জ্বলদর্চি

নামালিয়া বা পূব খাটা/ সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৩২

নামালিয়া বা পূব খাটা 

সূর্যকান্ত মাহাতো


"নামালিয়া" শব্দটি ডিকশনারিতে কোথাও খুঁজে পেলাম না। শব্দটি পেলাম বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পশুপতি প্রসাদ মাহাতোর "জঙ্গলমহল ও ঝাড়খণ্ডী লোকদর্শন" গ্রন্থে। শব্দটি পড়ে যেটুকু বুঝলাম, শব্দটি এসেছে "নামাল" শব্দ থেকে। 'নামাল' বলতে নিচু এলাকা বা জমিকে বোঝানো হয়। এই নিচু এলাকা বা জমিতে জঙ্গলমহল থেকে যারা শ্রমিকের কাজ করতে আসেন তাদেরকেই ওরা স্থানীয় ভাষায় "নামালিয়া" বলে।

'নামাল' শব্দটিকে অনেকে 'নামহাল' বলেও উচ্চারণ করে থাকে। এর আবার একটি অন্য নামও আছে। "পূব খাটা।" 'পূব' বলতে বোঝানো হয় পূর্ব দিক। অর্থাৎ জঙ্গলমহলের পূর্ব দিকে অবস্থিত হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর জেলা। জঙ্গলমহলের পশ্চিম প্রান্তের মানুষেরা পূর্ব দিকের এই জেলাগুলোতেই শ্রমিকের কাজ করতে আসে। তাই একে বলে "পূব খাটা"।

পূর্ব দিকের এই জেলাগুলোর সঙ্গে জঙ্গলমহলের পশ্চিম প্রান্তের ভৌগোলিক অবস্থানের বেশ তারতম্য রয়েছে। দুটো এলাকার ভিন্নধর্মী ছবিও লক্ষ্য করা যায়। হাওড়া, হুগলী, মেদিনীপুর কিংবা বাঁকুড়ার মতো নিচু এলাকার জমিগুলো হল সেচ যুক্ত, তিন ফসলি। অর্থাৎ বছরে তিন বার ফসল উৎপাদন করা যায়। অন্যদিকে জঙ্গলমহলের শিলদা, বেলপাহাড়ী, নয়াগ্রাম সহ পুরুলিয়ার পাথুরে জমিগুলো হল এক ফসলি। অনেক উঁচু। বন্যা প্লাবিত হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। তাই এধরনের উঁচু জমিগুলোকে বলে 'টাঁড়'। জমিগুলো আবার বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল। বছরে ওই বর্ষার সময়েই একবার চাষবাস হয়। অন্য সময় জলাভাবে পতিত থাকে।

নামালে বড় বড় চাষী। ওদের অনেক অনেক জমি জায়গা। আর এদিকে জঙ্গলমহলের মাহাতো, সাঁওতাল, মুন্ডা, শবর সহ আরও একাধিক জাতির লোকেদের জমি জায়গা অনেক কম। দু একজন যা ব্যতিক্রম আছেন। তাই নামালের বৃহৎ চাষীদের জমি যেমন আছে, কিন্তু শ্রমিক নেই। আর জঙ্গলমহলের মানুষের শ্রম করার ক্ষমতা আছে, কিন্তু তাদের পর্যাপ্ত চাষের জমি নেই। তাই স্বল্প জমিতে চাষ করে ওদের অভাব কখনও দূর হয় না। অর্থের অভাব, খাদ্যের অভাব, দৈনন্দিন শখ পূরণের অভাব সব সময় তাদের নিত্য সঙ্গী। এই অভাব পূরণ করতেই তাদের বাড়তি রোজগারে মনোযোগ দিতে হয়। সংসারে একটু সচ্ছলতা আসে। এটা ভাবতেও তাদের ভালো লাগে। তাই পূর্বের জেলাগুলোতে ফি-বছর শ্রমিকের কাজে যোগ দেয়। হয়ে ওঠে নামাল দেশের 'নামালিয়া' বা 'পূব খাটা' শ্রমিক।

নামালিয়ার কাজ করা বা শ্রমিক হিসেবে পূব খাটা অত সোজা বা সহজ কাজ নয়। আনন্দ বা খুশির তো নয়ই। বরং অনেক বেশি যন্ত্রণাময়। কষ্টদায়ক। প্রচন্ড পরিশ্রম সাপেক্ষ। তাই নামালিয়াদের জীবন খুব একটা সুখের হয় না। তাদের সেই কাজের অভিজ্ঞতা শুনলে 'দাসপ্রথা'-র কথা মনে পড়ে যাবে।

কারণ নামালিয়াদের কঠোর ও কঠিন পরিশ্রম করতে হয়। নারী কিংবা পুরুষ সকলকেই। তাদেরকে শোষিতও হতে হয়। কারণ তারা যথার্থ মজুরিও পায় না। সস্তার শ্রমিক বা কম দামের শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে হয়।

শারীরিক পরিশ্রমের পাশাপাশি নারী শ্রমিকদেরকে নানা রকমের যৌন নিগ্রহও সহ্য করতে হয়। যা বড় নির্মম। তারপরেও তাদের দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করে যেতে হয়। কিছু বাড়তি উপার্জনের প্রত্যাশায়। নিজস্ব বাড়িঘর ছেড়ে এই দূর দেশে এসে দিনরাত পরিশ্রম করে, কষ্ট করে ওদের অর্থ উপার্জন করতে হয়। সেটা বড় কম কথা নয়।

