জ্বলদর্চি

মস্কোয় দুর্গোৎসব / বিজন সাহা

মস্কোয় দুর্গোৎসব / বিজন সাহা 


১৯৮৯ সাল। পেরেস্ত্রোইকার দমকা হাওয়ায় এক এক করে ভেঙে পড়তে শুরু করেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন বাধা নিষেধের দেওয়াল। সেবারই তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যায় মাস্টার্স শেষ করে ছুটিতে বাড়ি ফিরলাম কিছু দিন পরে পিএইচডি করতে মস্কো ফেরার ইচ্ছে নিয়ে। আজ যাই কাল যাই করতে করতে কেটে গেল ১৪ সপ্তাহ। আসলে নেহেরু কাপ, পূজা এসব লোভনীয় আইটেম এই বিলম্বের কারণ। ১৯৮৩ সালে মস্কো যাবার পর থেকে পূজা কথাটাই ডিকশনারি থেকে উধাও হয়ে যায়। কিন্তু অনেক দিন পরে সেই সুযোগটা যখন আসে তখন ঠিক করি আরও কয়েকটা দিন থেকে যেতে। সেটাই এখনও পর্যন্ত শেষ বারের মত দেশে পূজা দেখা। সেবার মায়ের সাথে ধামরাই গেছিলাম প্রতিমা দেখতে। শেষ বারের মত। 

আসলে সেই সময় পূজা আমাকে তেমন আর টানত না। ছোট বেলায় আমাদের বাড়িতে পূজা হত। হত বাড়ি থেকে একটু দূরে রামার ভিটায়। রামা, মানে রাম বসাক। তখন এলাকা থেকে কোন হিন্দু পরিবার ইন্ডিয়া চলে গেলে আমরা চেষ্টা করতাম সেই জায়গাটা কিনে রাখতে। ওটাও এভাবেই আমাদের হয়, যদি নামে সেই রামার ভিটাই রয়ে যায়। তবে সেখানে কিছুই করা হত না, না বাগান না অন্য কিছু। বছরে একবারই কয়েকদিনের জন্য ভিটেটা জীবন্ত হয়ে উঠত। সেটা এই দুর্গা পূজার সময়। ওটা ছিল বাড়ি থেকে একটু দূরে, বড় খালের ওপারে। যখনই বদু ভাই, নালু ভাই ও বাড়ির অন্যান্য কর্মচারীরা কাঠের পুল মেরামতে নামত, বুঝতাম পূজা সামনে। আমাদের তখন অনেক জমিজমা, গরু বাছুর, সুতার কারখানা, তাই বাড়িতে অনেক লোক কাজ করত। এর পর ওরাই একে একে নিয়ে আসত এঁটেল মাটি, শন, বাড়ির ঝাড় থেকে বাঁশ কেটে গড়ত কাঠাম বা কাঠামো আর সেই সাথে অস্থায়ী মণ্ডপ। আসত দেউরীরা। ধীরে ধীরে এই শন, মাটি, বাঁশ রূপ নিত দেব দেবীর। এতদিন পর্যন্ত আমরা বাচ্চারা, মুসলিম কর্মচারী আর দেউরীরা সবাই হাত লাগিয়ে কাজ করতাম। এরপর যখন প্রতিমার চোখ ফুটানো হত আমাদের আর ওদিকে যেতে দেওয়া হত না। পুরোহিত আর মা, বড়মা, মেঝমা, খুড়িমারা দেবতাদের দখল নিয়ে নিতেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে আসত আত্মীয় স্বজন। আসত ঢুলী, আসত মাইক। ক’টা দিন কাটত মহা আনন্দে। এরপর এক সময় দুর্গা পূজা বন্ধ হয়ে যায়। সে সময় বেশ কয়েকবার কাত্যায়নী পূজা হয়েছে বাড়িতে। সে এক অন্য আনন্দ। এর আগে কাত্যায়নী পূজার নামই শুনিনি। তখন আমাদের এলাকায় দুর্গা পূজার বাইরে শুধু বাসন্তী পূজা হত পাশের গ্রামে সুরেন জ্যাঠামশাইয়ের বাড়িতে। 

তবে সেসব ছোট বেলায় – যখন ঠাকুর দেবতায় বিশ্বাস ছিল, তারা ছিলেন শক্তিশালী আর দুর্গতিনাশিনী। কলেজে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। বিপ্লবের প্রথম ধাপ যেমন আইন অমান্য করা, নাস্তিকতার প্রথম ধাপ তেমনি পূজা পার্বণ এড়িয়ে চলা, না মানা। তাছাড়া সেই সময় পূজা আগের সেই অর্থ হারিয়ে ফেলে। আগে যদি মানুষ ভক্তি সহকারে পূজা দেখতে যেত সত্তরের দশকের শেষের দিক থেকে সেখানে আসে প্রতিযোগিতা কার বাড়ির প্রতিমা কত সুন্দর। এ যেন সুন্দরী প্রতিযোগিতা। অনেক কিছুর মতই পূজাটাও লোক দেখানো একটা আইটেমে পরিণত হয়। এরপর ভগবানের সাথে আমার একটা চুক্তি হয় – আমরা একে অন্যের কাজে নাক না গলানোর মানে এক অনাক্রমণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করি। যদিও প্রথম দিকে পারলেই একহাত নিতে চেষ্টা করতাম, সবাইকে দেখাতে চেষ্টা করতাম ভগবানের অসারতা তবে সময়ের সাথে বুঝি বিশ্বাসের মত অবিশ্বাসও একটা বিশ্বাস। তাই ভগবানকে ভগবানের মত থাকতে দেওয়াই ভাল।  

ফিরে আসি আবার মস্কোয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি যখন দেশ থেকে মস্কো ফিরি তখন বলতে গেলে এক অবিশ্বাস্য খবর শুনলাম। বন্ধুরা বলল মস্কোয় বসবাসকারী পশ্চিম বঙ্গের বাঙালিরা দুর্গা পূজা করার কথা ভাবছে। খবরটা ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত। কেননা সোভিয়েত ইউনিয়নে লোকজন কমবেশি নাস্তিক ছিল আর সোভিয়েত ইউনিয়নে যারা পড়াশুনা করতে আসত তাদের বেশির ভাগ দেশে বাম রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল তাই ধর্মীয় কর্মকাণ্ডে খুব একটা আগ্রহী ছিল না বলেই জানতাম। 

মনে রাখতে হবে তখন ১৯৮৯ সাল। পেরেস্ত্রোইকা তুঙ্গে। ধীরে ধীরে ফিরে আসছে মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতা। তবে এটা ঠিক সোভিয়েত আমলেও সেটা ছিল, অন্তত আমি সেটাই দেখেছি। তবে ধর্ম তখন মোটেই জনপ্রিয় ছিল না। এ দেশে চারটি ধর্মের মানুষের বাস – রুশ অর্থোডক্স যা কি না খ্রিস্টান ধর্মের একটা শাখা, ইসলাম (মূলত সুন্নী, তবে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য সহ), ইহুদি ধর্ম আর বৌদ্ধ ধর্ম। মস্কোয় (শুধু মস্কো কেন, সমস্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন জুড়েই) যদিও অধিকাংশ গির্জা হয় বন্ধ ছিল বা তা অন্য কোন কাজে ব্যবহৃত হত, তবে কিছু কিছু গির্জা ঠিকই কাজ করত। আমি নিজে ফ্রান্স দূতাবাসের বিপরীতে যে সক্রিয় গির্জা ছিল সেখানে বেশ কয়েকবার গেছি ইস্টারের রাতে। সেখানে মূলত বৃদ্ধা মহিলারা যেতেন আর আমাদের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতেন। এছাড়া ছিল মসজিদ (এখনও আছে)। আমাদের অনেক বন্ধুর বিয়ে ওখানেই হয়েছে আর তাই বেশ কয়েকবার গেছি। সিনাগগ কাজ করত, তবে কখনই যাওয়া হয়নি। এখানে প্যাগোডা ছিল না। বৌদ্ধরা মূলত কালমিকি, তুভা, বুরিয়াতি এসব প্রদেশে বাস করত। কিন্তু এখানে হিন্দু ধর্মের লোকজন ছিল না, যদি না বিদেশী ছাত্রদের কথা বাদ দেয়া হয়। তাই হঠাৎ করে মস্কোয় দুর্গা পূজা হতে চলছে শুনে প্রচণ্ড অবাক হয়েছিলাম। আর হয়তো এজন্যেই পরের বছরের পূজার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিলাম। মনে হয় এর আগে কখনই অপেক্ষার শুরু এত আগে হয়নি। না, এটা ধর্ম বিশ্বাস থেকে নয়, মস্কোয় পূজা – এটা অনেকটা ভেল্কিবাজির মত মনে হয়েছিল আর তাই ব্যাপারটা ঠিক কিভাবে আর কোথায় হয় সেটা দেখার জন্যেও মনে তোলপাড় শুরু হয়েছিল।       

দেখতে দেখতে কেটে যাবে বছর। হবে কি হবে না, কেমন হবে এসব জল্পনা কল্পনার মধ্য দিয়ে শুরু হল দুর্গা পূজা। জানা গেল পূজা হবে শাবলভস্কায়ার ওখানে একটা ক্লাবে। যেহেতু সেবারই প্রথম তাই একেবারেই অন্য ধরণের প্রতিমা বা মণ্ডপের ছবি এঁকেছিলাম মনে মনে। সেটা করেছিলাম দেশের পুজার অভিজ্ঞতা থেকে। থাকবে ঢাক ঢোল, বাজবে শঙ্খ ঠিক যেমনটা দেখেছি দেশে। একটা ক্লাবের কোণে পূজা। পূজা আছে, কিন্তু পূজার সেই আমেজ নেই। বলতে গেলে একটু হতাশ হয়েই ফিরে এলাম যদিও প্রতিদিন বিকেল হলেই কি এক টানে সেখানে চলে যেতাম। আসলে সেই সময় শুধু রুশদের জন্য নয় আমাদের জন্যও মস্কোয় পূজা ছিল এক ধরণের এক্সটিক ব্যাপার। এর পরেই কয়েকবার সেখানেই পূজা হবে, ১৯৯৪, ১৯৯৫ সালে হবে প্রগেস সিনেমা হলে। সে সময় আমি অবশ্য হোস্টেল ছেড়ে দিয়েছি, চাকরি নিয়ে চলে গেছি দুবনায়। আমার স্ত্রী ও সন্তানেরা তখন মস্কোয়, যেখানে পূজা হয় সেখান থেকে একটু দূরেই আমাদের বাসা। ইতিমধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন হারিয়ে গেছে। রঙ বেরঙের ধর্মীয় সেক্টের আবির্ভাব ঘটছে রাশিয়ায়। প্রায় সত্তর বছর ভিন্ন সমাজ ব্যবস্থায় বাস করে অভ্যস্ত মানুষ নতুন করে নিজেকে খুঁজছে। কিছু মানুষের হাতে অঢেল সম্পদ কিন্তু অধিকাংশ দিশেহারা। ওই সময়টা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সংগ্রাম করার সময়। কিন্তু এসবের মধ্যেও পূজা কয়েক দিনের জন্য হলেও আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যেত দেশে। তাছাড়া প্রথম দিকে পূজার উদ্যোক্তারা ছিল এদেশে পড়াশুনা করা ভারতীয়, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের ছাত্রছাত্রীরা আর প্রগতি প্রকাশনে যারা কাজ করতেন তাঁরা। তবে নব্বুইয়ের দশকের মাঝামাঝি এখানে বিদেশী ডায়স্পরার একমাত্র না হলেও প্রধান প্রতিনিধি আর ছাত্ররা থাকে না। ব্যবসায়ীরা তাদের স্থান দখল করে। এখানে বাস করতে শুরু করে অনেক পরিবার। এসব ব্যবসায়ীদের বউয়েরা যাদের অধিকাংশের ঘরের কাজ আর ছেলেমেয়েদের দেখাশুনা করার বাইরে তেমন কিছু করার ছিল না তারা পূজায় আর সঠিক ভাবে বলতে গেলে যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে নতুন প্রাণ দান করে। ফলে একদিকে পূজা যেমন আর্থিক সহযোগিতা পায় অন্যদিকে পায় কাজের হাত আর সবচেয়ে বড় কথা পূজার প্রাসঙ্গিকতা। একে ঘিরে শুরু হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। এত দিন পূজার কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। একবার মনে হয় ভারতীয় দূতাবাসে পূজা হয়েছিল। তবে নতুন বাস্তবতায় দেবীর জন্য একটা স্থায়ী ঠিকানা অপরিহার্য হয়ে ওঠে আর সেই ঠিকানা হয় গণ মৈত্রী  বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক ক্লাব বা ইন্টারক্লাব। এ ঘটনা খুব সম্ভব ঘটে ১৯৯৭ সালে। 

এখানে স্থায়ী ঠিকানা নিয়ে দুটো কথা না বললেই নয়। রাশিয়ায় পশ্চিমা ধারণা অনুযায়ী ঠিক দাস প্রথা না থাকলেও প্রায় সমমানের ব্যবস্থা ছিল। আর সেই প্রথা ১৮৬১ সালে সংস্কার করা হয়েছিল। তারপরেও লোকজন চাইলেই যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারত না, সবাই কোন না কোন জায়গার সাথে যুক্ত ছিল। সোভিয়েত আমলেও সেই প্রথা ছিল। প্রতিটি লোকের একটা স্থায়ী ঠিকানা থাকতে হত, আর সেখানেই তাকে কাজ করতে হত। অন্য কোথাও (অন্য শহর, অন্য প্রদেশ) সে কাজ পেত না, চিকিৎসা পেত না, ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাতে পারত না। এক কথায় সামাজিক সকল রকম সুযোগ সুবিধা জন্য তার একটা নির্দিষ্ট ঠিকানা থাকতে হত। এখন সেই সাথে অস্থায়ী ঠিকানা যোগ হয়েছে, তবে ঠিকানার ব্যাপারটা রয়েই গেছে। সেদিক থেকে যখনই পূজার জন্য একটা স্থায়ী ঠিকানা পাওয়া গেল সেটা এক ভিন্ন রূপ ধারণ করল। 
এর আগে ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন শহরে দুর্গা পূজার কথা শুনেছি বন্ধুদের মুখে। তবে সেখানে পূজা পঞ্জিকা ধরে হয় না, হয় উইক এন্ডে। সেদিক থেকে মস্কোয় পূজা হয় দেশের পঞ্জিকা ধরে। সব কিছু ঠিক মত হচ্ছে কিনা সেটা দেখাশুনা করেন স্থানীয় রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজ। কিছু লোকজন রুটিন করে উপোষ রাখে। প্রথম দিকে পুরোহিত ছিলেন মস্কোর বাইরের কোন এক শহরের এক ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক। পরে বেশ কিছুদিন রথীন চ্যাটার্জি পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। ইদানীং পুরিহিতের কাজ চালাচ্ছে প্রদ্যুম্ন চ্যাটার্জি। আর সার্বিক সহযোগিতায় থাকেন মস্কো রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী সুভাব্রতানন্দ মহারাজ। ২০১৪ সালে মস্কোয় দুর্গা পূজার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বেশ বড় আয়োজন করা হয়। ভারতের বাইরেও বাংলাদেশ, নেপাল ও অন্যান্য দেশের অনেকেই আর্থিক সহযোগিতা করে। দুর্গা দেবী তখন উপমাহাদেশীয় রূপ পান। তবে করোনা ভাইরাস দেবী দুর্গাকেও ক্ষমা করেনি। ফলে গত কয়েক বছর পূজা হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনে আর স্থানীয় একটা হোটেলে খুব সংক্ষিপ্ত আকারে মানে দর্শক বিহীন ক্রিকেট ম্যাচের মত। সবই হয়েছে, শুধু পাছে দেবী করোনা আক্রান্ত হন সেই ভয়ে ভক্তদের ওখানে যেতে দেওয়া হয়নি। শোনা যাচ্ছে এবার দেবী নিজের ঘরে ফিরে আসবেন আর ভক্তদের জন্য তাঁর দ্বার অবারিত থাকবে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে পূজার প্রতিমা ও সমস্ত উপকরণ আসে কোলকাতা থেকে। তবে প্রতিমা আনা হয় প্রতি তিন বছর অন্তর অন্তর। এ ছাড়াও একটা ছোট মূর্তি থাকে পারমানেন্টলি। এটা আকারে ছোট আর প্রতি বছরই মূল প্রতিমার সামনে রাখা হয়। মস্কো দুর্গা পূজা সত্যিকার অর্থেই সার্বজনীন। এখানে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, সাদা, কালো, হলুদ, লাল, এশিয়ান, আফ্রিকান, ইউরোপিয়ান, আমেরিকান – যে কেউই মন্দিরে আসতে পারে, পূজায় অংশ নিতে বা না নিতে পারে। এক কথায় এটা বিভিন্ন জাতি ধর্ম বর্ণের মানুষের মিলন মেলা।  


কি এই পূজা মস্কোর জন্য? এটা নিঃসন্দেহে অনেক কিছুর ব্যারোমিটার। এটা অনেকটা স্টক মার্কেটের ইন্ডেক্সের মত। পূজার গতিবিধি দেখে বোঝা যায় মস্কোয় বসবাসকারী পশ্চিম বঙ্গের মানুষের ব্যবসার শারীরিক অবস্থা। কারণ পূজা শুধু পূজা নয় এটা এখানে বসবাসরত অনেক মানুষের আনন্দ বেদনা, ভালোলাগা ভালোবাসা, সাফল্য ব্যর্থতার প্রদর্শনী। পূজার আনুষ্ঠানিকতার বাইরেও এ সময় এখানে হয় রান্নার প্রতিযোগিতা, নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লটারি। পূজা উপলক্ষ্যে বেরোয় আরাত্রিকা নামে ম্যাগাজিন। কখনও কখনও দেশ থেকে নামী দামী শিল্পীরা আসেন পূজা পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে। আর এর বাইরেও পূজা হল মিলন মেলা। হ্যাঁ, মস্কোয় উপমহাদেশের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয় – তা সে বিভিন্ন জাতীয় দিবস, নববর্ষ আর যাই হোক। তবে সে সব এক দিনের অনুষ্ঠান আর মূলত নিজ নিজ দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। পূজায় আসে সবাই। শুধু উপমহাদেশের লোকজন নয়, আসে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকার লোকজন। আসে প্রচুর রুশ যারা ভারত, ভারতের সংস্কৃতির ব্যাপারে আগ্রহী। এর পেছনে থাকে ভারতীয় দূতাবাসের সার্বিক সহযোগিতা। বাংলাদেশের দূতাবাসের অংশগ্রহণ থাকে এতে।

 আমাদের মত অনেকে, যারা পূজাটা ঠিক পূজা হিসেবে না নিয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করার সুযোগ হিসেবে নেয় তাদের জন্য এটা আকর্ষণীয়। কত মানুষের সাথে দেখা হয় যুগ যুগ পরে। তবে মস্কোয় আজকাল এই একই সময়ে দুর্গা পূজার বাইরেও দশেরা, নভরাত্রি এসব অনুষ্ঠান হয় ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকজনের অংশ গ্রহণে। আবার এই পুজাকে কেন্দ্র করে যে একটা কালেক্টিভ গড়ে উঠেছে তারা শুধু তাঁদের কাজকর্ম দুর্গা পূজার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সরস্বতী পূজা ও অন্যান্য সামাজিক কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে। আসলে ইউরোপ, আমেরিকা এসব দেশে বিশাল বিশাল ডায়াস্পোরা থাকায় সেখানে প্রবাসীদের পক্ষে অনেক কিছুই করা সম্ভব। মস্কো বা রাশিয়ায় প্রবাসীদের সংখ্যা একান্তই সীমিত। তাই বাইরে যেভাবে প্রবাসীরা নিজেদের দেশের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে এখানে সেটা পারে না। সেদিক থেকে মস্কোয় পূজার গুরুত্ব ধর্মের বাইরে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। হয়তো একদিন এই পুজাকে কেন্দ্রও করেই এদেশে ভারতীয় উপমহাদেশের এক্সপ্যাটদের একটা শক্তিশালী কমিউনিটি গড়ে উঠবে।

পুনশ্চঃ ঠিক কবে মস্কোয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল এ নিয়ে ভিন্ন মত আছে। আমার মনে ছিল ১৯৮৯ সালে আমি দেশে থাকাকালীন প্রথম বারের মত মস্কোয় পূজা হয়েছিল আর দেশ থেকে ফিরে পূজার গল্প শুনেছিলাম। পরে কিছু লোকের সাথে কথা বলে মনে হল সেটা ছিল ১৯৮৮। তবে ১৯৮৮ যে পূজা হয়নি সে ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অনেকেই বলল ১৯৯০। ২০১৪ সালে এখানে পূজার ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বিশেষ অনুষ্ঠান হয়। সেবার পূজা পরবর্তী পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে নচিকেতা পারফর্ম করেন। শুধু তাই নয় পরের দিন ভোরে দেশে যাব বলে আমি সেই অনুষ্ঠান মিস করি। তাই শেষ পর্যন্ত ১৯৯০ সালেই পূজা হয়েছিল বলে মনে হয়েছিল। কিছুক্ষণ আগে দিল্লি থেকে বন্ধু চঞ্চল ভট্টাচার্য লিখল “১৯৮৯ সালে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রনেন সেন ও ফার্স্ট সেক্রেটারি সন্তোষ গাঙ্গুলির উদ্যোগে প্রথম পূজা হয়। রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী লোকেশ্বরানন্দ এই পূজায় প্রতি উন্মোচন করেন। সন্তোষ গাঙ্গুলি এখন দিল্লির চিত্তরঞ্জন পার্কে থাকেন, অনেকবার সেই পুজো নিয়ে কথা হয়েছে। তাই, এই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।” তাই ব্যাপারটা মনে হয় শেষ পর্যন্ত অমীমাংসিতই রয়ে গেল। তবে প্রশ্ন থাকাটা সব সময়ই রহস্যময়। এখানেও না হয় থাকুক।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments