আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে
পর্ব ১৭
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
" তারে দেখাতে পারিনে কেন প্রাণ খুলে গো"
আমরা কি প্রাণ খুলে সবাইকে দেখাতে পারি বা বোঝাতে পারি আমাদের হৃদয়ের বেদন অন্তরের আকুতি? পৃথিবীতে দেখার একটা বিরাট মূল্য আছে। দেখা শব্দের অর্থ হচ্ছে দর্শন। দৃশ + অনট প্রত্যয় করে হয় দর্শন । কিন্তু দেখা হয় দুরকমের এক চোখের দেখা আর দুই মনের দেখা। বাইরের দেখা দিয়ে মানুষকে আন্দাজ করা যায় না you should not trust by appearance । দেখা যতটা বাইরের তার থেকে অধিক দেখা কিন্তু মনের। আমরা জানি দেবতাদের কেবল তৃতীয় নয়ন থাকে কারণ সব দেখার উর্ধ্বে ঈশ্বরের দেখা। কথায় আছে না ঈশ্বরের চোখ কে ফাঁকি দেওয়া যায়না। এই কথাটির বাস্তবতা আছে বইকি।এই যে মানুষ চুরি করে অন্যায় করে তখন সবার অগোচরেই করে কিন্তু একদিন না একদিন চোর ধরা পড়েই। মানুষেরও কিন্তু তৃতীয় নয়ন আছে তা হল মানুষের বিবেক। যখন আপনি কোনো একটি কাজ করতে যাবেন তখন একবার মনে হবে, না থাক ছেড়ে দিই, আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই আপনি উঠে দাঁড়াবেন, না না অলসতা করলে সাফল্য আসেনা এইটুকু শ্রম করতেই হবে। যে সুস্থ চিন্তা আপনাকে ফিল্টার করে ঠিক পথ দেখায় তা হল আপনার তৃতীয় নয়ন।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা "আমি" " আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ চুনি উঠল রাঙা হয়ে" আমার চেতনা আমার বোধ পান্নাকে সবুজ ভেবেছে তাই পান্না সবুজ হল। আবার ইংরেজ দার্শনিক " জন লক" বলেন " জন্মের সময় মানুষের মন থাকে সাদা কাগজের মতো " অভিজ্ঞতাতেই আমরা সমৃদ্ধ হই, আমরা চোখে দেখি, শুনি তারপর আস্তে আস্তে আমাদের মনের খাতা ভরতে থাকে। যেমন বিস্ময় এই বিশ্ব ব্রহ্মান্ড তেমন বিস্ময় আমাদের এই দুই চোখ। এই চোখের দেখার জন্যেই তো মনের এত খিদে। আর আমাদের পাহাড় সমান উচ্চাকাঙ্খা । হুমায়ূন আহমেদের "দেখা না দেখা" বলে একটি উপন্যাস আছে ভ্রমণ কাহিনীর উপর লেখা। ভ্রমণ মানেই চোখের ক্যামেরাই ছবি তোলা আর কত নতুন গল্প মনের গুদামে জমা রাখা। সব বিস্ময় সব আনন্দ ও কষ্টের ছবি চোখ তুলে রাখে। আর মন খুলে রাখে মনের সদর দরজা তাতে কত মানুষ কত পথ, নতুন নতুন গল্প আবিষ্কার সব লিপিবদ্ধ থাকে।
রবীন্দ্রনাথের একটি গান আমার খুব প্রিয় " দেখা না দেখার মেশা হে বিদ্যুৎলতা/ কাঁপাও ঝড়ের বুকে এ কি ব্যাকুলতা!" বিচিত্র পর্যায়ের গান ।
প্রিয়র দেখা পাওয়ার জন্য আমাদের মন কেমন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। দেখা হলেও হয়তো কথা হয়না আবার কথা হলেও যা বলার তা না বলা হয়ে থাকে। দেখা না হলে অদ্ভুত অস্থিরতা হরিণের মতো মন চপল হয়ে ওঠে, যেন কোথাও মনে শান্তি নেই "সে বিনে আর জানেনা, জানেনা মন আমার"।
এক শব্দের তো একটাই মানে থাকতে পারেনা।
সেদিন দুটি কমবয়সী ছেলে মারামারি করছে এ ওকে বলছে তোকে "দেখে" নেব। এই দেখার অর্থ পাল্টা জবাব দেওয়া মানে কেউ ছেড়ে কথা বলবেনা অর্থাৎ প্রতিহিংসা পরায়ণ মন।
আমরা বলি আহা কি দৃষ্টিনন্দন এই জায়গাটি! মানে আমাদের মুগ্ধতার কথায় আমরা বলতে চাইছি।
আবার রাগে কখনো কখনো বলি সে আমার দুচোখের বিষ! কথায় তো বলে কু -নজর
সু-নজর।
এখনো কত মানুষের কত কুসংস্কার আছে লোকে ভয় পায় এই নজর লেগে গেল বলে। বাচ্চাদের কালো টিপ, গোবরের টিপ পরানো হয় যাতে নজর না লাগে। শুধু আমাদের দেশ বা তৃতীয় বিশ্বের দেশ নয়, উন্নত দেশের মানুষের মনেও অনেক কুসংস্কার আছে এবং আছে কিছু বদ্ধমূল ধারণা ।
প্রচলিত বিশ্বাস আগেকার দিনে সাধুবাবাদের ক্রোধে চোখে আগুন জ্বলত তাঁরা চোখ দিয়ে ভষ্ম করে দিতে পারতেন। সত্য মিথ্যা জানিনা তবে চোখ দিয়ে যাদুকররা hyipnotize করে। খুব কাঁচা মনে হলেও কথাটা কিন্তু সত্য চোখই তো মনের আয়না। অনেক কথা মুখে বলা যায়না কিন্তু সেই অব্যক্ত ভাষা চোখে ফুটে ওঠে।
চোখ এবং মন দুটো জিনিস কতদূর যে ভ্রমণ করতে পারে তা বোধহয় ঈশ্বরেরও জানা নেই ।
মন ইচ্ছে করলেই শৈশবে ঘুরে বেড়াতে পারে।
আমরা সবাই পড়েছি
twilkle twinkle little star
how i wonder what you are?
up above the world so high
like a diamond in the sky
এই যে আমার এতো বিস্ময় জাগছে কারণ দুচোখ ভরে আমি সুন্দরকে দেখছি আর মন্ত্রমুগ্ধের মতো অবাক চোখে আনন্দ নিচ্ছি।
বাগানে যে এত ফুল ফুটে আছে, ফুল তুলে আমি দেবতার পায়ে অর্পণ করি। বাড়ির সৌন্দর্য বাড়াতে আমি বাগানে প্রাণ ঢেলে দিই। এ পৃথিবীতে ফুল, শিশু আর গান ছাড়া কোনো রূপের এবং সত্য সুন্দরের আলোচনা করা যায়না। প্রকৃতিই আসলে ঈশ্বর। আমার মনে হয় মানুষের চোখ সৃষ্টি হয়েছে বলেই ভগবান ফুল সৃষ্টি করেছেন। জগতের অপার সৌন্দর্যের মহিমা যেন সব ফুলের অন্তরেই লেখা আছে।
আপনি কোনো খাবারের দোকানে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, দাদা ভালো হবে তো? দোকানদার সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে নমুনা দিয়ে বললো খেয়েই দেখুন আগে তারপর না হয় নেবেন।
এই যে খেয়ে দেখা চেখে দেখা এ হলো জীভের স্বাদ গ্রহণ করা। তেমন পরখ করে দেখা হয় কোনো জিনিস। আবার কোনো জিনিস রান্না করে দেখা হয়। কোনো কোনো জিনিস অনুভব করেও দেখা হয়। আমার ব্যক্তিগত মতামত প্রত্যেকটি ইন্দ্রিয়ের আলাদা আলাদা দেখার চোখ থাকে।যে মানুষের ছটি ইন্দ্রিয় সমানভাবে সজাগ সেই ব্যক্তি তত বেশি বুদ্ধিমান তাঁর ততবেশি
আই-কিউ।
আমাদের চোখের দেখা আর মনের দেখার মধ্যে কেবল শুদ্ধ ভাবটা বজায় রাখার অভ্যাস করতে হবে। ঠাকুর শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ বলছেন "যখন বাসন মাজবে মনে করবে চিত্তমার্জনা করছ।যখন চন্দন ঘষবে মনে করবে নিজেকে নির্মল করে কোমল করে নিঃশ্বেষ করে মিলিয়ে দিচ্ছ ঈশ্বরে।পুজোর আয়োজনেও পূজা। প্রেমের আয়োজনে প্রেম"।
আমরা অনেক সময় বলি "আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী" .... দেখে আগে ভালো লাগতে হবে। চোখ যদি সন্তুষ্ট হয় তারপর না হয় এগোনোর কথা চিন্তা করা যাবে। চোখ আসলে আত্মাকে তৃপ্তি দেয়। আমাদের মা কাকিমারা বলতেন সবুজের দিকে তাকাও চোখ ভালো থাকবে।
সবুজ রঙের সতেজতা চোখকে আরাম দেয়।
প্রথম দেখাতেই আমরা প্রেমে পড়ে যাই love at first sight। eye contact না হলে কী করে বুঝবেন দুতরফের অনুভূতি? চোখই মনের ঠিকানায় love letter পাঠিয়ে দেয়।
এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের একটা গান মনে পড়ল " "ও কার চোখের চাওয়ার হাওয়ায় দোলায় মন" অথবা "ও কেন চুরি করে চায়?/ লুকাতে গিয়ে হাসি, হেসে পালায়"... সারাজীবন ধরে আমরা এইটুকু চাওয়ার আশা করে থাকি। প্রিয় চোখে চোখ রেখে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। মুখে একটি শব্দ না করেও অনেক কথা চোখ দিয়ে বোঝাতে ইচ্ছে হয়। by pablo neruda, love poem
............ when you appear
all rivers sound in my body
bells shake the sky
and a hymn fills the world
only you and i
only you and i my love
listen to it.
প্রিয় মানুষের দেখা পেলে সারা পৃথিবীতে যেন আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আমরা ভেসে যাই আবেগের স্রোতে। আসুন আমরা আমাদের
অন্তর দৃষ্টিকে জাগ্রত করি। আমাদের চেতনা ও বোধ কে সম্মানিত করি। চোখকে প্রেমের সিংহাসনে বসাই।
যাকে চেয়েছিলাম
শক্তি চট্টোপাধ্যায়
"যাকে চেয়েছিলাম তাকে পেলাম না
যে ঘাট ছাড়ে নৌকো তাতে গেলাম না।
কপাল আমার মন্দ তাতে সন্দেহ কি।
চোখ বুজলে প্রিয় কেবল তোমায় দেখি।"
আমরা স্বপ্নেও দেখি, জাগরণেও দেখি, চোখ বন্ধ রেখেও দেখি। চলতেই থাকে অবিরাম দেখার ক্রিয়া। প্রিয় মানুষের উপস্থিতি আমরা সবসময়ই কামনা করি। ভালোবাসার পিয়ানোটা বাজতেই থাকে। পায়ের সঙ্গে পায়ের দেখা, হাতের সঙ্গে হাতের দেখা, কিন্তু দুই চোখের তো কখনো মিলন হয় না! আজীবন দেখার তপস্যা করে আছে এই জগত সংসার।
0 Comments