জ্বলদর্চি

শিল্পীর প্রতিযোগিতা নিজের সাথে নিজের /সন্দীপ কাঞ্জিলাল

শিল্পীর প্রতিযোগিতা নিজের সাথে নিজের 

সন্দীপ কাঞ্জিলাল


প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য মানুষকে নানা রকম কায়দা কসরত শিখতে হয়। এর জন্য লাগে জ্ঞান। জ্ঞান মানুষ অর্জন করেছে নিজস্ব প্রয়োজনে। তা নিজের প্রয়োজনে হোক কিংবা সংসার দেশের প্রয়োজনেই হোক, এর ভেতরে মানুষ অনুভব করে বেঁচে থাকার আনন্দ। কিন্তু শুধু বেঁচে থাকার আনন্দ ক্ষণস্থায়ী, অল্পতেই তাই একঘেঁয়েমি এসে যায়। এই একঘেঁয়েমি দশা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ চায় বৈচিত্র‍্য। আনন্দের বৈচিত্র‍্যে সৃষ্ট মিশ্র আনন্দের মধ্য দিয়ে তৈরি হয় সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য মানুষ পায় প্রকৃতি থেকে, নিজের বা অন্যের সৃষ্ট কর্ম থেকে। সৌন্দর্যের বিশাল অঙ্গনে  মানুষের সৌন্দর্যময় সৃষ্টি— শিল্প। আর যে মানুষটি এই কাজ করেন তিনি হলেন শিল্পী। তবে প্রকৃতির সৃষ্টি শিল্পকর্ম নয়। কারণ শিল্পীর রয়েছে নিজস্ব বোধ। শিল্পী নিয়ম মানেন এবং নিয়ম ভাঙেন। প্রকৃতি নিয়মের শৃঙ্খলে বন্দি। সে শিল্পের জন্য নিয়ম ভাঙতে পারে না। আর শিল্পের গুণগত মান নির্ভর করে মানুষের নিজস্ব মেধা ও অভিজ্ঞতার উপর। আমাদের মনে রাখতে হবে কোনো মেধা বা অভিজ্ঞতা আল্টিমেট হতে পারে না। তাহলে কোনো শিল্প কিভাবে আল্টিমেট হবে। 

শিল্পের মধ্যে শিল্পীর সৃজনশীলতা থাকতে হবে। যদি তা না হয়, তবে তা হবে অনুকরণ। সৃজনশীলতা বলতে শিল্পীর নতুন সৃষ্টির উদ্দীপনা। শিল্পের ভেতর শিল্পী হিসেবে তিনি রাখবেন তাঁর স্বকীয়তা বা তাঁর নিজস্ব স্বাক্ষর। ধরা যাক কেউ একটি পাহাড়ের ছবি আঁকলেন। হয়তো সেই ছবিটির সাথে ক্যামেরায় তোলা ছবির কোনো পার্থক্য নেই। তবু তাঁকে আমরা শিল্পী বলবো না। শিল্পী যা চোখে দেখেন তা বাস্তব ছবি। আর মন ক্যামেরা দিয়ে তিনি যে ছবি তুলবেন সেখানে থাকে তার মনের আলো- ছায়ার খেলা। এই বাস্তবতার সাথে আলোছায়ার খেলা মিশিয়ে শিল্পী হয়ে উঠবেন স্রষ্টা। এখানে শিল্পী হয়ে উঠবেন 'একমেবাদ্বিতীয়ম'।


যদি কোনো সৃষ্টির ভেতরে শিল্পী মঙ্গলময় অনুভবকে শিল্প-ভোগীর কাছে পৌঁছতে না পারেন, তবে তিনি যথার্থ শিল্প সৃষ্টি করেননি। যে শিল্প মানুষের সুকুমার মনোবৃত্তিকে ধ্বংস করে দেয়, বা অমঙ্গলের বার্তা পাঠায়, তা কল্পনায় কিংবা সৃজনশীলতায় যতই নিখুঁত হোক না কেন, তা শিল্পের বর্জ্য হিসেবে পরিগণিত হবে। যতই বলা হোক সৃজনশীল কল্পবাস্তবতা থেকে শিল্পের উদ্ভব, কিংবা শিল্পীর কোনো সামাজিক দায় নেই, এতে শিল্পীর নিরপেক্ষতার বিষয় থাকলেও, বাস্তবে মেনে নেওয়া যায় না। শিল্পীর সামাজিক দায় থাকা জরুরি। কোন শিল্পীর শিল্পকর্ম যদি কোন আদর্শকে আঘাত করে, এর ফলে দাঙ্গার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, তাহলে তার দায় শিল্পীকেই নিতে হবে। যদি শিল্পের সাধনা সত্য-সুন্দরের সাধনা হয়, তাহলে সেই সত্য ও সুন্দরের সৃষ্টির দায় শিল্পীর। শিল্পে আবেগের স্থান আছে, কিন্তু অতিরঞ্জনের দ্বারা যেন কলুষিত না হয় সেটাও শিল্পীরই দেখার বিষয়। 

সৃজনশীল মানুষ বিজ্ঞানের সাধনা করে, বিষয়ের দুর্বোধ্যতা অপসারণ করার চেষ্টা করে, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং সত্যকে জানার জন্য। শিল্পী সৌন্দর্যের ভিতরে সত্য কিংবা সত্যের মধ্য দিয়ে সৌন্দর্যে পৌঁছতে চায় আনন্দলাভের জন্য। এখানে আত্মোপলব্ধিটাই বড়। এই বিচারে শিল্প হলো মানুষের বিশেষ সৃষ্টি। শিল্পীর সৌন্দর্যমন্ডিত ধ্যানের ভিতর দিয়ে শিল্পকর্ম গড়ে ওঠে। ধানের ভিতর দিয়ে শিল্পী যে সৌন্দর্যকে অনুভব করেন, তাকে যথাযথ ফুটিয়ে তুলতে পারার ভিতরে রয়েছে শিল্পীর সার্থকতা। 
যে মানুষটি নিজের আনন্দে সৌন্দর্য তৈরি করেন তিনিও শিল্পী। প্রকৃতির এই যে এত রূপ রস গন্ধ স্পর্শ শ্রবণের লীলা, প্রকৃতি এসব কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করে না। যা হওয়ার তা হয়, তা অনুভব করে কোন এক 'আমি' বা 'আমি সমূহ' আনন্দ বা দুঃখ পায়। কিন্তু শিল্পীর উদ্দেশ্য থাকতেই হয়। এই শিল্পীর শিল্পবোধের সাথে শিল্পীর রসগ্রহণকারীর শিল্পবোধের যোগাযোগ যথাযথভাবে হলে শিল্পকর্ম সার্থক হয়ে ওঠে।
নান্দনিকতা অনেক ক্ষেত্রেই অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, ধারণা দ্বারা প্রভাবিত হয় বা রসাস্বাদনের সহায়ক ভূমিকা পালন করে। রাগ সঙ্গীতের স্বরবিন্যাসে যে বিশেষ ধ্বনিশৈলী তৈরি হয়, তার কোন একটি শৈলী যদি কারো আগে থেকেই কোনো শ্রোতার জানা থাকে, তাহলে সহজেই কোন শিল্পীর পরিবেশনা দ্বারা সে আনন্দ লাভ করতে পারে বা বিরক্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে মানুষ তার পূর্ব অভিজ্ঞতাকে ব্যবহার করে। সে আগের অভিজ্ঞতার সাথে নতুন শোনার অভিজ্ঞতার তুলনা করে। ফলে শ্রোতার অভিব্যক্তি হয়, সে বলে—  যা শুনলাম এমনটা আর শুনিনি, কিংবা এত মন্দ পরিবেশনা আর কখনো শুনিনি। এরূপ তুলনা হতে পারে কবিতার ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে,  চিত্রকর্মের ক্ষেত্রে। সকল নান্দনিক উপস্থাপন সবার জন্য নয়, আবার সকল উপস্থাপনও নান্দনিক নয়। কিছু লোক যা দেখে আনন্দ লাভ করে, তা খুব খারাপ হতে পারে, বা খুব ভালো হতে পারে। উভয় ক্ষেত্রেই শিল্পী ভাবতে পারেন, তিনি যে স্থানে আছেন, সেখানে দর্শক-শ্রোতা পৌঁছতে পারছেন না। সেক্ষেত্রে বিনয়ের সাথে শিল্পীকেই ভাবতে হবে, তার কোনো  ত্রুটি আছে কিনা। বিনয়, শিল্প এবং শিল্পীর জন্য জরুরী। সত্যিকারের মানুষ হবে বিনয়ী। কারণ মানুষ পরম সত্যের সাধনা করতে পারে, কিন্তু লাভ করতে পারে না। যদি কেউ পারে তবে সে হয়ে উঠবে ঈশ্বর। সে আর যাই হোক অন্তত মানুষ থাকবে না। অন্য কোনো বিশেষ মানুষের তুলনায় সে হয়তো কোনো কিছু খুব ভাল পারে, কিন্তু সত্যিকার অর্থে সে পরম-মানে পৌঁছাতে পারেনি, বা পারবে না, এই অপারগতার কারণে তাকে বিনয়ী হতে হবে। বিনয় মানুষকে শৈল্পিক স্তরে নিয়ে যায় এবং সত্যিকারের মানুষ হওয়ার   হিসেবে বলা যায়, সে ভালো কবিতা লেখে, বড়ো কবি, আর যে ভালো কবিতা লেখে এবং বিনয়ী সে ভালো শিল্পী। আমাদের বড়ো কবির থেকে ভালো শিল্পী প্রয়োজন। জীবনের সকল ক্ষেত্রে শিল্পীর দরকার, যিনি নিজেকে সাজাতে পারেন, অন্যকে সজ্জিত করতে পারেন। 

তাই শিল্পীর প্রতিযোগিতা হবে নিজের সাথে নিজের। অন্যের সাথে প্রতিযোগিতার শিল্পীকে হীনমন্য করে, নিজের সাথে নিজের প্রতিযোগিতা করে সমৃদ্ধ।

ক্লিক করে পড়ুন। কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদারের স্মৃতিগদ্য। 👇

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments