জ্বলদর্চি

কবিতা অ্যাভিনিউ-২৩/ বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়

কবিতা অ্যাভিনিউ 
বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায় 

পর্ব ২৩ 

পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে যুগবোধ।তিনি যুগকে আত্মস্থ করেছেন গভীরভাবে।সমকালীনতার অন্তর্লোকে পৌঁছানোর জন্য তিনি জীবনব্যাপী অনুসন্ধান চালিয়েছেন।  নিরন্তর মানুষের ক্ষোভময় বেঁচে-থাকার মধ্যে বাঁচতে চেয়েছেন নিজস্ব আত্মগ্রন্থি মোচনের মধ্য দিয়ে- 
‘সুবাতাস ভারী করে কেউ কেউ দারুণ আহ্লাদে-
পৃথিবীর রাজপথ গলিপথ জুড়ে 
রাজকীয় আলোর প্লাবন
দেখে যায়, পায়
চরিতার্থ মানুষের সুখ।‘  
মানুষের জন্য তিনি যথার্থ বেদনা অনুভব করেছেন। রাজকীয় আলোর প্লাবন দেখে সুখী হওয়ার মানুষ তিনি নন। তাই সময়ের মানচিত্রে মানুষের অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের কথা তুলে ধরেছেন কবিতায়, তারই তত্ত্বায়ন ঘটেছে কবিতা বিষয়ক তাঁর অজস্র প্রবন্ধে। শুধু কবিতা নয় মহাকবিতার রচয়িতা তিনি। । পরিব্যাপ্ত মানব-সংস্কৃতিকে ধরতে চেয়েছেন বলেই বারবার তাঁর কাব্যে এসেছে পর্বান্তর।অখণ্ড জীবনের কথা তিনি তুলে এনেছেন নিভৃত উচ্চারণে-
‘যতই বয়স বাড়ে  আসক্তি জীবন ঘিরে 
বেড়ে যায় তত।
অথচ সন্তের বাণী, নিরাসক্ত হও, এই 
জীবন তো ক্ষণিকের। বয়সের কথা শুধু ভাবো।
দেরি নেই জীবনের শেষের সে দিন।’ 
এই কবিতা কি বয়সকে মনে করিয়ে দেয়? না কি জীবনের চরম সত্য তুলে আনে?  খণ্ড কবিতার পাশাপাশি জীবনের অখণ্ড আশ্রয় তিনি নির্মাণ করেছেন  মহাকবিতার বেদিমূলে। এখানেই তাঁর নিজস্ব ভূমি খুঁজে পেয়েছেন তিনি। সেই মহাকবিতায় পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে মানুষের সত্তা ও শূন্যতা ধরা পড়েছে। সেখানে তিনি তাঁর নিজের প্রতীতিতে স্থির থেকেছেন এবং নির্মাণ করেছেন যন্ত্রণার শিল্পগত উন্মোচন।কবিতাকে তিনি পৌঁছে দিতে চেয়েছেন সেখানে যেখানে কবিতা ‘‘আত্মদর্শন হয়েও বিশ্বের সমগ্র বেদনাকে ধারণ করে থাকবে, যা নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের মতন সহজ অথচ জরুরি হয়ে উঠবে। ইতিহাসে দর্শনে বিচিত্র-অনুভূতির সংক্রমণে কবিতা হবে নিষ্ঠুর অথচ করুণাময় এক যথার্থ আত্মঅভিজ্ঞান যা স্বকালের হয়েও অনাগত কালের প্রবীণ ন্যুব্জদেহী মানুষের যথার্থ শব্দযান; বামন অবতারের মতো ত্রিপদে ত্রিকাল ও ত্রিজগৎ ধারণ করে আছে’’ (‘কবিতাভাবনা’, বিচ্ছিন্ন অবিচ্ছিন্ন)।
কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের কবিতায় নিপীড়নের প্রদাহ কখনও উচ্চারিত হয়েছে ঘৃণার ভাষায় আবার কখনও তা বক্রোক্তির মধ্য দিয়ে। আবার তাঁর উচ্চারণের গায়ে এসে লেগেছে প্রতিবেশের শৃঙ্খলাবিহীন উন্মার্গগামীতা। আবার কখনও তিনি সরাসরি উচ্চারণ করেন কোন রকম আড়াল ছাড়াই।

রাজতন্ত্র গণতন্ত্র সাম্যবাদ বাত্‌লে দিতে পেরেছে কখনো
কোন্‌ পথে মানুষের চিরন্তন সূর্যোদয় হবে?
কোন্‌ পথ চলে গেছে লোভ ঈর্ষা অক্ষমতা রক্তপাত ঠেলে
প্রেমের বা করুণার বিকাশের প্রতিশ্রুত সাম্রাজ্যের দিকে। (ইবলিসের আত্মদর্শন)

একা থাকতে পারছি না
একা হলেই রক্তমাখা নিহত ফুলগুলো দুলে ওঠে
অন্ধকার ছিঁড়ে দুলছে ওই আহত নিহত ফুলগুলি
মাটি ঢেকে যাচ্ছে শুকনো ফুলে বীজে
আর দ্যাখো : মুহূর্তেই জ্বলে উঠছে রক্তচাপা শ্মশানচাপা ( আমি ওই ফুলগুলির কাছে যাব) 
ছেলেবেলাকার সেই চোখ-নাক-মসৃণ চিবুক
কিশোর, যুবক আজ নেই,
পণ্যভার বহনের ভারে ক্লিষ্ট প্রাণ
মানুষ হয়ে ছদ্মবেশী
যুগের অস্থির অভিনেতা
আজ সকলেই।
মুখ ও মুখোশে আজ ভেদ নেই, কোন ভেদ নেই।( মুখোশ, মুখোশ শুধু)

অনুভূতির ভেতর দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে নিষ্ঠুর সংদাহ।প্রতিটি রক্তক্ষরণ কবিতার নির্যাস হয়ে ধরা দেয় তাঁর কলমে এবং তিনি অকপটে তা লিপিবদ্ধ করেন।চারপাশে বিষাক্ত পরিবেশ, ধুলি ধূসরিত জীবনের ক্লেদ, নিজস্ব যন্ত্রণার প্রদাহ শোণিতাক্ত আভা মুখোশহীন অবয়বে প্রস্ফুটিত হয়েছে। দায়বদ্ধ কবির সন্ধিৎসা স্বচ্ছতা এবং সততা নিয়ে তিনি চারপাশের রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত এবং আহত মানুষের অরুন্তুদ যন্ত্রণা তিনি নিজের মধ্যে উপলব্ধি করেছেন। আবার কখনও কখনও স্থূল, চতুর মানুষের সুবিধাবাদী দিকটিকেও তুলে এনেছেন। আবার শিল্পের রূপ কেমন হবে, কোন শিল্পকে আমরা বলব প্রকৃত শিল্প, তার দিকনির্দেশও তিনি করেছেন।   
১ 
‘প্রকৃত কবিতা কিছু সুবাতাস এনে দেয় শস্যের উপরে’ 
‘প্রকৃত কবিতা থাকে শুভ কামনার মতো জন্মে ও বিদায়ে।’

২ 
যে যাবে অনেকদূর 
তাকে বলি – ধীর পায়ে হাঁটো
৩ 
আমি আজকাল অবলীলায় শুনতে পাই
শূন্যে ঝুলন্ত ঘণ্টার ধ্বনি;
দেখতে পাই সেই 
অদৃশ্য ঘড়ির কাঁটার অবিরাম সঞ্চরণ,
শুনতে পাই
নৈঃশব্দ্য মথিত কান্নার শব্দ,
আর আমার প্রিয়তম ইন্দ্রিয়গুলি
ওরা ক্রমশই হয়ে উঠছে প্রখর  আর অনুভূতিময়।( অনবসানের গান)
৪ 
আজও আমি মাঝে মাঝে সরিয়ে ফেলি চাদর আর দেখি
আমার মৃত স্বপ্নগুলির শরীর হয়েছে কিনা বিকৃত।
দেখি, ওরা যেমন ছিল তেমনি আছে
আমার স্পর্শের প্রতীক্ষায় ঘুমিয়ে আছে যেন;
স্পর্শ পেলেই চোখ মেলবে, আবার উঠবে জেগে।  ( অনবসানের গান) 
৫ 
সুবাতাস ভারী করে কেউ কেউ দারুণ আহ্লাদে-
পৃথিবীর রাজপথ গলিপথ জুড়ে 
রাজকীয় আলোর প্লাবন
দেখে যায়, পায়
চরিতার্থ মানুষের সুখ। ( কিছু পড়ে থাকে) 

পৃথিবীর ধ্বংসমত্ত জীবনের ভেতর প্রাণপ্রবাহের আলো জ্বেলে দেওয়ার দায়িত্ব কি একজন শিল্পীর নয়? মালিন্য এবং মিথ্যাশ্রয়ী ছায়ার ভেতর কোন বিদ্রোহ  বেঁচে থাকতে পারে না, একক মানুষের ক্ষমতা নেই নিজস্ব দ্রোহকে অগ্নিরূপ দেওয়ার। একক ক্রোধকে  সার্বজনীন রূপ না দিলে তার ভেতর স্থায়িত্বের কোন চিহ্ন আঁকা যায় না। 
১ 
নিত্য উচ্ছল জীবনে ভেসে থাকি,
ভাবছি সারাদেশে  কার্নিভাল
আমার স্থুলদেহ আরামে ঢেকে রাখি
অদূরে দেখি হাসে ক্রান্তিকাল। ( মধ্যবিত্ত) 
২  
দীর্ঘদিন থাকে না বেঁচে একার বিদ্রোহ।
কাণ্ড যত কঠিন হোক, শিকড়ে সংহতি
ডালপালায় আছড়ে পড়ে যখন দুর্গ্রহ 
পাতাও রোখে গতি।
ব্যক্তিগত দ্রোহের শেষে শূন্যে মেঘ জমে।
অসঙ্কোচে মেলেছি তাই আমার ডালপালা।
অস্মিতার আড়ালে থেকে নানান বিভ্রমে
বেড়েছে যতো জ্বালা ( অসঙ্কোচে দিয়েছি মেলে) 
৩ 
কেই বা ধরে রাখতে পারে মণির উজ্জ্বলতা, স্বপ্নের দ্যুতিময় আলিঙ্গন
দুঃখের হন্তারক যে বিস্ময় তার ভ্রূণকে ? (আমার দিনগুলো)
এই জিজ্ঞাসা কি প্রত্যেকের মানুষের নয়? আমাদের অন্তর্গত প্রশ্নের সমুদ্রে তোলপাড় ঢেউ ওঠে। আমরা নিজের ভেতরে কথা বলি ঠিক এই ভঙ্গিতেই-“ কেই বা ধরে রাখতে সমর্থ অন্তর্গত শুভ্রতা তরঙ্গ সঙ্কুল জাগরণ?/কোন সমুত্থিত কৃষ্ণ হাত মুহূর্তের স্তব্ধ করে দেয়/ নিরন্তর উত্তোলিত আনন্দ  ওই অস্থির সমুদ্রের উষ্ণতা?’ 
পড়া যাক তাঁর কবিতার আরও কিছু উজ্জ্বল চিহ্ন- 

১ 
হারিয়ে যাবার জন্য আসিনি, এসেছি তোমাদের 
পরিশ্রান্ত শরীরের উপরে ছড়িয়ে ডালপালা 
ছায়া দেব বলে।  
২ 
অন্ধকার থেকে আসে, অন্ধকার ফিরে চলে যায়
তোমার আমার এই অবিচ্ছিন্ন আত্মার প্রবাহ।
৩ 
তবুও আমরা শিল্পে বসিয়েছি আনন্দের হাট…
কিনে নাও সহজের একটুকরো জমি
৪ 
কিছু শোধ না করেই চলে যাবো
বলে তো আসিনি।
৫  
আমি পাহাড়ে আঘাত করে  খুলে দেব প্রস্রবণ
নীলিমার দিকে হাত তুলে স্পর্শ করব মাটিকে
চোখের মণিতে সূর্য জ্বেলে 
জ্বালিয়ে দেব ঘরের প্রদীপ ( সময়কে বলি) 

৬  

আমি চাই অনুপূর্ব জীবনের স্বাদ।
পাওয়া না পাওয়ার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে রয়েছি
একটি মানুষ নিখাদ। 

যদি সে আমাকে পোড়ায়, আমি পায়ে নত হই তারই
যদি সে পোড়ায়, আমি পুড়ে পুড়ে হয়ে যাই খাক
এবং অদ্ভুত ছাই ভরে রাখি শব্দের কলসে।
স্রোতে ভেসে যেতে যেতে সে খুঁজে ফিরছে খড়কুটো,
ভাঙন ভঙ্গুর পাড়ে দাঁড়িয়ে , নিজেরই মুদ্রাদোষে
টেনে তুলি তাকে,… নেই আমারই আশ্রয়, চাল ফুটো 
আমার পায়ের নিচে অনন্ত গহ্বর  মুখ মেলে
প্রতীক্ষায়, তার চাওয়া সামান্যই, খেতে চায় দেহ,
কখনও দিগন্ত জুড়ে হাত পাতি বিশাল সস্নেহ,
সেই হাতে ভিক্ষাপাত্র, প্রেম আর মৃত্যুর ভিখারি ।
আমি ভূতগ্রস্ত কবি, সারা বিশ্ব গিলে খেতে পারি।
 কবি তো ভূতগ্রস্তই সারা পৃথিবীকে গিলে খাওয়ার স্পর্ধা বা হিম্মত আর কেই বা দেখাতে পারে। তাই কবির মৃত্যু নেই বাঁচার প্রবল আসক্তি তাঁর নাভিমূলে 
 নাভিমূল থেকে উঠে আসছে বাঁচার সুতীব্র ইচ্ছে,
স্বপ্ন অন্তহীন
শেকড় চারিয়ে গাছ, পাতায় সবুজ প্রাণ 
মেলে ধরে বাতাসে দোলায়
মাথা, ফুল ফোটে নিত্য, নিরন্তর ঝরে,
রোজ ফোটে। 
                                                                                        ( চলবে)

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments