জ্বলদর্চি

ঝর্ণা আচার্য্য ( সমাজকর্মী, লোক গবেষক )/ভাস্করব্রত পতি

মেদিনীপুরের মানুষ রতন, পর্ব -- ২৪

ঝর্ণা আচার্য্য ( সমাজকর্মী, লোক গবেষক )

ভাস্করব্রত পতি

প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর খাদ্য সুরক্ষা ও জীবন জীবিকার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে তিনি নিবেদিত প্রাণ। যেসব সরকারি Scheme চলে, সেগুলি সম্পর্কে মানুষকে বোঝানো তাঁর কাজ। সচেতন করা তাঁর লক্ষ্য। কোল (হো), আদিবাসী, ধিমাল, লোধা, কোল, খেড়িয়া, বৈগা, মুণ্ডা, শবরদের নিয়ে তাঁর কাজের পরিসর। মানুষের অধিকার পাইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার তাঁর মননে। 

ঝর্ণা আচার্য্য এমনই একটি নাম, যে নাম শুধু জঙ্গলমহল নয়, রাজ্য জুড়ে বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সলতে। তাঁর শিখায় আলোকিত হয় হকের অধিকার থেকে অপ্রাপ্তির মুখগুলো। অকৃতদার ঝর্ণা আদিবাসীদের গরাম থান থেকে জেলাশাসকের সামনের টেবিলে বসে নিরীহ মানুষের পাওনার জন্য ধর্ণা দিতে পারেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। মিছিলে স্লোগান তুলতে পারেন লোকঠকানো কারবারীদের বিরুদ্ধে। লক্ষ্য একটাই। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নির্ভেজাল মানুষের জীবনযাপনে নির্ভরযোগ্য এবং নির্ভেজাল সুরাহার আভাষ এনে দেওয়া।
পশ্চিম মেদিনীপুরের কেশিয়াড়ীর বিনন্দপুরে বাড়ি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর করেও চাকরি করেননি এইসব প্রান্তিক মানুষের পাশে থাকার তাগিদে। তাঁর কাজের নিরিখে 'মেদিনীপুর ছাত্র সমাজ' দিয়েছে 'সর্বপল্লী সম্মাননা' (২০১৮)। এছাড়া 'মেদিনীপুর কুইজ কেন্দ্র সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি'র পক্ষ থেকে পেয়েছেন "THE REAL HERO OF THE SOCIETY" সম্মান (২০১৯)। কোল সমাজ হায়াম সানাগম সোসাইটি (২০১৫), সংকল্প ফাউন্ডেশন (২০২১), সোনারপুর বইমেলা (২০১৬), হেল্পিং হ্যাণ্ড ওয়েলফেয়ার সোসাইটি (২০২০), সানন্দা টিভি (২০২১) থেকেও তাঁর কাজের নিরিখে পেয়েছেন সম্মান। যদিও তিনি পুরস্কার নেওয়ার পক্ষপাতি নয়। আড়ালে আবডালে থেকেই বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে বদ্ধপরিকর। মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়াই তাঁর কাছে বড় পুরস্কার।

লোকসংস্কৃতিকে ভালোবাসেন। আর এই কাজ করতে গিয়েই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় তারাপদ সাঁতরা, অধ্যাপক ড. পিনাকী নন্দন চৌধুরী, হরিপদ বানুয়া প্রমুখের সঙ্গে। গেঁয়ো মানুষের চলমান জীবনের সংস্কৃতির খোঁজে বেরিয়ে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন তাঁদের প্রতি এক শ্রেণীর মানুষের বঞ্চনা, অত্যাচার, অনাচার আর শোষন, শাষনের কষাঘাত। বুঝেছিলেন এঁদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। সবাই এঁদের ঠকিয়ে করেকম্মে খাচ্ছে। চির অন্ধকারে এঁদের দৈনন্দিন জীবন। 
১৯৯২ সালে লোকসংস্কৃতি বিষয়ে যখন ভারতের গ্রাম, হাট, মেলা নিয়ে কাজ করছিলেন তখন পশ্চিমবঙ্গের পাথরশিল্পীদের নিয়ে কাজ করেছেন ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলায়। গাছের তলায় পড়ে থাকা পথের দেবতা নিয়ে কাজ করেছেন। পশ্চিমবঙ্গের মেলা, উৎসব, লোকক্রীড়া নিয়ে অসাধারণ ক্ষেত্রসমীক্ষামূলক কাজ তিনি উপহার দিয়েছেন গবেষকদের। সম্প্রতি প্রকাশিত হতে চলেছে লোকক্রীড়া বিষয়ক উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থ। যা গবেষকদের কাছে আকর গ্রন্থ হয়ে উঠবে। ARCHAEOLOGICAL OLD MANUSCRIPT এর ওপর কাজ করেছেন এক সময়। তিলদাগঞ্জে যে খনন হয়েছিল সেখানে অংশগ্রহণ করেছিলেন তিনি। ১৯৯৪ সালে পিংলা কলেজ মিউজিয়াম গঠনেও তাঁর ভূমিকা ছিল। যদিও তার অস্তিত্ব আজ আর নেই বললেই চলে। তারাপদ সাঁতরার শিষ্যা হিসেবে নিজেকে মনে করেন। ১৯৯৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্রের অধীনে ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজ করেছেন। সাংবাদিকতাও করেছেন। জেলার বিভিন্ন ম্যাগাজিনে অসংখ্য গবেষণা মূলক লেখার স্থপতি জঙ্গলমহলের এই লড়াকু মহিলা।

আমলাশোল, কাঁকড়াঝোর, কানিমৌলি, বুদরাসাই ইত্যাদি গ্রামে লোকসংস্কৃতির রশদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখতে পেয়েছিলেন সেখানকার মানুষের দুরবস্থা। কিন্তু মনের মধ্যে সেদিন জমেছিল একরাশ যন্ত্রনা। এরপর ২০০৪ এ আমলাশোলের মানুষের অনাহারে মৃত্যুর খবর উঠে আসে লাইমলাইটে। তখন আর নিজেকে সামলাতে পারেননি। বিভিন্ন কমিটির সঙ্গে যুক্ত করেন লোধা শবর কল্যান সমিতিকে। শুরু করেন কাজ। খুঁজে পান এখানকার মানুষজনের প্রতি রেশন ডিলারদের প্রতারণার করুণ চিত্র। রেশন কার্ড, জব কার্ড থাকতো ডিলারদের কাছে। মিলতোনা প্রয়োজন মতো চাল গম। শুরু করেন আন্দোলন। প্রথমে শাঁকরাইল ব্লকে। তারপর জেলাজুড়ে ও রাজ্যজুড়ে এই দাবিকে সামনে রেখে লাগাতার আন্দোলন। সফলতা পেয়েছেন আন্দোলনের মাধ্যমে।

পশ্চিম মেদিনীপুরের নাচনী শিল্পীদের সংগঠিত করার আপ্রাণ চেষ্টা তাঁর। আসলে তিনি চেয়েছেন তাঁদের উন্নয়ন এবং বিকাশ ঘটুক। তাঁর হাত ধরেই ঝাড়গ্রামের সিন্ধুবালা, বিন্দুবালা, সনকা, সাঁকরাইলের যমুনা, বেলাদের নাম আজ লোকে জানতে পারছে। এঁদের ছিলনা রেশন কার্ড। তা করে দিয়েছেন সরকারের সহায়তায়। শিল্পীর মর্যাদা অর্জনে পাশে থেকেছেন এইসব নাচনী শিল্পীদের। এঁদের নিয়ে পুরুলিয়াতে গিয়ে মিছিল পর্যন্ত করেছেন শিল্পীর পরিচয় আদায়ের জন্য। একসময় বেলপাহাড়ির পাথরশিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায়। মাওবাদী সময়ে ধুঁকছিল এই শিল্প। ঢাঁইকুসুম, বীরমাদল, শিমূলপাল, কাশীডাঙ্গা গ্রামগুলিতে এখন পাথর শিল্পের কাজ চলছে। তিনিই উদ্যোগ নিয়ে শিল্পীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিভিন্ন মেলাতে সেইসব সামগ্রী নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। এই মুহূর্তে তিনি 'পাথর শিল্প ও শিল্পী উন্নয়ন সমিতি 'র কার্যকরী সভাপতি। পটুয়াদের উন্নয়নেও তিনি পাশে থেকেছেন বারবার। ইসমাইল চিত্রকর, গোপাল চিত্রকররা আজ শিল্পীর মর্যাদা পেয়েছেন ঝর্ণা আচার্য্যর সৌজন্যে। একসময় গঠন করেছেন 'লোকশিল্পী ও আদিবাসী শিল্পী সমন্বয় সমিতি'। সাতশোল গ্রামের লোধা চাং শিল্পীদের প্রথম ভাতা পাইয়ে দিয়েছিলেন তিনিই। আজ লোকপ্রসার প্রকল্পে হাজারের বেশি বৈগা, ভূমিজ, মুণ্ডা শিল্পীদের ভাতা পাচ্ছে গোপীবল্লভপুর, নয়াগ্রাম, কেশিয়াড়ী এলাকায়। প্রায় দু হাজার মানুষ কে পাইয়ে দিয়েছেন জমির পাট্টা। ঐসব এলাকায় তিনি যেন জঙ্গলের দেবী!

যেদিন থেকে মনের কোনে জেগে উঠেছিল এঁদের হয়ে লড়াইয়ের, সেদিন থেকে ঝর্ণা আচার্য্য নিজেকে ভাবতে শুরু করেন এইসব বঞ্চিত, প্রতারিত মানুষজনের 'অভিভাবক' হিসেবে। কত মানুষ তাঁদের যথার্থ সরকারি অনুদান প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত। অশিক্ষা, কুঃসংস্কার আর বঞ্চনার ত্রহ্যস্পর্ষে নিমজ্জমান জঙ্গুলে মানুষগুলোর সাথে মিলিয়ে দিলেন নিজেকে। সেই কাজের নিরিখে পরিচিত হন মহাশ্বেতা দেবী, মেধা পাটেকরদের সঙ্গে। একজন সাধারণ পরিবারের মহিলা হয়েও তিনি শুরু করেন লড়াই। আদিবাসী বনবাসীদের যথার্থ অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার লড়াই। হকের ধন ছিনিয়ে আনার লড়াই। মাথা তুলে বেঁচে থাকার লড়াই। 

গঠন করেছেন সারা বাংলা আদিবাসী উন্নয়ন মঞ্চ, পশ্চিমবঙ্গ লোধা শবর সমাজ, আদিবাসী বৈগা সমাজ উন্নয়ন সমিতি, পাথর শিল্প ও শিল্পী উন্নয়ন সমিতি। গঠন করেছিলেন "রাঙামাটি আদিবাসী ও তপশিলী উপজাতি উন্নয়ন সমিতি"। একসময় দক্ষিনবঙ্গ মৎসজীবী ফোরামের রাজ্য সহ সম্পাদক ছিলেন। এখন পশ্চিমবঙ্গ লোধা শবর সমাজের কার্যকরী সভাপতি পদে রয়েছেন। ২০০৫ থেকে এঁদের পাশে থেকেছেন তিনি। লালগড় ব্লকে ৩৬০ জন এবং গোপীবল্লভপুরে ১০২ জন লোধা শবর পায়নি অন্ত্যোদয় কার্ড। সেইসাথে লালগড়ের ১০ টি লোধা অধ্যুষিত গ্রামের জোটেনি লোধা তালিকাভুক্ত হওয়ার তকমা। ঝর্ণার লড়াই এঁদের জন্যেও। লালগড়ের ৩২০ টি শবর পরিবার খেড়িয়া স্বীকৃতি পেলেও অনেক সুবিধা থেকে এখনও বঞ্চিত। গোপীবল্লভপুর ১, ২ ব্লকের বহু শবর এখনও সুযোগ সুবিধা পাননি। এইসব PTG তথা Primitive Tribal Group দের জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বদের নিয়ে সরকারের সাথে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক তৈরি করাই তিনি বেছে নিয়েছেন জীবনের লক্ষ্য হিসেবে।

কাজের সূত্রে ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তাঁর সদর্প পদচারণা। তাঁর লাগাতর আন্দোলন এবং সক্রিয় সহযোগিতায় নয়াগ্রামের গোয়ালডিহা গ্রাম পঞ্চায়েতের কিছু অসৎ মানুষের মৌরুসীপাট্টা চুকিয়ে দিয়েছিলেন। রেশন কার্ড ও জব কার্ড দেওয়া হয়নি শবর, বৈগাদের। সেই আন্দোলনে যুক্তদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তখন শুরু হয় অনশন। এরপর সরকার বাধ্য হয় এঁদের রেশন কার্ড দিতে। ক্ষুদ্র মৎসজীবীদের পরিচয়পত্র পাইয়ে দিতে তিনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। সেইসাথে প্রাকৃতিক সম্পদের এবং অরন্যের অধিকার নিয়ে বনাধিকার গ্রামসভা গঠনে থাকছেন মানুষের সাথেই।

শুধু মেদিনীপুর নয়, পশ্চিম বর্ধমানের দুর্গাপুর ফরিদপুর ব্লকের ইছাপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে তিনি যৌথভাবে মানুষের জন্য লড়ছেন 'দিশম আদিবাসী গাঁওতা'র সঙ্গে। পুরুলিয়াতে যুক্ত হয়েছেন 'প্রকৃতি বাঁচাও আদিবাসী বাঁচাও মঞ্চ' র সাথে। এখানকার অযোধ্যা গ্রাম পঞ্চায়েতে এবং কাশীপুর ব্লকের আগরডি চিত্রা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় তিনি আন্দোলনে সামিল। গত দু বছর ধরে জাতীয় "রাষ্ট্রসেবা দল" এর রাজ্য সভাপতি পদে রয়েছেন তিনি। এ রাজ্যের ১০ টি জেলায় গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠায় তিনি উন্মুখ। বিশেষ করে দলিত, শিশু, মহিলা, আদিবাসী, মুসলিম অত্যাচারিত মানুষের পাশে থেকে তাঁদের বেঁচে থাকার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি প্রাকৃতিক সম্পদের সমবন্টনের অধিকার পাইয়ে দিতে তিনি জাগ্রত।
পশ্চিম মেদিনীপুরের গ্রাম, পাহাড়, জঙ্গলের সাথে থেকে পেয়েছেন সকলের সহযোগিতা এবং ভালোবাসা। মা মিনুরাণী এবং বাবা কাশীনাথই তাঁর কাজের অনুপ্রেরণা। কমিউনিজমে বিশ্বাসী পরিবার। ঝর্ণার কথায়, "আমার পরিবার বিশেষ করে বাপি (বাবা) ও মাকে জন্ম থেকেই দেখেছি মানুষের বিশেষত আর্থিক ও সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষের পাশে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে দাঁড়াতে। বাপি তাঁদের বঞ্চনা শোষনের বিরুদ্ধে সংগঠিত করে প্রতিবাদ ও সরকারের কাছে ডেপুটেশন দিয়ে আদায় করত। আর অন্য দিকে মা অসহায় দরিদ্র মানুষের মধ্যে নিজেদের খাদ্য বিলিয়ে দিত। আমার বাপি একটা রুটি ভাগ নেওয়ায় বিশ্বাস করতেন"।

সহজ সরল মেহনতি খেটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়ানোর রেওয়াজ সেই সূত্রেই পাওয়া। "ঝর্ণা" নামটি আজ তাই জঙ্গলমহলের সাথে মিলেমিশে একাকার। পাহাড়ী খরস্রোতা বহমান এক বিপ্লবী যেন এই ঝর্ণা। মেদিনীপুরের নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের স্বার্থে তাঁর জীবন যৌবন উৎসর্গ করেছেন। এমন 'মানুষ রতন' জেলায় পাওয়া দুষ্কর।

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments