জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৩৯ /প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৩৯

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন,“...নরেন্দ্র, রাখাল, নিরঞ্জন, এদের ব্যাটা ছেলের ভাব।” (শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত) বাস্তবিকই নিরঞ্জন অত্যন্ত শক্তিশালী ও বীরভাবাপন্ন ছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের শেষ অসুখের সময় তাঁকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার দায়িত্বটি একান্তভাবে গ্রহণ করেন তিনি। এই সময় যুবক ভক্তেরা ঠিক করেছিলেন যে ঠাকুরের কাছে যখন তখন যাকে তাকে যেতে দেওয়া হবে না। নিরঞ্জন এই অপ্রিয় কাজটির ভার নিজ স্কন্ধে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে ধারণ করেছিলেন। শুধু তাই নয় চূড়ান্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখিও হতে হয়েছিল। এই সময়ে একদিন ভক্তপ্রবর শ্রীযুক্ত রামচন্দ্র দত্ত মহাশয় ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তিনি ঠাকুরের কাছে যেতে চাইলে নিরঞ্জন বাধা দেন। তখন অনন্যোপায় রামবাবু কিছু মিষ্টি ও মালা লাটুর ( পরবর্তীকালে স্বামী অদ্ভুতানন্দ ) হাতে দিয়ে বলেন, “ওরে, এগুলো প্রসাদ করে এনে দে।” লাটু স্বভাবতই নিরঞ্জনের আচরণে দুঃখিত হন। নিরঞ্জনকে বলেন নিজেদের মধ্যে এইসব নিয়ম জারি করার কি আদৌ প্রয়োজন আছে? নিরঞ্জন অবশ্য নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকলেন। এইবার লাটু খোঁটা দিতে ছাড়লেন না। বললেন,“শ্যামপুকুরে সেদিন দানা-কালী বিনোদিনীকে সাহেব সাজিয়ে নিয়ে এসেছিল, তুমি তাকে ছেড়ে দিতে পারলে, আর আজ এর মতো লোককে ছাড়তে চাইছ না?” শ্রীরামকৃষ্ণের শ্যামপুকুরে অবস্থানকালে ভক্তিমতী অভিনেত্রী বিনোদিনী ঠাকুরের গৃহীভক্ত শ্রীযুক্ত কালীপদ ঘোষের ( দানা-কালী নামে যিনি অধিক পরিচিত ছিলেন ) কাছে ঠাকুরকে দর্শন করার আকুতি জানান। ওই সময় নিরঞ্জন প্রমুখ ভক্তেরা নিয়ম করেছিলেন ওই জাতীয় স্ত্রীলোকেদের ঠাকুরের কাছে যেতে দেওয়া হবে না। কারণ এদের স্পর্শে ঠাকুরের অসুখ আরও বেড়ে যায়। এদিকে দানা-কালী অন্য কোনও উপায় না দেখে শ্রীরামকৃষ্ণ সমীপে উপস্থিতের জন্য আকুল বিনোদিনীকে সাহেব সাজিয়ে নিয়ে আসেন। দ্বারী নিরঞ্জনকে সম্পূর্ণ ফাঁকি দিয়ে তাঁকে ঠাকুরের কাছে নিয়ে আসেন। সেখানে অবশ্য ঠাকুরের কাছে সব কিছু প্রকাশ করে দেন দানা- কালী। এই নিয়ে হাসিঠাট্টাও হয়। যাই হোক লাটু বোধহয় ঠিকঠাক জায়গাতেই খোঁচা মেরেছিলেন। কেননা এই কথায় নিরঞ্জনের মন দ্রবীভূত হয় এবং তিনি রামবাবুকে উপরের ঘরে ঠাকুরের কাছে যেতে বলেন।
 লাটু মহারাজ বলেছেন,“কারুর অসুখ শুনলে দৌড়ঝাঁপের কাজ নিরঞ্জনভাই নিজের মাথায় নিত।” মঠ জীবনের একেবারে শুরুর দিকে শশী মহারাজ ( স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ) একবার বাইরে গিয়ে জ্বরাক্রান্ত হন। নিরঞ্জন তাঁকে পরম যত্নে মঠে নিয়ে আসেন এবং সেবা-শুশ্রূষা দ্বারা সুস্থ করে তোলেন। এলাহাবাদে যোগানন্দ স্বামী বসন্তে আক্রান্ত হলে, অবিলম্বে তাঁর রোগশয্যাপ্রান্তে উপস্থিত হতে দেখা যায় নিরঞ্জনকে। ১৮৮৮ সালে লাটু মহারাজ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। এক্ষেত্রেও সেবাযত্নের দায়িত্ব অনেকখানিই পালন করেন। ভক্তশ্রেষ্ঠ বলরাম বসুর শেষ অসুখের সময় স্বামী শিবানন্দ ও স্বামী সদানন্দের সঙ্গে প্রাণ ঢেলে আন্তরিকভাবে সেবাকার্যে অংশ নেন। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহত্যাগের পরপরই নরেন্দ্র প্রমুখের সঙ্গে নিরঞ্জনও আঁটপুর গিয়েছিলেন। সেখানে একটি পুকুরে স্নান করতে গিয়ে সারদা মহারাজ ( স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ ) ডুবে যান। কোনোরূপ প্রাণের মায়া না করে তাঁকে উদ্ধার করেন নিরঞ্জনই।
 শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনার অন্যতম প্রধান কারিগর ছিলেন নিরঞ্জন মহারাজ। ঠাকুরের ইচ্ছা ছিল তাঁর পূত দেহাবশেষ গঙ্গাতীরে সমাহিত করা হয়। কিন্তু কার্যত এই নিয়ে প্রবীণ ও নবীন ভক্তদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। প্রবীণেরা সিদ্ধান্ত নেন যে কাঁকুড়গাছিতে রামবাবুর উদ্যানে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন যুবক ভক্তেরা কোনও উপায় না দেখে সাময়িকভাবে ঠাকুরের ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সযত্নে রক্ষার্থে বলরাম-ভবনে পাঠিয়ে দেন। এছাড়া পূত দেহাবশেষ যাতে তাঁদের কাছেই থাকে সেই বিষয়ে শশী ( স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ ) এবং নিরঞ্জন ( স্বামী নিরঞ্জনানন্দ ) তৎপর হয়ে ওঠেন। তাঁরা গোপনে পরামর্শ করে একটি নূতন পাত্রে অর্ধেক-এর বেশি ভস্মাবশেষ ও অস্থিনিচয় সরিয়ে রাখেন। যথাসময়ে অবশিষ্ট অস্থিপূর্ণ কলসটি প্রবীণদের হাতে তুলে দেন। শশী ও নিরঞ্জনের তৎপরতা এবং আগ্রহে সংরক্ষিত এই অস্থিই পরবর্তীসময় ‘আত্মারামের কৌটা’য় করে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে আনেন।
 সম্ভবত ১৮৮৭ সালের শুরুর দিকে নিরঞ্জন বরানগর মঠে যোগ দেন এবং সন্ন্যাস গ্রহণান্তে নিরঞ্জনানন্দ নামে পরিচিত হন। এই সময় কাশী, ৺বৈদ্যনাথধাম প্রভৃতি স্থানসহ উত্তরভারতের অন্যান্য তীর্থস্থানসকল দর্শন করেন। কাশীতে বংশীদত্তের বাড়িতে থেকে কিছুকাল তপস্যা করেন। এখানে মাধুকরী ভিক্ষা করতেন।
 তীর্থরাজ প্রয়াগে কল্পবাস করেন। ১৮৯১-৯২ সালে স্বামী বিরজানন্দ ( কালীকৃষ্ণ মহারাজ ) বরানগর মঠে যাতায়াত শুরু করেন। সেই সময় নিরঞ্জন মহারাজকে প্রায়ই দক্ষিণেশ্বরে পঞ্চবটীতে ও শ্রীশ্রীঠাকুরের ঘরে ধ্যান করতে দেখতেন। মাঝে মাঝে তিনিও সঙ্গী হতেন তাঁর। নিরঞ্জনানন্দজীর পূতসঙ্গে কালীকৃষ্ণ মহারাজের বৈরাগ্য উদ্দীপিত হয় বহুলমাত্রায়। পরবর্তীসময়ে বিরজানন্দজীকে সঙ্গে নিয়ে নিরঞ্জন মহারাজ বেশ কয়েকবার জয়রামবাটী যান। কালীকৃষ্ণ মহারাজকে অসম্ভব স্নেহ করতেন। জয়রামবাটী থেকে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে কালীকৃষ্ণ মহারাজ মঠে এলে বলরাম-মন্দিরে তাঁর সেবার ব্যবস্থা করেন। এই সময় গিরিশবাবুর কাছে তাঁকে নিয়ে যেতেন, তাঁর মুখে শোনাতেন শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা। ১৮৯৪ সালে নিরঞ্জনানন্দজী সিংহলে গিয়ে উপস্থিত হন। এই দেশের যেখানেই যাচ্ছিলেন সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের মহিমাকীর্তন করায় তাঁর অনুরাগীসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। স্বামী বিবেকানন্দ এই বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন। একটি পত্রে লেখেন, “নিরঞ্জন সিলোন প্রভৃতি স্থানে অনেক কার্য করিয়াছে।” দীর্ঘকাল দক্ষিণভারত ও সিংহলে অতিবাহিত করার পর ১৮৯৫ সালের শুরুতে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবের আগেই আলমবাজার মঠে প্রত্যাবর্তন করেন। ‘ক্রমে ক্রমে রটিল বারতা’ -- ১৮৯৬ সালের শেষে পাশ্চাত্য দেশ থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন করতে চলেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। সংবাদ পাওয়ামাত্রই নিরঞ্জনানন্দজী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের নিমিত্ত অতি দ্রুত কলম্বো অভিমুখী হলেন। ১৫ জানুয়ারি জাহাজ থেকে অবতরণের সময় স্বামীজীকে তিনিই সর্বপ্রথম অভ্যর্থনা জানান। এরপর তিনি স্বামীজীর সঙ্গে দক্ষিণভারতের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণান্তে কলকাতায় এসে উপস্থিত হন। এই বছরেই স্বামিজীর সঙ্গে পাঞ্জাব ও কাশ্মীরের বহু স্থানে গিয়েছিলেন। ১৮৯৮ সালে স্বামীজীর আলমোড়া যাত্রার সঙ্গীও হন। সেখান থেকে কাশীতে এসে পুনরায় বংশীদত্তের বাগানে তপস্যারত হন। এবার তাঁর সঙ্গী ছিলেন স্বামী শুদ্ধানন্দ ( সুধীর মহারাজ )।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments