জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/সপ্তম পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী               
সপ্তম পর্ব         
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন  

আমরা এখন প্রায় ষাট বৎসরেরও অধিক সময়ের অতীতে ফিরে যেয়ে দেখব কিভাবে রামতনু মিশ্র আজকের মিঞা তানসেনে পরিবর্তিত হলেন। তানসেনের জন্ম সময় ও জন্ম বৃত্তান্ত নিয়ে স্বচ্ছ কোন ধারনা ঐতিহাসিকেরা আজ পর্যন্ত দিতে পারেননি। কোন কোন ঐতিহাসিকদের মতে তাঁর জন্ম সময় পনেরশো খ্রিস্টাব্দ আবার কেহ কেহ উল্লেখ করেছেন ১৪৯৩ থেকে ১৫০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোন একসময়ে তানসেনের জন্ম হয় বর্তমানে মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী বেহাত গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মুকুন্দ মিশ্র, বারানসী নগরীর বাসিন্দা, হিন্দু ব্রাহ্মণ, কিন্তু মায়ের নাম কোথাও পাওয়া যায়নি। মুকুন্দ মিশ্র একজন কবি ও সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন যিনি কিছুকাল বারানসীর কোন এক মন্দিরের পূজারী ছিলেন। বিয়ের পরে মুকুন্দ মিশ্র ও তাঁর স্ত্রীর কোন সন্তানাদি না থাকায় তারা মনের কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলেন। কারণ তাদের যতগুলি সন্তান জন্মগ্রহণ করছিল জন্মের কিছুদিন পরে সন্তানগুলি মারা যাচ্ছিল। এমন সময়ে এক বন্ধুর পরামর্শে মুকুন্দ মিশ্র গোয়ালিয়রের বিখ্যাত দরবেশ সুফি-সাধক মহম্মদ ঘাউসের কাছে পুত্র লাভের আশায় যান। মহম্মদ ঘাউস মুকুন্দ মিশ্রের হাতে একটি পবিত্র সুতো বেঁধে দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেছিলেন যে এক বৎসরের মধ্যে তাঁর পুত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে এবং সেই পুত্র জগৎ বিখ্যাত হবে। সেই সময় থেকে তাঁরা গোয়ালিয়রের নিকটবর্তী বেহাত গ্রামে বাস করতে লাগলেন। কিছুদিনের মধ্যেই মুকুন্দ মিশ্রের স্ত্রী এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিলেন এবং সেই পুত্রের নাম রাখলেন রামতনু মিশ্র বা তন্না মিশ্র। ছোটবেলায় অন্য শিশুদের মতো রামতনুর পড়াশোনাতে কোন আগ্রহ ছিল না। সারাদিন নিকটবর্তী জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতো আর বিভিন্ন পাখপাখালির কণ্ঠস্বর এবং বড় বড় জীবজন্তুর গলার স্বর শুনে নকল করত। শিশুর ভবিষ্যৎ নিয়ে মুকুন্দ মিশ্র চিন্তায় পড়ে গেলেন।                       

একদিন বৃন্দাবন থেকে বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হরিদাস স্বামী ও তাঁর শিষ্যরা গোয়ালিয়র যাবার পথে জঙ্গলের রাস্তা অতিক্রম করে যাচ্ছিলেন। দূরের থেকে তাঁদের দেখে রামতনু একটি গাছের ডালে পাতার আড়ালে বসে বাঘের হুঙ্কারের ন্যায় আওয়াজ করলো। হরিদাস স্বামীর শিষ্যেরা এই ডাক শুনে ভয় পেয়ে ভাবলেন নিকটস্থ জঙ্গলে নিশ্চিত বাঘ আছে। এমন সময়ে রামতনু গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে তাদের সামনে এসে দাড়ালো। বালকের নিখুঁত স্বরভঙ্গিমা শুনে দলনেতা হরিদাস স্বামী বুঝতে পারলেন বালকের কণ্ঠস্বর ঈশ্বরপ্রদত্ত। তিনি বালককে সঙ্গে নিয়ে তার পিতা মুকুন্দ মিশ্রের কাছে গিয়ে হাজির হয়ে তার অনুমতি চাইলেন যে বালকটিকে তার আশ্রমে নিয়ে গিয়ে সঙ্গীতের তালিম দিবেন। বালকের মা যদিও এই কথায় বালকটিকে সুদূর বৃন্দাবনে পাঠাতে রাজি ছিলেন না কিন্তু হরিদাস স্বামীর পীড়াপীড়িতে ও মুকুন্দ মিশ্রের বিশেষ আগ্রহে তাকে হরিদাস স্বামীর সাথে বৃন্দাবনে পাঠিয়ে দিলেন। হরিদাস স্বামী রামতনুকে নিয়ে বৃন্দাবনে যমুনা কিনারে নিধুবনে তাঁর আশ্রমে নিয়ে গেলেন। সেখানে দীর্ঘ দশ বছরের সাধনায় রামতনু গুরুর সৃষ্ট ধ্রুপদ এবং বিভিন্ন রাগ যেমন ভৈরবী, দরবারী তোড়ি, দরবারী কানাড়া, মল্লার, সারঙ্গ, রাগেশ্বরী প্রভৃতি রাগগুলি আয়ত্ব করে রামতনু থেকে তানসেনে পরিনত হন। 

দশ বছর ধরে রামতনু যেমন একনিষ্ঠভাবে সঙ্গীত শিক্ষায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন অনুরূপভাবে হরিদাস স্বামীও তাঁর মত শিষ্য পেয়ে তাঁর সকল বিদ্যা তাকে পরিপূর্ণভাবে দান করেছিলেন। সঙ্গীতের প্রাথমিক স্তর বা নিয়মগুলি থেকে শুরু করে সিদ্ধহস্তে তানপুরা বাজানো, সা রে গা মা পা থেকে শুরু করে সংগীতের বিভিন্ন রাগ আয়ত্ত করলেন তানসেন। তিনি শিখলেন কিভাবে সঙ্গীতের বিভিন্ন রাগ বদলে দেয় মানুষের মনের অবস্থা। প্রকৃতি ও মানব মনের সাথে সঙ্গীতের নিগূঢ় সম্পর্ক অনুভব করতে লাগলেন। একটি রাগ কিভাবে কাউকে যেমন আনন্দে পর্যবসিত করতে পারে আবার পরক্ষণেই বিপরীত একটি রাগ কিভাবে চোখে জল এনে দিতে পারে। এসব কিছু যেন তানসেনের নখদর্পণে এসে গিয়েছিল। বলাবাহুল্য ইতিহাসের পাতায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গুরু-শিষ্যের মধ্যে হরিদাস স্বামী এবং তানসেনের নাম উজ্জ্বল হয়ে রইল।                     

এদিকে তানসেনের বাবার অসুস্থ হবার খবর শুনে তানসেন গুরুর অনুমতি নিয়ে বৃন্দাবন থেকে ফিরে আসলেন গোয়ালিয়রে তাদের গ্রামের বাড়িতে। মুকুন্দ মিশ্র মারা যাবার পূর্বে তানসেনকে বলে গেলেন যে সে যেন এরপরে সুফি সাধক হজরত মহম্মদ ঘাউসের কাছে গিয়ে সংগীত শিক্ষা গ্রহণ করে। পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পরে তাঁর মাও মারা গেলেন। এই সময়ে তিনি মানসিক দিক দিয়ে বিমর্ষ হয়ে নিকটস্থ শিবমন্দিরে যেয়ে শিবস্তোত্র গাইতেন। একদিন পিতার উপদেশ স্মরণ করে তানসেন মহম্মদ ঘাউসের কাছে যাবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু তার আগে তিনি চিন্তা করলেন বর্তমান গুরু হরিদাস স্বামীর সম্মতি নেওয়া প্রয়োজন। তিনি কাল বিলম্ব না করে বৃন্দাবনে যেয়ে হরিদাস স্বামীকে সমস্ত ঘটনাবলী বলার পরে হরিদাস স্বামী বললেন যে তাঁর দরজা সবসময়ই রামতনুর জন্য খোলা থাকবে এবং সে সুফী সাধক মহম্মদ ঘাউসের কাছে সঙ্গীত শিক্ষার জন্য যেতে পারে। তানসেন এর পরে মহম্মদ ঘাউসের কাছে গিয়ে তিন বৎসর যাবত সংগীত শিক্ষার আরো বিভিন্ন দিক নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করলেন। মহম্মদ ঘাউস তানসেনকে এই সময়ে গোয়ালিয়রের অন্যান্য সঙ্গীত শিল্পীদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন এবং গোয়ালিয়রের রাজা মানসিংহ তোমর ও তার সুন্দরী, সঙ্গীতজ্ঞা গুর্জরী স্ত্রী মৃগনয়নী দেবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন যার ফলে তানসেনের পরিচিতি সঙ্গীতজগতে বৃদ্ধি পেতে থাকে।                                                                                                                                                                                                                                                                                                          

রাজপ্রাসাদ যাতায়াত করতে করতে রাজার এক পরিচারিকার প্রেমে পড়লেন তানসেন। মেয়েটির নাম ছিল হোসেনী যার অর্থ সুন্দরী। তারা দুজনে বিয়ে করলেন এবং তানসেন ধর্মান্তরিত হলেন। এই হোসেনীর গর্ভে তানসেনের পাঁচ পুত্র কন্যা জন্মগ্রহণ করে। এরা হলেন এরা হলেন হামিরসেন, সুরতসেন, তানরস খান সরস্বতী ও বিলাস খান, যারা পরবর্তীকালে সংগীতের এক এক জন দিকপাল হয়ে উঠেন। আবার ঐতিহাসিকদের মতে তানসেন আকবরের আগ্রা প্রাসাদে যাবার পরে আকবরের কন্যা মেহেরুন্নেসাকেও বিবাহ করেন। বলাবাহুল্য যে মেহেরুন্নেসাকে বিবাহ করার পূর্বে তানসেন ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন।

মহম্মদ ঘাউস মারা যাবার পূর্বে তাঁর সকল সম্পত্তি তানসেনের নামে লিখে দিয়ে গেলেন এবং তানসেন পরিবার নিয়ে সেখানেই বাস করতে লাগলেন। তানসেনের সঙ্গীতের খ্যাতি শুনে নিকটবর্তী রেওয়ার রাজা রামচন্দ্র সিংহ তাঁকে তাঁর রাজসভায় এসে সভাগায়কের পদ অলঙ্কৃত করার অনুরোধ জানালেন। তাঁর গান শুনে রাজা রামচন্দ্র তাঁকে আর ছাড়তে চাইলেন না ফলে তানসেন রাজা রামচন্দ্রের প্রাসাদেই বাস করতে লাগলেন। এরপরের ঘটনা হলো দিল্লির সম্রাট আকবর তাঁর গানের সংস্পর্শে এসে তাঁকে আগ্রা রাজপ্রাসাদে নিয়ে যান। সেই ঘটনা আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি। আকবরের রাজসভায় গিয়ে তানসেনের খ্যাতি যেন আকাশ ছুঁতে লাগলো। এতদিন যেন তানসেন সঠিক জায়গা পাননি তার সঙ্গীত প্রতিভা বিকাশের জন্য আকবরের সভায় তাকে সেই ক্ষেত্রটি দিল। রাতের বেলায় তানসেন আকবরকে দরবারী কানাড়া রাগের মাধ্যমে ঘুম পাড়াতেন এবং সকালে মিঞা কি তোড়ি রাগে ঘুম ভাঙাতেন। এইভাবে সম্রাট আকবরের দৈনন্দিন জীবনে তানসেন অবিচ্ছেদ্যভাবে গাঁথা হয়ে গিয়েছিলেন। তাই সম্রাটের নবরত্ন সভায় যে তানসেন থাকবেন এ কোন অদ্ভুত কথা ছিলনা। কথিত আছে তানসেন যখন তার বিভিন্ন রাগ গাইতেন তখন আশেপাশের পশুপাখিরাও তার গান শুনতে প্রাসাদ চত্বরে চলে আসতো। প্রকৃতির সাথে এমনই সুরের বন্ধনে নিজেকে তিনি বেঁধেছিলেন। প্রবাদ একবার আকবরের একটি হস্তী উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করায় তানসেন সেই হস্তীটিকে সঙ্গীতের মাধ্যমে শান্ত করেন। এছাড়াও তিনি বাহার রাগের মাধ্যমে গাছে গাছে ফুল ফোটাতে পারতেন।
আকবর বাদশার দরবারে তার প্রধান সঙ্গীতশিল্পী তানসেন ছাড়াও আরো ৩৬ জন সভাগায়ক আছেন। তারা কেউ ইরানী, কেউ তূরাণী, কেউ বা রাজপুত বা হিন্দুস্থানী। এমনকি মাণ্ডুর ক্ষমতাচ্যুত রাজা বাজবাহাদুর সঙ্গীতবিদ্যায় পারদর্শী বলে তাঁকেও সম্রাট সভাগায়কের আসন দিয়েছেন। সম্রাটের দরবারে তানসেন ব্যতীত অন্য যে ৩৬ জন গায়ক আছেন তাদের মধ্যে সাতজন গায়ক সম্রাটের দরবারে বিশেষ সমাদর লাভ করেন। তাঁরা হলেন জ্ঞান খাঁ, দরিয়া খান, বাবা রামদাস, সুরদাস, মিঞা মসনদ আলি খাঁ, বাজবাহাদুর এবং মিঞা খোদাবক্স। এদের মধ্যে মিঞা খোদাবক্স দরবারের প্রবীণতম গায়ক। মিঞা তানসেনের পরেই সম্রাট সবথেকে বেশি সমাদর করেন এই মিঞা খোদাবক্সকে। অবশ্য তার আরেকটি কারণ হল মিঞা খোদাবক্স আকবরের পিতা হুমায়ুনের সময় থেকে সভাগায়কের পদ অলংকৃত করে আছেন। দরবারে এই সাত গায়কের জন্য সপ্তাহে একটি করে নির্দিষ্ট দিন নির্ধারিত করা আছে। জুম্মাবার থেকেই সপ্তাহ শুরু হয়। জুম্মাবারে সঙ্গীত পরিবেশন করেন মিঞা খোদাবক্স আর সপ্তাহ শেষ করেন বৃহস্পতিবারে বাবা রামদাস। এঁরা ছাড়াও অন্য যে ২৯ জন                                        গায়ক আছেন তারা সম্রাটের ইচ্ছানুসারে সংগীত পরিবেশন করেন, কিন্তু মিঞা তানসেন এই ৩৬ জন গায়কের ক্ষেত্রে যে নিয়ম প্রযোজ্য তার উর্ধ্বে। তিনি সভার প্রধান গায়ক ও নবরত্ন সভার সদস্য। সাধারণতঃ নবরত্ন সভার শ্রোতৃমন্ডলের সামনে অথবা সম্রাটের সামনে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। আবার কখনো সখনো সম্রাটের দরবারে বিশেষ কোন অতিথির আগমন ঘটলে সম্রাটের অনুরোধে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। দরবারে সংগীত পরিবেশন করতে না হলেও তানসেনকে প্রত্যহ নবরত্ন সভায় উপস্থিত থাকতে হয়। এই নবরত্ন সভায় সম্রাটকে বিভিন্ন প্রশাসনিক এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রধান পরামর্শদাতা হলেন রাজা মানসিংহ মন্ত্রী টোডরমল আব্দুর রহিম এবং আবুল ফজল সরাসরি দরবারের আলাপ-আলোচনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয়। সম্রাটকে ধর্ম বিষয়ে উপদেষ্টা দেন মোল্লা দোপিয়াঁজা ও ফকির আজিওদ্দিন। কোন গুরুতর বিষয়ে সভার সদস্যরা সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলে সম্রাট তীক্ষ্ণবুদ্ধির বীরবল ও অসম্ভব শীতল মস্তিষ্কের ফৌজির পরামর্শ নেন। দরবারের সময়টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময় তানসেন নিজ গৃহে অবস্থান করেন। নিজের কক্ষে তিনি কোন রাগরাগিণীর আলাপে অথবা নতুন কোন রাগ রাগিনী সৃষ্টির কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। আগ্রা কেল্লাতে তানসেনের জন্য নির্ধারিত হাভেলিতে তাঁর সঙ্গে শুধু একমাত্র কন্যা সরস্বতী ও কিছু কাজের লোক থাকে। তানসেনের স্ত্রী হোসনী চার পুত্রকে নিয়ে বেহাত গ্রামে তানসেনের আদিবাড়ীতেই থাকেন। তানসেনের হাভেলিতে লোকসমাগম কম হওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গীত সাধনার কোনরূপ ব্যাঘাত ঘটে না, নিভৃতে সঙ্গীত সাধনায় তিনি মেতে থাকেন।  
                                                                   ক্রমশঃ


পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments