জ্বলদর্চি

বাংলা প্রবাদ : নারী প্রসঙ্গ /সুশান্তকুমার দোলই


বাংলা প্রবাদ : নারী প্রসঙ্গ

সুশান্তকুমার দোলই


মানুষের বহুদর্শিতা বা দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল হলো প্রবাদ । প্রবাদ সংক্ষিপ্ত বাক্যবিন্যাসে ও মানবজাতির অভিজ্ঞতার মাধুর্যে সমৃদ্ধ। গ্রামীন জীবনের গভীর ভাব-অনুভূতি যেমন ব্যক্ত হয় তেমনি মানুষের দীর্ঘদিনের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রার মর্মবাণীও পুঞ্জীভূত হয় প্রবাদে। স্পেনীয় ভাষায় প্রবাদ সম্পর্কে একটি কথা প্রচলিত আছে – যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় –“Proverb is a short sentence based on long experience.”

প্রতিটি প্রবাদ সৃষ্টির মূলে রয়েছে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং কোনো না কোনো ঘটনা। গ্রামীন মানুষ বিজ্ঞানকে যতটা না জানে, তার চেয়ে বেশি জানে প্রকৃতির মেজাজ-মর্জি, ঝড়-বৃষ্টি, জোয়ার-ভাটা, গাছ-গাছালি, নদ-নদী-পাহাড়, পশু-পাখি এবং তার পারিপার্শ্বকে। মানুষের স্বভাবধর্ম, জীবনের বিভিন্ন পর্বের পরিবর্তন, সামাজিক রীতি-নীতি, মানুষের দৈনন্দিন নানা সমস্যা, স্বার্থপরতা – তারা লক্ষ্য করে মোহমুক্ত দৃষ্টিতে। গভীর পর্যবেক্ষণের ফলে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পথ বেয়ে যা কিছু সঞ্চিত হয় তা সত্য বলেই পরিগণিত হয়। এ সত্য নীতিবাক্যের সত্য নয়, এ সত্য উপলব্ধিজাত। অধিকাংশ প্রবাদই কিন্তু নিরক্ষর মানুষের সৃষ্টি।

    ক্ষুদ্রতর পারিবারিক জীবন-গণ্ডীতে প্রবাদের স্থান সুগভীর। পরিবারের তথা গার্হস্থ্য জীবনের নানা পারস্পরিক সম্পর্কের নিরিখে সৃষ্টি হয়েছে প্রচুর প্রবাদ। সেখানে নারী-বিষয়ক প্রবাদগুলির ভূমিকা অপরিসীম। লোকমুখে প্রচারিত ও প্রবাহিত এইসব নারীকেন্দ্রিক প্রবাদগুলি প্রাচীন হলেও লৌকিকতায় এবং সামাজিকতায় সেগুলি আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। এমনকি সমাজ-সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন ঘটলেও সেইসব প্রবাদের তাৎপর্যের এতটুকু খর্বতা ঘটেনি। 

এমন একটা সময় ছিল যখন মেয়েরা কথায় কথায় ছড়া কাটতো বিভিন্ন প্রসঙ্গে। সেইসব ছড়ায় থাকতো তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা। বাস্তব পরিস্থিতিকে তারা অনুভব করতো জীবন দিয়ে। তাই সাংসারিক ঘটনা এবং প্রত্যক্ষ অনুভূতির অকৃত্রিম প্রকাশ ঘটতো এইসব প্রবাদে। তাতে ভাবের কথা নয়, আদর্শের কথা নয় – থাকতো একান্ত ঘরের কথা। সেইসব প্রবাদে জীবন্তরূপে স্থান পেয়েছে প্রাত্যহিক গৃহস্থালির দ্বন্দ্ব-কলহ, দ্বেষ-হিংসা, উত্তেজনা-অবসাদ, দৈন্য, সংকীর্ণতা, অক্ষমতা, অসহিষ্ণুতা।



পরিবারে নারীর অবস্থান বিবিধ। নারী কখনো মা, কখনো শাশুড়ি, কখনো-বা স্ত্রী, সতীন, কন্যা, পুত্রবধূ, ননদ, বোন, কখনো আবার মাসি-পিসি। ভিন্ন ভিন্ন রূপের মধ্যে পরিবারে তাদের বিশেষ কিছু মানসিক প্রতিরূপ প্রত্যক্ষ করা যায়। ‘মা’ বাঙালি ঘরের প্রধান নারী চরিত্র। ‘মা’কে কেন্দ্র করে প্রচুর প্রবাদের সৃষ্টি হয়েছে। যেমন –

১. চিঁড়ে বল, মুড়ি বল, ভাতের বাড়া নাই।
                      পিসি বল, মাসি বল মায়ের বাড়া নাই।।
 ২. বটের ছায়া, মায়ের মায়া,
      অশথের ছায়াই ছায়া, মায়ের মায়াই মায়া।
৩. মা নাই যার না’ নেই তার।

চিঁড়ে মুড়ির সাথে ভাতের যেমন তুলনা হয় না তেমনি মমতাময়ী মায়ের সঙ্গে মাসি-পিসির তুলনা হয় না। মা অতুলনীয়া। সংসার-অরণ্যের বটবৃক্ষ। মা নৌকার (না’) সঙ্গে উপমিত। অকূল সংসার-সমুদ্রে ঝড় ঝাপটা থেকে রক্ষা ক’রে মা সন্তানকে শান্তির তীরভূমিতে পৌঁছে দেন। যার মা নেই তার দুঃখ-কষ্টেরও সীমা নেই।

    শাশুড়ি-পুত্রবধূর দ্বান্দ্বিক চিত্র বহু প্রবাদে প্রতিফলিত।  শাশুড়ির সঙ্গে পুত্রবধূর সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রে মধুর নয় – তিক্ত। বিশেষ করে পুত্র যদি স্ত্রৈণ হয় তাহলে শাশুড়ির রাগ-ক্ষোভ-দুঃখ একত্রিত হয়ে প্রতিহিংসার রূপ নেয়। যেমন –

গিন্নি ভাঙল নাদা, ও কিছু নয় দাদা,
মেয়ে ভাঙল কাঁসি, পড়ল একটু হাসি।
বউ ভাঙল সরা, গেল পাড়া পাড়া। 

শাশুড়ির মাটির হাঁড়ি ভাঙাটা নগণ্য বিষয়, মেয়ের কাঁসি ভাঙাটাও তুচ্ছ কিন্তু বউ-এর সরা ভাঙাটা গুরুতর ব্যাপার। 

  পদ্মমুখী ঝি আমার পরের ঘরে যায়।
আর উনুনমুখী বউ এসে বাটায় পান খায়।।

কন্যার মুখটি যে প্রস্ফুটিত শতদল আর পরের বাড়ির মেয়েটির মুখ বিশ্রী – অর্থাৎ কন্যার প্রশংসা এবং বউয়ের নিন্দা প্রসঙ্গে প্রবাদটি প্রযোজ্য। 

    আবার বউয়ের চলন-বলন, রূপ, কণ্ঠস্বর, স্বভাব শাশুড়ির দ্বারা ব্যঙ্গবিদ্ধ হয়েছে নিচের প্রবাদগুলিতে –

১. বউয়ের চলন-ফেরন কেমন? না, তুর্কি ঘোড়া যেমন।
 বউয়ের গলার স্বর কেমন? না, শালিক কোঁকায় যেমন।।
২. বউ নয়তো হীরে –
 কাল দিয়েছি পাটের শাড়ি, আজ ফেলেছে ছিঁড়ে। 
৩. বউ নয়, রূপসী বিদ্যেধরী।
নাকটি যেন কুমড়ো বড়ি।।

    ধীরে ধীরে বধূটিও হয়ে ওঠে শাশুড়ির প্রতি বিরূপ। সে চায় শাশুড়ির মৃত্যু। তাহলে বধূটি হবে গৃহ-সংসারের একমাত্র অধীশ্বরী। তখন সে স্বামী নিয়ে স্বতন্ত্র সংসার গড়ে তুলবে। বধূর সেই কামনা রূপ পেয়েছে প্রবাদের ভাষায় –

১. একলা ঘরের গিন্নি হবো।
  চাবি-কাঠি ঝুলিয়ে নাইতে যাবো।।
২. জা-জাউলি আপনা উলি ননদ মাগী পর।
  শাশুড়ি মাগী মরলে ’পরে হবো স্বতন্তর।।

শাশুড়ির মৃত্যু ঘটলেও বধূর কোনো শোকানুভূতি হবে না –

শাশুড়ি ম’ল সকালে
খেয়ে দেয়ে মনে থাকলে
কাঁদবো তখন বিকালে। 

বউ পরের বাড়ির মেয়ে। শাশুড়ির প্রতি তার বিদ্বেষ থাকতেই পারে। কিন্তু নিজের গর্ভজাত সন্তান যখন বউ পেয়ে মাকে ভুলে যায় তখন মায়ের হৃদয় অভিমানে হয় ভারাক্রান্ত।  ছেলে বউকে শাসন করলে কিংবা নতুন শাড়ি কিনে দিলেও মায়ের বিদ্রূপবাণ শাণিত হয়ে ওঠে। আর এই প্রসঙ্গের প্রবাদগুলি শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় অসামান্য –

১. বউয়ের গায়ে কি হাত ওঠায়
  লোক দেখিয়ে বালিশ কিলায়।
২. মায়ের গলায় দিয়ে দড়ি
  বউকে পরায় ঢাকাই শাড়ি। 
৩. বাছার আমার কি দিব তুলনা, 
  বউয়ের পাছায় ঢাকাই শাড়ি।
  মায়ের কোমরে টেনা।।

ননদ-ভ্রাতৃবধূ কেন্দ্রিক প্রবাদগুলিও গভীর ব্যঞ্জনায় সমৃদ্ধ। ভ্রাতৃবধূর আচার-আচরণ, চলন-বলন, সাজ-পোষাক, রূপগুণ, আর প্রাত্যহিক কাজকর্ম – সবকিছুই সমালোচিত হয় ননদের দ্বারা। কখনো কখনো ননদও অপমানিত হয় ভ্রাতৃবধূর দ্বারা। তাই উভয়ের মুখ থেকেই উচ্চারিত হয় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে ভরা বেশকিছু প্রবাদ –

ননদিনী রায় বাঘিনী, দাঁড়িয়ে আছে কালসাপিনী।

ননদিনী হিংস্র-স্বভাবা, কলহপ্রিয়া। তাই শ্বশুরবাড়িতে প্রবেশের আগেই ননদিনী সম্পর্কে বধূর ভীতির শেষ থাকে না। বিয়ের পর ননদ যখন শ্বশুরবাড়ি যায় তখন ভ্রাতৃবধূর মায়া-কান্না প্রসঙ্গে একটি প্রবাদ হলো –

বাপ কাঁদে, মা কাঁদে আছাড় বিছাড় খেয়ে। 
ভাইয়ের বউ অভাগী কাঁদে চোখে মরিচ দিয়ে।।

আর একটি প্রবাদে আছে –

ভাল কথা, মনে পড়ল আঁচাতে আঁচাতে।
ঠাকুরঝিকে নিয়ে গেল নাচাতে নাচাতে।।

ঠাকুরঝি আর ভ্রাতৃবধূ  স্নানে গিয়েছিল নদীতে। কুমীরে ধরে নিয়ে গেছে ঠাকুরঝিকে। অথচ ঘরে ফেরার পরও অনেকক্ষণ মনেই পড়ে নি ভ্রাতৃবধূর। খাওয়া-দাওয়ার পর আঁচানোর সময় মনে পড়েছে সে কথা। এখানে ননদিনীর প্রতি চরম অবহেলা জনিত মনোভাবের প্রকাশ ঘটেছে। 

    বহু প্রবাদে ভ্রাতৃবধূ বাক্যবাণে জর্জরিত করেছে ননদিনীকে – বাংলাসাহিত্যে সেগুলি প্রবাদ রূপে অমরত্ব লাভ করেছে। 

১. ননদিনী রায় বাঘিনী পাড়ায় পাড়ায় কুচ্ছ গায়।
     ননদিনী মরলে পরে সুখের বাতাস বইবে গায়।।
 ২. ননদিনী প্রেমবাদিনী 
      জ্বালাইয়া মাইলো দিবস রজনী। 
৩. ননদী বিয়ের কাঁটা,
  বিষ মাখা দেয় খোঁটা।

ভাজকে ননদ যন্ত্রণা দিয়ে থাকে কিন্তু সে যখন শ্বশুর বাড়ি যায়, তার ননদও তাকে যন্ত্রণা দিয়ে থাকে। এই প্রবাদে বলে –
ননদেরও ননদ আছে। 

এবার আসা যাক সতীনের কথায়। বাংলার কৌলিন্য প্রথার প্রভাবে এক সমর বহু বিবাহ প্রচলিত ছিল। তার ফলে বাঙালি সংসারে একটি চরম সমস্যা ছিল ‘সতীন সমস্যা’। নারীরা কখনো সতীন  চায় না। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ছদ্মবেশিনী অন্নপূর্ণা ঈশ্বরী পাটনীকে বলেছিল –

গঙ্গা নামে সতা তার তরঙ্গ এমনি। 
জীবন স্বরূপা সে স্বামীর শিরোমণি।।

এই সতীন সমস্যা বাঙালি গৃহের অভ্যন্তরের শান্তির পরিবেশকে বিঘ্নিত করেছিল । সতীনের হিংসা, দ্বেষ, প্রতিহিংসার প্রতিটি স্তরকে কেন্দ্র করে বহু প্রবাদ সৃষ্টি হয়েছে। যেমন –

একা ছিলাম ঘরের মাঝে মাথার ঠাকুর। 
সতীন এলো এবার হলাম আস্তাকুঁড়ের কুকুর।।

নিজের বোন যদি গ্রহবৈগুণ্যে সতীন হয় তাহলে সেই বোন-সতীনের অত্যাচার অসহনীয় হয়ে ওঠে দিদির কাছে । তাই দিদির বেদনাময় অনুভূতি –

১. আন সতীনে নাড়ে চাড়ে
    বোন সতীনে পুড়িয়ে মারে।
২. নিম তেতো, নিসিন্দা তেতো, আর তেতো খর। 
     তার চেয়ে অধিক তেতো বোন সতীনের ঘর।।

বোন যেখানে সতীন সেখানে প্রতিযোগিতাও কঠিন। আর সব প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠা চায়। তাই বোন-সতীনও দিদিকে পরাজিত করে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। 

যমকে ভাতার দিতে পারি। 
সতীনকে তবু দিতে নারি।।

সতীনের জ্বালা এমনই যে, সতীনকে খুন করতেও পিছপা হয় না। 
১. অশথ কেটে বসত করি,
  সতীন কেটে আলতা পরি। 
২. বঁটি বঁটি বঁটি,
  সতীনকে ধরে কাটি।
এ এক অদ্ভুত নারী-মনস্তত্ত্ব।  সতীন বিনষ্টিতে এক উৎকৃষ্ট আনন্দলাভ।  
সতীনের হাত সাপের ছোঁ,
চিনি দিলে তুলে থো। 

সতীন যদি খাদ্য পরিবেশন করে তবে তা বিষবৎ পরিত্যাজ্য। সাপের ছোবল যেমন প্রাণ কেড়ে নিতে পারে তেমনি সতীনের দেওয়া খাদ্যেও প্রাণ সংশয় ঘটতে পারে। 
    পরিবারে কন্যা-সন্তানের একটি বিশিষ্ট স্থান রয়েছে। তবে পুত্র-সন্তানের তুলনায় কন্যার আদর কম। কন্যা-সন্তানের বহুমুখী মানস প্রতিরূপ বিম্বিত হয়েছে প্রবাদে –

১. সাত জন্মে পাপ করলি,
    মেয়ে জন্মে তবে এলি।
২. ছেলেরা হীরের আংটি,
     মেয়েরা মাটির কলসী। 
৩. সব পুত্র সম্পদ, কন্যা সব আপদ।
৪. ছেলে শিখবে লেখাপড়া,
  মেয়ে শিখবে রান্না বাড়া।

কন্যা-সন্তান যেন এক একটি দুঃসহ বোঝা, অবাঞ্ছিত অভিশাপ। হৃদয়হীন স্বার্থপর পক্ষপাতদুষ্ট পুরুষশাসিত সমাজে পুত্র ও কন্যার এহেন পার্থক্য বড়ই বেদনার। কেননা, উপরোক্ত প্রবাদগুলিতে কন্যা-সন্তানের অবহেলিত রূপই ফুটে উঠেছে।  

    এইভাবে প্রবাদের মধ্য দিয়ে নারীমনের বহুমাত্রিক দিক বিধৃত হয়েছে। নারীর ঈর্ষা, কলহপ্রিয়তা, স্নেহপরায়ণতা, প্রতিহিংসা, মিষ্টতা, তিক্ততা বাংলা প্রবাদের আঙিনায় জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে। 

গ্রন্থঋণ :
১. বিনয় ঘোষ - বাংলার লোকংস্কৃতির সমাজতত্ত্ব
২.ড. ফাল্গুনি ভূঞ্যা – বাংলার লোকসংস্কৃতি : মনস্তাত্ত্বিক অন্বেষা ও প্রয়োগ
৩.সুদেষ্ণা বসাক – বাংলার প্রবাদ
৪. মদনচন্দ্র করণ – প্রবাদের স্বরূপ ও সীমানা : বাঙালীর পরিবার জীবন
৫. ড. বরুণকুমার চক্রবর্তী – বঙ্গীয় লোকসংস্কৃতি কোষ
 
ক্লিক করে পড়ুন। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগদ্য। 👇

পেজে লাইক দিন👇


Post a Comment

1 Comments