জ্বলদর্চি

চিকিৎসক বিদ্যাসাগর /প্রসূন কাঞ্জিলাল


চিকিৎসক বিদ্যাসাগর

প্রসূন  কাঞ্জিলাল


সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত, সমাজসেবী, সমাজ সংস্কারক, এক বিশাল জ্ঞানের অধিকারী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়কে সারা বিশ্বের মানুষ চেনেন। কিন্তু চিকিৎসক রূপে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যাপ্তি সমন্ধে খুব কম সংখ্যক মানুষই জ্ঞাত। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগর মহাশয় এর আগ্রহ ও অবদান ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য। কিন্তু তার চিকিৎসা পদ্ধতির মূল অস্ত্র ছিল তার নিঃস্বার্থ সেবাপরায়ণতা এবং দরিদ্র মানুষের প্রতি তার অন্তরের ভালোবাসা।
বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার অত্যন্ত মানবিক নাকি ঐশ্বরিক বিবরণ পাওয়া যায় তার কারমাটার বাস কালে দরিদ্র শিক্ষাহীন সাঁওতালদের সান্নিধ্যে। বিহারীলাল সরকার লিখছেন "সাঁওতাল প্রবল পীড়ায় প্রায় শয্যাগত বিদ্যাসাগর তাহার শিয়রে বসিয়া, মুখে ঔষধ ঢালিয়া দিতেন, হা করাইয়া পথ্য দিতেন উঠাইয়া বসাইয়া মলমূত্র ত্যাগ করাইতেন সর্বাঙ্গে হাত বুলাইয়া দিতেন।" এ আন্তরিকতার হদিশ পেয়েছে শুধু সাঁওতালরা নয় সমাজের বিভিন্ন বৃত্তের মানুষ আর এই প্রয়াসের বলিষ্ঠতা তার আকৈশোরের অভ্যাস অথবা বলা ভালো জীবনধর্ম। এই মরমী মনটি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার বহু আগে থেকেই ছিল সে কোন কৈশোর কালে বাবা ঠাকুরদাসের আশ্রয়দাতা 
জগদ্দূর্লভ সিংহের পরিচিত কিছু মানুষ কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে শুনে বালক ঈশ্বরচন্দ্র তার বাবা ও দুই ভাই এর ভোজনের আয়োজন করে অসহায় পাঁচজন রোগীর কাছে গেলেন। ক্রমাগত বমি ও মলত্যাগের ক্লান্ত ও পিপাসার্ত মানুষগুলির জন্য স্থানীয় গৃহস্থ বাড়ি থেকে জল এনে খাওয়ালেন, ডাক্তার রূপচাঁদের বাড়ি থেকে বেদানা, মিছরি, এক কলসি পরিষ্কার জল এনে রোগীদের খাওয়ালেন নিজের হাতে বমি মলমূত্র পরিষ্কার করে ধোয়া কাপড় পড়ালেন। ডাক্তারের জল চিকিৎসায় আর ঈশ্বরচন্দ্রের সেবায় ক্রমে রোগীরা সুস্থ হয়ে উঠলেন। ১৮৬৬ সালের দুর্ভিক্ষে কলকাতার কলেজ স্কয়ার অঞ্চলে উপোসী মানুষকে নিজে হাতে খাবার পরিবেশন করেছিলেন । বীর সিংহ গ্রামে অন্ন ছত্র খুলেছিলেন, বিদ্যাসাগরের কড়া হুকুম ছিল যত টাকা খরচ হোক কেউ যেন অভুক্ত না থাকে। ১৮৬৯ - ৭০ সালে বর্ধমান এ এক ভয়ানক জ্বরে প্রচুর মানুষ মারা যায়। জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সেইসব মানুষদের বিদ্যাসাগর সেবা ঔষধ পথ্য দিয়ে সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত করেছেন। সেই জ্বর ছিল প্রকৃতপক্ষে ম্যালেরিয়া। বিদ্যাসাগর এ রোগের চিকিৎসার জন্য ডিসপেনসারি, ওষুধ পত্রের ব্যবস্থা করে ক্ষান্ত হননি, কলকাতায় এসে সেকালের ছোটলাট গ্রে সাহেবের কাছে বিষয়ের গুরুত্ব বোঝান। ফলে সরকারি বদান্যতায় আরো অনেক ডিসপেন্সারি খোলা হল। বিদ্যাসাগরের ডিসপেন্সারি থেকে শুধু ওষুধ পত্র নয় পয়সা ও পরনের কাপড় পর্যন্ত পাওয়া যেত। এই ডিসপেন্সারীর কাজে বিদ্যাসাগরকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্রের ভাইপো ডাক্তার গঙ্গা নারায়ন মিত্র। ম্যালেরিয়া রোগীকে সেখান থেকে কুইনাইন দেওয়া হত প্রয়োজনে তাদের বাড়ি গিয়েও বিদ্যাসাগর স্বয়ং ওষুধ পথ্য পৌঁছে দিয়ে আসতেন। বিদ্যাসাগরের এই অনন্য সাধারণ সেবার কথা স্মরণ করে, আরেক বিশিষ্ট মানুষ রজনীকান্ত গুপ্ত লিখছেন "১৮৮৩ সালে একদা তিনি বিদ্যাসাগর মশাই প্রাত:কালে ভ্রমণ করিতে করিতে এই নগরের প্রান্ত ভাগ অতিক্রম করিয়া কিয়দ্দূর  গিয়েছেন, সহসা দেখিলেন একজন বৃদ্ধা অতিসার রোগে আক্রান্ত হইয়া পথের পাশে পড়িয়া রহিয়াছে। দেখিয়ে তিনি ওই মল লিপ্ত বৃদ্ধাকে পরমযত্নে ক্রোড়ে করিয়া আনিলেন এবং তাহার যথোচিত চিকিৎসা করাইলেন। দরিদ্রা বৃদ্ধা তাহার যত্নে আরোগ্য লাভ করিল।"

আসলে বিদ্যাসাগর সারাজীবন যখন যে কাজে নেমেছেন, সেখানে তার নিষ্ঠায় কোন খাদ রাখেন নি, নিখুঁত কর্ম সম্পাদনকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার ক্ষেত্রে এর অন্যতা দেখা যায় না চিকিৎসকের ডিগ্রী না থাকলে পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, অপার ধৈর্য এবং সীমাহীন মমতা, যে গুণগুলি না থাকলে একজন ডিগ্রীধারী চিকিৎসকও ব্যর্থ হয়ে যেতে পারেন। 
  কারমাটারে একদিন সকালে এক মেথর কাঁদতে কাঁদতে এসে তাকে বলল, আমার ঘরে মেথরানির কলেরা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলেন বিদ্যাসাগর ওষুধের বাক্স আর মোড়া নিয়ে এক ভৃত্য তার সাথী হল। সারাদিন রোগীর কাছে থেকে  প্রয়োজনীয় ঔষধ দিয়ে সেবা করে গেলেন। তাকে কিছুটা ভালো দেখে সন্ধ্যেবেলায় বাড়ি ফিরে স্নানাহার করলেন।
এই সেবার এক সুন্দর উদাহরণ দিয়েছেন জীবনীকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কারমাটার থেকে বন্ধু রাজনারায়ণ বসুকে চিঠিতে লিখছেন বিদ্যাসাগর ,"আমি কল্য অথবা পরশ্ব আপনাকে দেখিতে যাইব স্থির করিয়াছিলাম কিন্তু এরূপ দুটি রোগীর চিকিৎসা করিতেছি যে তাহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া যাওয়া কোনমতেই উচিত নহে, এজন্য দু চারি দিন দেওঘর যাওয়া রহিত করিতে হইল।"

শুধু নিজে চিকিৎসা করতেন এমন নয় ১৮৭৭ সাল থেকে প্রতিবছর প্রায় ২০০ টাকার বই, ওষুধ বিদেশ থেকে আনাতেন, বই পড়তেন, নিজেই প্রয়োজনে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বিতরণ করতেন, ওষুধ বিলোতেন  দরিদ্র মানুষের চিকিৎসায়, পুরোটাই মানব কল্যাণের নেশায়। তার অতি বড় নিন্দুকেরাও কেউ বলেননি বিদ্যাসাগর ডাক্তারি করেছেন ফি নিয়ে। ডিসপেন্সারি করেছেন নিজের গ্রাম বীরসিংহে ,সেখানে নিজে গ্রামবাসীদের চিকিৎসা করেছেন, মেজ ভাই দীনবন্ধুকেও উৎসাহিত করেছেন একই কাজে। বর্ধমান ফিভারের সময় বিস্তীর্ণ এলাকায় একইভাবে ডিসপেনসারি খুলে চিকিৎসা করেছেন, নিজের উদ্যোগে, প্রয়োজনে সরকারি প্রশাসনের উচ্চস্তরস্তরে সেখানে কোন রোগের জাত ধর্ম বিচার করেননি। এখানে একটি কথা না বললেই নয় যে, কোন শাস্ত্রে পারদর্শিতার আড়ালে থাকে দীর্ঘ ও ধারাবাহিক শ্রম। হোমিওপ্যাথি বিদ্যায় প্রাতিষ্ঠানিক প্রথাগত শিক্ষা না পেলেও তার স্বশিক্ষার আন্তরিকতার কথা জানলে বিস্মিত না হয়ে পারা যাবে না। তার ব্যক্তিগত সংগ্রহের স্বাস্থ্য বিজ্ঞান সম্পর্কিত বইগুলি তার নিবিড় অনুরাগের হদিস দেয় বর্তমানে কলকাতায় সাহিত্য পরিষদ ভবনে রাখা আছে। হোমিওপ্যাথি, চাইল্ড কেয়ার সাইকোলজি, সাধারণ স্বাস্থ্য সম্পর্কিত অজস্র বই। শারীরবিদ্যায় প্রগাঢ় অনুরাগ ও যথাচিত জ্ঞান না থাকলে কি আর জীবনের শেষ প্রান্তে এসে মেয়েদের সম্মতি বিলে পূর্ব নির্দিষ্ট ১২ বছর বয়স থেকে মান্যতা দিতে আপত্তি জানান! শুধু শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে নয় তিনি জেনেছিলেন স্বদেশের মেয়েদের রজ:স্বলা হওয়ার বয়স ১২ বছরেই স্থির থাকে না,  ১৩,১৪ এমনকি ১৫ বছরেও পৌঁছতে পারে। এ ধারণা পেতে তাকে হয়তো বা সাহায্য করেছিলেন, বাংলায় প্রথম সব ব্যবচ্ছেদকারী, সংস্কৃত কলেজে একদা বৈদিক শ্রেণীর ছাত্র, পরবর্তীতে পাশ্চাত্য চিকিৎসায় শিক্ষিত চিকিৎসক এবং তার প্রিয়জন পণ্ডিত ও গবেষক মধুসূদন গুপ্ত।

চিকিৎসক অগ্রজ এর আরো অন্তরঙ্গ পরিচয় দিয়েছেন‌ সহোদর শম্ভু চন্দ্র বিদ্যারত্ন মহাশয়। ১৮৭৫ সালে তার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, "দাদা প্রাতঃকাল হইতে বেলা ১০ ঘটিকা পর্যন্ত সাঁওতাল রোগী দিগকে হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসা করিয়া থাকেন এবং পথের জন্য সাগু- বাতাসা মিছরি প্রভৃতি নিজে হইতে প্রদান করিতেন, অপরাহ্ন বেলায় পীড়িত সাঁওতালদের পর্ন কুটিরে যাইয়া তত্ত্বাবধান করিতেন।"এখানে লক্ষ্যনীয় তিনি শুধু ওষুধ দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না ,যুক্তিনিষ্ঠ বিদ্যাসাগর জানতেন পথ্য সঠিক না হলে শুধু ওষুধে রোগ সারে না। কারমাটারে বিদ্যাসাগরের আরেকদিন এর জীবন কথা উল্লেখ করেছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি দেখলেন সকাল থেকে অনবরত সাঁওতালরা তার কাছে ভূট্টা নিয়ে আসছে আর তিনিও কোনরকম দরাদরি না করে সব ভুট্টা কিনে নিচ্ছেন। কিছু পরে হরপ্রসাদ দেখলেন প্রখর রোদে ঘর্মাক্ত বিদ্যাসাগর হনহন করে আল পথ ধরে হেঁটে আসছেন, একটি পাথরের বাটি। হরপ্রসাদ প্রশ্ন করাতে বিদ্যাসাগর জানালেন কিছুক্ষণ আগে একটি সাঁওতালি এসে খবর দিয়েছে তার ছেলের নাক দিয়ে হু হু করে রক্ত পড়ছে, বললে, বিদ্যাসাগর তুই এসে যদি তাকে বাঁচাস। আমি একটা হোমিওপ্যাথিক ওষুধ নিয়ে গেছিলাম জানিস এক ডোজ ওষুধেই ছেলেটার রক্ত পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যাসাগর আরো বললেন এরা তো মেলা ওষুধ খায় না অল্প ওষুধে এদের উপকার হয়। 
হরপ্রসাদ আরো প্রশ্ন করে জেনেছিলেন ,গ্রামটি বেশি দূরে নয় মাত্র মাইল দেড়েক পথ ।২১ শতকে এসে ভাবতে অবাকই লাগে ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ প্রখর রৌদ্রে অনায়াসে তিন মাইল পথ পরিক্রমা করে এলেন শুধুমাত্র দিন-দরিদ্র অবহেলিত অন্ত্যজ মানুষের সেবায়।
    এবার আসি অন্য এক দৃশ্যে।  সারা জীবন অজস্র ব্যাধিতে ভুগেছেন বিদ্যাসাগর । খুব শৈশবে প্লীহার রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে ক্রনিক পেটে ব্যথা কোষ্ঠবদ্ধতা, উদরাময় রক্ত আমাশা ইত্যাদি ছিল তার নিত্য সঙ্গী। পরিণত বয়সে কাজের তাগিদে বিস্তৃত ভ্রমণ করতে হয়েছে হুগলি, বর্ধমান নদিয়া, মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলার প্রত্যন্ত প্রান্তে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন গ্রামের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য পরিষেবা হীন দিনলিপি। সামান্য উপায় খুঁজে পেলে একজন অতি সংবেদনশীল মানুষ সমস্যা থেকে কি মুখ ফেরাতে পারেন বিদ্যাসাগরের চিরকালীন করুনা সিক্ত মন সীমাহীন উৎসাহে তৎক্ষণা পরোপকারী প্রবৃত্ত হয়েছেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় মনোনিবেশ সেই চিত্ত বৃত্তিরই প্রকাশ।
    অধ্যাপক ক্ষুদিরাম বসু স্মরণ করেছেন তার একবার পেটের ব্যারাম হয় সেকালের বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক ডক্টর প্রতাপচন্দ্র মজুমদার ও ব্রজেন বাল্যের ওষুধে কাজ দিচ্ছিল না। বিদ্যাসাগর মহাশয় তাকে দেখতে এসে বই খুঁজে খুঁজে ওষুধ দিলেন দু-তিনবার সেই ওষুধ খাওয়ার পর সুস্থ হয়েছিলেন। স্বয়ং মহেন্দ্রলাল সরকারের ওষুধ পাল্টে দিয়ে বিদ্যাসাগর আরেক রোগী লাল বিহারী দে'র লিভার অ্যাবসেস সারিয়েছিলেন।
    বিদ্যাসাগর মহাশয় এর অনন্ত অনুসন্ধিৎসু মন তাকে দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘটনার থেকেও আবিষ্কারের পথ দেখিয়েছে বারবার। সেরকমই এক ঘটনায় আলোকপাত করি, 
পুরানো হাঁপানি রোগের কারণে বিদ্যাসাগর মহাশয় শীতকালে বিশেষভাবে কষ্ট পেতেন। তখন তার অভ্যাস ছিল সকাল বিকেল দুবেলা গরম চা পান ।একদিন চা পানের পর তার মনে হল বেশ সুস্থ লাগছে, হাঁপানির টান যেন বেশ কিছুটা কম। গৃহভৃত্যকে জিজ্ঞাসা করে জানলেন, সেদিনের চা সে নিজেই তৈরি করেছে। বিদ্যাসাগর প্রশ্ন করলেন চায়ের মধ্যে কি আদার রস মেশানো হয়েছে? গৃহভৃত্য বলল না সেরকম কিছু সে করেনি , তবে তাড়াহুড়ো কেটলিটি না ধুয়ে জল চাপিয়ে দিয়েছে। কেটলি খুলে দেখে বিদ্যাসাগর যুগপৎ বিস্ময় এবং ঘৃণা অনুভব করলেন। কেটলির মধ্যে দুটি আরশোলা পড়ে আছে। বিদ্যাসাগরের অনুসন্ধিতসু মন বললো, এক কেটলি জলে যদি বেশ কিছু আরশোলা ফুটিয়ে পরে সেই নির্যাস অ্যালকোহলে ফেলে ছেকে ও পরে লঘু দ্রবণ করে হোমিওপ্যাথি ওষুধ বানানো যায়, তবে হাঁপানি রোগের ক্ষানিক উপশম হতে পারে।
  ভুবন কৃষ্ণ মিত্র লিখছেন এভাবে হোমিওপ্যাথি মতে ওষুধ তৈরি করে তিনি বহু রোগীকে না জানিয়ে এই ওষুধ সেবন করান এবং বিনা ব্যয় বহু লোকের রোগের উপশম ঘটান। যেকোনো যুক্তিনিষ্ঠ মন অপ্রাকৃত কিছু দেখলে অনুসন্ধানে ব্যস্ত হবেই। বিদ্যাসাগর ও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। পরবর্তীকালে তার বানানো এই ঔষধটি 'Blatta  Orientalis' নামসহ মেটেরিয়া মেডিকা বইটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সমাজ সংস্কারক এবং জ্ঞানের সাগর বিদ্যাসাগর মহাশয়ের গবেষণার ইতিহাসে এই কৃতিত্বের কথা হয়তো এখানের বহু হোমিওপ্যাথি গবেষকেরাই জানেন না হয়তো।

সেকালে কি বাংলায় ডাক্তার ছিল না ? সেখানে বিদ্যাসাগরের মতো অন্যতম শাস্ত্রে পন্ডিতের নাক গলানোর কি দরকার ছিল?  তাও জীবনের প্রান্তিক পর্বে! উত্তরের নির্দ্বিধায় বলা যায় ব্যবস্থা ছিল তো বটেই ১৮৩৫ সালে কলকাতায় মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর পাশ্চাত্য মতে চিকিৎসা বিদ্যার চর্চা যথেষ্টই হতো। পাশাপাশি দেশীয় আয়ুর্বেদ, হাকিমি চিকিৎসার ব্যবস্থাও পুরো মাত্রায় বজায় ছিল।

বিদ্যাসাগরের এই কাজে এগিয়ে আসার কারণ আর কিছুই নয় তার বিজ্ঞানমনস্ক মনের কাঠামোয় সদা জাগ্রত সেই অপার সেবা পরায়ণতার মনোবৃত্তি যা তাকে তাড়না করেছিল দরিদ্র আর্ত মানুষের রোগের চিকিৎসার জন্য স্বল্প ব্যয় নিরাময় যোগ্য এক এক নতুন ধরনের প্রায়োগিক চিকিৎসা ব্যবস্থায়। বিদ্যাসাগরের হোমিওপ্যাথি চর্চার কেন্দ্রে হয়তো ছিল দেশের অগণিত দরিদ্র অসহায় মানুষের বেদনায় সেই জীবন প্রমাণ এমপ্যাথি অর্থাৎ নিজের দারিদ্র ভরা শৈশব অথবা কৈশোরের অভিজ্ঞতায় যা তিনি নিবিড় ভাবে জেনেছিলেন, দুঃখ দুর্দশা তাড়িত মানুষের জন্য সেই নিজস্ব অনুভব ক্ষন মুহূর্তের জন্য ভোলেননি। একই স্পন্দনে অনুভব করেছিলেন তাদের দুর্দশার মাত্রা। তাই হয়তো প্রথা মাফিক চিকিৎসক না হয়েও তার নিঃসংশয়ে চিকিৎসকের ছদ্মবেশ নেওয়া তারই জন্য প্রৌঢ়ত্বে সীমায় দাঁড়িয়ে সমাজসেবার ভিন্নতর রূপ আশ্রয় করেছিল।

বিদ্যাসাগরের জন্মের দুইশত তিন বছর উপলক্ষে অনেক বিদগ্ধ আলোচনার ভিড়ে কেমন করে প্রকাশ পায়নি, তার জীবনের এই বিশেষ অধ্যায়টি। একজন শিক্ষা প্রসারী পুস্তক প্রণেতা এবং পুস্তক ব্যবসায়ী বিদ্যাসাগর কিভাবে তার পরিশ্রম ও অধ্যাবসায় এবং অপরিসীম মানব দরদ নিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এক ডিগ্রি বিহীন স্বশিক্ষিত নি:শঙক চিকিৎসক। ডাক্তার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

সময়টা ছিল ১৮৬৬ সাল। বহুদিন ধরে বিদ্যাসাগর দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগছিলেন প্রচলিত চিকিৎসায় কোনরকম উপশম ঘটছিল না। সেই বিপদ থেকে তাকে সরিয়ে তুললেন কলকাতার বউবাজার অঞ্চলের পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে শিক্ষিত, অগ্রণী চিকিৎসক , ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল দত্ত, ভারতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার অন্যতম পথপ্রদর্শক। হোমিওপ্যাথি এই বিচিত্র চিকিৎসা বিদ্যার আবিষ্কারক ছিলেন ১৭৫৫ সালে জন্ম নেওয়া জার্মান চিকিৎসক স্যামুয়েল হ্যানিম্যান। প্রথাগতভাবে পাশ্চাত্য চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যায়ন করলেও সমকালীন চিকিৎসা পদ্ধতির আসুরিক প্রয়োগ পদ্ধতি দেখে তিনি বীতশ্রদ্ধ হয়েছিলেন। একসময় উইলিয়াম কিউ লেন্সের  'আ ট্রিটিস অন মেটেরিয়া মেডিকার ' অনুবাদ করতে গিয়ে দেখলেন পেরুভিয়ান গাছের ছাল থেকে পাওয়া সিঙ্কোনা, ম্যালেরিয়া রোগ সারায়। রসায়নে বিশেষ পারদর্শী মানুষটি নিজের ওপর এই রসায়নের প্রয়োগ করে দেখলেন। তার নিজের শরীরেও ম্যালেরিয়ার মত লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আরো বেশ কিছু রসায়নের এই ধরনের প্রভাব লক্ষ্য করে তিনি সিদ্ধান্ত করলেন যে সব বস্তু বা জিনিস কোন সুস্থ মানুষের দেহে কোন বিশেষ রোগ লক্ষণ দেখাতে পারে, সেই একই জিনিস ওই বিশেষ রোগ বৈশিষ্ট্য যুক্ত রোগীর রোগ নিরাময়ও করতে পারে। মতবাদটির ব্যাখ্যা করলেন এইভাবে "লাইক কিউরস লাইক"। ১৭৯৬ সালে এই ভাবনা থেকে যা তো নতুন চিকিৎসা পদ্ধতির নাম দিলেন হোমিওপ্যাথি। অনেক বস্তুর ওপর পরীক্ষা করে ,তাদের প্রয়োজনমতো লঘু দ্রবণ তৈরি করে, বিষাক্ত রাসায়নিক প্রভাব দূর করলেন। ১৮১০ সালে প্রকাশিত হলো তার বিখ্যাত বই "দ্য অর্গানন অফ হিলিং আর্ট", পরে লিখলেন আরেকটি বই "মেটেরিয়া মেডিকা পুরা", হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার সাপেক্ষে নিরাময়ের তথ্যাদি ও রিপোর্ট।
          ৮৮ বছরের জীবন কালের এই বিজ্ঞানের চিকিৎসা দর্শন বিদ্যাসাগর মহাশয়কে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৪৩ সালে হ্যানিম্যানের মৃত্যু হলেও এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ততদিনে সারা পৃথিবীতে সমাদৃত হয়ে গেছে। ভারতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, প্রবেশ করে ১৮৪৯ সালে ডক্টর জন মার্টিন হানিগরারগার এর মাধ্যমে, পাঞ্জাবের মহারাজা হরি সিং এর অসাড় স্বরতন্ত্রী ও উদরীর চিকিৎসার সুবাদে। ১৮৪৭ - ৪৮ সালে ভারতে ঘটে যাওয়া কলেরার মহামারীতে দক্ষিণ ভারতের তাঞ্জোরে এসে চিকিৎসা করলেন আরেক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডক্টর স্যামুয়েল ব্রুকিং। ততদিনে জার্মান ও সুইডিস মিশনারিরা অল্প খরচে ভারতের সাধারণ মানুষ এবং সেনানিদের চিকিৎসা করেছিলেন।
কলকাতায় ১৮৫১ সালে এলেন বিখ্যাত ফরাসি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক ডাক্তার তৌনেরে (Tonnere)। উৎসাহী রাজেন্দ্রলাল দত্ত তার কাছে কিছুটা প্রশিক্ষণ পেলেন । ১৮৬৬ সালে ইউরোপ থেকে কলকাতায় এলেন আরেক বিখ্যাত হোমিওপ্যাথ ডক্টর টি বেরেনী (T.Bereigny), খুব সাফল্যের সঙ্গে তিনি কলকাতায় চিকিৎসা শুরু করলেন।  ইতিমধ্যে বিদ্যাসাগরের পরামর্শে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় অভ্যস্ত রাজেন্দ্রলাল দত্ত তার কাছে আরো নিষ্ঠা ভরে এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রশিক্ষণ নিলেন এবং প্র্যাকটিস করতে লাগলেন। কিন্তু তখনও তার কাছে তেমন লোক সমাগম হয় না। এ বিষয়ে স্মরণ করা যাক বিদ্যাসাগর মহাশয়ের সহোদর শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্নের স্মৃতিচারণ, "অনেকে বলিতে লাগিল ,যদিও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা ভালো এবং বিদ্যাসাগর মহাশয় আপনার পরম বন্ধু তবে তাহাকে অগ্রে কেন না চিকিৎসা করেন?" 'আর ঠিক এই সময়ই তার প্রায় সমবয়সী বন্ধু ডাক্তার রাজেন্দ্রলাল এর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় কয়েকদিনের মধ্যেই পুরানো মাথা ধরা রোগের চিকিৎসার সুফল পেলেন। সুফল পেলেন আরো কিছু সমকালীন মানুষ, উপকার পেলেন ভীষণভাবে কোষ্ঠবদ্ধতায় আক্রান্ত ও আরো কিছু অসাধ্য সাধন ব্যাধিতে কাতর রাজ কৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগরের অন্যতম জীবনীকার বিহারীলাল সরকারের ভাষায়, "এ হেন রোগে কেবল হোমিওপ্যাথিক এর বিন্দু পানে আরাম হইল দেখিয়া বিদ্যাসাগর মহাশয় বিস্মিত হইয়াছিলেন।" আশৈশব যুক্তিনিষ্ঠ বিদ্যাসাগর চিকিৎসার ফল দেখে নিশ্চিত ভাবে এর গুরুত্ব বুঝতে পারলেন। আরেক জীবণিকার চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাষায় "তিনি যখন বুঝলেন যে এই বিন্দু বিন্দু ঔষধ সেবনেও উপকার হইয়া থাকে তখন আর স্থির থাকিতে পারিলেন না, ঔষধের উৎকৃষ্টতা ,মূল্যের অল্পতা  এবং সেবনের সুবিধা সন্দর্শনে তিনি ইহার সুপ্রচারে প্রাণপণ সাহায্য করিতে লাগিলেন।"বিদ্যাসাগর মহাশয় এর আগ্রহ হবে না কেন? তিনি তো জানেন উনিশ শতকের দারিদ্র্য লাঞ্ছিত ম্যালেরিয়া কলেরা প্লেগ ইত্যাদি মহামারী অনুষ্ঠিত তার স্বদেশে এমন স্বল্প ব্যয়ের চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহার যথার্থ এবং বাস্তবসম্মত। ইতিমধ্যে রাজেন্দ্রলাল দত্ত ও ডক্টর তৌনের, ১৮৫০ থেকে ১৮৫১ সালের ম্যালেরিয়া আক্রান্ত অনেক রোগীকে সারিয়ে তুলেছেন। ব্রিটিশ সরকার তখন দেশীয় প্রাচীন আয়ুর্বেদ বা হাকিমী চিকিৎসাকে স্বীকৃতি দিতে নারাজ। আবার পাশ্চাত্য ঘরানার চিকিৎসা দেশীয় মানুষের তেমন আস্থা গড়ে ওঠেনি, এই অবস্থায় ইউরোপীয় ঘরানা এই নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি অবলম্বন করলে দোষ কি?
উনিশ শতকের অন্যতম এই প্রাণপুরুষ চিন্তায় মননে ফরাসি জার্মান দর্শন সংস্কৃতির মুগ্ধ সমর্থক ,স্বল্প ব্যয়এর, পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াবিহীন এই বিদেশী চিকিৎসা পদ্ধতিকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করলেন এবং বিশ্বাস করেছিলেন যে এই বিদেশী এই চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে দেশের মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষ চিকিৎসা পরিষেবা পাবে। নিজে বিষয়টি সঠিকভাবে অবগত হওয়ার চেষ্টা করলেন উদ্বুদ্ধ করলেন নিজের ভাই দীনবন্ধু ন্যায় রত্ন ও আরো পরে আরেক ভাই ঈশানচন্দ্রকে। এই ঈশান চন্দ্রের উত্তরাধিকারী পরবর্তীতে ভারতের হোমিও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে দিয়েছেন। শুধু নিজেদের ভাইদের নয় শেখালে তার আরো অনেক অনুগত মানুষজনকে শিক্ষার জন্য পাঠিয়েছিলেন রাজেন্দ্র লাল দত্তের দাতব্য চিকিৎসালয়ে। সেইসব শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চিকিৎসা করতে লাগলো। তবে এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগরের সেখানের বিশিষ্ট এলোপ্যাথি ডাক্তার, ভারতের বিজ্ঞান গবেষণা প্রচারের আদি পুরুষ, নন্দলাল সরকারকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় উৎসাহিত করা। এ প্রসঙ্গে সুন্দর স্মৃতিচারণ করেছেন তার ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন। " মহেন্দ্র বাবু মধ্যে মধ্যে মধ্যে মধ্যে ভাবিতেন বিদ্যাসাগর মহাশয় ভারতে অদ্বিতীয় ব্যক্তি হইয়াও হোমিওপ্যাথির এত গোড়া কেন? এক দিবস অগ্রজের সহিত অনেক বাদানুবাদের পর হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা কিরূপ তাহা পরীক্ষা করবার জন্য তাহার নিকট হার স্বীকার করেন।
  এক দিবস মহেন্দ্র বাবু ও দাদা ভবানীপুরে অনারেবল দ্বারকানাথ মিত্র মহোদয় কে দেখিতে গিয়াছিলেন। তথা হইতে উভয়ে বাটী আসিবার সময় এক শকটে আইসেন। আমিও উনাদের সমভিব্যাহারে ছিলাম।গাড়িতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা উপলক্ষে ভয়ানক বাদানুবাদ হইতে লাগিল দেখিয়া শুনিয়া আমি বলিলাম মহাশয় আমাকে নামাইয়া দেন আপনাদের বিবাদে আমার কর্ণে তালা লাগিল।" সেই সময় ভারতে দ্বিতীয় এমডি বিখ্যাত এলোপ্যাথি চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল এত সহজে রাজি হবেনই বা কেন তিনি স্থির করলেন এ বিষয়ে নিজেই পরীক্ষা করবেন।
ভারতবর্ষীয় বিজ্ঞান সভার প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোগী মানুষটি শেষ পর্যন্ত নিজের তাগিদে এই চিকিৎসা প্রণালী পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে অনুসন্ধান করে নিশ্চিত হলেন। এলোপ্যাথি চিকিৎসা ত্যাগ করে সেকালে প্রতিপত্তি সম্পন্ন হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। কিভাবে এগিয়ে আসেন ডক্টর বিহারীলাল ভাদুড়ি ,ডক্টর অন্নদাচরণ খাস্তগীর প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। এই তাগিদের পেছনে মানুষ কিন্তু সেই দরিদ্র প্রেমিক সমাজসেবক গোয়ার এক পন্ডিত।বিদ্যাসাগর।

দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ,এই সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাছে ন্যূনতম স্বাস্থ্য পরিষেবা টুকু পৌঁছে দেওয়ার জন্য শুধুমাত্র শখ ও শৌখিনতায় নয় রীতিমতো অধ্যাবসায় করে বিদ্যাসাগর মহাশয় নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন এই সমাজের উপকারের স্বার্থে। উনিশ শতকে শেষার্ধ থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথমার্ধে এলোপ্যাথি চিকিৎসকদের পাশাপাশি সমাজের কিছু বিশিষ্ট মানুষ হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় আগ্রহী হয়েছিলেন। বলা বাহুল্য এরা হয়তো সকলেই বিদ্যাসাগরকে অনুসরণ করেছিলেন। এই তালিকায় ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র শ্রী অরবিন্দ ঘোষ, বিবেকানন্দ, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ। কিন্তু এদের সবার পূর্বসূরী বিদ্যাসাগর ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই অনন্য। কোন সাময়িক শখ অথবা শৌখিনতা নয় ইউরোপীয় ঘরানার এই চিকিৎসা পদ্ধতি, তিনি আয়ত্ত করেছিলেন শিক্ষার্থীর নিষ্ঠায়। ছাত্র জীবনে যে নিষ্ঠাও পরিশ্রমে শিখেছিলেন সংস্কৃত সাহিত্য ব্যাকরণ ন্যায় দর্শন পরিণত বয়সে যে আকুতিতে শিখেছিলেন ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে এসেও তার মধ্যে শিক্ষার্থীর সেই আগ্রহে বিন্দুমাত্র ভাটা পড়েনি। এমনভাবে শিখতে কিন্তু কোন দীক্ষাহীন অচিকিৎসককে দেখা যায়নি। কেমন ছিল তার অধ্যাবসায় পর্ব? 
তার সহোদর শম্ভু চন্দ্র বিদ্যারত্নের কথা বিদ্যাসাগর মহাশয় প্রতিবছর প্রথমে বেরিনি কোম্পানি ও পরে থ্যাকার কোম্পানি মারফত অর্ডার দিয়ে বিলেত থেকে অনেক টাকার হোমিওপ্যাথি পুস্তক আনাতেন। তার লাইব্রেরী এইসব বইতে ভরা থাকত। বিদেশে সদ্য প্রকাশিত হোমিওপ্যাথি বই কিনে গোগ্রাসে পড়েছেন, ভালো করে অ্যানাটমি শেখার জন্য নর কঙ্কাল অবধি বিদেশ থেকে কিনেছেন। তার জন্য প্রথামাতিক পাঠ নিয়েছেন সেকালের বিখ্যাত অ্যানাটমি অধ্যাপক ডক্টর চন্দ্র মোহন ঘোষ এর কাছে। ডক্টর ঘোষের সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়িতে নিয়মিত পাঠ নিতে যেতেন। হোমিওপ্যাথি মতে চিকিৎসায় রোগ লক্ষণ পর্যবেক্ষণ খুব দরকারি। দরকার সেসব তথ্য নতিভুক্ত করা যাতে পরবর্তীতে রোগের অনুসন্ধান পর্বে ধারাবাহিকতা বজায় থাকে ও নিরাময় সহজ হয়। এর জন্য একেবারে প্রথমাফিক ডাইরিতে নথিভুক্ত করেছেন রোগ লক্ষণ, রিপোর্ট এবং নিরাময়কাল। ইন্দ্র মিত্রের লেখা বিদ্যাসাগরের জীবনীতে এরকম নয় জনের কেস হিস্ট্রির উল্লেখ আছে। সেসব রোগের প্রকৃতিও ভিন্ন ভিন্ন যেমন  বমি ও হিক্কা, ক্ষুদামান্দ্য অম্বল, গোড়ালি ব্যথা ,পেট ব্যাথা ,পাতলা মল ,নিতম্বে ফোড়া থেকে শুরু করে জরায়ুর ক্যান্সার এমনকি অতিরিক্ত রজস্রাব ,সাদাস্রাব ইত্যাদি মেয়েলি অসুখের উল্লেখ ও প্রেসক্রাইবড্ ওষুধের কথা আছে। শেষ উক্ত দুটি অসুখের রোগী নিয়ে যথাক্রমে তার কন্যা ও পুত্রবধূ। একুশ শতকের পটভূমিতে যা সহজ স্বাভাবিক বলে মনে হয় , উনিশ শতকের পটভূমিতে পুত্রবধূ অসংকোচে গোপন রোগের বিবরণ দিচ্ছেন চিকিৎসককে এবং চিকিৎসক শ্বশুরমশাই স্বয়ং পুত্রবধূ স্ত্রী রোগের চিকিৎসা করছেন, নথি রাখছেন তা নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক প্রচেষ্টা। চিকিৎসা শাস্ত্রে কোনরকম ডিগ্রি না নিয়েই অকুতোভয়ে চিকিৎসা করেছেন একাধিক্রমে অনেক বছর, বেশ কিছু রোগের যেমন সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে কিছু নিয়মিত অসুখ যেমন ঠান্ডা লাগা, জ্বর ,পেটে ব্যথা অম্বল ইত্যাদি। এই বিষয়ে নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগে থেকেছেন বয়সে ১৩ বছরের ছোট বিখ্যাত চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকারের সঙ্গে। ১৮৭৯ সালের ১২ ই এপ্রিল পেট ব্যথায় কাতর মহেন্দ্রলাল চিকিৎসার পরামর্শের জন্য বিদ্যাসাগরের সঙ্গে দেখা করলেন। একমাস পর বিদ্যাসাগরের নাতির শরীর খারাপের কারনে তার চিকিৎসা করতে বিদ্যাসাগরের বাড়ি গেলেন মহেন্দ্রলাল। বিদ্যাসাগর তাকে উপহার দিলেন লিবেন্থ্যালের লেখা হোমিও থেরাপিটিক্স
(Libenthal's Homeo Therapeutics)। এক সপ্তাহ পর মহেন্দ্রলাল শিশু রোগীর কুশল সংবাদ জানতে পুনর্বার দেখতে এলেন বিদ্যাসাগর মহাশয়ের নাতিকে এবং বিদ্যাসাগরকে উপহার দিলেন হেইনিগসের অ্যানালিটিক্যাল থেরাপিটিক্স (Heineg's Analytical Therapeutics)। এভাবেই দুই বিশিষ্ট মানুষ একে অপরের প্রেসক্রিপশনে যথার্থতা যাচাই করে নিয়েছিলেন এবং অব্যাহত রেখেছিলেন চিকিৎসা বিদ্যার সারস্বত প্রবাহ।
      ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় এই সমাজ , এই বিশ্বের কাছে দয়ার সাগর, বিদ্যাসাগর, নারী শিক্ষা প্রচারী, বিধবা বিবাহ প্রচলন আন্দোলনের হোতা, বর্ণপরিচয় প্রণেতা রূপে বহুল পরিচিত হলেও 
বিদ্যাসাগরের কৃতিত্বের, ত্যাগের সর্বোপরি সেবার এই নতুন দিক সন্দর্শনে আমাদের মাথা বারবার নত হয়ে আসে শ্রদ্ধায় ও ভক্তিতে। চিকিৎসক বিদ্যাসাগরের অবদানও ইতিহাসে স্বর্নোজ্বল হয়ে থাকবে চিরকাল।। 


*তথ্য সহায়তা ----*

১। শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন , বিদ্যাসাগর জীবন চরিত ও ভ্রম নিরাস , চিরায়ত প্রকাশ, মার্চ ২০১৯, 
 
২।. উইকিপেডিয়াঃ-- স্যামুয়েল হ্যানিম্যান

৩।  ড জি এম ফারুক, আধুনিক হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা, দৈনিক সংগ্রাম, ঢাকা,  ৩রা জুলাই ২০১২

 ৪। Dilli Homeopathic Anusandhan Parishad;  Origin and Growth of Homeopathy in India (http:// www, delhihomeo.com)

৫। ড়া শঙ্কর কুমার নাথ   "চিকিৎসা বিজ্ঞানে আত্মমগ্ন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর; অজানা বিদ্যাসাগরঃ অনন্য দিশারি ( গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত ) বিদ্যাসাগর  চর্চা ও গবেষণা কেন্দ্র , কলকাতা ২০১৯ 

৬। বিহারীলাল সরকার , বিদ্যাসাগর, ১৮৯৫, 

৭। চন্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় , বিদ্যাসাগর , ১৯০৯, 

৮।  ইন্দ্রমিত্র , করুণাসাগর বিদ্যাসাগর,আনন্দ, কলকাতা,  ২০১২, 

৯। Biswas B, Jhansi S, potu R, patel S et. al ... Physicochemical study of homeopathic  drug, Blatta orientalis . Indian J Res  Homeopathy  2018 :12: 125-31 

১০।  Brian A Hatcher. Vidyasagar: The Life and after Life Of an eminent Indian. Routledge, India  2019.

১১। DattaGupta Mahua. Negotiating the Trajectory of a Marginal Medical  Discipline : Homeopathy in Colonial Bengal.  Ph. D Thesis submitted to the University Of Burdwan  2015.

১২। ক্ষুদিরাম বসুঃ বিদ্যাসাগর স্মৃতি, পঞ্চ পুষ্প, আষাঢ ১৩৬৬,.

১৩। রজনীকান্ত গুপ্ত, স্বর্গীয় ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, ১৮৯৩,

১৪। ভুবন কৃষ্ণ মিত্রঃ জীবতত্ত্ব, জন্মভূমি, ফাল্গুন ১৩০৮,

  ১৫।   Hazra S,  Indian Renaissance Of Homeopathy.( https://www. homeotimes.com  )

১৬।. Press Information Bureau, Govt Of India, President’s Secretariat, 22.08.2016. (https://pib.gov.in)

১৭। ডা . শঙ্কর কুমার নাথ, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের গোরার কথাও পন্ডিত মধুসূদন গুপ্ত, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, ২০১৯,

১৮! রিশেষ সহায়তা -- শ্রীমতি সুবর্ণা নাগ (পা্ল)


পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments