জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে /রোশেনারা খান/পর্ব ৩৮

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৩৮

কিংক্রস স্টেশন থেকে বেরিয়া প্রথমে রাতের খাবার কিনে নিয়েই হোটেলে ঢোকার কথা ভাবা হলেও, পরে দীপ বলল, বাবলি সারাদিন হোটেলে বন্দি হয়ে আছে, ওকে নিয়ে বেরিয়ে খাবার কিনে ফিরব। সেইমত জারাকে আমার কাছে রেখে ওরা বেরিয়ে  গেল। তবে বেশিক্ষণের জন্য নয়। কারণ জারার বয়স আজ ১ মাস ২৪ দিন। বুকের দুধ ছাড়া কিছু খায় না। আমাদের রুমদুটি প্রায় মুখোমুখি। রুমের মধ্যে চা ও কফির সমস্ত ব্যবস্থা রয়েছে। কিছুক্ষণ পরে ওরা ফিরে এসে জানাল, খাবার অর্ডার দিয়ে আসেছে, আধঘণ্টা দেরি হবে। দীপকেই খাবার নিতে যেতে হবে। আসলে চা কফি ছাড়া রুমের মধ্যে অন্য খাবার খাওয়া নিষেধ। তাই খাবার লুকিয়ে নিয়ে আসতে হবে। আধঘণ্টা পরে দীপ রুকস্যাকে খাবার ভরে নিয়ে এল। রান্না ভীষণই ভাল। সারাদিনের ক্লান্তিতে খাবার পরেই দুচোখে ঘুম নেমে এল।     

      পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দুজনের জন্য চা বানিয়ে খেলাম। তার আগে অবশ্যই দাঁত ব্রাশ করেছি। বাসিমুখে চা খেয়ে সাহেবিয়ানা দেখানোর ইচ্ছে একদমই নেই। ওরা মনে হয় এখনো ঘুমচ্ছে। কিছুক্ষণ বাদে আমরা স্নানও সেরে নিলাম। আজ সবাই মিলে সারাদিন লন্ডন শহরে ঘুরব। ন’টার দিকে বাবলি জারাকে আমার কাছে দিয়ে গেল। আমরা যখন বেরনোর জন্য তৈরি হচ্ছি্‌, একজন নেপালি মহিলা রুম পরিষ্কার করতে এলেন। কপালে লাল টিপ আর মুখে হিন্দি ভাষা শুনে তাঁকে যেন কত চেনা, কত আপন মনে হল।
              ওরা নিজেরা জামাকাপড় পরে রেডি হচ্ছে দেখে আমি জারাকে ওর ড্রেস পরিয়ে রেডি করলাম। তিনটে ব্যগে জল, খাবার, ক্যামেরা, ছাতা, জারার এক্সট্রা  জামাকাপড় ও ন্যাপি ভরে তিনজনে তিনটে ব্যাগ আর জারার প্র্যাম ঠেলে নিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে আগে ম্যাকডোল্যান্ডে গেলাম। খাবার নিয়ে একটা ফাঁকা টিবিল দেখে খেতে বসলাম। প্র্যামটা নিচে রেখে কারসিটে করে ওকে নিয়ে এসেছি, জানেই না ও কোথায় আছে, বা কোথায় যাচ্ছে? টিকিট কাটা হয়ে গেছে, মেট্রো  ধরার জন্য আবার চলমান সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে হবে। প্র্যামটা ভাঁজ করে বাবলি নিল। দীপ ঘুমনো অবস্থায় জারার কারসিট হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে চলমান সিঁড়িতে পা রাখল। আমার জারাকে নিয়ে ভীষণ ভয় করছিল। যাইহোক, আমরা আমাদের স্টেশনে নির্বিঘ্নে পৌঁছালাম। ট্রেনের টিকিট কাটা হয়েছে গ্রিনপার্ক যাওয়ার জন্য। ওখান থেকেই সিটি টুরের বাস ধরতে হবে। ট্রেনে উঠে দুটি সিট খালি পেয়ে আমরা দুজন বসলাম, যেহেতু গন্তব্যস্থল একটা স্টেশন পরেই, তাই ওরা দুজন জারার প্র্যাম ধরে গেটের সামনে দাঁড়াল।  সবাই মিলে রওনা হলাম ঠিকই, কিন্তু চিন্তা হচ্ছে জারাকে নিয়ে। আজ ওর বয়স ১ মাস ২৫ দিন। আমাদের দেশে এইটুকু বাচ্চাকে নিয়ে এভাবে বেড়ানর কথা ভাবতেও পারিনা। চিন্তার কারণ ওয়েদার। আকাশ জুড়ে মেঘের ঘনঘটা, কখন যে বৃষ্টি নেমে আসবে তা বলা কঠিন। এখানকার ওয়েদার রিপোর্ট বেশ ভাবে মিলে যায়। রিপোর্ট জানিয়েছে  চারটের পর বৃষ্টি হবে। যাইহোক, আমরা ট্রেন থেকে নেমে সিটি টুরের বাসে চড়লাম এবং একেবারে সামনে বসলাম। একদিকে আমি আর খান সাহেব, অপর  দিকে দীপ আর বাবলি বসল। মাঝ খানের প্যাসেজে জারার কারসিট রাখা হল। ওবেশ ঘুমচ্ছিল, হঠাৎ মাইক্রোফোনের তীব্র আওয়াজে ঘুম ভেঙ্গে চিৎকার করে কেঁদে উঠল। ওর কান্না শুনে গাইড ভদ্রমহিলা আমাদের কাছে এসে বার বার দুঃখপ্রকাশ করতে লাগলেন। বুঝলাম এঁদের শিষ্টাচার ,ভদ্রতা এবং শিশুর প্রতি কতটা যত্নশীল ও স্পর্শকাতর। বাস থেকে নেমে বাবলি একটা বেঞ্চে বসে ওকে খাওয়াতে শুরু করল, এদেশে যেখানে সেখানে বাচ্চাকে খাওয়ানো যায় না। বেচারার খুব খিদে পেয়েছিল। মেয়ের কান্না দেখে বাবলি খুব ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ও হোটেলে ফিরতে চায়। দীপ বলল আমাদের বাসে উঠিয়ে দিয়ে বাবলিদের নিয়ে হোটেলে ফিরে যাবে। আমি তখন বললাম, ছাদ খোলা বাসে চড়লে ও কাঁদবে বলে মনে হয় না। যদি কাঁদে তাহলে আমরা সবাই হোটেলে ফিরে যাব। আবার আমরা চলমান সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
    বাস দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু আমাদের টিকিট চেক করতে করতে বাস ছেড়ে চলে গেল। চিন্তার কারণ নেই, ১০ মিনিট অন্তর এই বাস সারা শহর পাক খাচ্ছে। এই বাসেও দোতলার সামনের দিকে ৪ টে সিট পেলাম, ২ জন করে আমরা  দুদিকে বসলাম। জারা কারসিটে ঘুমোচ্ছে। গ্রিনপার্ক আয়তনে অনেক বড়। এর ভিতর দিয়ে বা পাশের রাস্তা ধরে বাকিংহাম প্যালেসে যাওয়া যায়। আজও লন্ডন শহরটা এক দিয়ে এসে বাকিংহাম প্যালেস দেখব, এটাই ঠিক হল। লন্ডনের মত শহর ৩/৪ দিনে ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। আমরা কলকাতার কতটুকু দেখতে পেরেছি? যারা কলকাতায় বাস করেন, তারাও যে কলকাতার সবকিছু চেনেন, জানেন, তা নয়।
    যাইহোক আমাদের বাস গ্রিন পার্ক ছাড়িয়ে হাইড পার্কের পাশ দিয়ে চলেছে। পার্কের মাঝখানে একটা সুন্দর ফোয়ারা দেখা যাচ্ছে। ফোয়ারার জল সাদা ফেনার মত। এই পার্কে ডায়নার নামে একটি ঝর্ণা রয়েছে। এছাড়াও রয়েছে অ্যালবার্ট মেমোরিয়াল এবং একটি প্যালেস। মার্বেল আর্চের তিনদিক  ঘুরে আমাদের বাস চলেছে বেকার স্ট্রিটের দিকে, এখানেই রয়েছে ম্যাডাম তুসোর মিউজিয়াম রয়েছে।  যা গতকাল দেখেছি। ঘড়ির দিকে চোখ রাখার সময় হয়নি, প্রয়োজনও হয়নি। এখানে এখন অন্ধকার নামে ১০ টার পর।
    সারা শহর ঘুরে বাস আবার গ্রিন পার্কে এসে দাঁড়াল। আমরা নেমে পড়লাম। বাকিংহাম প্যালেসের সামনে দাঁড়িয়ে রোমাঞ্চিত হলাম, এই প্যালেসে ব্রিটেনের রানী বাস করেন। ডায়না বেঁচে থাকলে হয়ত এই প্যালেসেই বাস করতেন। এখানে আসা থেকে দেখছি, খবরের কাগজে রোজ কিছু না কিছু ডায়নার  খবর থাকে। যাইহোক এই প্যালেসে ৭০০ টি কামরা আছে। বাইরের মানুষ যখন খুশি এখানে প্রবেশ করতে পারেনা। বছরের মধ্য অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর এই দুইমাস, মানে গ্রীষ্মের সময়  প্যালেসের স্টেট রুমগুলি জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।  রানী এইসময় স্কটল্যান্ড যান গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে। তার মানে রানী এখন এই প্রাসাদেই আছেন। প্যালেসের বাইরেও অনেক কিছু দেখার আছে। আমরা ঘুরে ঘুরে সেই সবের ছবি তুলতে লাগলাম। প্যালেসের দিকে পিছন ফিরে তাকালে বামদিকে একটা খুব সুন্দর গাছ গাছালিতে  ঘেরা একটা লেক। লেকের  জলে বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস, হাঁসের ছানা সাঁতার দিচ্ছে। লেকের মাঝখানে্ একটা সরু কাঠের  পুল রয়েছে। দূর থেকে পুলের ওপরের ফাঁকা অংশ দিয়ে দূরে লন্ডন আই দেখা  যাচ্ছে। আরও এগিয়ে সামনে মার্বেল আর্চ, আমরা তার তলা দিয়ে  বাইরে বেরিয়ে  এলামে। হঠাৎ একটা মানুষে চালানো রিক্সা চলে যেতে দেখলাম। জানলাম সাওয়ারি নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়, দিঘায় ঘোড়ায় চড়ার মত সখে চড়ার জন্য। আফসোস,  রিক্সাটার একটা ছবি তোলা হল না।  টেমসের বুকে ভাসাও হল না। জারা আবার কান্না শুরু করেছে। ওইটুকু বাচ্চা আর কত ধকল সহ্য করবে? আমরা হোটেলে ফিরে ফ্রেস হয়ে বিছানায় গা এলিয়ে টিভিতে খবর দেখছিলাম। ওয়েদার রিপোর্ট জানাল আগামীকাল দুপুর অব্দি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। মানে কাল আর ঘোরা যাবে না। ঠিক হল ১২টায় লাঞ্চ করে একেবারে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে ব্রিটিশ মিউজিয়াম যাব, ওখান থেকে বেরিয়ে ফেরার বাস ধরব।

      ঘুমের মধ্যে মনে হচ্ছে টেবিলের ওপর ইঁদুর নাচানাচি করছে, তারই  আওয়াজ কানে আসছে, ঘুম ভাঙ্গতে বুঝলাম ওটা বৃষ্টি পড়ার আওয়াজ। চা বানিয়ে খেয়ে ব্যাগ গোছানো শুরু করলাম। আজ আর ব্রেকফাস্ট নয়, তাড়াতাড়ি লাঞ্চ করে বের হতে হবে। স্নান করে রেডি হয়ে নিলাম। দীপ খাবার নিয়ে এলো। ঠিক ১২টাতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আগেই গাড়ি বুক করা ছিল। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, ব্রিটিশ  মিউজিয়ামে পৌঁছাতেই অঝোরে বৃষ্টি নামল। ছাতা মাথায় কোনও রকমে গেট থেকে  মিউজিইয়ামে  ঢুকলাম। হাতে রয়েছে মিউজিয়ামের ম্যাপ। পৃথিবীর প্রায় সব দেশের শিল্প সামগ্রী এখানে মজুত রয়ে্ছে। এসব কয়েক ঘণ্টায় দেখে ওঠা সম্ভব নয়। এক একটা ফ্লোর একদিনে দেখে ওঠা যাবে না।দেশ বিদেশের অসংখ্য মূর্তি রয়েছে, যেগুলোর বেশির ভাগই ইতিহাস বইয়ে দেখা। মুসলিম দেশের শিলালিপি, মনোমুগ্ধাকর তৈজসপত্র, শিরস্ত্রাণ যেমন রয়েছে, তেমন ভারত থেকে নিয়ে যাওয়া প্রচুর দেবদেবীর ছোট ছোট পাথরের মূর্তি কাচের শোকেসে সাজানো আছে। মোগলদের শিল্পকলাও রয়েছে। রয়েছে লাফিংবুদ্ধের নানা আকারের মূর্তি। 
    অসংখ্য শিল্পকলার মধ্যে যে সামান্য কিছু দেখা সম্ভব হয়েছিল, তারমধ্যে  কয়েকটা ছবি আজও মনে গেথে রয়েছে। একটি হল এক সময়কার মিশরের রানী হাটসেপসুটের নকল দাড়ি লাগানো সোনালী রঙের মূর্তি। সমস্ত রকম যোগ্যতা  থাকা স্বত্বেও নারীর শাসন মেনে নিতে মিশরবাসী খুব একটা রাজি ছিলনা। ইনি ছিলেন মিশরের রাজা প্রথম থুতমসের কন্যা। ভাইয়েদের তুলনায় হাতসেপসুট সব বিষয়ে দক্ষ ছিলেন। রাজার ইচ্ছে ছিল তাঁর অবর্তমানে কন্যা হাটসেপসুট যেন মিশরের শাসনভার গ্রহণ করে। কিন্তু মিশরবাসী তা মানবে না। সেই সময়  মিশরের রাজ পরিবারে ভাইবোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন ছিল। হাটসেপসুট তখন তাঁর সৎভাইকে বিয়ে করে মিশরের রানী হয়ে মুখে দাড়ি লাগিয়ে ছদ্মবেশে  দক্ষতার  সঙ্গে মিশর শাসন করেছিলেন। কেউ চিনতে পারত না। সবাই তাঁকে রাজ পরিবারের কোনও পুরুষ ভাবত। এইভাবে ১৪ বছর শাসনকার্য চালানোর পর হঠাৎ অসুস্থ হয়ে  দ্বিতীয় থুতমোস মারা গেলে আবার সিংহাসনে কে বসবেন?  এই নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়।। সে আর এক কাহিনী। তা আর বলছি না। এবার আমাদের ফিরতে হবে।

                                        ক্রমশ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments