আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে পর্ব এগারো
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
মরমী মেলা
"দেখবি চল পুতুলনাচ চড়ক মেলাতে। কিনে দেব জরির ফিতা চুড়ি দুহাতে" । এই গানটিই যেন নিজে একটি ছবি। সব মানুষই মেলা দেখেছেন।।এখন চড়ক গাছ মনে পড়লে ভয় পাই। অতো উঁচুতে চামড়ায় লোহার হুক বিঁধে কি ভাবে মানুষ ঘোরে? বড় বিস্ময় জাগে। মেলা মানেই তো মিলন ক্ষেত্র।
এক দৃষ্টে চেয়ে আছে বাচ্চা মেয়েটি জিলিপির দিকে। তার মা তাকে ধাক্কা মেরে বললো "দাঁড়া দেখছি ক টাকা আছে", আঁচলের খুঁট খুলে দশ টাকা বের করে জিলিপি কিনে দিল। একটা জিলিপি বর বউ ভাগ করে খেল আর ঠোঙাটি মেয়েটির হাতে দিল। নাকে সর্দি টানতে টানতে মনের আনন্দে জিলিপি খাচ্ছে।। কোলের ছোট টা এখনো খেতে শেখেনি। অজস্র লোক সমাগম। মলিন পোশাক পরা মানুষেরা উজ্জ্বল চোখ মুখে আনন্দে উড়ে বেড়াচ্ছে। খাবারের গন্ধে মাছি উড়ে আসছে।
সারা মাঠ ধুলোয় ধূসর। কাঁদতে কাঁদতে ধেবড়ে গেছে বাচ্চাটির চোখের কাজল । শুয়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে, তার মা উঠিয়ে নিয়ে একটা চড় মারলো হালকা করে। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম কী হলো গো বাচ্চা কে মারছো কেন?
ঝুলায় চইড়বে গো আমার আর উয়ার বাবার দমে চক্বর লাগে, তাবাদে কিমন করে চইড়বো বলো ?
বাচ্চা মানুষ কী করে বুঝবে এসব ? পৃথিবীর সব আশ্চর্যের ভেতর নিজেকে মেলে ধরতে চায়। সে মেলায় এসেছে আর আনন্দ গায়ে মাখবে না?
নব বিবাহিত আদিবাসী যুগল একটি শাড়ির স্টলের ভেতর ঢুকে শাড়ি দেখছে তারপর দাম জিজ্ঞাসা করল। কোনো শাড়িই পাঁচশো টাকার কমে নেই। কী আর করবে বেজার মুখে দোকান থেকে বেরিয়ে তার স্বামীকে বললো "ই বার পুজোয় মোটা কাপড় লিবো নাই। সরু কাপড়টা লিবো শুনে লাও।" স্বামী বললো "এক মাইনা খেটে লিবো হয়ে যাবেক, নাই চিন্তা কর"। দুজনের চোখে যেন পূর্ণিমা চাঁদ নেমে এলো।
বতর্মান যুগে যান্ত্রিকতার আঁচ লেগেছে শহরে এবং গ্রামে। সেই মেলার রূপ আর নেই।
এখন মেলাতে থাকে ইলেকট্রনিকস যন্ত্রপাতি, ঘর সাজানোর সরঞ্জাম, বিভিন্ন রকম নামি দামি শাড়ি, বুটিকের পসরা। কত রকম মেলা হস্ত শিল্প মেলা, বই মেলা, বাণিজ্য মেলা । পিৎজা বার্গার স্যান্ডুইচ, মোমো, বিভিন্ন ধরনের কেক,পেস্ট্রি, ব্রউানি, ট্যাকো, হটডগ ,চাইনিজ, থাইফুড,মোগলাই বলতে বলতে আমি হাঁপিয়ে যাব। দল বেঁধে আসা পাড়া ঝেঁটিয়ে ফুরফুরে আনন্দ কারোর মুখে দেখিনি। নকল আলো নিয়ে অহং সর্বস্ব মানুষ । বিশ্বাস করুন এই মেকি মেলা আমার খুব একটা পচ্ছন্দ নয়। বিহারে শোন পুরের বিখ্যাত মেলার নাম জানেন? আসলে সেটি হচ্ছে পশু মেলা। বিভিন্ন রকম গৃহপালিত পশু সেখানে কেনা বেচা হয়। আমি এক অদ্ভুত মেলার কথা জানি বাঁকুড়ার কেঞ্জাকুড়া মুড়ির মেলা। রাঢ় বাংলার মানুষ মুড়ি অন্ত প্রাণ। মেন কোর্সের মধ্যে মুড়ি অন্যতম। দারকেশ্বর ঘাটে বসে মুড়ি খাওয়া। আট থেকে আশি মুড়ি খাওয়ার আনন্দে মেতে ওঠে বলতে গেলেই জিভে জল এসে যাচ্ছে। আমিও তো মুড়ি ভক্ত। গায়ে শীত বস্ত্র জড়িয়ে একের পর এক খাবল মুড়ি তুলে নিয়ে তাতে টমেটো, পেয়াজ কাঁচা লঙ্কা,বেগুনি, মটরশুঁটি, শশা চানাচুর মাখিয়ে মুড়ি খাওয়া যেন অমৃত স্বাদ। মনোরম শীতের সকালে উড়ে আসে আহ্লাদিত দুএকটি বক। আত্মীয় স্বজন বন্ধু চা খাওয়া খোশমেজাজে গল্পের তুবড়ি ফাটে। এই মেলাটির কথা আমি ভুলতে পারিনা।
মনে পড়ে শান্তিনিকেতনে পৌষ মেলার কথা। কত দেশ থেকে কত বাউল আসে সে এক অদ্ভুত দৃশ্য যে দেখেনি তার এ জন্মের এখনো অনেক কিছুই অজানা। আমি অনেক মাটির গয়না কিনে ছিলাম আজও খুব সুন্দর আছে সেগুলি। গঙ্গাসাগরের মেলার কথা আমরা সকলে জানি। এখন গঙ্গা সাগর যাওয়া অতো শক্ত নয়। আস্ত ভারতবর্ষ দর্শন হয়ে যায়। বস্ত্রহীন ল্যাংটো সাধুবাবার দেখা পাওয়া যায় সেখানে । বসে আছেন ছাই ভষ্ম মেখে ধূপ ধুনো জ্বালিয়ে। থেকে থেকে বিকট আওয়াজ বোম ভোলে, জয় শঙ্কর। গাঁজা ফুঁকে চোখ মুখ লাল করে বসে আছেন। কত মানুষ আসছেন কত সমস্যা নিয়ে তাঁদের কাছে।
কতরকম মেলা যে আমাদের দেশে বিশেষ করে আজ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের বারো মাসে তেরো পার্বণ কে কেন্দ্র করে বসে তা বলে শেষ করা যাবেনা। তবে গ্রাম্য মেলার যেন আলাদা প্রাণ আছে। যেমন ধরুন অগ্রদ্বীপের গোপীনাথের মেলা খুব বিখ্যাত। এক্তেশ্বরের গাজন মেলা। গাজন শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা হয় গর্জন থেকে গাজনের জন্ম। কোচবিহারের রাশমেলা উত্তর ও পূর্ব ভারতের সবচাইতে বড় মেলা।
খেদাইতলার সাপের মেলা স্থানীয় মানুষদের মতে আড়াশো বছরের পুরনো মেলা। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে বেদে বেদিনীরা আসে সাপ নিয়ে। বিখ্যাত গোবরডাঙার গোষ্ঠবিহার মেলা
জলপেশের শিব রাত্রি মেলা তে মেতে ওঠে জলপাইগুড়ির লোক। জয়দেব কেন্দুলির মেলা তো পৃথিবী বিখ্যাত। কত বাউল আসে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। মকর সংক্রান্তি তে তিস্তা বাজারে বেণীর মেলা তে পুণ্য স্নান হয়।
ধলদিঘির মেলা। ধাওয়াল গ্রামের কংসাব্রতর
মেলা পান্ডুয়ার বাইশ হাজারির মেলা, মালদা জেলার গাজল থানার অন্তর্গত।
বেগোপাড়ার বড়দিনের মেলা নদিয়ার রানাঘাটে। মাহেশের রথের মেলা মেলা তো ইতিহাস সৃষ্টি করেছে।
মুর্শিদাবাদে বেরার মেলার কথা অনেকেই জানেন না। বেরা মানে ভাসান খোজা খিজির উৎসব।
ভাদ্রমাসের শেষ বৃহস্পতিবার ইমামবাড়ার সামনের ঘাটে ভাগীরথির জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয় বেরা। মুর্শিদাবাদের মানুষের কাছে বেরা মঙ্গলের উৎসব সম্প্রীতির উৎসব।
"দাদা পায়ে পড়ি রে মেলা থেকে বউ এনে দে" অংশুমান রায়ের বিখ্যাত গান। মেলা মিলনের জায়গা। মনের মানুষ কে অবশ্যই খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আমাদের একঘেয়ে জীবনে মেলার গুরুত্ব অসীম। আমাদের ছোট ছোট আশা প্রদীপের আলোর মতো আলো পায়। প্রাত্যহিক দুঃখ সুখ সব কিছু দূরে সরিয়ে জীবনকে একটু
মেলে ধরতে চাই মেলার রঙের স্পর্শে। মেলা শব্দের অর্থ অনেক । যেখানে অনেক মানুষ একত্রিত হয় বেঁধে বেঁধে থাকে মানুষের মিলিত হৃদয়। বারবার মেলা আসুক আমাদের জীবনে।
আমরা উৎসবে মেতে উঠি মিলন মেলায় মিলিত হই মনে প্রাণে ।
0 Comments