জ্বলদর্চি

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী/ত্রয়োদশ পর্ব/দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

তানসেন - এক অসাধারণ সঙ্গীতশিল্পী               
ত্রয়োদশ পর্ব         
দেবী প্রসাদ ত্রিপাঠী

মালকোশ 

রাত্রিতে শোবার পরেই তাঁর ঘুম ধরে গেলো। হঠাৎ মধ্যরাত্রিতে ঘুম ভেঙে শুনতে পেলেন কে যেন মালকোশ রাগের করুন মূর্ছনায় হাভেলিকে ভরিয়ে তুলেছে। কিছুক্ষণ কান খাড়া করে রেখে বুঝতে পারলেন দ্বিতলের চত্বর থেকে রূপবতী এই রাগ গাইছে। কিছুক্ষণ পরে রাগ শেষ হল। গবাক্ষ দিয়ে চাঁদের আলো কক্ষে প্রবেশ করেছে এবং তাতে কক্ষটি আলো-আঁধারিতে পূর্ণ। তিনি পুনরায় শয্যায় নিদ্রা যাবার উপক্রম করতে যেয়ে দেখলেন উন্মুক্ত দরজার সামনে একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। 

তিনি বিছানা থেকে প্রশ্ন করলেন "এত রাত্রে কে তুমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছ"? তাঁর প্রশ্নের পরে দেখলেন দরজা দিয়ে শ্বেতশুভ্র বস্ত্র পরিহিতা অবগুণ্ঠনবতী রূপোয়াতী তাঁর কক্ষে প্রবেশ করে দরজা ভেজিয়ে দিল। গবাক্ষ পক্ষে চাঁদের আলো প্রবেশ করার তানসেনের দৃষ্টি গোচর হল রূপোয়াতীর পরিধানে স্বচ্ছ বস্ত্রের অভ্যন্তরে তার পরিপূর্ণ যুবতী শরীরের সমস্ত গিরি উপত্যকা। কোন এক অজানা আশঙ্কায় তার ভারী বক্ষ ওঠানামা করছে। তাকে তাঁর শয়ন কক্ষে এইবেশে প্রবেশ করতে দেখে তানসেন প্রশ্ন করলেন "এই নিশীথরাত্রে আমার কক্ষে তোমার একাকী প্রবেশ করা অনুচিত হয়েছে"। 

অবগুণ্ঠন মুক্ত হয়ে রূপোয়াতী বলল "এ সময়ে আপনার কক্ষে না এসে আমার কোনো উপায় ছিল না"।

তানসেন জিজ্ঞেস করলেন "বল, কি তোমার প্রয়োজন আমার কাছে"? 
রূপোয়াতী বলল "আপনি তো আগামীকাল সম্রাটের দরবারে দীপক রাগ গাইবেন বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু এছাড়া কি অন্য কোনো উপায় ছিল না? আপনি ভালভাবে জানেন যে এই দীপক রাগের প্রভাবে আপনার নিজের শরীর অগ্নিদগ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল"। 

তানসেন বললেন "জানি বলেই তো সরস্বতীকে এই কয়েকদিনে মেঘমল্লার রাগের তালিম দিয়ে তৈরি করেছি। সে আমার সঙ্গে আগামীকাল দরবারে যাবে"।    

"কিন্তু সরস্বতী তো মাত্র চোদ্দ বছরের কিশোরী। তার যদি মেঘমল্লার রাগ গাইতে কোন ভুল ত্রুটি হয় তাহলে কিভাবে আপনার জীবন রক্ষা হবে? চতুর্দশী স্বরস্বতীর বা আমার তারপরে কি হবে"? 

রূপোয়াতীর এই কথা শুনে তানসেন বললেন " হ্যাঁ সে চিন্তা আমারও আছে কিন্তু এ ছাড়া তো অন্য কোন রাস্তাই খোলা ছিল না"। 

"কেন আপনি যদি এখান থেকে আজ রাতের অন্ধকারে সম্রাটের অগোচরে চলে যেতেন"। 

রূপোয়াতীর কথায় তানসেন জিজ্ঞেস করলেন "কোথায় যাব?" 

তানসেনের কথার উত্তরে রূপোয়াতী বলল "আপনি সরস্বতীকে নিয়ে আমার সাথে রাজপুতানার মরু দেশে চলুন। সেখানে আমাকে নিয়ে ঘর বেঁধে আপনি আমাকে ও সরস্বতীকে সঙ্গীতের তালিম দেবেন। সঙ্গীতই হবে আমাদের ধ্যান-জ্ঞান। আমি আগ্রা দুর্গের প্রধান দ্বাররক্ষীকে বলে একটি অশ্বের ব্যবস্থা করেছি। প্রধান দ্বাররক্ষী আমার দেশের লোক সম্পর্কে দেশোয়ালি ভাই। আপনি সত্বর তৈরী হয়ে আমার সাথে চলুন"। 

এই কথায় তানসেন বললেন "দেখো ভীরুতা বা কাপুরুষতাকে জীবনে কখনো প্রশ্রয় দিতে শিখিনি, তাতে যেমন আমার অপযশত হবে অনুরূপভাবে আমার গুরুদেবের সম্মানহানি হবে। তাছাড়া তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার যে কথা বলছ সে কথা আমি মনেপ্রাণেও সায় দিতে পারছি না, কারণ আমি আমার স্ত্রীয়ের প্রতি দায়বদ্ধ। আমার পক্ষে তোমাকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এছাড়াও পালিয়ে গেলে কি সম্রাটের রোষানল থেকে বাঁচতে পারব আমরা? দীপক রাগে দগ্ধ হওয়ার চেয়ে সম্রাটের রোষানল আরো ভয়ঙ্কর। তুমি এই সমস্ত চিন্তা মন থেকে মুছে ফেল"। 

তানসেনের এই কথা শুনে করুন ভাবে রূপোয়াতী কক্ষ থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পূর্বে অস্ফুট স্বরে স্বগতোক্তি করল 'দেখি আমি একবার শেষ চেষ্টা করে। যাকে আমি মনেপ্রাণে গুরু ও দয়িতের আসনে স্থান দিয়েছি তাঁর জীবন রক্ষার দায়িত্ব আমারও'।                    

রূপোয়াতী চলে যাবার পরে তানসেন শয্যায় যেয়ে শুয়ে পড়লেন কিন্তু তাঁর চোখে আর নিদ্রার আবেশ আসছে না। তার শুধুই ক্ষণে ক্ষণে মনে আসছে রূপোয়াতীর যাবার সময়ের শেষের কথাগুলো 'দেখি আমি একবার শেষ চেষ্টা করে'। তাহলে কি তার মনে কোন গোপন ইচ্ছা আছে?  
                                                               ক্রমশঃ

 পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments