আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে
কথা বলা শিল্প পর্ব নয়
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
অনেকেই ভালো গল্প করতে পারেন।কারণ কথা বলাও একটা আর্ট। যেমন ধরুন কাউকে আপনি সুন্দর করে খাবার পরিবেশন করলেন এবং তা দেখেই আপনার রুচি বোধের প্রকাশ পাবে।খুব ভালো লাগবে।কোনো কোনো মানুষ দেখবেন এমন সুন্দর করে খান তার খাওয়া দেখলেই খিদে পেয়ে যায়। যা কিছু সুন্দর দৃষ্টি নন্দন এবং সত্য তাই শিল্প।কিছু কিছু মানুষ এত সুন্দর করে কথা বলেন যে ঘন্টার পর ঘন্টা তার কথা শুনলে আলোস্য আসেনা।গান না হয়েও কিছু কথা ভীষণ সুরেলা হয়।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা এমনই সহজ জিনিস কে আরো শক্ত কঠিন গুরু গম্ভীর করে তোলে। সেই জন্য ছেলেমেয়ে ভয় পায়। আমার উপস্থাপনা যদি গল্পের ছলে হয় তাহলে খুব সহজেই শিশু ধরতে পারে। রবীন্দ্রনাথ তাই প্রকৃতির মাঝে পাঠ নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।দূর ভ্রমণের ক্লান্তি লাঘব হয় যদি মনের মতো বন্ধু পাওয়া যায়। যে মানুষের জীবন যত বৈচিত্র্যময় তার গল্পের ঝুলিও তত পরিপূর্ণ। ভীষণ বাচাল ভাট বকা মানুষের কথা খুব বিরক্তিকর লাগে। সেই মানুষের সামান্য একটি কথা আজীবন আপনাকে কুরে কুরে খাবে। কিছু কিছু কথার ভার সত্যিই বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে। counselling বা কাউন্সেলিং এই ব্যাপারটা এখন আমাদের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি তে এখন এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কোনো রকম কোনো ঔষধ নয় শুধুমাত্র আপনার সমস্যাটি জেনে সুন্দর ভাবে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে আপনি জীবনে দিশা পাবেন।
মাইল্ড কোনো ঔষধ থাকলেও আসল ঔষধ আপনার মনের বন্ধু হওয়া। যত মানুষের সঙ্গে মিশবেন তত পরিবর্তিত হবেন। ব্যক্তি মানুষ যদি আমার কথা বলেন আমি খুব কম কথা বলি। তবে কেউ কথা বললে আমার খুব শুনতে ভালোলাগে।
মন দিয়ে সবার কথা শুনি।সব থেকে ভালোলাগে বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে। কারণ বাচ্চারা ধর্ম,বর্ণ,জেন্ডার বোঝেনা। ওদের বিস্ময় জগৎ সম্পর্কে। বীজ থেকে অঙ্কুর এবং অঙ্কুর থেকে পাতা ফুল, ফল সব কিছুই শিশু মনকে ভাবিয়ে তোলে। খুব অল্পে ওরা খুশি হয়।সব সময় ফুল, ফল পশুপাখি এবং বিভিন্ন দেশের গল্প ওদের কাছে করলে বাচ্চাদের কল্পনা শক্তি প্রসারিত হবে।
আবার বড়দের ক্ষেত্রে যখনই মনে কোনো কষ্ট পাবেন খুব প্রিয় বিশ্বস্ত জনের কাছে খোলাখুলি আলোচনা করবেন। সুখের সময় এবং দুঃখের সময় কোনোটাই চিরস্থায়ী নয়। আমরা সামাজিক জীব আমাদের বন্ধু এবং আত্মীয়তার খুব প্রয়োজন। নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে একাকিত্ব একটা বিরাট সমস্যা। বাচ্চাদের পরিবারের আত্মীয়স্বজনদের স্পর্শে রাখুন। ওদের স্নেহ আদর থেকে বঞ্চিত করবেননা।বয়স্কদের প্রতি খুব আন্তরিক ব্যবহার করা দরকার । কারণ ওঁরা বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়। ভাবুন ঐ বয়সটা আপনারও একদিন আসবে।
ভালো বই কিন্তু বিরাট বন্ধুর ভূমিকা নেয়।
ভালো গান শুনলেও কিন্তু আনন্দ হয়।
আমি কী করলাম আর কী হলাম সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা আমার ব্যবহার আমার কথায় যেন কেউ আঘাত না পায়। সময় চলে যায় কথা কিন্তু থেকে যায়। কোনো কোনো মানুষের গলার স্বর শুনেই আমরা মুগ্ধ হই। মনে আছে সেই বিখ্যাত কিছু কন্ঠস্বর "খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়" "বরুণ মজুমদার, " ভাবলে এখনো গায়ে কাঁটা দেয়। একজন ব্যক্তিকে চোখে না দেখে কেবল স্বর শুনে তার একটা ছবি আমরা এঁকে ফেলি মনে মনে। আমি অনেককেই দেখেছি যারা গল্প করতে জানেন খুব সুন্দর করে কথা শুরু করেন। কথাবলা মানে জেলেরা যেমন করে জাল বোনে ঠিক তেমনই। কথা কোথায় থেকে কোথায় চলে যাবে আপনি বুঝতেই পারবেননা। কথায় কথায় বিশ্ব ভ্রমণ হয়ে যাবে। কেউ যদি বলেন, আমি তোমাকে ভালোবাসি তখন আপনার মনের অবস্থা কী হবে বলুন তো? কী অদ্ভুত এই বাক্যটি তাই না? এই বাক্যের জন্য মানুষকে কত শ্রম করতে হয় বলুন তো? অপরপক্ষে আমি তোমাকে ঘৃণা করি এই বাক্যবন্ধ তো পৃথিবী ওলোট পালট করে দিতে পারে। সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যেতে পারে দুটি পথ, দুটি জীবন কিংবা আস্ত একটি পরিবার ।
তেমনই তালাক তালাক তালাক তিনবার বললেই মুসলমান সমাজে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কের পবিত্র বন্ধন এক নিমেষে শেষ হয়ে যায়।আইন এখন অন্য কথা বললেও সমাজে এই সামান্য শব্দের দ্বারা আজও অনেক ক্ষতি হয় ।
ভাবুন তো যে মানুষ কথা বলতে পারেননা কানে শুনতে পাননা তঁর কত কষ্ট! সবার আগে আপন ভাষা খুব ভালো করে জানা দরকার। তবেই অন্য ভাষা আপনি সহজে শিখতে পারবেন। communication language হিসেবে English পড়ানো হয় বিভিন্ন engineering প্রতিষ্ঠানে এছাড়াও সাধারণ কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে।কারণ তাদের বাইরে চাকরি করতে গেলে international language একমাত্র মাধ্যম।
যাইহোক আমাদের জিভকে সচেতন ভাবে ব্যবহার করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। কথা বলতে পয়সা লাগেনা, কোন ট্যাক্স লাগেনা বাক স্বাধীনতা আমাদের আছে তাই যা ইচ্ছে আমরা বলে ফেলি। কথার ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা করুন। আপনার কথার দাম আপনার মূল্য বোধই আপনা কে দেবতা করে তুলবে। অনেক রাগী মানুষ নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেননা। তাদের বলি ঠান্ডা মাথায় একটু ভেবে দেখবেন। নিশ্চয়ই মানুষ কে বলবেন প্রয়োজনে কড়া হয়ে কিন্তু কটু কথায় নয়। খুব রাগ হলে ওয়াশরুমে গিয়ে ভালো করে পা ধুয়ে নেবেন তাতে অনেক উপকার হয়। মানুষের মর্যদা আপনার একার নয়।
বাইরের চেহারা দেখে কোনো মানুষকে বিচার করা যায়না। কার ভেতরে কোন ঈশ্বর বিরাজ করছে আপনি কী জানেন? তার অগাধ পান্ডিত্য কত ধরনের বই তিনি পড়েন আপনি কী করে জানবেন?যারা সত্যিকারের কিছু জানেন তারা অন্তত ঢাক ঢোল পেটাননা। আমাদের অসহিষ্ণু আচরণ আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
একটি চপের দোকানে খুব ভিড় হয়। সেই ভিড় ঠেলে এক পাগল দোকানদারের কাছে গিয়ে হাত পাতে। তখন দোকানি বলে চপ খাবি দাঁড়া বলে গরম তেল হাতে দেয় চপের বদলে। যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে ছেলেটি। সবাই তখন মজা দেখছে কেউ বা পাশ কাটিয়ে চলে গেছে।তখন মোসলেম বলে একজন হৃদয়বান মানুষ এগিয়ে আসে। সেই মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেটিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে সুস্থ করে তোলে। সেই থেকে শুরু হলো মোসলেম দার পথ চলা। পথে ঘাটে যখনই দেখেন মানসিক ভারসম্যহীন মানুষ তিনি নিজের ঘরে নিয়ে এসে সেবা শুশ্রুষা করেন আবার তাকে নিজের ঘরে ফিরিয়ে দেন। এমন মানুষের মাঝেই তো দেবতার বাস তাই না? এই তো ক্ষুদ্র জীবন আমাদের তাই দুটো ভালো কথা ভালো কাজ করে যদি সবার ভালো করতে পারি এর থেকে পুণ্য কিছু হয়না। শেষে বলি "সবারে বাস রে ভালো নইলে মনের কালো ঘুচবে নারে। আছে তোর যাহা ভালো ফুলের মতো দে সবারে"।
0 Comments