জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা--৪০/প্রীতম সেনগুপ্ত


পর্ব ৪০

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত


এই সময় কাশীর কতিপয় যুবক শ্রীযুক্ত কেদারনাথ মৌলিকের ( পরবর্তী কালে স্বামী অচলানন্দ ) বাড়িতে সমবেত হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরের বিষয়ে আলোচনা করতেন। নিরঞ্জন মহারাজ এঁদের আলোচনা সভায় একদিন উপস্থিত হন। শ্রীযুক্ত চারু ( দত্ত ) বাবুর ( উত্তরকালে স্বামী শুভানন্দ ) মাধ্যমে এই যোগাযোগ হয়েছিল। নিরঞ্জনানন্দজী সহজ সরল ভাষায় ঠাকুরের কথা বলেন। উপস্থিত ভক্তেরা সেইসব কথার ভাবমাধুর্যে মুগ্ধ হন। এর কিছুদিন পরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথিতে তিনি কেদারনাথের বাড়িতে পুনরায় পদার্পণ করেন। শ্রীরামকৃষ্ণের এক অন্তরঙ্গ পার্ষদের উপস্থিতি উপস্থিত ভক্তজনেদের মাঝে উদ্দীপনা বয়ে আনে। সেদিন নিরঞ্জনানন্দজী স্বয়ং শ্রীশ্রীঠাকুরের বিশেষ পূজাদি সম্পন্ন করেন। আয়োজন স্বল্প হলেও ভক্তদের মধ্যে উৎসাহ ছিল প্রভূত। ভক্তরা কিঞ্চিৎ প্রসাদও পেয়েছিলেন। এইভাবেই নিরঞ্জনানন্দজীর উদ্যোগে ও অনুপ্রেরণায় কাশীধামে শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মোৎসবের সূচনা হয়। কাশীতে আরও কিছু কাল অতিবাহিত করার পর তিনি হরিদ্বার চলে যান। এই পর্যায়ে কেদারনাথ ও নিরঞ্জনানন্দজীর মধ্যে এমন একটি সম্পর্কের বাতাবরণ তৈরি হয় যা কেদারনাথের জীবনে তাৎপর্যপূর্ণ। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাসেও যা অতি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা স্বামী অচলানন্দের মতো এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনে আবির্ভূত হলেন। প্রবল বৈরাগ্যের বশবর্তী হয়ে ১৮৯৯ সালের অগাস্ট মাসে একদিন হরিদ্বারে এসে উপস্থিত হন কেদারনাথ। নিরঞ্জন মহারাজ এখানে একটি ছোট ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। কেদারনাথ তাঁর কাছে এসে উপস্থিত হলেন। প্রণামান্তে তাঁকে বললেন, “শ্রীশ্রীঠাকুরের চরণে আশ্রয় লাভের আশায় গৃহত্যাগ করে আপনার কাছে এসেছি।” ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ ভক্তমালিকা, প্রথম ভাগ, স্বামী গম্ভীরানন্দ ) অত্যন্ত প্রীত হয়ে নিরঞ্জন মহারাজ তাঁকে সেখানে নিজের কাছে রাখলেন এবং গেরুয়া বস্ত্র দান করে কীভাবে মাধুকরী ও শ্রীশ্রীঠাকুরের সেবা করতে হয় ইত্যাদি সাধুবৃত্তি শিখিয়ে দিলেন।

 ১৯০০ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বামীজী ( স্বামী বিবেকানন্দ ) পুনরায় আমেরিকা থেকে প্রত্যাবর্তন করলেন। স্বামীজীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আনন্দে আনন্দিত হলেন নিরঞ্জন মহারাজ। ১৯০২ সালে কাশীধামে যান স্বামীজী। সেখানে স্বামীজীর বাসের জন্য কালীকৃষ্ণ ঠাকুরের প্রাসাদোপম বাড়িটি সংগ্রহ করেন নিরঞ্জনানন্দজী। এই সময়েরই কিছু আগে প্রসিদ্ধ জাপানী শিল্পী ওকাকুরা ভারতে এসে প্রাচীন স্থানসমূহ দেখবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। স্বামীজী নিরঞ্জনানন্দজীকে তাঁর সঙ্গে দেন। তাঁরা দু'জনে ( নিরঞ্জনানন্দজী ও ওকাকুরা ) একত্রে বুদ্ধগয়া, আগ্রা, গোয়ালিয়র, অজন্তা প্রভৃতি দ্রষ্টব্য স্থানগুলি পরিদর্শন করেন। নিরঞ্জনানন্দজীর অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ ওকাকুরা স্বামীজীকে পত্র লিখে অশেষ প্রশংসা করেন। এদিকে ১৯০২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বামীজী কাশীধামে খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্বামী শিবানন্দজীর সঙ্গে নিরঞ্জনানন্দজী তাঁকে বেলুড় মঠে নিয়ে আসেন। মঠে এসে পাগড়ি মাথায়, হাতে লাঠি নিয়ে স্বামীজীর দ্বার রক্ষার কাজটি পরম আনন্দ ও গৌরবের সঙ্গে করেন। একথা স্মরণ করা যেতেই পারে যে, শ্রীশ্রীঠাকুরের অসুখের সময়ও তিনি একই কাজ করেছিলেন পরম নিষ্ঠায়, যা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে।
 শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি অপার শ্রদ্ধা পোষণ করতেন নিরঞ্জন স্বামী। একটি চিঠিতে স্বামীজী লেখেন, “নিরঞ্জন লাঠি-বাজি করে; কিন্তু তার মায়ের উপর বড় ভক্তি। তার লাঠি হজম হয়ে যায়।" নাট্যসম্রাট গিরিশচন্দ্র ঘোষ মন্তব্য করেছিলেন, “আমিই কি প্রথমে মানতুম -- নিরঞ্জনই আমার চোখ খুলে দিলে।” এখানে শ্রীশ্রীমা'কে মানার কথাই বলেছেন গিরিশচন্দ্র। তাঁর এমন মন্তব্যের কারণ ছিল। কেননা, পুত্রশোকে বিহ্বল গিরিশচন্দ্রের শোক নিরসনের জন্য আমোঘ রাস্তার সন্ধান দিয়েছিলেন নিরঞ্জনানন্দজী। গিরিশচন্দ্রকে সঙ্গে নিয়ে কিছুদিন জয়রামবাটীতে মায়ের কাছে মায়ের বাড়িতে অবস্থান করেন। এই সময় জগজ্জননী মা সারদার মর্ম সম্যকভাবে উপলব্ধি করেন গিরিশচন্দ্র। এদিকে ১৯০২ সালের ৪ জুলাই ইন্দ্রপতন ঘটল। স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মহাসমাধিতে প্রবেশ করলেন। নিরঞ্জনানন্দজীও স্বল্পায়ু ছিলেন। স্বামীজীর দেহত্যাগের পর তিনিও এই ধরাধামে আর বেশিদিন ছিলেন না। পুরনো আমাশয় রোগ বেড়ে যাওয়ায় হরিদ্বারে চলে যাওয়া স্থির করলেন। এই সময় বিস্ময়করভাবে শ্রীশ্রীমায়ের প্রতি তাঁর অতিরিক্ত নির্ভরতার ভাব লক্ষ্য করা যায়। কেন এই নির্ভরতার ভাব তাঁর মধ্যে দেখা দিল তা কেউই বুঝে উঠতে পারেন নি। হরিদ্বার যাওয়ার কিছুদিন আগে থেকে তিনি আব্দার করলেন মাতৃ-হস্তে রন্ধনের, মাতৃ হস্তে আহারের। এইসবের জন্য মায়ের মুখ চেয়ে থাকতেন। অবশেষে বিদায়ের মুহূর্তে সমস্ত ধৈর্যের বাঁধন ভেঙে গিয়ে অবোধ শিশুর মতো কাঁদতে থাকলেন। মায়ের চরণ দুটিতে লুটিয়ে সে কি অধীর কান্না, আকুতি! এই যে শেষ দেখা তা বোধহয় তিনি জানতেন। হরিদ্বারে এসে একটি ভাড়াবাড়িতে উঠে যথারীতি তপস্যায় রত হলেন। স্বাভাবিকভাবেই শরীরের প্রতি উদাসীনতায় শারীরিক উন্নতির বদলে অবনতিই দেখা দিল। আমাশয়ে তো ভুগছিলেনই হঠাৎ প্রাণঘাতী বিসূচিকা দেখা দিল। ১৯০৪ সালের ৯ মে ( ২৭ শে বৈশাখ, ১৩১১ বঙ্গাব্দ ) মাত্র ৪২ বছর বয়সে তিনি চির নিদ্রায় গেলেন। এই বীরভক্তের স্থান হল জগজ্জননীর ক্রোড়ে।
 স্বামী বিবেকানন্দ স্থাপিত শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের কোনওরূপ পদে কোনও সময়েই ছিলেন না নিরঞ্জনানন্দজী। কিন্তু তাঁর জীবনের মূল সুরটি ছিল শ্রীশ্রীঠাকুরের প্রতি বিশ্বাস ও নির্ভরতা। আধ্যাত্মিক গুণবিচারে তাঁর স্থানটি ছিল অতি উচ্চে, কারণ শ্রীরামকৃষ্ণের ছ'জন ঈশ্বরকোটি সন্তানের অন্যতম ছিলেন তিনি, যা পূর্বেই উল্লিখিত হয়েছে। কাশীপুর উদ্যানবাটীতে গলরোগে আক্রান্ত শ্রীরামকৃষ্ণ ও মাস্টারমশাইয়ের কথোপকথন এই প্রসঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ।

 শ্রীরামকৃষ্ণ -- “...আচ্ছা, এত ঈশ্বরীয় রূপ দর্শন, ভাব, সমাধি! -- তবে এত ব্যামো কেন? 
 মাস্টার -- আজ্ঞা, খুব কষ্ট হচ্ছে বটে, কিন্তু উদ্দেশ্য আছে। 
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- কি উদ্দেশ্য? 
মাস্টার -- আপনার অবস্থা পরিবর্তন হবে -- নিরাকারের দিকে ঝোঁক হচ্ছে। -- ‘বিদ্যার আমি’ পর্যন্ত থাকছে না।
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- হ্যাঁ, লোকশিক্ষা বন্ধ হচ্ছে -- আর বলতে পারি না। সব রামময় দেখছি। -- এক-একবার মনে হয়, কাকে আর বলব! দেখো না, -- এই বাড়ি ভাড়া হয়েছে বলে কতরকম ভক্ত আসছে।

 “কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন বা শশধরের মতো সাইনবোর্ড তো হবে না, -- অমুক সময় লেকচার হইবে।” ( ঠাকুর ও মাস্টারের হাস্য )
 মাস্টার -- আর একটি উদ্দেশ্য লোক বাছা। পাঁচ বছরের তপস্যা করে যা না হত, এই কয়দিনে ভক্তদের তা হয়েছে। সাধনা, প্রেম, ভক্তি। 
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- হাঁ, তা হল বটে! এই নিরঞ্জন বাড়ি গিছলো।  (নিরঞ্জনের প্রতি ) তুই বল দেখি, কিরকম বোধ হয়? 
 নিরঞ্জন -- আজ্ঞে, আগে ভালবাসা ছিল বটে, -- কিন্তু এখন ছেড়ে থাকতে পারবার জো নাই।
 মাস্টার -- আমি একদিন দেখেছিলাম, এরা কত বড়লোক! 
 শ্রীরামকৃষ্ণ -- কোথায়? 
  মাস্টার -- আজ্ঞা, একপাশে দাঁড়িয়ে শ্যামপুকুরের বাড়িতে দেখেছিলাম। বোধ হল, এরা এক-একজন কত বিঘ্ন ঠেলে ওখানে এসে বসে রয়েছে -- সেবার জন্য।
 ...শ্রীরামকৃষ্ণ -- “লোক বাছা যা বলছ তা ঠিক। এই অসুখ হওয়াতে কে অন্তরঙ্গ, কে বহিরঙ্গ বোঝা যাচ্ছে। যারা সংসার ছেড়ে এখানে আছে, তারা অন্তরঙ্গ। আর যারা একবার এসে ‘কেমন আছেন মশাই’ জিজ্ঞাসা করে, তারা বহিরঙ্গ। ( শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, শ্রীম-কথিত, অখণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, পৃষ্ঠা-১০১১-১২ )
 বলা বাহুল্য, নিরঞ্জন, পরবর্তীতে স্বামী নিরঞ্জনানন্দ, শ্রীশ্রীঠাকুরের একান্ত অন্তরঙ্গ ছিলেন।

পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

0 Comments