জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৪২ /প্রীতম সেনগুপ্ত



শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা -৪২

প্রীতম সেনগুপ্ত


 রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ষষ্ঠ সঙ্ঘাধ্যক্ষ পরম পূজ্যপাদ শ্রীমৎ স্বামী বিরজানন্দ মহারাজের বর্ণনা থেকে শশী মহারাজের বিষয়ে একটি চমৎকার ধারণা পাওয়া যায়। বর্ণনাটি এইরকম --“...ছুটি পেলেই আমরা মাঝে মাঝে বরাহনগর যেতে লাগলুম। শশী মহারাজকে দেখলেই ভয় হতো। সর্বদা যেন ভাবে গরগর থাকতেন। খুব কড়া লোক ছিলেন। আমাদের পাঠ্যবিষয়েও নানা জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। পড়াশুনা এড়াতে আমরা মঠে আসছি কিনা দেখতেন। আমরা যদি ঠিকমতো তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না, তিনি আমাদের বকতেন। বলতেন পড়াশুনায় অবহেলা করা উচিত নয়। আমি গোড়া থেকেই তাঁকে বলে রাখলুম, অন্য সব বিষয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করুন, কেবল অঙ্কের প্রশ্ন করবেন না, ওতে আমি বড় কাঁচা। শশী মহারাজ বললেন, তুমি গ্রীষ্মের বন্ধে এখানে এসে থাক। আমি এমন অঙ্ক শিখিয়ে দেব যে ফেল করার ভয় থাকবে না। আমি বললুম -- বাবাকে জিজ্ঞেস করে দেখি। বাবাকে সব বলতে তিনি রাজি হলেন। বললেন, বেশ তো যাও না। গ্রীষ্মের ছুটি হলে বইটই দপ্তরে বেঁধে মঠে হাজির হলুম। সকলে ভারী খুশি। মঠে গিয়ে বইটই পড়াশুনা সব কিন্তু ভুল হয়ে গেল। ঠাকুরের কাজ এবং ওঁদের সেবা করতেই ভরপুর হয়ে গেলুম। তখন তো চাকর-বাকর ছিল না। আমি ওঁদের সব কাজেই সাহায্য করতুম। পুকুর থেকে জল আনা, ফুল তোলা, বাসন মাজা ইত্যাদি নানা কাজে ভোর থেকে রাত দশটা পর্যন্ত তন্ময়ভাবে কোথা দিয়ে কেটে যেত। কেমন যেন একটা নেশার ঘোরে দেড়মাস চলে গেল। শশী মহারাজ একবারও জিজ্ঞাসা করলেন না, কই দেখি কি বই তোমার। আমারও কোনও হুঁশ ছিল না।” বস্তুতপক্ষে বরাহনগর মঠে জীবনযাত্রার যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা বিরজানন্দজী দিয়েছেন, যা রীতিমতো আকর্ষণীয়। বর্ণনায় আরও পাওয়া যাচ্ছে -- “মঠ, বরাহনগরে পরামাণিক ঘাট রোডে টাকীর মুন্সীদের ঠাকুরবাড়ির পশ্চাৎ ( পশ্চিম ) ভাগের ভগ্ন জীর্ণ বাড়ির উপর তলায় ভিতরের অংশে ছিল। রাস্তার উপর একটা দরজা দিয়ে ঢুকে একটু খোলা জমি পার হলে সিঁড়ি দিয়ে উঠে কাঠের রেলিং ও থামওয়ালা বারান্দার দক্ষিণদিকের সামনের বড় ঘরটায় আমি যাবার আগে ভাড়া ছিল; পরে এমনি খোলা পড়ে থাকতো। ভিতরের মঠের অংশ বাহির রাস্তা থেকে দেখা যেত না, খুব নির্জন ছিল। এখন সমস্ত বাড়ি ভূমিসাৎ হয়েছে -- বাইরের অংশ ছাড়া। ভিতরের মঠের অংশের কোন ফটো পাওয়া যায় না। পেছনের দিকে শাক-সবজির বাগান, সজনে গাছ, একটি বেলগাছ ও কয়েকটি নারিকেল ও আমের গাছ ছিল। একটি পুষ্করিণীও ছিল। বাগানে শাক-সবজি বড় বিশেষ কিছু হতো না -- ডেঙ্গো ডাঁটা, ২/৪টি কুমড়ো, শশা, কলা ইত্যাদি। এক উড়ে মালি ছিল, তাকে কেলো বলে ডাকতো। তরকারি কিছু না থাকলে শশী মহারাজ মাঝে মাঝে বাগানে ঢুকে ডেঙ্গো, কুমড়ো শাক, সজনে ডাঁটা বা পাতা ফুল যা পেতেন নিমেষের মধ্যে ছিঁড়ে বঁটি দিয়ে কেটে নিয়ে আসতেন। আর কেলো মালি উড়ে ভাষায়, ‘আরে আরে কি কর, কি কর, ঔসব খা দিল, নিও না, নিও না’ বলে পিছু পিছু তাড়া করতো, কখনো গালি পাড়তো, চেঁচাতো। কিন্তু শশী মহারাজ কিছুই ভ্রূক্ষেপ করতেন না। উপরে গোঁভরে আপনার মনে চলে আসতেন। এই নিয়ে সকলে মিলে খুব হাসিফূর্তি হতো। যা হোক মঠের সকলের সঙ্গে কেলো মালির বেশ প্রীতির ভাব ছিল। যখন সুবিধা হতো তাকে প্রসাদ মিষ্টান্নাদি দেওয়া হতো।” ( স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের স্মৃতিমালা ও রচনাসংগ্রহ, স্বামী চেতনানন্দ ও স্বামী বিমলাত্মানন্দ সম্পাদিত, উদ্বোধন কার্যালয়, পৃ: ৭৬-৭৭ )


 বরাহনগর মঠে সন্ধেবেলায় ঠাকুরঘরে শশী মহারাজের আরতি করা একটি অপূর্ব ব্যাপার ছিল। দেখবার মতো! এই বিষয়ে লাটু মহারাজ ( স্বামী অদ্ভুতানন্দ ) বলছেন -- “বরানগর মঠে শশীভাই এমন আরতি করতো, কি বলবো? ঠাকুর ঘরটা তখন গম্ গম্ করতো। শশীভাই মুখে ‘জয় গুরুদেব’! জয় গুরুদেব!’ বলতো। ...হরবখৎ শশীভায়ের চিন্তা ছিলো ঠাকুরের সেবা কেমনভাবে চলবে, কি কি দেওয়া হবে, আর কখন কোনটা দেওয়া হবে। তাঁর পূজার কাজ সে নিজে হাতে করতো! ...হামাদের বলতো -- তোদের কোন ভাবনা নেই, তোরা সাধন ভজন নিয়ে পড়ে থাক। এঁর ( অর্থাৎ ঠাকুরের ) দৌলতে সব জুটে যাবে।” শশী মহারাজ আরতির শেষভাগে ধূপধুনা খোলকরতাল বাদ্যের মধ্যে ভাবোন্মত্ত অবস্থায় ‘জয় গুরুদেব শ্রীগুরুদেব’ বলে রীতিমতো হুঙ্কার দিয়ে তালে তালে উদ্দাম নৃত্য করতেন। ঘরের একদিক থেকে অন্যদিকে নৃত্যরত হতেন, তাঁর এই উদ্দীপিত আরতি সকলের মধ্যে এক ভাবের আবেশ সৃষ্টি করত। সমস্ত বাড়িটায় আধ্যাত্মিক কম্পন অনুভূত হত। তাঁর মুখমণ্ডল, সমগ্র চেহারা যেন অগ্নিস্বরূপ হয়ে উঠত। হুঙ্কার ও নৃত্য থামতে  চাইত না। খোলবাদকের হস্তদ্বয় চলনশক্তিরহিত হত। আরতির অন্তে সকলে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করতেন। পরে গুরুগীতা থেকে ‘অজ্ঞানতিমিরান্ধস্য জ্ঞানাঞ্জন শলাকয়া। চক্ষুরুন্মীলিতং যেন তস্মৈ শ্রীগুরবে নমঃ।।’ ইত্যাদি শ্লোক ও পূজ্যপাদ স্বামী অভেদানন্দজী বিরচিত স্তবের শেষাংশ --‘নিরঞ্জনং নিত্যমনন্তরূপং ভক্তানুকম্পাধৃতবিগ্রহং বৈ। ঈশাবতারং পরমেশমীড্যং তং রামকৃষ্ণং শিরসা নমামঃ’ আবৃত্তি করা হত।

 বাবুরাম মহারাজ বা স্বামী প্রেমানন্দজী মনে করতেন মঠ, ঠাকুরবাড়ি এসবের মূল হচ্ছেন শশী মহারাজ। রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ), শরৎ মহারাজ (স্বামী সারদানন্দ) এমনকী স্বামীজীও নন। এটা মনে করার পিছনে রয়েছে একটি ঘটনা। আলমবাজার মঠে (বরানগর মঠের পরবর্তী শ্রীরামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দ্বিতীয় মঠ) স্বামীজী প্রভৃতি একবার ঠাকুর পূজায় আপত্তি করলেন। একমাত্র শশী মহারাজই এর প্রতিবাদ করেন। তিনি ছেঁড়া মাদুরের উপর ঠাকুরের ছবি রেখে পূজা করতেন। একদিন স্বামীজী ও আরও অনেকে ঠাকুর পূজা তুলে দেওয়ার জন্য রাগ করে বলরাম বসুর গৃহে চলে যান। একমাত্র শশী মহারাজই ছিলেন পূজার পক্ষপাতী; তাই তিনিই আলমবাজারে রইলেন। পরদিন বলরামবাবু স্বামীজী প্রভৃতিদের আবার বুঝিয়ে সুঝিয়ে আলমবাজার মঠে পাঠিয়ে দেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পূজা ছিল শশী মহারাজের জীবনের প্রধান অবলম্বন। ঠাকুর বলতেন খুঁটি ধরে থাকা। শ্রীরামকৃষ্ণপূজারূপ খুঁটিটি তিনি আজীবন আঁকড়ে ধরে থেকেছিলেন। ভক্তজনেদের কাছে যা চির অনুপ্রেরণাময়।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments