জ্বলদর্চি

বাংলা গল্পের পালাবদল— ৮ /অমর মিত্র /বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

(বাংলা ছোটোগল্পের ইতিহাসের দিকে তাকালে দ্যাখা যাবে, মাঝে মাঝেই বাঁক বদল হয়েছে তার। বিষয়— আঙ্গিক সমস্ত দিক থেকেই বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। আর এই বদলের সঙ্গে গভীরভাবে সংযোগ রয়েছে সময়ের। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে বিশ শতকের পঞ্চাশের বছরগুলিতে লিখতে আসা গল্পকারদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চাশ-পরবর্তী ছোটোগল্প ও গল্পকারদের নিয়ে তেমন আলোচনা আমাদের নজরে আসেনি। কিন্তু এই সময়ে বাংলা ছোটোগল্প বৈভব ও ঐশ্বর্যে ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছে গিয়েছে। এই সময়-পর্বে লিখতে আসা নির্বাচিত লেখকদের চারটি করে গল্প নিয়ে বিন্যস্ত হবে এই আলোচনা। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় আলোচনা সম্ভব হবে না। বিভিন্ন সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ের গল্পকার উঠে আসবেন। এভাবেই বাংলা গল্পের অভিমুখকে চিহ্নিত করবার চেষ্টা করা হবে।)

বাংলা গল্পের পালাবদল— ৮ 
বিশ্বজিৎ পাণ্ডা

অমর মিত্র 

বিশ শতকের সত্তরের দশকের শুরুতে চাকরি নিয়ে কলকাতা ছেড়ে মেদিনীপুরে চলে গিয়েছিলেন অমর মিত্র (জন্ম-১৯৫১)। সবিস্ময়ে লক্ষ করেছিলেন নতুন পরিবেশ। সেই পরিবেশে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন উপলব্ধির জন্ম হত তাঁর ভিতর। এইভাবেও মানুষ বাঁচে! গ্রাম তাহলে এই! শুরু হল তাঁর সাহিত্য সাধনা— “তার আগেও গল্প লেখার চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুয়ার সব বন্ধই ছিল যেন। শহর থেকে দূরে গিয়ে, কখনো কংসাবতী, কখনো সুবর্ণরেখা, কখনো ডুলুং, তারপর হলদি নদী, বঙ্গোপসাগরের তীরে বদলি হয়ে হয়ে আমার এক সময় মনে হলো আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান। আমার মতো করে এই পৃথিবীটাকে দেখতে পাচ্ছে কে ? আমি বরং লিখেই যাই। আমি বরং আমার ক্ষুদ্র ক্ষমতাটুকু ব্যবহার করে চাষীবাসী বিপন্ন মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করি।”

অমর মিত্রের গল্পে অদ্ভুত একটা জোর আছে। সেই জোর সত্যের জোর। জীবনের বাস্তব সত্য তাঁর হাতে চিরকালীন সত্যে উন্নীত হয়। লেখকের সত্য দর্শনের মহত্ত্বে সাহিত্যের বাস্তবতার শরিক হয়ে ওঠেন সকলে। যাপিত জীবনের বাস্তবতা নিয়ে লেখা শুরু করলেও সেখান থেকে যাত্রা করেন অন্য কোনও বাস্তবতার সন্ধানে। অনেক সময় তিনি শূন্য থকে যাত্রা করে সম্পূর্ণ অচেনা একটা জায়গায় পৌঁছে যান। এই প্রার্থিত সত্যে পৌঁছনোর জন্য অন্য এক বাস্তবতা নির্মাণ করেন। তাঁর গল্পের বাস্তবতায় তাই থাকে পরাবাস্তবের ছোঁয়া। সেই ছোঁয়ায় দূর ভারতবর্ষের কোনও প্রান্তিক মানুষও তাঁর সাহিত্যের বাস্তবতার ভিতরে নিজের জীবনসত্য অনুভব করতে পারেন। সময়ের ফ্রেমে আশ্চর্য চলমান ছবি আঁকেন তিনি। সেই ফ্রেমে ধ্বনিত হয় সমগ্র ভারতবর্ষের স্পন্দন।

অমর মিত্রের প্রতিটি গল্পই স্বতন্ত্র— বিষয়, বর্ণনায়, আঙ্গিকেও। তিনি মনে করেন গল্পের আঙ্গিক আসলে লেখকের দ্যাখার চোখ— “লেখক যেভাবে দেখবেন এই জীবনকে, তাঁর গল্প তিনি সেই ভাবে বলবেন।” তাই ‘দানপত্র’ (‘অনীক’, শারদীয়া, ১৯৮০) গল্পটি লিখেছিলেন দানপত্রের আইনি ভাষায়, দলিল লিখনের পদ্ধতিতে। গল্পটি শুরু হচ্ছে এভাবে—

“দানপত্র (সাহেবমারি বাস্কে সম্পাদিত)
গ্রহীতাঃ সাহেবমারি বাস্কে, পিং ৺মুচিরাম বাস্কে, জাতি সাঁওতাল, গূঢ় অর্থে ভারতীয়, সাকিন মৌজা সনারিমারা, অর্থে স্বদেশ ভারতরাষ্ট্র।  
দাতাঃ সাহেবমারি বাস্কে, পিং ৺মুচিরাম বাস্কে, জাতি ঐ সাকিন ঐ।
কস্য জবরদখলী স্বত্ববিশিষ্ট স্বত্বের জোতজমি বাস্তুভিটা ইত্যাদি স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি আদির পারিবারিক সদর্থে সামাজিক দানপত্র মিদং কার্য্যাঞ্চাগে, পরগণা সাঁন্তালীবসান, ভারতরাষ্ট্রভুক্ত তপশীলবর্ণিত সম্পত্তি—”

এরপর দীর্ঘ বর্ণনা। গল্পটি শেষ হচ্ছে—

“এতদর্থে সাক্ষীগণের সাক্ষাতে লিখিত পড়িত করতঃ সুস্থ শরীরে স্বেচ্ছাপূর্বক সরল অন্তকরণে অন্যের বিনা প্ররোচনায়, পবিত্র করমপরব দিবসে, অত্র সামাজিক দানপত্র সম্পাদন করিলাম।
  ইসাদী       ভবদীয়
(মেঘ অরণ্যময় পৃথিবী ও জন্মদাত্রী মৃত্তিকা) সাহেবমারি বাস্কে
       সাকিন সোনারিমারা
    ভারতরাষ্ট্র
(তপশীল পর পৃষ্ঠায় বর্ণিত)” 

আপাতভাবে দেখলে মনে হবে এটি একটি দলিল। দানপত্রের উইল। কিন্তু এরই মধ্যে অমর বলেছেন, জমির ইতিহাস অর্থ্যাৎ জমির হাত বদলের ইতিহাস। ভারতবর্ষের অরণ্যভূমি, জমি আদিম অধিবাসীদেরই সম্পত্তি ছিল। পাহাড় জঙ্গল কেটে খেতভূমি করেছেন তাঁরাই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, রক্তজল করা পরিশ্রমে। সরকারি মহাফেজখানার ধুলিমলিন নথিপত্রে এই ইতিহাসই রয়েছে জমির। কিন্তু নথিপত্র তাঁরা রাখেন না। তাঁরা চেনেন মাটিকে। কারণ, “নথিপত্র ফসল উৎপাদন করে না।” তাঁদের এই ভুল একসময় ভাঙে। দু-একজন উৎকল ব্রাহ্মণ ভাগ্যান্বেষণে এসে কৌশলে আদিবাসীদের জমি হাতিয়ে নিয়েছে। আইন তাদের সহায়। তাই আদালতে গিয়েও লাভ হয়নি কিছুই। উকিলের জেরায় সহজেই মিথ্যাকে সত্য প্রতিপন্ন করা হয়।  

লেখক এই গল্পে ঐতিহাসিক তথ্য-উন্মোচনের উল্লেখযোগ্য একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, জমির নামের সঙ্গে তার আসল মালিকানার চিহ্ন জড়িয়ে আছে— “তুমি অবগত যে সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট দশ বিঘার লপ্তটি নিমে সাঁওতালের জমি নামে পরিচিত। কে এই নিমে সাঁওতাল ? তাহা জানা নাই। আমাদিগের পূর্বপুরুষ কেহ হইবে। ঐ জমি এখন উৎকল ব্রাহ্মণদিগের হেফাজতে। উহার পার্শ্ববর্তী তিরিশ বিঘার টুকরো টুকরো লপ্তগুলি সাঁওতালি সোঁত নামে চিহ্নিত। এখন উহা সাঁওতালদিগের নহে। এমনি বাগদির মাঠ, ডোমের মাঠ, মহালিশোল, ধারোপায়জোড়া কত জমি!” 

জমির সঠিক ইতিহাসের পাশাপাশি এ গল্পে লেখক একটি মিথ্যা ইতিহাসকে আলোকিত করেছেন। সদর শহরে স্থাপিত সাহেবের মূর্তির ইতিহাস। মানুষের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার অতীত ইতিহাস। ‘সাহেবমারি’ এই নামে লুকিয়ে আছে সাহেবকে মারা বা হত্যা করবার কথা। যা প্রাচীন ও সত্য তাই ইতিহাস। সেই ইতিহাসকে মহাফেজখানায় রেখে এদেশে প্রচলিত হয়েছে মিথ্যে কাহিনি। সাঁওতালদের শৌর্যের কথা, সততার কথা মানুষের কাছে প্রকাশিত হয়নি। বিকৃত ইতিহাস তাঁদের বর্বর চোয়াড় আখ্যা দেয়। সেই ইতিহাসকে অগ্রাহ্য করে সাহেবমারির প্রকৃত ইতিহাসকে প্রকাশ করেছেন অমর। 

একদা সাহেবের লালসার শিকার হয়েছিল ঈশ্বরবাবুর সুন্দরী কন্যা। তাকে সাহেবের কামনার হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই ঈশ্বরবাবুর বাঁধা মুনিশ সাঁওতাল পুরুষ খুন করে সাহেবকে। এই ইতিহাস কেউ জানে না। ঈশ্বরবাবু ঠিক উল্টো কথাই প্রচার করলেন। সকলে জানল তাঁর ষোড়শী কন্যার প্রতি দুর্ব্যবহার করেছিল সাঁওতাল পুরুষ। তাকে বাধা দিতে গিয়ে প্রাণ হারাতে হয় সাহেবকে। সরকারি সাক্ষী হয়েছিলেন ঈশ্বরবাবু। সরকার বাহাদুরের দ্বারা সম্মানিতও হয়েছিলেন তিনি। 

অমরের গল্পে এই রকম দুঃসাহসী উন্মোচন থাকে। সঠিক ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা থাকে। দেশের যে রাজনৈতিক ইতিহাস তা সাধারণ মানুষের কথা বলে না। অথচ সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের প্রসঙ্গ ছাড়া পূর্ণতা পায় না কোনও ইতিহাস। অমর মিত্রের গল্পের মধ্যে ধরা থাকে সেই ইতিহাস। মানুষের ইতিহাস। সভ্যতার ইতিহাস।  

জমি তথা ভূমি সংক্রান্ত সমস্ত জটিলতা, কূটকচালি অমর মিত্রের লেখায় যেভাবে উঠে এসেছে সেভাবে পূর্বাপর অন্য কোনও বাঙালি লেখকের লেখায় আসেনি। আর এই জমির সূত্র ধরে তিনি বাংলা তথা ভারতবর্ষের প্রকৃত ইতিহাসের সন্ধান করতে চেয়েছেন।   
অমরের লেখায় কল্পনার জায়গাটা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বাস্তবতার সঙ্গে কল্পনাকে, জাদুবাস্তবতাকে, স্বপ্নকে, দর্শনকে অনায়াস দক্ষতায় মেলাতে পারেন। আর সেখান থেকে ভয়াবহতার মধ্যেও পাঠককে কোনও পজিটিভ জায়গায় নিয়ে যান। ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়েও আশার আলো দেখতে পান।

একটা সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কলম ধরেন তিনি। তাই সমাজের বিপন্ন মানুষদের যাপনকেও সযত্নে গল্পের বিষয় করে তোলেন। হেরো, বিপন্ন মানুষেরা স্বপ্ন দ্যাখেন শুধু। একদিন তাঁদের সকল সমস্যা দূর হবে— এই স্বপ্ন নিয়ে বাঁচেন। এটাই তাঁদের একমাত্র সম্বল। ‘গাঁওবুড়ো’ (‘অমৃত’, ১৯৭৭) গল্পের সত্তর বছরের বুড়ো ফকিরচাঁদ পিঠের লাঠিতে ছোট্ট পুঁটলি ঝুলিয়ে চৈত্রের ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়ে বড়োবাবুর উদ্দেশ্যে। দশ মাইল দূরে দুর্গাহুড়ি জঙ্গল পেরিয়ে পশ্চিমে সুবর্ণরেখার তীরে কন্যাডিহার বড়োবাবু মানুষের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারেন। সব অসুখ সারিয়ে দিতে পারেন। তাই যত কষ্টই হোক বড়োবাবুর কাছে তাকে যেতেই হবে। চোখে দেখতে পায় না। বড়োবাবু এমন এক বদ্যির সন্ধান দেবেন যার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই চোখ ভালো হয়ে যাবে। গাঁয়ের একটি মেয়েকে নিয়ে তার ছেলে পালিয়েছে চাকুলিয়া। “এই পুত্রটিকে ঘরে ফিরিয়ে আনার এমন অব্যর্থ পরিকল্পনার সন্ধান তিনি দিয়ে দেবেন যে ভালোবাসার মেয়েটিকে ছেড়ে সে সুড়সুড় করে ঘরে এসে ঢুকবে।” শরিকে ধান কেটে নেয়। ফসল বাঁচানোর জন্য বড়োবাবু উপদেশ দিয়ে দেবেন। এমনকি বউ-মরা বুড়োর বিশ্বাস একটা গরিবের মেয়েরও সন্ধান করে দেবেন বড়োবাবু, যে তার তপ্ত রক্ত শীতল করে দেবে।
 
প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার জন্য, জীর্ণ-দীর্ণ মানুষগুলোকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য লড়াই করতে হয়। লড়তে লড়তেও স্বপ্ন দ্যাখে মানুষ। কেউ কেউ স্বপ্ন বুনে দেয়। এই গল্পের ফকিরচাঁদ যেমন। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। স্বপ্ন ফেরি করতে করতে চলে সে। রাস্তায় বহু বিপন্ন মানুষ বড়োবাবুকে জানানোর জন্য তাদের আর্জি পেশ করে। যদিও তারা কেউই বড়োবাবুর নাম শোনেনি আগে। ফকিরচাঁদের কাছে প্রথম শুনেছে ‘দীর্ঘ উন্নত দেহ’ ‘টকটকে রঙ’ ‘দেওতার মতন’ বড়োবাবুর কথা। জঙ্গলে সাঁওতালরা বলে— “আমাদের বড় দুঃখ বুড়ো। শালুই পূজায় ধুমধাম করতে পারিনে। শাল গাছই জোটে না, ফরেষ্টার চালান দেবে খড়্গপুরে, আমাদের এই দুঃখ। আমাদের কষ্ট হয় যে পূজায় বরাহ বলি দিতে পারিনে, কত দুঃখু! আমার মেয়েটা ভিনদিশি হা-ঘরের সঙ্গে পালিয়ে যাবে বোধ হয়... নেশা করলে পুলিশে এসে ধরে। সব চালান দিবে ঝাড়গ্রামে।”

ফকিরচাঁদ বহু কষ্ট করে শেষ পর্যন্ত পৌঁছলেও বড়োবাবুর দ্যাখা পায় না। কন্যাডিহাতেই কেউ জানে না তাঁর মহিমার কথা। একজন বলে— “হা হা তুমি স্বপ্ন দিখ গাঁওবুড়ো, এমন মানুষ কই ? কোথাও নেই। এমন মানুষ আজকাল আর থাকে না, থাকে না।” 

সে বালির মধ্যে নেমে হাহাকার করে ওঠে— “চলি গেল্যে তো সব দুঃখু গুলান নি গেঁলেনি কেনে ?” 

গল্পের শেষে পৃথক একটি অনুচ্ছেদ— “ফেরার পথে সেই জঙ্গলে সেই মাঠে সেই খালের সামনে অপেক্ষা করে থাকে যে যেমন। গাঁওবুড়ো কাল ফেরেনি আজ ফিরলো না তবু ফিরবে নিশ্চয়ই।”   

আশ্চর্য এক জীবন পরিক্রমার গল্প। আশ্চর্য এক স্বপ্নবয়ান। অত্যাচার-অনাচারে জর্জরিত গরীব মানুষদের বেঁচে থাকার ইচ্ছেকে লেখক তুলে ধরেছেন এই গল্পে। রুক্ষ করুণ অথচ এক স্বপ্নঘন ছবি। লেখক নিরাশ করেননি। শেষ পর্যন্ত স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। এই স্বপ্নই গ্রামীণ মানুষদের কাছে বেঁচে থাকার অন্নজল— শুশ্রূষা। 

এ বছর (২০২২) এই ‘গাঁওবুড়ো’ গল্পের জন্য অমর মিত্র পেয়েছেন আন্তর্জাতিক ‘ও হেনরি’ পুরস্কার। বাংলা ছোটোগল্পকে তিনি বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন। এই বছরেই আবার পেঙ্গুইন র‍্যান্ডম হাউস ভিন্টেজ সিরিজ-এ প্রকশিত হয়েছে তাঁর ‘ধনপতির চর’-এর ইংরেজি অনুবাদ।       

অদ্ভুত এক দেশজতা আছে তাঁর রচনায়। আমাদের শিকড় নিহিত যে গ্রামীণ ভারতবর্ষের মাটিতে সেই ভারতবর্ষ হয়তো আমাদের অচেনা নয়। এর আগেও এগুলি বিষয় হয়ে এসেছে বাংলা সাহিত্যে। কিন্তু অমর তা এমনভাবে উপস্থাপন করেন যাতে বহুস্তরিক, বহুমাত্রিক দেশটাকে নতুন করে আবিষ্কার করি আমরা। 

আমাদের মধ্যবিত্তের চৌর্য-যাপনের অন্য এক মুখ ‘হনন-আত্মহনন’ (‘শারদীয় নবান্ন’, ১৯৯২)। গল্পের নির্মল স্বাস্থ্য দপ্তরের নিম্ন করণিক। একদিন একটা ইলিশ কিনে আনে পরিচিত হাবুলের দোকান থেকে। মাসের শেষদিকে ইলিশ কেনার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু হাবুল অসুস্থ। অনেকদিন পরে দোকান খুলেছে। বলল দিনের মাছ দিনে বিক্রি করতে হবে তাকে, তাই কিনে নিল। কিছু পরে বাড়িতে হাজির হাবুল। নির্মল মাছ নিয়ে টাকা দিতে ভুলে গিয়েছিল। কারণ সেই সময় নির্মলকে তার এক বন্ধু অমলেন্দু ডেকে নিয়ে যায়। তাদের এক বন্ধু দিলীপ আত্মহত্যা করেছে। স্ত্রী সুচরিতার সামনে নির্মল জানায় সে টাকা দিয়েছে। সুচরিতা বারবার বলে, বুড়ো দরিদ্র মাছওয়ালা মিথ্যে বলবে না। তার নির্দেশে কদিন পরে মাইনে পাওয়ার পরে পঞ্চাশটা টাকা হাবুলকে দিয়ে আসে। হাবুল একই মাছের দাম দুবার নিতে চাইছিল না। ছুঁড়ে দিয়ে এসেছে। নির্মল। বাজারের সকলকে বলেছে একই মাছের দাম দুবার নিয়েছে হাবুল। সে ভদ্রলোক বলে মিথ্যে বলেছে হাবুল। হাবুলের কাছ থেকে সে আর মাছ নেয় না। তাকে দেখিয়ে তার পাশের দোকান সুধীরের কাছ থেকে মাছ নেয়। আর সে গল্প রসিয়ে রসিয়ে করে সুচরিতাকে। হাবুল একদিন ডিমওয়ালা ট্যাংরা নিয়ে বসেছে। সেদিন তাকে শুনিয়ে সুধীরকে নির্মল বলে, তার পছন্দের মাছ এনে দেওয়ার কথা—“জ্যান্ত ট্যংরা, বেশ কালো রঙের, বেগুন কচু দিয়ে ঝোল খাব ডিমভরা যেন হয়।” আবার হাবুলের কাছে মৌরালা মাছ দেখে সুধীরকে সে বলে— “আজ যদি মৌরালা থাকত নিতাম।” 

নির্মল শুধু বাজারে নয়, তার অফিসেও বলেছে হাবুলের কথা। জনে জনে শুনিয়েছে মানুষ দিন দিন কীভাবে অসৎ হয়ে যাচ্ছে। গল্পে মাঝে মাঝে এসেছে দিলীপের মৃত্যুর প্রসঙ্গ। কেন আত্মহত্যা করেছে তা জানা যায়নি। একদিন সন্ধ্যায় অফিস ফেরত নির্মল দেখতে পায় হাবুলকে। হাবুল তার ময়লা জামার বুক পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বার করে দিতে চায়। সে জানায়, তারই ভুল হয়েছিল— “আপনি নন, কুণ্ডু লেনের এক বাবু তিনি নিজে এসে দিয়ে গেছেন সকালে।...আপনার বাবা, বড়বাবু সেবার হাসপাতালে ভরতি হলেন, আমিই তো বিনি পয়সায় মাছ দিয়ে গেছি, পরে বড়বাবু বেশি টাকাই দিয়েছিলেন সত্যি... চোর, মথ্যেবাদি অপবাদের চেয়ে যে আমার মরাই ভাল দাদাবাবু।” 

নির্মল আর দাঁড়াতে পারে না। দৌড়ে বাড়ি ঢোকে। সুচরিতার হাতে টাকা দিয়ে চলে যায় হাবুল। নির্মলের মুখ থেকে বেরিয়ে যায় হাবুল মিথ্যেবাদি। এতদিন পরে কেউ টাকা দিয়ে যায়! কুন্ডু লেনের একজনের কথা সে বানিয়ে বলেছে। সুচরিতার সামনে মুখ তুলতে পারে না সে। “চোখ ঝাপসা। চশমা ঝুলছে চোখের উপর। দিলীপ ঘোষ মারা গেছে খবরটা দিল অমলেন্দু। সে শুনতে শুনতে চলেই এসেছিল। এক টাকা ফেরতও নিয়েছিল। এই পর্যন্ত তো জানা যাচ্ছে। যা জানা যাচ্ছে না তা হল শেষ মাসের টান। ভেবেছিল পরদিন হাবুলকে বলে দেবে টাকাটা মাস ফুরোলে নিয়ো। কিন্তু হাবুল এসে যখন দাঁড়াল দরজায়, কী ভাবে যে মুখ থেকে বেরিয়ে গেল কথাটা, কই নাতো! পঞ্চাশ টাকার নোট যে দিলাম। কথা তো ফিরিয়ে নেওয়া যায় না।” জেদ চেপে গিয়েছিল। তর্ক করেছিল সুচরিতার সঙ্গে। সুধীরের কাছে মাছ কিনে প্রত্যেকদিন প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে বুড়ো হাবুল দাসই মিথ্যে বলেছে। 

গল্পের শেষদিকে এসে লেখক নির্মলের ভাবনায় সেদিনের এই ঘটনার কথা বলেছেন। গল্পের শেষে সুচরিতার দুটি মাত্র কথা— “বুঝতে পারছ মানুষ কেন আত্মহত্যা করে বিনা কারণে ? বুঝতে পারছ মানুষ কোন কৌশলে মানুষকে মারে ?” 

অহংকারী নির্মলের হতাশা ও অসহায়তার শরিক হয়ে উঠি আমরা। ভিতর থেকেই অনুভব করি তাকে। সে যেন আমাদেরই দোসর। এটাই তো আমাদের নিম্ন মধ্যবিত্তের নিত্যনৈমিত্তিক বাস্তবতা। এর সত্যতাকে এড়িয়ে যেতে পারি না। মধ্যবিত্তের অজস্র ভণ্ডামি, প্রতারণা, ইতরতা, ক্রুরতা, কদর্যতা, নগ্নতা, মিথ্যাচার ইত্যাদি প্রতিদিনের নানা বিকার তাঁর বহু গল্প ধারণ করে আছে।     

সময়ের সঙ্গে সময়কে জুড়ে দিতে ভালোবাসেন অমর। তাই তাঁর গল্পে সময়ের অনেকগুলি স্তর একই সঙ্গে প্রতিভাত হয়। অসামান্য মুনশিয়ানায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ের খতিয়ানকে অদৃশ্য সুতোয় বেঁধে ফেলেন।   

একজন লেখকেরই গল্প ‘বাবুইবাসা’ (‘শারদীয়া বর্তমান’, ১৪২৭)। লেখকের মৃত্যুর পরে তাঁর লেখার নিদারুণ পরিণতির গল্প। খুব মান্য, ক্ষমতাবান সাহিত্যিক ছিলেন নিখিল দত্ত। একটি বড়ো পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সদস্য ছিলেন। তরুণ লেখকদের উপরে বড়ো প্রভাব ছিল তাঁর। গল্পের কথক সমীরণ বসুও তাঁর স্নেহধন্য ছিলেন। সমীরণ প্রায়ই যেতেন নিখিল দত্তর বাড়ি বাবুইবাসায়। ছোটোছেলে বাবুইয়ের নামে বাড়ির নাম রেখেছিলেন তিনি। বিরাট সুসজ্জিত লাইব্রেরি ছিল বাড়িতে। সেখানে সমীরণের প্রথম বই ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ও রাখা ছিল। কতদিন এসে তিনি দেখেছেন নিখিলবাবু বাড়ির সামনের বাগানে ডেক চেয়ারে আধশোয়া হয়ে তাঁর সেই সদ্য প্রকাশিত বইটি পড়ছেন। 

সে সব বহুদিন আগের কথা। বছর পনেরো আগে মারা গিয়েছেন নিখিল দত্ত। তারপর আর বেলঘরিয়ার সেই বাড়িতে যাওয়া হয়নি সমীরণের। এখন তাঁর এক নাটকের বন্ধু ত্রিদিবের অনুরোধে যেতে হচ্ছে। ত্রিদিব নিখিলবাবুর একটি উপন্যাস ‘বাবুইবাসা’ নাট্য প্রযোজনা করতে চায়। তাঁর জন্য পরিবারের অনুমতি নিতে হবে। সেই কারণে ত্রিদিবকে নিয়ে সমীরণ এলেন তাঁর একসময়ের সাহিত্য-গুরুর বাড়িতে। কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় এসে বাড়ি খুঁজে পেলেন না। পাশের মিষ্টি দোকানে খবর নিয়ে জানলেন লেখকের মৃত্যুর পরে বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট হয়েছে— “তিন কোটি টাকার ডিল হয়েছিল, রাইটার স্যারের মৃত্যুর বছর পাঁচেক বাদে, তারপরই সবাই চলে যান।”  

ঠিকানা জোগাড় করে সমীরণ যান নিউটাউনের এক আবাসনে। সেই ফ্ল্যাটের নামও ‘বাবুইবাসা’। দরজা খুলে বেরোল নিখিলবাবুর ছেলে বাবুই। পরিণত বয়সে বাবার মতোই। কথা প্রসঙ্গে জানা গেল নিখিলবাবুর মৃত্যুর চার বছর পরে তাঁর স্ত্রী মারা গেছেন। তারপর বাড়ি বিক্রি করেছে তারা। সমীরণ জানতে চান, নিখিলবাবুর বইগুলোর কথা। বাবুইয়ের স্ত্রী জানাল, এগারোশো স্কয়ার ফিটের ফ্ল্যাটে বইয়ের জায়গা কোথায়। তাই সব প্রমোটারকে দিয়ে এসেছে। বাইপাসে ধাপার মাঠে চোখ যায় সমীরণের। বিড়বিড় করেন তিনি— “হেরে গেলেন নিখিলদা, হেরে গেলেন। মৃত্যুর সঙ্গে সাঁতরে শেষ পর্যন্ত দম ফুরিয়ে ফেললে গো নিখিলদা!” 

তাঁর মনে হয়— “প্রমোটার তিন লরি বই এনে ধাপার মাঠে ফেলে আগুন জ্বালিয়ে ফিরে গিয়েছিল একদিন। ৪৫১ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় বই পুড়ছিল।... বইগুলি নষ্ট করতেই যেন বাড়ি ভেঙে এমন বহুতল নির্মাণ যার কোনও তলেই কোনও বই নেই। সেই আগুন জ্বলছে ওই দূরে জঞ্জালের পাহাড়ে। সমীরণের মনে হয়, তার বই পুড়ছে। সমীরণ নিজের প্রথম বইটির নাম উচ্চারণ করতে করতে প্রজ্জ্বলিত পাহাড় পার হয়ে যেতে থাকে। যেতেই থাকে। পাহাড়ও বইয়ের আগুন নিয়ে চলতে থাকে তার সঙ্গে।”  

আত্মজৈবনিক উপাদান মিশে আছে এই গল্পে। মিশে আছে সময়ের অজস্র পরত। ‘মাঠ ভাঙে কালপুরুষ’ অমর মিত্রের প্রথম গল্পের বই। আগামী প্রজন্মের কাছে কাগুজে বইপত্রের আর কোনও মূল্য নেই। অমর মিত্র জানেন, ডিজিটাল-যাপনে আর বইপত্রকে আগলে রাখবে না আগামী প্রজন্ম। মাপা আয়তনের ফ্ল্যাটে বাড়তি জায়গা নেই সাহিত্যের। সমস্ত লেখকেরই ভবিতব্য এটা। গল্পের মধ্যে অন্তর্লীন হয়ে আছে একজন লেখকের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয়, সন্দেহ এবং হাহাকার।  
 
সাধারণভাবে বাংলায় অমুসলিম লেখকদের রচনায় মুসলিম জীবন তথা মুসলিম মানস তেমন গুরুত্ব পায়নি। যে অল্প কয়েকজন অমুসলিম লেখকের লেখায় মুসলিম মানস বিষয় হয়ে উঠেছে তাঁদের মধ্যে অন্যতম অমর মিত্র। তাঁর গল্পে বাংলার প্রান্তিক মুসলমান জনগোষ্ঠীর ভাবচ্ছবি উঠে এসেছে। তাদের দৈনন্দিন যাপন ও চর্চার কথা যেমন উঠে এসেছে, তেমনই তাদের অধ্যাত্মচেতনাও।

‘কুলছুমের হাত’, ‘বছিরুদ্দি ভূমি ধরিতে যায়’, ‘হাসেম আলির সাতকাঠা’, ‘আবহমান’, ‘হস্তান্তর’, ‘আগুনের দিন’ ইত্যাদি গল্পে বাংলার কৃষি-নির্ভর মুসলিম জীবনের যাপন ও চর্চা, সমাজ-ভাবনা ও জীবনাদর্শের প্রতিফলন ঘটেছে। সেখানে জমি-কেন্দ্রিক দ্বন্দ্বের প্রাধান্য। গ্রামীণ মুসলমানদের জীবনবৃত্তে জমি-কন্দ্রিক সংঘাত, লোভ-লালসার চিত্র প্রকট হয়েছে তাঁর গল্পে। সেই সমস্যার নিরিখে গল্পের চরিত্রগুলির মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লষণও করেছেন লেখক। এভাবে তিনি বহু ধর্ম-বর্ণেরর মানুষের মিলনভূমি এই দেশের মানবিক মানচিত্রকে আলোকিত করতে চেয়েছেন।  
   
‘অমর মিত্রের ছোটগল্প’-এর উপক্রমণিকায় লিখেছিলেন— “বিষয় নিয়ে তো লিখি না। লেখার পরে তা হয়তো বিষয় হয়ে যায়। লেখার আগে তো তা থাকে সামান্য বেদনার অনুভূতি। হয়তো কিছুই না। শূন্য থেকে যাত্রা।” এই শূন্য থেকে যাত্রা করে জীবনের গহনে প্রবেশ করেন লেখক। লৌকিক আখ্যানকে উন্নীত করেন অলৌকিক আধারে। বিষয়ের বিন্যাসে আপাত অবাস্তবতাও বাস্তবতায় মূর্ত হয়ে ওঠে। অমর মিত্র যেমন গ্রামের গল্প লিখেছেন, তেমনি শহরজীবনেরও গল্প লিখেছেন সমান দক্ষতায়। দরিদ্র এবং মধ্যবিত্তের পরাজয় লাঞ্ছনা বিপর্জয় আত্মসমর্পনের পাশাপাশি তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্খা-প্রেম-ভালোবাসা-সংকল্প-সাহসিকতার কাহিনিই তাঁর গল্প। নির্ভার অথচ ইঙ্গিতময়তায় ঝকঝকে তাঁর লেখা। বদলে যাওয়া সময় এবং মানুষের প্রাত্যহিক যাপনের বিচিত্র স্বরূপ অমর মিত্রের গল্পের মূলধন।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

3 Comments

  1. আশ্চর্য এক লেখা পড়ে ভালোবাসায় চোখে জল এলো।

    ReplyDelete
  2. আশ্চর্য এক লেখা পড়ে ভালোবাসায় চোখে জল এলো।

    ReplyDelete