অধ্যাপক ডঃ ক্ষীরোদ চন্দ্র মাহাতো এই নামালিয়াদের যন্ত্রণাময় জীবন নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল, "নামালিয়ার দীর্ঘশ্বাস"। সংবাদ প্রতিদিন সংবাদপত্রে ১০ সেপ্টেম্বর ২০০০ সালে সেটি প্রকাশিতও হয়েছিল। সেই প্রবন্ধকে নামালিয়াদের জীবনের যন্ত্রণামাখা এক মর্মান্তিক দলিল বলা যেতে পারে। ক্ষীরোদ বাবু পরবর্তীকালে "দ‍্য স্টেটসম্যান" পত্রিকার পক্ষ থেকে সে কারণে 'গ্রামীন সংবাদ' বিষয়ে পুরস্কারও পেয়েছিলেন।

কোনও কোনও মেয়ে নামালিয়া তো কোলের শিশুকে পর্যন্ত সঙ্গে নিয়ে যায়। ওই টুকু দুধের শিশুকে তো আর বাড়িতে এক রেখে যাওয়া যায় না। তাই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে হয়। ঝুঁকি থাকে। কিন্তু কী আর করবে! অভাব যে বড়ই কঠিন জিনিস! মাথার ঘাম পায়ে ফেলে পরিশ্রম করতে হয় চাষের কাজে। রোদে পুড়ে কাজ করতে হয় বলে তাদের গায়ের গোরা রঙও পুড়ে কালো হয়ে যায়। একটি পাঁতা গানে সে ছবিও ফুটে উঠেছে---

"সকালেই শুই উঠি দে গো বিটি নামহালের টাকা।
নামহালে টাকা সহজে তো আর মফতে হয় না
চাম রাঙা দেহে আয় কালি পড়িল।"

নামাল খাটার এক ভয়ংকর ছবি ফুটে উঠেছে গানটিতে। পরিশ্রমের টাকা আদায় করতে গিয়ে মেয়েটি তার কষ্টের কথাগুলোই বলেছে।
পরিশ্রমের টাকা তো, তাই সহজে ছাড়বে না। কারণ সেটা মুফত বা এমনি এমনি আসে না। ঘাম ও রক্ত ঝরাতে হয়েছে।


নামালিয়ারা স্বপ্ন দেখে। নামাল খাটা টাকায় সংসারে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ফিরবে। নতুন জামা কাপড় কিনবে। নিজেদের ছোট ছোট খুশি ও শখগুলো পূরণ করতে পারবে। সেই সঙ্গে সন্তানেরও শখ পূরণ করবে। তাই কঠোর পরিশ্রমেও ওরা ভেঙে পড়ে না। ওই ছোট ছোট স্বপ্ন গুলোই তখন খুশি হয়ে খেলা করে ওদের যন্ত্রনা মাখা ক্লিষ্ট মুখগুলোতে। তাদের গতর খাটাতে ওই স্বপ্নগুলো রসদ যোগায়। অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু শোষকের কাছে তার কোন মূল্য নেই। তারা যতটা সম্ভব এদের শোষণ করেই ছাড়েন।

এ প্রসঙ্গে আম্বেদকরের একটি কথা মনে পড়ে গেল। "জাতি ব্যবস্থা মারফত মানুষে মানুষে বিভাজনই শুধু নয়, শ্রমজীবী মানুষদের অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে বিভাজন করার মূল আধার চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা। কারণ ব্রাহ্মণবাদী সামন্তবাদীরা জাত ব্যবস্থার সুবাদে সস্তা শ্রমিকের মাধ্যমে সম্পদ গড়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছেন।"

তবে অবস্থাটা এখন অনেকটাই বদলেছে। নামালিয়া শ্রমিকদের সংখ্যা এখন অনেক কম। প্রায় নেই বললেই চলে। এখন বিকল্প রোজগার করতে শিখেছে অনেকেই। সেইসঙ্গে ১০০ দিনের কাজ তো অনেকটাই সুবিধে করে দিয়েছে। সে সম্পর্কে নয়াগ্রামের পাঁতা নাচের লোকশিল্পীরা, একটি গানও বেঁধেছেন---

"আমরা যাব মাটি কাটিতে
তবে একশ দিনের কাজ খুল‍্যাইঞছে ডুংরি ধারের মাঠে
ধর বাবুর মা ঝড়া কদ‍্যাল
মোরা যাব মাটি কাটিতে
ও তরা শুন গ বাবুর মা
এবার নামাল যাব নাই
পাস বইয়ে তে তুইলব‍্য টাকা
অভাব রইব‍্যে নাই।"

স্বাধীনতার এত বছর পরেও এই নামালিয়াদের নিয়ে কারও কোনও উৎসাহ নেই। সত্যিই তো "এই নামালিয়া শ্রমিকদের হয়ে বলার কোনো রাজনৈতিক দল নেই। নেই কোন "হিউম্যান রাইট" নিয়ে শোরগোল তোলা কোন এন.জি.ও বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।" (জঙ্গলমহল ও ঝাড়খন্ডি লোকদর্শন/পশুপতি প্রসাদ মাহাতো)। এটাই সব থেকে বড় কষ্টের।

গ্রন্থ ঋণ: জঙ্গলমহল ও ঝাড়খন্ডী লোকদর্শন/ পশুপতি প্রসাদ মাহাতো

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments