জ্বলদর্চি

পাতা বেঁদা: ভালোবাসার মিলনমেলা /সূর্যকান্ত মাহাতো

জঙ্গলমহলের জীবন ও প্রকৃতি

পর্ব - ৪০

পাতা বেঁদা: ভালোবাসার মিলনমেলা

সূর্যকান্ত মাহাতো


পাতা বেঁদা। জঙ্গলমহলের "সাঁতভূম" অঞ্চলের সব থেকে বড় মেলা। 'সাঁতভূম' হল 'সঁন্ত' বা 'সাঁওন্তভূম'। সাঁওতালদের আদি বাসস্থান। এই আদি বাসস্থান থেকেই নাকি তাদের 'সাঁওতাল' নামকরণ হয়েছে (পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি, বিনয় ঘোষ/ দ্বিতীয় খন্ড)। সমগ্র জঙ্গলমহলের বুকে এত বড় মেলা আর কোথাও বসেনি। লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি ঘটে দু দিনের এই মেলায়। শিলদার অদূরে 'ওড়গোন্দা' গ্রামে বসে এই মিলন মেলা। জঙ্গলমহলের জেলাগুলো সহ পশ্চিমবাংলা ছাড়াও প্রতিবেশী ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, বিহার ও আসাম থেকেও প্রচুর আদিবাসী মানুষ এই মেলায় অংশ নিতে আসে। যানবাহনের সংখ্যাটা থাকে হিসেবের বাইরে। বাসের সংখ্যাটাই থাকে শতাধিক।

মেলায় উপস্থিত মানুষের ঢল জনজোয়ারে পরিণত হয়। মেলার মাঠ উপচে পড়ে মানুষের স্রোতে। কয়েক কিমি জুড়ে কেবলই মানুষের ঢল। একেবারে গরিব মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চ পদস্থ সমস্ত পেশার মানুষই এই মিলন মেলায় অংশ নেয়। আনন্দবাজার পত্রিকা এই মেলাকে কার্যত আদিবাসীদের কুম্ভ মেলা বলেই উল্লেখ করেছেন (আনন্দবাজার পত্রিকা ৬ই অক্টোবর ২০১৪)। বিজয়া দশমীর দিন থেকে এই মেলা শুরু হয়। চলে একাদশী ও দ্বাদশী পর্যন্ত। দশমীর দিন অ-আদিবাসী মানুষেরা এ মেলায় অংশগ্রহণ করে। কিন্তু একাদশী ও দ্বাদশী এই দুদিন সম্পূর্ণভাবে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের মেলা। অন্যান্যরা তখন অপাঙক্তেয়। পুরো মেলা জুড়ে কেবল ওদেরই সংস্কৃতি তখন বিরাজমান।

মেলায় সারা রাত্রি ধরে চলে আদিবাসীদের নাচ গান। পাতা নাচ। ভুয়াং নাচ সহ আরো কত কী। ধীর পায়ে সুললিত ছন্দে নেচে নেচে, গেয়ে গেয়ে, মাদলের তালে তালে মেলাকে আরো বেশি মুখর করে তুলে। মেলার সমস্ত মাঠ জুড়ে বসে নানান ধরনের দোকানপাট। কি নেই সেখানে! সারি সারি কাপড়ের দোকান, খাবারের দোকান, লোহা নির্মিত নানান ধরণের দ্রব্য সামগ্রী। পাথর নির্মিত নানান সৌন্দর্যময দ্রব্য যেমন নোড়া, গাড়ু, থালা প্রভৃতি। বিক্রী হয় তীর ধনুক, সেই সঙ্গে বাঁশের বাঁশি সহ আরো কত কী। বাচ্চা থেকে বড় সকলেরই মনোরঞ্জনের সামগ্রী এই মেলায় পাওয়া যায়। তবে সব থেকে বড় বিস্ময়কর হল বইয়ের দোকানগুলো। মেলার একটা সারির পুরোটাই বইয়ের দোকান। সেখানে সাঁওতালি ভাষার নানান বই এবং সেইসঙ্গে অন্যান্য ভাষার সাঁওতালি অনূদিত বইয়ের সম্ভারও থরে থরে সাজানো থাকে। সব ধরনের বই থাকে দোকানগুলোতে। কি নেই সেখানে! তাদের সংস্কৃতির উপর রচিত বই, ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে শুরু করে সাহিত্য বিষয়ক বই, এমনকি একাধিক কম্পিটিটিভ এক্সাম এর বইও মেলায় বিক্রি হয়। সেইসঙ্গে নানান গবেষণামূলক বইও বিক্রি হয় প্রচুর। কারণ স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, থেকে শুরু করে কলেজ পড়ুয়া অধ্যাপক অধ্যাপিকা থেকে গবেষণারত ছাত্র ছাত্রী সকলেই এই মেলায় অংশ নেয়। তাই সকলেরই চাহিদা অনুযায়ী বই থাকে দোকানগুলোতে। জঙ্গলমহলে অ- আদিবাসী মেলাগুলোতে যা কখনোই চোখে পড়ে না।

"পাতা বেঁদা" মেলা আসলে কী? 'পাতা বেঁদা' শব্দটি "পাট্টা বিধৌ পরব" থেকে এসেছে বলে মনে করেন ধরম হাঁসদা। 'পাট্টা' থেকে পাটা বা পাতা শব্দটি এসেছে। 'পাট্টা' শব্দের অর্থ জমির দলিল। অর্থাৎ নিজের মতো করে পাওয়া। এই মেলাটাকেও তারা এক রকম নিজেদের মতো করেই গ্রহণ করে নিয়েছে।

আবার 'পাতা বিঁধা'-র অর্থ হল, লক্ষ্যভেদ। এখানে 'পাতা' নিশানা অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আর 'বিঁধা' শব্দটি 'বিদ্ধ করা' অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। অর্থাৎ তীর দিয়ে লক্ষ্যভেদ করাই হলো 'পাতা বেঁদা'।

কী উপলক্ষে বসে এই মেলা! সে সম্পর্কে একটা লোকবিশ্বাসও প্রচলিত আছে। জিতা অষ্টমীর পুণ্য তিথিতে ধলভূমের রঙ্কিনীদেবীর থানে কল্পারম্ভ শুরু হয়। ওই দিন সেখানে আদিবাসীদের "বিঁধা পরব" অনুষ্ঠিত হয়। এক পক্ষ কাল পরে বিজয়া দশমীতে ওড়গোন্দায় সেটা শেষ হয়। ওই দিন নাকি রঙ্কিনী দেবী তথা ভৈরবী, ওড়গোন্দার ভৈরব দেবতার সঙ্গে মিলিত হতে আসেন। সেই উপলক্ষ্যেই বসে 'পাতা বেঁদা'-র মেলা। ওড়গোন্দার এই পাতা বেঁদার সঙ্গে ধলভূমের বিঁধা পরবের দারুন মিল। ওই দুটো নাকি একই পরব। "ভৈরব মাহাত্ম্য কথা"-ই সেইরকমই উল্লেখ আছে।

"ভৈরব ভৈরবী স্থানে দেখো একি পর্ব 
লুপ্ত হয় ক্রমে ক্রমে দেব কীর্তি সব।"

ভৈরব ও ভৈরবী তথা রঙ্কিনীর মিলনে ঐদিন সাঁতভূমের মাটি কেঁপে কেঁপে ওঠে। ধ্বনিত হয় গুড়গুড় শব্দ। অমরেন্দ্রনাথ মজুমদার এর "ভৈরব রঙ্কিনী মাহাত্ম্য কথা"-য় সেকথা সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে।

"শ্রী ভৈরব সাড়া দেন গুড় গুড় রব
পরগনার ভূমি জল কেঁপে কেঁপে ওঠে"

দেবতার মিলন ভূমি তাই ভক্তদেরও মিলনক্ষেত্র হয়ে উঠে। এটাই এই মেলার একটা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য। যা অন্য কোন মেলায় এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। মেলায় আগত যুবক-যুবতীরা পরস্পরকে টিপ্পনি কাটে। প্রেম নিবেদন করে। পরস্পর সম্মতি প্রদান করলে বা সাড়া দিলে বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। এইভাবে সাথী বা সঙ্গী নির্বাচনে থাকে তাদের অবাধ স্বাধীনতা। পিতা-মাতা ও পরিবারেরও থাকে তাতে সম্মতি। এ এক দারুন ব্যাপার!

বিশিষ্ট সমাজসেবী খগেন্দ্রনাথ মাণ্ডি বলেন, মেলায় জীবনসঙ্গিনী খোঁজার এই রীতি সামাজিক প্রথারই অঙ্গ।(আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই অক্টোবর, ২০১৪)

গবেষক সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ক্ষয়িষ্ণু জনজাতি নিজেদের অস্তিত্বের সংকট থেকেই মেলা প্রাঙ্গণে দেবতাকে সাক্ষী রেখে জীবনসঙ্গী নির্বাচনের প্রথা চালু করেছিল বলে অনুমান। সম্ভবত সেই কারণেই এই মেলায় যুবক যুবতীর মধ্যে মেলামেশা ও পছন্দের স্বীকৃতি দেয় পরিবার।(আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ই অক্টোবর,২০১৪)

এ মেলা তাই ভালোবাসার মেলা। হৃদয়ের অনুভূতির মেলা। ভালোবাসাকে তারা কখনো পাপ বলে মনে করে না। ধামসা মাদলের বাজনায়, গানে গানে তাই দুইদিন ধরে চলে তাদের জীবনসঙ্গিনীর অনুসন্ধান।

বিপুল মানুষের সমাগম হলেও এই মেলা অদ্ভুতভাবে সমস্ত রকম প্রচারের আলো থেকে অনেকটাই দূরে। জঙ্গলমহলের কোলে একেবারেই নিভৃতে, নির্জন ভাবে নিজেদের মতো করেই আদিবাসীরা এই মিলনমেলায় অংশ নিয়ে চলেছেন বছরের পর বছর। যা তাদের সংস্কৃতিকে আরো বেশি মজবুত করে তুলছে। গত দুই বছর করোনার কারণে মেলা বন্ধ ছিল। এবছর পুনরায় চালু হয়েছে।

ছবি সংগ্রহ বিবেকানন্দ মাহাত

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments