জ্বলদর্চি

চণ্ডী মাঝি ( সঙের গানের শিল্পী ) /ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ১৪

চণ্ডী মাঝি ( সঙের গানের শিল্পী )

ভাস্করব্রত পতি

রূপনারায়ণের গ্রাসে উজাড় গ্রামের উঠোন। তুলসিতলা। খেলার মাঠ। একদিকে চর ভাঙছে। অন্যদিকে চর জাগছে। ভিটাহারা মানুষ। বসতহারা মানুষ। কেউবা অদূর ভবিষ্যতে ভিটাহারা হওয়ার অপেক্ষায়। আচাইপুরের বুকে অনেক মানুষের মতো ভিটা হারানোর আশঙ্কায় দিন গুণছেন বৃদ্ধ চণ্ডী মাঝিও। কিন্তু সেই আশঙ্কার কালো মেঘ কখনই তাঁর সুরসাধনায় ছোবল মারতে পারেনি। তাঁর নিজস্ব জগতে আঘাত হানতে পারেনি।

তিনি জেলার মধ্যে একমাত্র গায়ক এবং লেখক যিনি ‘সঙের গান' করেন। আজ হারিয়ে গেছে এ গান। অনেকেরই স্মৃতি থেকে মুছে যেতে বসেছে এ গানের সুর। সেই স্মৃতিকে কিছুটা চাগিয়ে রাখতে লড়ছেন বৃদ্ধ চণ্ডী মাঝি। তাঁর 'শূন্য পকেটে অভাব'! কিন্তু স্বভাব বদলায়নি মানুষটার। বয়সের ভারে ন্যুব্জ। স্মৃতি সেভাবে মনকে চাগায়না। শিল্পের প্রতি সমাজের এই অবহেলা, অনাদর যেন ক্রমশঃ তাঁকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। তাঁর মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে। 

১৯৪৩-এ জন্ম। এর ঠিক ১২ বছর বাদে চণ্ডীর জীবনে ঠাঁই পায় সঙের গান। সেই গানের ধারা আজও তাঁর 'গলা' ধরে সমানভাবে জীবন্ত। হয়তো শ্রোতা নেই। তারিফ করার লোক নেই। অর্থ সংস্থানের উপায় নেই। তবুও তিনি লড়ছেন। তাঁর এই লড়াইতে পাশে আছেন সহধর্মিনী তিলোত্তমা।

ছোটবেলায় নাম ছিল 'নর্মদা'। কিন্তু বাড়ির লোক খেপাতো 'নর্দমা' বলে। সেই 'নর্দমা'কে তিনি বিয়ে করে গড়ে তুলেছেন তিলোত্তমাতে। ঠিক তেমন ভাবেই সমাজের নর্দমারূপ অংশকে তীক্ষ্ণ লেখনির গুণে তৈরি করেছেন তিলোত্তমা রূপে! তাঁর ক্যারিশমা এখানেই। তাঁর লেখা গানে থাকে জীবনের কথা। বেঁচে থাকার কথা। ভালোবাসার কথা। প্রেমের কথা। মানুষের কথা।

শুধু বসতবাটিটুকু সম্বল এই শিল্পীর। জমিজিরেত কিছুই নেই। সহায় সম্বলহীন এই মানুষটিকে রূপনারায়ণ গিলে ফেলতে পারেনি এখনও। গিলতে পারেনি তাঁর শিরদাঁড়াকেও। মনুষ্যত্বকেও। এখনো বেঁচে রয়েছে তাঁর শিল্পীসত্বা। অতি সাধারণ দরমার বেড়া দেওয়া ঘরেই সঙের গান লিখে চলেছেন জেলার একমাত্র প্রতিনিধি হিসেবে। রূপনারায়ণের পাড়ে সেই ঘরে পৌঁছনোর সাধ্যি কি হবে কোনও দিন শহরে 'বাবু' দের?

কলকাতার জেলেপাড়ার সঙের গান তিনি দেখেননি কোনওদিন। শোনেনওনি। তবুও আজ তিনি অনায়াসে লিখছেন সঙের গান। আসলে ১২ বছর বয়স থেকে গুরুদেব শচীন্দ্রনাথ মণ্ডলের হাত ধরে এ পথে ভাব জমিয়েছেন। সখ্যতা গড়েছেন। ভালোবসেছেন গানকে। তখন অবশ্য গ্রাম গ্রামান্তরে সঙের গানের ভালোই চল ছিল। আজ এসব ভোকাট্টা। এই গানের নামই শোনেনি অনেকেই।

বাবার মৃত্যুই তাঁকে এ পথে নামিয়ে দিয়েছে। 'মনের দুঃখে এ গান আমি শিখেছি' -- জবাব চণ্ডী মাঝির। সেদিনের কথা আজও মনে রয়েছে তাঁর। সেদিন গুরুদেব বলেছিলেন, 'জীবনে বেঁচে থাকতে গেলে মনকে শান্তি দিতে হয়। আর শান্তি মেলে গানের সুরে।' এরপর আর থেমে থাকতে পারেননি। নিজেকে ভাসিয়ে দেন গানের ঢেউতে। এখন সঙের গানের পাশাপাশি করছেন কীর্তন গান।

বৈশাখী গাজনে ডাক পেতেন তিনি। মাঝে মাঝে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে পেতেন গান গাওয়ার বরাত। কিন্তু এলাকার উৎসবে এসে যায় আধুনিকতার পরশ। আর তাতেই 'অপ্রয়োজনীয়' হয়ে পড়ে চণ্ডী মাঝিদের শিল্পীর জীবন। দুঃখে, অভিমানে, ক্ষোভে ছেড়ে দেন গান। অন্তত ১৩ বছর তিনি 'সন্ন্যাস' নিয়ে নেন গান থেকে। কিন্তু সেই অন্তরাল থেকে তাঁকে আলোয় ফিরিয়ে আনেন লোকগবেষক ড. শ্যামল বেরা। পাশে এসে দাঁড়ায় মধুসূদন মুখোপাধ্যায়দের 'সহজিয়া'। পেয়েছেন 'সহজিয়া সম্মান'। ফের ২০০১ থেকে শুরু হয় নতুন সূর্যের ভোর।

আজ কেবল পার্শ্ববর্তী হাওড়া জেলায় সঙের গানের সামান্য চল রয়েছে। কিন্তু অবিভক্ত মেদিনীপুরে সঙের গান আর কেউ করেননা এখন। উৎসাহও নেই। ঢণ্ডী মাঝির লেখনীতে প্রাণ পেয়েছে প্রায় ৬০ টি গান। সেইসব গান অবশ্য মৃত্যুর প্রহর গুনছে। পলিতে লটকে যাওয়া রূপনারায়ণের জলের স্রোতে ভেসে যাওয়ার অপেক্ষায়। 'একা কুম্ভ' হয়ে লড়ছেন আচাইপুরের সঙের গানের শেষ শিল্পী চণ্ডী মাঝি।

আরও পড়ুন

জ্বলদর্চি পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments