জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৪৪/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৪৪

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 ১৮৯৭ সালে মার্চ মাসের শেষ দিকে স্বামী সদানন্দের সঙ্গে মাদ্রাজে পৌঁছলেন রামকৃষ্ণানন্দজী। প্রথমদিকে আইস হাউস রোডের একটি ভাড়া বাড়িতে উঠলেন। পরবর্তী সময়ে স্বামীজীর একান্ত অনুগত ভক্ত এস বিলগিরি আয়েঙ্গারের আইস হাউস নামের তিনতলা বাড়ির একতলার ঘরগুলি বিনা ভাড়ায় পেয়ে সেখানেই স্থানান্তরিত হলেন। স্বামীজীর পাদস্পর্শপূত এই বাড়িটি। ‘ক্যাসল কার্নন’ ছিল বাড়িটির প্রকৃত নাম। মাদ্রাজে আসার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীশ্রীঠাকুরের পট স্থাপনপূর্বক পূজাকার্য আরম্ভ করে দিলেন শশী মহারাজ। ১৮৯৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন স্থানে রামকৃষ্ণ মিশন দুর্ভিক্ষে সেবাকাজ আরম্ভ করলে ওই কাজে সাহায্যের জন্য পত্রিকায় আবেদন প্রকাশ করলেন এবং অন্যান্যভাবে অর্থসংগ্রহের কাজে মন দিলেন। এইভাবে তাঁর কর্মক্ষেত্রের প্রসার হতে থাকল। আবার বিদ্বৎসমাজেও পরিচিত হতে থাকলেন। কারণ, মাদ্রাজের ইয়ং মেনস অ্যাসোসিয়েশনে ধারাবাহিক যে সব বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেগুলি ‘ব্রহ্মবাদিন’ ও ‘প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা দুটিতে প্রকাশিত হয়। এছাড়া মাদ্রাজের বিভিন্ন স্থানে শাস্ত্রালোচনাও করতেন নিয়মিতভাবে। ত্রিপ্লিকেন ও মায়লাপুর অঞ্চলে গীতা ও উপনিষদ ব্যাখ্যা, পুরাসোয়াকাম ও চিন্তাদ্রিপেটে গীতাব্যাখ্যা এবং ওয়াই এম এইচ অ্যাসোসিয়েশনে ‘যোগসূত্র’ ব্যাখ্যা করতেন। প্রতি একাদশীতে মঠে ভজন হত। এই বছর বেশিরভাগ সময়ই তিনি রামকৃষ্ণ ভাবধারা প্রচারে ব্যস্ত ছিলেন, শুধুমাত্র একবার ৺রামেশ্বর দর্শন যাওয়া ছাড়া। ১৮৯৯ সালের ১৯ মার্চ রবিবার মাদ্রাজ শহরে শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মতিথি উৎসবে বিপুল উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। এই উৎসবের আয়োজন তিনিই করেন। সর্বশ্রেণির হিন্দু তো বটেই, এমনকী মুসলমানরাও এতে যোগদান করেছিলেন! ১৯০২ সালে স্বামী বিবেকানন্দের মহাপ্রয়াণের পর তাঁর উদ্যোগে পাচাইয়াপ্পা কলেজে বিবেকানন্দ স্মৃতিসভার অধিবেশন হয়। এই অনুষ্ঠানে পৌরহিত্য করেন মাননীয় আনন্দ চার্লু মহাশয়। পরের বছর থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ জন্মতিথি উৎসবের মতো বিবেকানন্দোৎসবও নিয়মিতভাবে উদযাপিত হতে থাকে। স্বামীজী জন্মতিথি উৎসব বিষয়ে স্বামী শঙ্করানন্দজী ( রামকৃষ্ণ সঙ্ঘর সপ্তম সঙ্ঘ্যাধ্যক্ষ ) জানাচ্ছেন -- “১৯০৩ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে ক্যাসল কারনানে অবস্থিত মঠে প্রথমবার স্বামীজীর জন্মতিথি উৎসব পালিত হলো। উৎসবের অন্যান্য অঙ্গের সাথে নারিকেল বাগানে বহু গরিব মানুষকে পেট ভরে খাওয়ানো হয়েছিল। এই সময় আমেরিকার ওহিও থেকে আগত মিঃ ও হায়াত নামে এক আমেরিকাবাসী মঠের সংলগ্ন বহির্বাটিতে একটি ঘরে ছিলেন। সেই লোকটিকে তার মানসিক ভারসাম্যহীনতার জন্য থিওসফিক্যাল সোসাইটি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মহারাজ তাকে মঠে স্থান দিয়েছিলেন ও তার আমেরিকা ফিরে যাবার ব্যাপারে কলম্বোতে চিঠি লিখেছিলেন। লোকটি প্রায় কথা বলতেন না বা খাবার খেতেন না। তিনি গোড়ালির উপর ভর দিয়ে সুতো কাটা অভ্যাস করতেন। আর তিনি বলতেন যে এভাবে মনঃসংযোগ করা যায়। দেখা যেত, তিনি দুধ পছন্দ করতেন। সেই কারণে হাফ ডজন দুধের টিন তাকে দেওয়া হয়েছিল। পরদিন সকালে ব্রহ্মচারীটি দেখেন যে, সব টিন উধাও হয়ে গেছে। জিজ্ঞাসা করলে মিঃ হায়াত কোন উত্তর দেননি। খালি টিনগুলি জানালা দিয়ে নারিকেল বাগানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সকলে ভয় পেলেন যে, লোকটি অসুস্থ হয়ে পড়বেন। কিন্তু তার কিছুই হলো না। কারণ তিনি পরদিন অন্য কোন খাবার খাননি। 
 এরপর উৎসবের দিন দুপুরে সে সমুদ্রের ধার থেকে ছুটে এসে খবর দিল যে, একটি লোক জলের স্রোতে ভেসে যাচ্ছে ও সে বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। মহারাজ ব্রহ্মচারীকে ব্যাপারটা দেখার জন্য পাঠালেন। প্রচণ্ড গরমে বালিতে ব্রহ্মচারী খালি পায়ে অতি কষ্টে সমুদ্রের ধারে গিয়ে দেখল যে, কেবল একজন কুষ্ঠ রোগী সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে তার গা ধুচ্ছে। মিঃ হায়াতকে অতি কষ্টে বাধা দেওয়া হচ্ছিল যাতে উনি কুষ্ঠ রোগীকে টেনে না তোলেন। রোগীটির স্নান হয়ে যাবার পর তাকে মঠে খাবার জন্য নিমন্ত্রণ করা হলো। ঠিক সময়ে সে উপস্থিত হলো ও মিঃ হায়াত তা দেখে খুব খুশি হলেন। পরে মিঃ হায়াতকে কলম্বো পাঠিয়ে দেওয়া হল যখন জানা গেল আমেরিকা ফিরে যাবার জন্য টাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে।” ( স্বামী রামকৃষ্ণানন্দের স্মৃতিমালা ও রচনাসমগ্র, স্বামী চেতনানন্দ ও স্বামী বিমলাত্মানন্দ সম্পাদিত ) এখানে উল্লিখিত ব্রহ্মচারীটি স্বামী শঙ্করানন্দজী স্বয়ং।
 শশী মহারাজকে মাদ্রাজে প্রেরণ করবার পিছনে স্বামীজীর একটি উদ্দেশ্য ছিল। দাক্ষিণাত্যের মানুষ স্বভাবত গোঁড়া প্রকৃতির। ধর্মজীবনে যতই উচ্চে আরোহণ করুন না কেন, আচার নিষ্ঠার ঘাটতি তারা বিন্দুমাত্র সহ্য করতে পারেন না। স্বামীজী মাদ্রাজ থেকে ফিরে আসবার সময় জনৈক ভক্তকে বলেছিলেন -- “I shall send you one who is more orthodox than your most orthodox men of the South and who is at the same time unique and unsurpassed in his worship and medidation of God.” দাক্ষিণাত্যে শ্রীরামকৃষ্ণের সর্বধর্মসমন্বয়ের ভাব এবং স্বামী বিবেকানন্দের অস্পৃশ্যতা বর্জিত উদার মতবাদ প্রচার করা শশী মহারাজের কাছে খুবই কঠিন কাজ ছিল। এর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছিল তাঁকে। এই সময় জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী মাদ্রাজের অধিবাসী এই প্রসঙ্গে লিখছেন --“His classes were scattered in the different parts of the city and to many of these he used to go on foot for a long time. On certain days of the week he had to lecture more than twice or thrice and would return to Math quite tired, unfit to cook his food even. I have known days when a loaf of bread purchased from bakeries was his simple meal for the night, that was because there was little energy left in him for cooking or there were no food-stuffs in Math.”
 এক গ্রীষ্মের সকালে মহারাজ ক্লাস সমাপন করে ঘোড়ার গাড়িতে মঠে ফিরলেন। ঘরে ঢুকে তিনি কাপড় ছেড়ে এক কোণায় বসে পাখা দিয়ে নিজেকে হাওয়া করতে থাকলেন। গ্রীষ্মকালের প্রবল গরমে এই অবস্থা! তাঁর এমন অবস্থা দেখে পিছন থেকে এক ব্রহ্মচারী তাঁকে হাওয়া করতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর মহারাজ হাত থেকে পাখাটি ছুড়ে ফেলে দুটি হাত মুষ্টিবদ্ধ করে কারোর সঙ্গে যেন যুদ্ধে রত হতে উদ্যত হলেন। বলতে লাগলেন --‘তোমার জন্যই আমাকে এত কষ্ট পেতে হয়। দেখ, আমার কী কষ্ট।’ পর মুহূর্তে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত হয়ে মাটিতে মুখ ঘষতে-ঘষতে বলতে থাকলেন --‘না ভাই, না ভাই, আমায় ক্ষমা কর, আমায় ক্ষমা কর। তুমি যা করেছ তাই যথার্থ। সব ঠিক আছে, সব ঠিক আছে।’ দুই চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় বইছে জল, মুখমণ্ডল আনন্দে উদ্ভাসিত। এই সব কিছুরই উদ্দিষ্ট ব্যক্তিটি ছিলেন তাঁর গুরুভ্রাতা যুগাচার্য স্বামী বিবেকানন্দ। যিনি তাঁকে মাদ্রাজে প্রেরণ করেন।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments