আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে
পর্ব ১২
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
"হৃদয়ে লেখ নাম"
"তোমারই নাম বলব নানা ছলে" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানটি আমরা সবাই কোনো না কোনো সময় গেয়েছি। ঈশ্বর প্রেমে গাই গান, মানুষ মানুষে হৃদয়ের প্রেমে এই গান গাই । একই গানের কতরকম আবেদন থাকে।। বারবার নামের অন্তরে নিজেকে মেলে ধরি। দিকে দিকে যেন সবার মুখে মুখে প্রচারিত হয় আমার নাম। আমরা আজীবন কত কষ্ট করি এই নামটুকু কেনার জন্য। কখনো বা নামের আড়ালে চাপা পড়ে যায় আস্ত মানুষটি। "সখী সে হরি কেমন বল নাম শুনে যার এতো প্রেম জাগে চোখে আনে এত জল" নজরুলের বিখ্যাত গানটি সেই কৃষ্ণনামের গুণগানের কথাই তো বলা হয়েছে এখানে । কৃষ্ণ নামেই হৃদয়ের দুকূল ভেসে যায়। ভক্ত আর ভগবানের প্রেম।কৃষ্ণ প্রেমের ঠাকুর। কৃষ্ণের আরাধিকা রাধিকা।জয় রাধে বললেই কৃষ্ণ খুশি হন, রাধানামে কৃষ্ণকে পাবার আকুতি আছে।
কোনো কোনো নাম নিজেই
একটা প্রতিষ্ঠান। যেমন রবীন্দ্রনাথ বললে একটা জাতির পরিচয় বহন করে। অনেক লেখক ছদ্মনাম ব্যবহার করতেন বা করেন এখনো। যখন নিজের নাম বহুল প্রচলিত হয় তখন ফ্রেশ করে কোনো কিছু শুরু করার জন্য পেন নেম বা ছদ্ম নাম ব্যবহার করতেন। যেমন উদাহরণ স্বরূপ বলতে পারি সিস্টার চারলোট, এমিলি, এ্যানি (বাংলা তে লেখা খুব শক্ত) প্রভৃতি লেখকরা ছদ্ম নাম ব্যবহার করতেন যেমন কিউবার, এলিস, অ্যাক্টন বেল এই নামে।ওঁরা ভেবেছিলেন মেয়ে বলে তাঁদের লেখা কে সিরিয়াসলি নেবেনা সমাজ তাই তাঁরা জেনারেল নাম ব্যবহার করতেন যা পুরুষের নামের মতো শোনায়। স্টিফেন কিং তাঁর পাঁচটি উপন্যাস রিচার্ড ব্যাচম্যান নামে প্রকাশিত হয়েছিল। চার্লস ডাগসুন তাঁর ছদ্মনাম Lewies carroll তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন তাঁর সাড়া জাগানো বাচ্চাদের বই অ্যালিস অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড । আবার আমাদের বাংলা তে রবীন্দ্রনাথ ভানুসিংসের পদাবলি লিখেছেন ব্রজবুলি ভাষায়। অসামান্য সব রচনা।
পরশুরাম ব্যবহার করতেন রাজশেখর বসু।
নীললোহিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। হুতোম পেঁচা কালিপ্রসন্ন সিংহ। অনিলাদেবী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বনফুল বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়।
এরকম বহু লেখক ছদ্ম নাম ব্যবহার করতেন।
অনেক সময় নামের বিড়ম্বনা মানুষকে সহ্য করতে হয়। খুব বিখ্যাত মানুষের ছেলেমেয়েরা যেমন নামের জন্য যেমন উতরে যায় তেমন নামের আড়ালে আসল প্রতিভা চাপা পড়ে যায়।বিখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী কিশোর কুমারের ছেলে অমিত কুমার তেমন নাম করতে পারেন নি কারণ সবাই অমিত কুমারের ভেতর কিশোর কুমারকে খুঁজে চলেছেন।
অমিত কুমারের প্রতিভা কিন্তু কম কিছু নয়।এরকম হাজারো উদাহরণ দেওয়া যায়।
একটা গল্প বলি আপনাদের আমি বোনের সঙ্গে একবার ঠাকুর দেখতে গেছিলাম। বোন বললো চল চোরের পুজোটা দেখে আসি খুব ভালো পুজো হয়। ওরা সবাই আমেরিকায় থাকে পুজোর সময় এখানে আসে। বল্লাম একি চোর কেন বলছিস? বললো "আরে শোন ও একবার সাইকেল চুরি করে খুব মার খেয়েছিল, সেই থেকে ওর নাম চোর হয়ে গেছে। তারপর কোনো একটা কাজ নিয়ে আমেরিকা চলেগেছিল ড্রাইভিং খুব ভালো জানে"। আমি অবাক হয়ে শুনলাম। এখন তো চুরি করেনা ভালো কাজই করে তবু বদনাম গেলনা হায় কপাল! একবার আমার বোন ফোন করছে ওর বান্ধবীকে বলছে "হ্যালো পলট্রি তুই বিকেলে থাকবি? তাহলে দিদিকে নিয়ে তোদের বাড়ি যাব" বুঝুন ঠ্যালা আমি বকলাম একথা কেউ বলে? বললো "আরে অভ্যাস হয়ে গেছে ওর নাম মিঠু কর্মকার"। ওদের পলট্রির ব্যবসা অনেক দিনের তাই সবাই ওদের ঐ নামে বলে।
"what's in a name" Shakespeare বলেছেন নামে কী আসে যায় ? নামে আসে যায় আবার কিছু আসে যায়ও না। আপনি গোলাপ রজনীগন্ধার নাম করলেই সুমিষ্ট গন্ধ অনুভব করবেন। সারা বিশ্বের মানুষ দিনে রাতে কতবার হ্যালো বলে বলেন বলুন তো? আলেকজান্ডার গ্রাহামবেলের প্রেমিকার এর নাম হ্যালো। এই নাম ছাড়া কোনো কথাই ফোনে শুরু করা যায়না। এমনকি সামনাসামনি আমরা অচেনা লোককে হ্যালো বলে সম্বোধন করি। হ্যালো হলো নামের জয় ধ্বজা। বৈদিক যুগের বিখ্যাত নারী মৈত্রেয়ী গার্গী লোপামুদ্রা বিদূষীদের নাম আমরা সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করি। তাঁরা ছিলেন মনে প্রাণে ভীষণ আধুনিক। "কালের কপোল তলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এ তাজমহল" মুমতাজের স্মৃতি সৌধ পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম। তাজ নামের উজ্জ্বল পতাকা আমাদের সম্পদ আমাদের গৌরব।
বেদ পুরাণ জাতক কথাসরিৎসাগরে পদবির উল্লেখ তেমন পাওয়া যায়না। জন্মসূত্রের পরিচায়ক হিসাবে নিজের নামের সঙ্গে পিতার নাম যোগ করার রেওয়াজ ছিল বৈদিক বা পৌরাণিক যুগে। অরুণের পুত্র উদ্দালক আরুণি,
বিবস্বানের পুত্র বৈবস্বাত মনু।
বিক্রমাদিত্যের সভায় নবরত্নরা কেবল নিজের নামেই উজ্জ্বল ছিলেন কালিদাস, বরাহমিহির, বররুচি, অমরসিংহ, ক্ষপণক,
ধন্বন্তরি, ঘটকর্পর, শঙ্কু এঁদের কোনো পদবি নেই।
নামের পেছনেই আমরা ছুটে মরি।
জন্মের তিথি নক্ষত্র দেখে নাম রাখার প্রচলন আছে। শুধু মানুষ নয় লোকজন আদরের পোষ্যর নাম করণ করে যথেষ্ট ধুমধাম করে। আমরা কথায় কথায় বলি তিনি নামকরা সঙ্গীত শিল্পী, নামযাদা ডাক্তার, নামীদামি লেখক ইত্যাদি ইত্যাদি।
উনি তোমার খুব নাম করছিলেন বললে বুঝতে হবে আমার প্রশংসা করছিলেন। ঐ ভদ্রলোকের পাড়ায় খুব দুর্নাম তাই ওঁর দোকানে তেমন বিক্রিবাটা হয়না। আবার আমরা বলি তিনি দেশের নাম উজ্জ্বল করেছেন।
যার প্রতি আমাদের হৃদয়ের আবেগ আছে সেই নাম শ্রবণেও আমরা চরম শান্তি পাই। সেই প্রবাদটার কথা মনে আছে? " কানা ছেলের নাম আবার পদ্মলোচন"... অনেকেই এরকম খোঁটা দেন। আমি রিক্সা চালক, ভ্যান চালকের নাম রাজা দেখেছি, প্রচলিত নাম অনেকেই রাখেন।
আমার বাবা একটা গল্প করেছিলেন এখনো মনে আছে বাবা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করতেন।
এক বৃদ্ধা তার নাতি কে নিয়ে এসেছেন বাবা যথারীতি নাতির নাম জানতে চেয়েছেন। বৃদ্ধা বলছিলেন "বাবা নাতির নাম এখেছি আম আজত্ব" ( রাম রাজত্ব) সেখানে উপস্থিত সবাই হেসে অস্থির। বাবা হাসতে হাসতে বলেছিলেন "মাসিমা আপনার অনেক ক্ষমতা পুরো রাজত্ব তুলে আনলেন?" যাইহোক নামের পেছনে ছুটতে গিয়ে
বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবেন না। আগে দেখুন শিশুটি কী চাইছে? খুব ভালোবেসে যা করবে
তাতেই নাম সম্মান বাড়বে। কোনো কোনো নামের প্রতি আমরা ভীষণ দুর্বল যেমন অমিতাভ বচ্চন বললে আমি প্রেমে পড়ি বারবার। নামের জন্য রিলেরেসের দরকার নেই । শ্রম ছাড়া কিছুই হয়না। নাম নয় মানুষ কাজ চায় আর সততা চায়। নামের ভারে আসল মানুষটা চাপা পড়ে যেন যান্ত্রিক না হয়ে যায়। কীর্তন গান গানের জগতে বিরাট জায়গা দখল করে আছে। ভগবানের নাম গুণের বর্ণনা করাই তো কীর্তন। আবার অনেক সময় দুটি ভিন্নধর্মী মানুষের মধ্যে বিবাহ হলে পরে আবার তাদের ধর্মমতে নতুন নামকরণ হয়।
মানুষের পেশা থেকে তাদের সারনেম হয়ে যায় যেমন গুড়িয়া, ময়রা, ঠাকুর,হালদার,জেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মজার কথা বলি আমি একবার আমার বান্ধবীকে কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম চিন দেশের লোকের ওরকম নাম কেন রে? ও মজা করে বলেছিল ওরা একটা কাঁসার বাটি একটু উচু থেকে ফেলে দেয় তখন যে শব্দ হয় ওটাই তার নাম করণ হয় শুনে খুব হেসেছিলাম।
নাম নিয়ে নামতা পড়ে লাভ নেই ভালো কাজ করব, সুন্দর হৃদয় নিয়ে চলব।সূর্যের তো একটাই নাম তেমনই থাক আমাদের নাম এবং ধাম। সবথেকে বড় নাম পৃথিবী । আরো একটি অন্তরের অন্ততরতম নাম ভারতবর্ষ যে মাটি আমাকে বুকে ধরে আগলে রাখে। প্রিয় শিল্পী মান্নাদের গানের কথায় বলি " হৃদয়ে লেখ নাম সে নাম রয়ে যাবে ".....।
0 Comments