখানি ক্ষমতা হবে।তাই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে ইন্দ্র অশ্বমেধের ঘোড়াটি চুরি করে কপিলমুনির আশ্রমে লুকিয়ে রাখেন। এদিকে ঘোড়াটির কোনো সন্ধান না পেয়ে সগরের অবস্থা করুণ। তাঁর যজ্ঞের আয়োজন নষ্ট হয়ে যাওয়ার অবস্থা। যজ্ঞ অসম্পূর্ণ হলে স্বর্গে প্রবেশের চাবিকাঠি ফস্কে যাবে। হতাশায় একেবারে নিমজ্জিত হলেন সগর।
কী উপায়?
তখন সগর তাঁর ষাট হাজার পুত্রকে ঘোড়ার অন্বেষণে পাঠালেন।সগর সন্তানরা নানা স্থান দাপাদাপি ও হল্লা করে শেষে পৌঁছায় শান্ত সুন্দর কপিল মুনির আশ্রমে। 
সেখানে গিয়ে দেখল ঘোড়াটি আশ্রমে বাঁধা। তখন তারা বুঝল, তাহলে কপিল মুনি চোর।তাদের পক্ষে ইন্দ্রের চালাকি ধরা সম্ভব ছিল না।
সগরপুত্রগণ আশ্রমে তাণ্ডব চালাতে লাগল।এবং কপিল মুনিকে উত্তম মধ্যম দিতে গেল।এই দুর্বিনীত আচরণ কপিল মুনি সহ্য করতে পারলেন না।সকলকে একসঙ্গে ভস্ম করে দিলেন।
তখন সগর অংশুমানকে বললেন,যাও দাদুভাই, তোমার পিতৃব্যদের খুঁজে নিয়ে এসো।
অংশুমান কপিল মুনির আশ্রমে যান এবং সবকিছু জ্ঞাত হয়ে ঘোড়াটি নিয়ে ফেরেন।যজ্ঞও সম্পন্ন হয়। কিন্তু সে ষাট হাজার পুত্রকে ফিরিয়ে আসনে পারলেন না।
তাই সগর রাজার দুঃখের অন্ত ছিল না।
তিনি স্বর্গারোহনের সকল সুবিধাকে গ্রহণ করলেন না,সর্বদা বিলাপে কষ্টে দিনাতিপাত করতে লাগলেন।
তখন পুত্র ফিরে পাওয়ার উপায় জানলেন,একমাত্র স্বর্গ থেকে গঙ্গাকে আনয়ন করলেই ষাট হাজার পুত্রের মুক্তি ঘটবে।
এ অতি দুরূহ কর্ম।
ত্রিশ হাজার বছর অপেক্ষা করে সগর স্বর্গ চলে গেলেন।
তারপর অংশুমান সিংহাসনে বসে সেই কাজ সম্পন্ন করতে পারলেন না।
এলেন তাঁর পুত্র দিলীপ চেষ্টা করলেন। ব্যর্থ হলেন।
তারপর এলেন ভগীরথ। 
তিনি সাধন শুরু করলেন।
তাঁর ছিল মন্ত্রের সাধন কিংবা শরীর পাতন।
ভগীরথের সাধনায় তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা গঙ্গাকে আনার জন্য অনুমতি দিলেন।
কিন্তু সরাসরি স্বর্গ থেকে গঙ্গা পৃথিবীতে এলে গোটা বসুন্ধরা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে গঙ্গার স্রোতপ্রলয়ে। তাই ভগীরথ শরণাপন্ন হলেন মহাদেবের।
তিনি যদি তাঁর জটায় স্বর্গ থেকে আসা গঙ্গাকে জটাকে ধারণ করে, তারপর গতি নিয়ন্ত্রণ করে ছাড়েন,তাহলে সবদিক রক্ষা হয়। 
ভগীরথের কাতর প্রার্থনায়,তাই করলেন মহাদেব। 
এবং সেই পুণ্যসলিলা গঙ্গার স্পর্শে তিন পুরুষ ধরে ছাইভস্ম হয়ে পড়ে থাকা সগর রাজার পুত্ররা শাপমুক্ত হন।
মহাদেবের জটা থেকে গঙ্গা যে স্থানে পড়েন,তাই গঙ্গাসাগর।
সেই পুরাণপ্রতিত পুণ্যস্থানে এমন সব ঘটনা ঘটে,এমন সব মৃত্যু ঘটে, এমন সব নোংরামি হয়, তাতে নিজেদের মুখ দেখাতে লজ্জা লাগে।

সত্যি তাই, তীর্থস্থানের মর্যাদা ও ঐতিহ্য কেউ বোঝে না,বলে উঠলেন রাসবিহারী। 

কুমারচন্দ্র সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন,এ-র জন্য চাই পড়াশোনা, নিজের দেশের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরম্পরা জানতে হয়, কজন তা করেন? কজন গঙ্গাসাগরের মাহাত্ম্য বোঝেন!
গঙ্গাসাগরে কেন যাই জানো? দিনরাত সেখানে কাজ করার চেষ্টা করি,সাধ্যমতো সেবা করি,ঐতিহ্য ও পরম্পরার প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস তুলে ধরি,তার কারণ এখানেই বেশি লোক সমাগম হয়।এই মেলার সময় এ-ই সুবিস্তীর্ণ বালিতট একটা ভারতবর্ষ হয়ে ওঠে,এখানে যদি সমুদ্রের জল থেকে মন্দিরের সিঁড়ির ধাপ পর্যন্ত যদি পবিত্র, স্বচ্ছ এবং শ্রদ্ধাময় রাখতে পারি,দেশ জাগানোর কাজ অনায়াসে হয়ে যাবে। মানুষ যখন বুঝবে তীর্থস্থান সত্যি সত্যি দেবতার গৃহ হয়ে উঠেছে,তখন তাদের নিজেদের দেশের প্রতি দৃষ্টি যাবে,আগ্রহ জন্মাবে এবং এই তীর্থ থেকেই দেশের জন্য কাজ করতে এগিয়ে আসবে।

এভাবে ভেবেছেন কুমারবাবু, আপনি তো সত্যি সত্যি দেশসেবক, আপনাকে দেখে শিখছ, কীভাবে ধুলোয় মধ্যে দাঁড়িয়ে একটা দেশ নির্মাণের ডাক দেওয়া যায়! 

এসব ছাড়,বলে উঠলেন কুমারচন্দ্র, আগে এইলোকগুলোকে সুস্থ করে তোলো,জাহাজের মধ্যে কিছু যাত্রী কলেরার জন্য অসুস্থ হয়ে পড়েছল। তাদের জন্য চিন্তা থেকে কুমারচন্দ্র অস্থির হয়ে আছেন।

গঙ্গাসাগর।

প্রচুর লোক সমাগম। 
চারিপাশে তিল ধারণের জায়গা নেই। 
অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে শিশু,সাধারণ বাড়ির গৃহবধূ থেকে জমিদারের নর্তকী, মন্দিরের পুরোহিত থেকে নানা রকমের দালাল,মণিহারী দোকান থেকে খাওয়ার হোটেল, সব মিলিয়ে এক বিরাট অদ্ভুত সম্মিলন।
মন্দিরের ঠিক উলটো দিকে মুখোমুখি নানারকম ক্যাম্প তৈরি হয়েছে।

সেখানেই কুমারচন্দ্রের দলবল উপস্থিত। 
একটু ফাঁকা জায়গা পেতেই তার ওপর 
তীর্থযাত্রীদের জন্য সারিবদ্ধ ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছে। চিকিৎসা,ঔষধ প্রদান,পানীয় জলের ব্যবস্থা করা, নিরুদ্দিষ্টদের খুঁজে দেওয়া,বালির স্থান পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন রাখা, কেউ কোনো বদমাসি-লোক ঠকানো করলে তার শাস্তি বিধানের ব্যবস্থা হয়েছে। কপিল মুনির আশ্রম থেকে সাগরতটের শেষবিন্দু পর্যন্ত স্বেচ্ছাসেবক দলের ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ করছে। একই সঙ্গে মাড়োয়ারি রিলিপ ফান্ড এবং বজরং পরিষদও কাজ করছে।
রাত্রি বারোটা।
ক্যাম্পের সদস্যগণ সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত। তাদের এবার একটু বিশ্রামের সময়।
কিন্তু দেখা গেল কুমারচন্দ্র একটি চৌদ্দ পয়া মোটা ও শক্ত লাঠি হাতে নিয়েছেন এবং পশ্চিমী বিহারীদের মতো মাথায় একটা গামছা বেঁধেছেন

রাসবিহারী জিজ্ঞেস করলেন,কী কুমারবাবু,এতো রাতে কোথায় যাচ্ছেন?

এখনই তো আসল কাজ শুরু ভাই

মানে?

মানে হল,অনেকে আছে, তারা দিনের বেলায় পুণ্যভূমি মনে করে,কিন্তু রাত হলেই তীর্থস্থানের মতো সহজ পাপভূমি আরও নেই!  তারা সেই সব কাজে এতোখানি দক্ষ ও দুঃসাহসিক, এই পবিত্র স্থানের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে পারে না! তাদের বোঝাতে চাই,দিন হোক বা রাত, তীর্থস্থান মানে পবিত্রভূমি।এখানে মানুষের  ক্ষতি করা মানে ঈশ্বরের অপমান করা।
বলেই বেরিয়ে গেলেন।
কুমারচন্দ্র সতর্ক ও বিনিদ্র চোখে গোটা গঙ্গাসাগর ঘুরে বেড়াতেন।
এই সময় একটি ঘটনা ঘটল।
ক্যাম্প থেকে বেশ দূরে একটি কীর্তণের আসর বসেছিল।সেখানে বেশ কয়েকটি হ্যাজাক আলো জ্বলছিল। 
তারপরেই বেশ অন্ধকার। 
কুমারচন্দ্র দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কীর্তণের সুর শুনছিলেন। সহসা একটা জিনিস তাঁকে খটকা দিল।
তিনি কীর্তণের আসর ত্যাগ করে ছোট ছোট মঞ্চের পেছনে চলে গেলেন।সেই দিকটি খুবই অন্ধকার। সেই অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে তিনি দেখতে পান,একটি ভারি বস্তাগোছের কিছু দু'জন লোক তুলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
তিনি সতর্ক হয়ে তাদের পিছু নিলেন।
সামনের বালির স্থান শেষ হতে একটা বিরাট ঝোপজঙ্গল পড়ল।
সেই জঙ্গলের মধ্যে একটা আলো দেখা গেল। সেখানে আরও চারজন-পাঁচজন লোক আছে।
একটি খড়ের ছোট গাদা,তার পাশে মাটিতে তিনটি হ্যারিকেন জ্বলছে। একটি ঝুলছে গাছে।
একটি স্বাস্থ্যবান যুবক সেই গাদার ওপর বসে।গলায় সোনার হার চকচক করছে।চোখের দিলে তাকালেই দেখলেই বোঝা যায়,কোনো জমিদারের বকে যাওয়া কুলাঙ্গার। এবং বাইরে স্বাস্থ্য দেখালেও, কোনো ক্ষয়রোগে অতি দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। 
তার পায়ের কাছে একটি মহিলা মাথা নিচু করে কাঁদছেন।
সেখানে গিয়ে রাখা হল বস্তাটা।

সেই দুজন বহনকারী রেখে পাশে সরে গেল।
ক্রন্দনরতা মহিলা সেই বস্তাটি দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। 
ওরে বিনু, মারে তোকে বাঁচাতে পারলাম না!

যুবকটি দাঁত কিড়মিড়িয়ে হেসে উঠল।
তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,আমার চোখে একবার পড়লে,আমার ভোগে না যাওয়া পর্যন্ত নিস্তার নেই, ভগবানও বাঁচাতে পারবে না!

তারপর নিজেই বস্তার মুখ খুলতে গেল।

বহনকারীর একজন বলল,হুজুর, চালাকি জানেন এই মাগীর, মেয়েটাকে কীর্তণীয়া সাজিয়ে রেখেছিল,মোরা ঠিক তক্কে তক্কে ছিলাম,আপনি যার ওপর নজর দিয়েছেন,সে যে সুন্দরী হবে জানতাম,কিন্তু এ যে পরী, একেবারে ডানাকাটা পরী।
দেখুন।

চোপ শালা,আমার নজর করা জিনিস তুই উপমা দিস,এদিকে আয়

সেই বহনকারী কাছে গেলো,বাধ্য কুকুরের মতো।তারপর যুবকটি গ্যাঁক করে তার পেটে লাথি মারল।
দূর হয়ে যা,চোখের সামনে থেকে,আমার জিনিস, আমি দেখব, উপমা দেবো, রতন, রতন 

বলা মাত্র অপর একটি লোক মদের গ্লাস নিয়ে উপস্থিত হল।যুবকটি তা পান করে বস্তাটি খুলে ফেলল।তার ভেতর থেকে একজন নারীকে দেখা গেল,যার মুখ বাঁধা।
মেয়েটির মা আবার যুবকটির পায়ে পড়ল,একে ছেড়ে দিন বাবু,মোর মেয়ের গানের গলা ভালো, ঠাকুরের গান করে, ও সত্যি বড় হবে,এইভাবে নষ্ট করবেন নিকো... 

গান করে,বেশ আমি ওর ঠাকুর,আমাকেই গান গেয়ে সন্তুষ্ট করলেই হবে।
বলেই যুবকটি মেয়েটির মাকে দুহাত দিয়ে সজোরে ঠেলে দিল।
সেই মুহূর্তে কুমারচন্দ্র উপস্থিত হল।
তিনি প্রথমে মেয়েটির মাকে তুলে ধরে জিজ্ঞেস করলেন,কোথায় লাগেনি তো মা আপনার?

মেয়েটির মা চোখ বিস্ফারিত করে কুমারচন্দ্রকে দেখছে। এই রকম স্থানে সহসা কোনো লোক যে আসতে পারে,বাঁচাতে পারে,তার জানা ছিল না।
কারণ এই গঙ্গাসাগর অঞ্চলে সৎ ও পরোপকারী চন্দ্রকান্ত জমিদারের একমাত্র পুত্র একেবারে বাপের বিপরীত। তার মতো দুর্মুখ ও অসভ্য লোকের মুখোমুখি হওয়ার সাহস কেউ দেখাতে পারেনি! 
বাপ সেই জন্য তাকে ত্যাজপুত্র করেছেন। 
এরই ভয়ে মেয়ের ইজ্জত-সম্ভ্রম বাঁচাতে মন্দিরের কাছে আশ্রয় নিয়েছে।কিন্তু শেষে ধরা পড়ে গেছে। 
কুমারচন্দ্র সরাসরি সেই লম্পট যুবকটির সামনে দাঁড়াল।
কঠিন স্বরে বললেন,ওকে ছেড়ে দাও।
যুবকটি একটু ভড়কে গেল।
তারপর স্থির হয়ে বলে উঠল,যদি না ছাড়ি,কী করবে তুমি? 
কুমারচন্দ্র কোনো উত্তর না দিয়ে, সেই বস্তা খুলে মেয়েটিকে বের করলেন।
যুবকটি চিৎকার করে উঠলেন, রতন, রতন। 
রতন নামক লোকটি একটি লাঠি নিয়ে দৌড়ে এসে সেটি কুমারচন্দ্রের বাহু লক্ষ্য করে প্রহার করল।
লাঠিটি আঘাত করা মাত্র সেটি দুটি ভাগে ভেঙে একটি ছিটকে সেই জমিদারতনয় যুবকটি মুখে গিয়ে লাগল। এতো দ্রুত ঘটনাটি ঘটল,যে জমিদারের পুত্রটি মাথা সরাবার সময় পেল না!
তার নাক ফেটে রক্ত বের হল।
তারপর কাটা কলা গাছের মতো সেই খড়ের গাদার ওপর পড়ে গেল।
যারা সঙ্গে ছিল,তারা সেই দৃশ্য দেখে যুবকটিকে ফেলে অন্ধকারে জঙ্গলঝোপে টানা দৌড় দিল।
কুমারচন্দ্র স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন।
তাঁর হাতে লাঠি ছিল। 
কিন্তু তিনি কাউকে আঘাত করতে মনে প্রাণে চান না।
মায়ের কাছে মেয়েটিকে দাঁড় করিয়ে বললেন, আপনারা সোজা ক্যাম্পে চলে যান,ওখান থাকলে,কাজ করলে কেউ ক্ষতি করতে পারবে না।
মা ও মেয়েটি অবাক হয়ে দেখল।বুঝল,এই অন্ধকারে সত্যিকারের মানুষরূপী দেবতার সাক্ষাৎ ঘটেছে। 
এই তো পুণ্যতীর্থের মহিমা।
মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে কুমারচন্দ্রকে পায়ে হাত দিয়ে গড় করল।
কুমারচন্দ্র মৃদুস্বরে বলে উঠলেন,কেনো ভয় নেই, আমি থাকতে কেউ তোমাদের গায়ে হাত দেওয়া তো দূরের কথা,চুল স্পর্শ করতে পারবে না।যাও, সাবধানে যাও।

তারা চলে গেলে,অজ্ঞানরত যুবকটিকে কুমারচন্দ্র জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করতে লাগলেন।
পাশেই একটি ছোট ডোবা ছিল।
সেখান থেকে জল এনে মুখে ছিটিয়ে দিলেন।
যুবকটির জ্ঞান ফিরল।
সে মারাত্মক রকমের চমকে উঠল।
তার সঙ্গীসাথীরা কেউ কাছাকাছি নেই। সেই লোকটি তাকে সেবা করছে। যাকে সে মারতে উদ্যত হয়েছিল।
সে মৃদুস্বরে বলে উঠল,কে তু-তু- আপনি? 
কুমারচন্দ্র সহজ গলায় বললেন,আমার কথা ছাড়,তুমি আগে ঠিক হও, তারপর খোঁজ করো তুমি আসলে কে? এবং এইসব কী করে বেড়াচ্ছ!
যাও নিজের ঘরে ফিরে যাও।
বলেই কুমারচন্দ্র পিছন ফিরে হাঁটতে শুরু করলেন।
যুবকটি খড়ের গাদার ওপর শুয়ে কুমারচন্দ্রের দিকে স্তব্ধবাক হয়ে চেয়ে রইল।

রাসবিহারী ও শরদিন্দু সেই রাতেই কুমারচন্দ্রকে খুঁজতে বেরিয়েছে। কারণ সেই মা-মেয়েটি ক্যাম্পে গিয়ে সব ঘটনা খুলে বলেছে।
ভোররাতের দিকে মেলার একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে তাঁরা কুমারচন্দ্রকে খুঁজে পেল।
দেখল,একজন বৃদ্ধা একটি ত্রিপলের ওপর শুয়ে আছে।তার পায়ে বোধহয় লেগেছে। কুমারচন্দ্র একটা মাটির কলসি নিয়ে সাগর থেকে জল এনে তার পায়ে দিচ্ছেন এবং ভোরবেলা বলে আশেপাশে লোকজন বেশ কম, যারা আছে,তারা কেউ সাহায্য করছে না!
কিন্তু কুমারচন্দ্র কাজ করে যাচ্ছেন।
তারা গিয়ে ভালো করে জানল,এই বৃদ্ধা মহিলাকে সাহায্য করার কেউ নেই, যে দলের সঙ্গে এসেছিল,তারা তাকে,ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে।সবচেয়ে বড় কথা,এই বৃদ্ধা অল্প বয়সে বেশ্যাবৃত্তি করত।তাই সকলের চোখে ঘৃণার পাত্রী।
কিন্তু কুমারচন্দ্র সেই বৃদ্ধাকে সুস্থ করতে নিজেকে একেবারে সঁপে দিয়েছেন। একটি দোকান তখনও খোলেনি! সারারাত হয়তো দোকানপাট চালিয়েছে।এখন একটু বিশ্রাম।
সেখানে গিয়ে দোকানদারকে তুলে তার হাতে পায়ে ধরে এক বাটি গরম দুধ জোগাড় করে বৃদ্ধাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন।
শরদিন্দু কুমারচন্দ্রের সেবা-নিষ্ঠা দেখে কেঁদে ফেলল।
কিন্তু বৃদ্ধাটি বাঁচলেন না!
কিছুক্ষণ পরে শববাহক দল এসে বৃদ্ধাটিকে তুলে নিয়ে চলে গেল সরকারের জন্য। 
কুমারচন্দ্র সেই বৃদ্ধার সঙ্গে সঙ্গে চললেন।
সৎকার শেষে কুমারচন্দ্র এসে দাঁড়ালেন সাগরের জলের সামনে।তার পায়ে আলতো স্রোত এসে লাগছে।
পুবদিকে ধীরে ধীরে সূর্য উঠছে।
সেই দিকে আলোর একটি স্থিররেখা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কুমারচন্দ্র।

রাসবিহারী একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন,বলে উঠলেন,শরদিন্দু, পুরাণ তো সেভাবে পড়িনি!   ভগীরথকে কোনোদিন চোখে দেখিনি! ডাক্তারি করি তো,এইসব গল্প কথায় বিশ্বাস হয় না! কিন্তু কুমারচন্দ্রের মতো মানুষকে দেখলে সত্যি বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। পুণ্যতোয়া গঙ্গা আনতে কী সাধনকষ্ট করেছিলেন ভগীরথ, সত্যি তো সেই গঙ্গা এসেছেন, কিন্তু তার পবিত্রতা ও শক্তিময়তা রক্ষা করতে হলে আরও ভগীরথের প্রয়োজন, ঐ দ্যাখ, আমাদের চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। রক্তমাংসের ভগীরথ। 

শরদিন্দু ভোরে সূর্যের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কুমারচন্দ্রকে একবার দেখলেন, তারপর মৃদুস্বরে বললেন,ঠিক,ঠিক, ঠিক 
তারপর মন্ত্রের মতো বলে উঠলেন, 

"এই লভিনু সঙ্গ তব
সুন্দর, হে সুন্দর 
পুণ্য হল অঙ্গ মম
ধন্য হল অন্তর 
সুন্দর হে, সুন্দর। 
আলোকে মোর চক্ষু দুটি 
মুগ্ধ হয়ে উঠল ফুটি,
হৃদগগনে পবন হল
সৌরভেতে মন্থর
সুন্দর, হে সুন্দর। "

ক্রমশ....

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇
 

Post a Comment

0 Comments