জ্বলদর্চি

খর্জুর বীথির ধারে--৭/মলয় সরকার

খর্জুর বীথির ধারে

মলয় সরকার

(৭ম পর্ব ) সপ্তম পর্ব

এর পরই এসে গেল রোমানদের হাতের স্থাপত্যের ছাপ। এবং পরবর্তী রাস্তার নাম কলোনাদেদ স্ট্রিট (Colonnaded Street) । এর অর্থ হচ্ছে, যে রাস্তায় অনেক স্তম্ভ বা Column থাকে। আর আমরা রোমান স্থাপত্য যেখানেই দেখেছি, সেখানেই দেখেছি এই রাস্তার পাশে প্রচুর স্তম্ভের সারি। দেখেই বোঝা যায় এখানে এককালে প্রচুর ঘর বাড়ি চার্চ ইত্যাদি ছিল।এই রাস্তাটি ১০৬ খ্রীষ্টাব্দে তৈরী হয়েছিল। এটাকে  Street of Facades  বলে।অর্থাৎ এমন রাস্তা যার দিকে মুখ করে আছে নানা অট্টালিকার প্রধান দরজা। আসলে রাজবাড়ীটাই তো এই রাস্তায়। তাই বোধ হয় এই নাম। 

যেতে বাঁ দিকে পড়ল একটি রোমান মুক্ত মঞ্চ বা থিয়েটার। এর গ্যালারী গুলি এখনও রয়েছে প্রায় অক্ষত। মঞ্চের মধ্যে দর্শক বা নাট্যব্যক্তিত্বদের প্রবেশপথও রয়েছে। এখানে নাকি ৫০০০ দর্শক বসার মত জায়গা ছিল। এখান থেকেই অনুমেয় যে, ৫০০০ দর্শকের জায়গা যেখানে একটা মঞ্চে থাকে, তাহলে সেখানে জনসংখ্যা কত ছিল। ডান দিকে রয়েছে বেশ বড় কিছু স্থাপত্য, অনেক কারুকাজ করা উঁচু উঁচু রাজকীয় ঘরের মত। সেটি নাকি ছিল রয়াল প্যালেস বা রাজবাড়ি।এটি নাকি  সমাধিও বটে। রোমান স্তম্ভের স্থাপত্য কিন্তু এর পর থেকে বহুদূর চলেছে। শুধু তাই নয়, রাস্তার ডানদিক দিয়ে চলেছে একটি বড় নালা ধরণের খাত। সেটি জল বেরোনোর খাতও হতে পারে বা রাজবাড়ির প্রতিরক্ষা ব্যাপারের পরিখাও হতে পারে। প্যালেসটি বেশ উঁচু। তার ঘরের সংখ্যা বা কারুকাজও অনেক। বেশ অনেকটা জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেটি মাটির থেকে বেশ উঁচুতে।
মাঝে ইতস্ততঃ ঘুরে বেড়াচ্ছে  গরীব কিছু আরব কিশোর বা বয়স্ক মানুষ। সঙ্গে রয়েছে উট , খচ্চর এবং ঘোড়া। লোকগুলির বয়স বোঝা মুস্কিল। রোদের জন্যই হোক আর ওদের সাধারণ পরিচ্ছদই হোক এক গাদা কাপড় চোপড়ে পুরো দেহ ঢাকা, মুখটুকু কোন রকমে বেরিয়ে আছে। ওরা জিজ্ঞাসা করছে, যাবেন না কি। আমরা দরদামের ঝামেলার জন্য ওদের এড়িয়েই চলছিলাম। অবশ্য মনের মধ্যে যে ওদের জন্য দয়া হছেও না তা নয়। ওরাও তো আমাদের অপেক্ষাতেই থাকে। এই সব পর্যটকরা ভাড়া করলে তবেই তো ওদের রুজি রোজগার। কিন্তু এই করতে গিয়ে বিদেশে অহেতুক ঝামেলায় জড়াতে রাজী নই।


উপরে রোদ বেশ চড়া হচ্ছে। ফটো তোলাও খুব মুস্কিল হচ্ছে। মাথার উপরে চড়া রোদ হলে সবাই জানেন, সেটা ফটোগ্রাফির পক্ষে বেশ কঠিন কাজ। অথচ, এরপর তো এ সুযোগ এর জীবনে আসবে না। তাই সাধ্যমত আমার ক্ষমতায় চেষ্টা করছি এই সব স্মৃতিকে ধরে রাখতে।
ইতিমধ্যে দেখি হঠাৎ আমাদের পাশে আবির্ভূত হল একটি বেদুইন তাঁবু। আবির্ভূত বলছি, এই কারণে যে, সেটিকে আগে খেয়াল করিনি।মাটি ফুঁড়ে যেন হাজির হল যাদুমন্ত্রের মত, যখন মনে হচ্ছে ,একটু ছায়া পেলে হত। একটু জিরিয়ে নিতাম। এত বড় রাস্তায় কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, অথচ সেপ্টেম্বরের রোদ এখানে ঝাঁ ঝাঁ করছে বেলা প্রায় এগারোটাতেই। বেদুইন তাঁবু দেখে বুলবুলকে বললাম, চল একটুখানি আরব সাকীর হাতের সুরার স্বাদ নিয়ে আসি। আরবে এসেছি আর সাকীদের সাথে মুলাকাত করব না ,এ কি করে হয়।  

ঢুকলাম দোকানে। সরাই খানাটি বেশ বড়। আপাদমস্তক মোটা ঝকঝকে কাঠ দিয়ে তৈরী ,যেন পালিশ করা মনে হচ্ছে। সাজানো রয়েছে কিছুটা আরব ঢংয়ে। অনেক রঙীন রঙীন কাপড়ের ব্যাগ ঝুলিয়ে শোভা বৃদ্ধি করা হয়েছে।কায়দাটি বেশ ভাল। লম্বা  করে পাতা দু সারি বেঞ্চের উপর পাতা রয়েছে আরব গালিচার মত কিছু। তবে যিনি এর মালিক, তিনি মোটেই, আরবের মানুষ বলতেই যে ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে সাদা আলখাল্লা পরা, সে রকম নন। সাধারণ শহুরে মানুষের মত পোষাকে। তবে সঙ্গের মেয়েটি এখানকার মতই ফর্সা, লাল গোলাপী গালের ও বেশ সপ্রতিভ। অর্থাৎ ওই বোরখা আবৃতা নন, বরং বেশ আধুনিকা। মেয়েটি মালিকের নিজের মেয়েও হতে পারে, ভাব ভঙ্গী দেখে তাই মনে হচ্ছিল। তাকে দেখে বুলবুল বলল, নাও, তোমার আরব সাকী হাজির।তবে পুরানো দিনের মত নয়, আধুনিকা সাকী! কি সুরা চাইবে চাও। 
মেয়েটি অতিথিদের সাথে বেশ সপ্রতিভ ভাবেই কথা বলছে ও আপ্যায়ন করছে। আমাদের দেখে ,আগে বলল, বসুন।
দেখলাম, অনেকেই বসেছেন, এই  প্রচণ্ড রোদের থকে রেহাই পেতে ও  বিশ্রাম নিতে। দেখি মাথার উপরে ফ্যানও ঘুরছে, রান্নার জায়গায় আধুনিক যন্ত্রপাতি সবই রয়েছে। বুলবুলকে বললাম, আধুনিক বেদুইনদের আধুনিক তাঁবু। এখানে কি আর সেই বইয়ে পড়া মধ্যযুগের সাকী পাব, যার কোলে মাথা দিয়ে হাতে সুরার পেয়ালা নিয়ে আর শায়রীর বই হাতে শুয়ে থাকব। আধুনিক সাকীর কাছ থেকে এখনকার উপযুক্ত রসাস্বাদনই করতে হবে অগত্যা।
বুলবুল আড়ে কটাক্ষ করে হাসল।

নিলাম আরবের ব্ল্যাক টি। আর কিছু টুকটাক স্ন্যাক্স। 
মেয়েটি বলল, এখানকার চা খেয়ে দেখুন, ভুলবেন না।
মনে মনে বললাম, আরবের চা আর তার সাথে তোমার হাতের ছোঁয়া—--

 এই চড়া রোদের থেকে এসে, সাকীর হাতের ব্ল্যাক টিতে চুমুক দিতে দিতে মনে মনে চলে গিয়েছি অনেক দূরে। চোখের সামনে ফুটে উঠল, পূর্ণিমার চাঁদের ভরা জ্যোৎস্নায় ভাসতে ভাসতে সাকীর কোলে মাথা দিয়ে পান করছি অমিয় সুরা। চলে গেলাম সেই মধ্যযুগের কাব্যলোকে। “ কোথাও আমার হারিয়ে যেতে নেই মানা, মনে মনে” 
মনে হল, আমি যেন শুয়ে আছি সাকীর পাশে, আর
 সে হাতে সুরার পেয়ালা ধরিয়ে বলছে,

“ মুসাফির এস উদ্দাম নব জীবনের রঙে রূপে
ভোগের পেয়ালা কানায় কানায় ভরে নাও চুপে চুপে
গত বছরের তিক্তস্মৃতির ক্রন্দন লেখা যত
শেষ হোক জ্বলে নব ফাগুনের সুধা সুরভিত ধূপে”    (ওমর খৈয়াম)

হঠাৎ বুলবুল ঠেলা দিয়ে  বলল, কি হল , চা নিয়ে বসে আছ কেন? ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কি ভাবছ?
হঠৎ ফিরে এলাম পেট্রার এই রৌদ্রদগ্ধ বাস্তব জগতে। ওকে আর কি বলি! বললাম, না কি সুন্দর সাজিয়েছে দোকানটা, তাই দেখছি। ও হেসে বলল,দোকান না দোকানী? 

এগোলাম এখান থেকে।বাইরে একটু বেরিয়েই দেখি একটি সমাধি। বেশ উঁচু উঁচু। এ সব ঐতিহাসিকরা দেখে বিচার করে স্থির করেছেন। আমরা বুঝব না।যা লেখা আছে তাই বুঝছি। বেশ দু’ একটা বড় বড় স্থাপত্য কে বলা হচ্ছে Tomb বা সমাধি। একটি বেশ অনেকগুলো থাম ওলা, সেটি Urn Tomb । এর মাথার উপরে একটি ঘট মত আছে। তাই এই নাম।এটি একটু উঁচুতে, সিঁড়ি করা আছে ওঠার জন্য। সবই একটু উঁচুতে। মনে হয় এখানে বন্যার সম্ভাবনা ছিল খুব, তাই এই ব্যবস্থা। আমরা এর কোনোটার উপর উঠিনি। তাহলে আমাদের আর ক্ষমতা বা সময় কোনটাতেই কুলোত না।তবে এত সত্বেও, পরে বন্যার হাত থেকে একে রক্ষা করা যায় নি। আর একটি Silk Tomb।এটির পাথরের রঙের সৌন্দর্য্যের জন্য নাকি এই নাম। এখানে অনেগুলিকেই সমাধি বলা হয়েছে।

যাই হোক, এর পর পেলাম পরবর্তী কালে জেরাসে দেখা রোমান মন্দিরের মত বিশাল উঁচু এক স্থাপত্য,যার নাম গ্রেট টেমপ্ল। এখানে অনেক স্তম্ভ , সিঁড়ি দেওয়ালের কারুকার্য অনেকটাই অক্ষত রয়েছে। সিঁড়ি দিয়ে উঠলাম উপরে। সেখানে এক বিশাল বাঁধানো চত্বর। নীচে মন্দিরের গেট , উঁচু দেওয়াল সব দাঁড়িয়ে অতীত দিনের সাক্ষ্য দিচ্ছে। এর সামনে চারিদিকে ছড়ানো রয়েছে অতীত নগরীর টুকরো টুকরো ধ্বংসস্তুপ।আমরা এর উপরে উঠলাম। কারণ এর সিঁড়ি বেশ সুন্দর আর উপরেও অনেক কিছু দেখার মত জিনিস রয়েছে। এখান থেকে অনেক দূরে দৃষ্টি যায়।

দূরে কিছু পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে। বুঝলাম, সেখানেও রয়েছে এই ধরণের কাজ। সেটা হওয়াটাই স্বাভাবিক। মাত্র একটি রাস্তাই তো এতবড় শহরের সবটুকু হতে পারে না। এর চারিদিকে অনেকই জনবসতি নিশ্চয়ই ছিল। তার মধ্যে এইটুকু হয়ত বেশি আকর্ষণীয়।

এখানে সামনের রাস্তার উপর বেশ কয়েকটি স্তম্ভ পরপর দাঁড়িয়ে রয়েছে অবিকৃত অবস্থায়। শুধু তাদের মাথায় ছাদটাই নেই। এটির নাম রোমান গেট।

এর পর রয়েছে একটি বাইজান্টাইন স্থাপত্যের চার্চ। এটি ঘেরা রয়েছে।তবে দেখা যাচ্ছে এর মোজাইক টালির সুন্দর সুন্দর কাজ।

আমরা রাস্তা ধরে চলছি তো চলেইছি এর কি যেন এক টানে সমানে এগিয়ে যাচ্ছি।আমার চিরদিনই ইতিহাসের প্রাচীন ধংসস্তুপে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগে। আমার মনে হয় যেন ফিরে যাই সেই সব যুগে। যেখানে যেখানে এই ইতিহাস খুঁজে পাই ছুটে যাই সেই সব অতীতে, তা রোমের কলোসিয়ামের মধ্যেই হোক কি চীনের প্রাচীরের মাথাতে , কখনও বা আজটেকদের  মন্দিরে। আমার যেন কেমন একটা আচ্ছন্নতা ভিড় করে , আমার আমিত্ব হারিয়ে যায়, ভুলে যাই স্থান কাল পাত্র।চারিদিকে দেখতে পাই সেই সব যুগের মানুষদের হাঁটা চলা, পাই তাদের সেই সময়ের সান্নিধ্য। কখনও আজটেকদের পূজার নির্মমতায় শিউরে উঠি, আবার এই পেট্রার মধ্যে সাকীর কথা ভেবে স্বপ্ন দেখি। 

“ দূরে বহুদূরে
স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে
খুঁজিতে গেছিনু কবে শিপ্রা নদী পারে
মোর পূর্বজনমের প্রথমা প্রিয়ারে।
মুখে তার লোধ্ররেণু লীলাপদ্ম হাতে
কর্ণমূলে কুন্দকলি কুরুবক মাথে,
তনু দেহে রক্তাম্বর নীবিবন্ধে বাঁধা
চরণে নূপুরখানি বাজে আধা আধা।
                  বসন্তের দিনে
ফিরেছিনু বহুদূরে পথ চিনে চিনে।”

চলুন এগোই পরের পর্বে—  (ক্রমশঃ)

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments