জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে -৪১/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৪১

আশেপাশে কোনো লোকালয় চোখে পড়ছে না। যতদূর দেখা যাচ্ছে, সবুজ মাঠ ছাড়া কিছু দেখতে পাচ্ছি না। পশুখামার থাকতে পারে,  কারণ দূরে একটা ষাঁড় চরতে দেখা যাচ্ছে। ব্ল্যাক স্মিথ সপ সেন্টারের মধ্যেই একজন স্কটিশদের ড্রেস পরে  (লাল,সবুজ,সাদা  চেকের স্কার্ট) ব্যাগপাইপার বাজাচ্ছেন। তাঁকেও ক্যামেরা বন্দি করলাম। একটা বিষয় বলা হয়নি, সেটা হল এই বাসের যাত্রীরা সবাই ভারতীয়, ইংল্যান্ডে বাস করেন কেউ, কেউবা দেশ থেকে আসা বাবা-মা বা স্ত্রী-ছেলেমেয়েকে  নিয়ে বেড়াতে  বেরিয়েছেন। কেউ বা ৬ মাস বা ২/১ বছরের জন্য এদেশে এসেছিলেন, দেশে ফেরার আগে ফ্যামিলি নিয়ে বেড়াতে বেরিয়েছেন। আমাদের মধ্যে  একটি পাকিস্তানী ফ্যামিলি রয়েছে। ওরা এদেশেই থাকে, যুবকটি ট্যাক্সি ড্রাইভার। ওদের ছোট্ট মেয়েদুটি খুব মিষ্টি দেখতে। ওদেরও ছবি তুললাম। ওরাও আমার সাথে ছবি তুলল।
    আমাদের আজকের যাত্রা শেষ হবে গ্লাসগোতে। ওখানেই ডিনার এবং রাত্রিবাস। গ্লাসগো পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। এত বড় শহর, বড় বড় বিল্ডিং, কিন্তু রবিবার বলে লোকজন চোখে পড়ছে না। এই সময়টাতে ওরা পাবে পানাহারে ব্যস্ত। বাস এসে দাঁড়াল শহরের বিখ্যাত এক ক্যাথিড্রাল চার্চের সামনে। এখনো চারিদিক রোদ ঝলমলে। ক্যামেরা হাতে আমরা সবাই নেমে পড়লাম। বাইরে কিছু ছবি তোলার পর চার্চের ভিতরে প্রবেশ করলাম। বহু প্রাচীন চার্চ। জানালার  কাচগুলিতে্  সুদৃশ্য নানারঙ্গের নকশা আঁকা রয়েছে। আরও অনেক কিছুই দেখার ছিল। কিন্তু পাঁচটা বেজে যাওয়াতে, আমাদের জানিয়ে দেওয়া হল, চার্চ বন্ধ করার সময় হয়ে গেছে। বেরিয়ে এসে আবার বাসে চড়লাম। বাস আমাদের নিয়ে ঘুমন্ত  নগরীর এদিক ওদিক ঘুরছে। আমাদের  আরও ২/১ জায়গায় যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পাঁচটা বেজে যাওয়ার কারণে তা আর হলনা। বাসে ঘুরতে ঘুরতে একটা নদী দেখলাম। নদীর ওপর খুব সুন্দর ব্রিজ রয়েছে। এখানে বেশিরভাগ শহরই নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। নটিংহামে রয়েছে কেন্টনদী, লন্ডনে টেমসনদী,  বেলফাস্টে শহরের বুকের ভিতর বয়ে চলেছে লগননদী। গ্লাসগোতে ক্লাইড নদী । বাস থেকে একটা রেস্টুরেন্ট দেখতে পেলাম, নাম কোহিনূর। এরপর আমরা হোটেলের সামনে নামলাম। বিশাল উঁচু এবং বড় হোটেল। আমাদের সঙ্গে একই ফ্লোরে তমালরা রুম পেলনা। যাইহোক,  স্নান সেরে আমি ও আর দুটি মেয়ে বাইরে রোদে পাতা বেঞ্চে বসে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। রোদ গায়ে লাগছে না। সবাই একসাথে ওই কোহিনূর রেস্টুরেন্টে ডিনার করতে যাব। মুম্বাইয়ের একটি মেয়ে আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলছিল। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওদের বাড়ির পাশে কয়েকটি বাঙালি পরিবার রয়েছে। তাদের কাছে ও বাংলা শিখেছে। 
                      ইতিমধ্যে গাইড এবং বাকি সবাই ডিনারে যাওয়ার জন্য হোটেলের বাইরে একত্রিত হয়েছেন। পায়ে হেঁটেই যাওয়া হবে। আমি খান সাহেবের সঙ্গ নিলাম। বাস থেকে দেখা কোহিনূর রেস্টুরেন্টেই আমাদের নিয়ে আসা হয়েছে। রেস্টুরেন্টের বাইরেটা একেবারেই চাকচিক্যহীন, কিন্তু ভিতরটা কোহিনূর মণির মতই জাজ্বল্যমান ।পানাহার, দুটিরই সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। ভেতরে ঢুকতেই বামদিকে বিভিন্ন ধরণের ড্রিংকসের বোতল আর গ্লাস সাজানো রয়েছে। আমাদের আগে যারা পৌঁছে ছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নারীপুরুষকে এখানে গ্লাসে চুমুক দিতে দেখছি। আমরা ভিতরের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেওয়ালে বড় বড় জয়পুরি পেন্টিং। স্নিগ্ধ আলোর নিচে সুন্দর করে টেবিল সাজানো রয়েছে। চেয়ারগুলিও বেশ নকশা করা। প্রত্যেকটা টেবিল কাঠের ফোডিং পার্টিশন দিয়ে ঘেরা। এখানেও খাবার নিজেকে নিয়ে খেতে হবে। খাবার নিতে গিয়ে দেখি একেবারে বাদশাহি আয়োজন। প্রথমে পকোড়া আর চাটনি নিলাম। প্রায় ৯/১০ রকমের পকোড়া রয়েছে। সব আইটেমই ৮/১০ রকমের রয়েছে। বিভিন্ন স্বাদের ভাত রয়েছে। বিভিন্ন পশুপাখির  মাংস রয়েছে। সেগুলি আবার বিভিন্ন জায়গার রেসিপি অনুযায়ী রান্না করা হয়েছে। কাশ্মীরি, হায়দ্রাবাদি, ইরানি, পাকিস্তানি, ইত্যাদি। চাপাটি ও নান রয়েছে বিভিন্ন স্বাদের। ডাল রয়েছে নানারকম, সবজি বলতে শুধু মাশরুম রয়েছে। আরও অনেক রকম খাবার দেখতে পাচ্ছি। সবকিছুর স্বাদ নেওয়াও সম্ভব নয়। এসব ছাড়াও অন্য একটি জায়গায় ফিরনি, কালজাম, কেক, সালাড দই ও বিভিন্ন ধরণের ফল রয়েছে। কয়েকটা আইটেম থেকে অল্প করে খাবার তুলে নিয়ে এসে বসলাম। সাহেব মেমরাও সপরিবারে এইসব মসলাদার খাবার খেতে এসেছেন। এঁদের জন্যই রান্নায় নুন ও ঝাল কম দেওয়া হয়। এরা ঝাল খায়না বললেই হয় আর নুন চিনি দুটি জিনিসই খুব কম খায়। আমাদের যেমন শিশুর জন্মের পর থেকেই চিনি মিশরি খাওয়ানো অভ্যাস করিয়ে দেওয়া হয়, এটা যে ভবিষ্যতে কতটা ক্ষতিকর হয়ে উঠবে তা আজও বেশিরভাগ মা ও পরিবারের মানুষজন বঝেন না। এখানে তা করা হয় না।
    যাইহোক, এখানে ডিনারের পর মুখসুদ্দিও পাওয়া গেল। ওরা সবাই আইসক্রিম খাচ্ছিলেন, আমি গলাব্যথার ভয়ে খাইনি। যা খেয়েছি তা খুবই সামান্য  হলেও, খাবার দেখে মন ভরে গেছে। বেরিয়ে আসার সময় কোহিনূরের বর্তমান মালিক ওয়াসিম খানের সঙ্গে আলাপ হল, এই রেস্টুরেন্ট ওনার বাবা রসুল খান তৈরি করেছিলেন। ওনাদের আদি বাসস্থান পাকিস্তানের অন্তর্গত পাঞ্জাবে।  হোটেলে ফিরে বাবলিকে ফোনে পেলাম। এর আগে বহুবার চেষ্টা করেও পাইনি। জারাটার জন্যই চিন্তা হচ্ছে। তবে বাবলি বলল, ওদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না। বকুলের সঙ্গে আজ কথা হয়নি। ছেলেটা যেন কেমন হয়ে গেছে। ওর জন্য মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয়। আকজন পুরুষের সফলতার পিছনে যেমন একজন নারীর ভুমিকা থাকে, তেমন একজন পুরুষের জীবনের সুখশান্তি নষ্ট হয়ে যাওয়ের পিছনেও একজন নারীরই ভূমিকা থাকে। 
      যেমনটা ভেবেছিলাম, সেরকম ঠাণ্ডা এখানে বোধ করছি না। তবে আগামীকাল আমাদের গন্তব্যস্থল এনভারনেস, ইউকের মানচিত্রে সবার অপরে এনভারনেস অবস্থিত। ওখানে ঠাণ্ডা বেশি হতে পারে। আগামিকাল আবার সকাল ৬ টাতে উঠতে হবে। কালকে পরার জন্য একখানা সাদার ওপর কাজকরা সিফন শাড়ি, ম্যাচিং উলের ব্লাউজ ও গহনা বের করে রেখে ঘুমোতে গেলাম। সকালে  চা বানিয়ে দুজনে খেলাম। তারপর স্নান সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে রেডি হলাম। ওনার খাবার নিতে ভুল্লাম না। লিফট আমাদের রেস্টুরেন্টে পৌঁছে দিল। হোটেলের প্রতিটি রুমেই ব্রেকফাস্টের সুদৃশ্য মেনুকার্ড রাখা আছে। তবে খাবার দেখেই খাব। খেলামও তাই। কিছুটা দই নিয়ে নিলাম। তারপর আবার রুমে গিয়ে ব্যাগ, স্যুটকেস নিয়ে নেমে এলাম। লিফটের মধ্যে একজন স্কটিশ মহিলা আমার ড্রেসের খুব প্রশংসা করলেন। আমরা বাসে উঠে বসে আছি। যথারীতি তমাল ও বনি সবার শেষে বাসে চড়েই আমার ড্রেস নিয়ে শুরু করল, কাকিমা, রোজ রোজ কী দিচ্ছেন? আজ একেবারে শাড়ি গহনা ম্যাচিং! আমি বললাম, এটা আমার নিজস্ব স্টাইল। রুজ-লিপ্সটিক পরিনা, তবে ম্যাচিং শাড়ি, গহনা ও তারসঙ্গে ম্যাচিং স্যান্ডেল, ব্যাগ ব্যবহার করতে ভালবাসি।
    সবাই বাসে উঠেছেন কিনা জেনে নিয়ে ড্রাইভার টনি বাসে স্টার্ট দিলেন। সবাই ক্যারিকেচারে ব্যস্ত। যথারীতি আমার মন ও চোখ জানালার কাচের বাইরে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ে মাঝে মাঝে আবছা হয়ে যাচ্ছে, পরক্ষণে আবার শুকিয়েও যাচ্ছে। গতকাল পাহাড়ের কোল দিয়ে বাস ছুটছিল।আজ আরও বেশি পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হবে। শহর ছাড়িয়ে বাস ছুটছে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। প্রায় ঘণ্টা দেড় পর গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে জল দেখতে পেলাম। ক্রমশ একটি লেক স্পষ্ট হয়ে উঠল। বাস লেকের পাড়ে একটা ফাঁকা যায়গায় দাঁড়াল। আমাদের গাইড নতুন, তাই উনি নেমে গিয়ে একটা ছোট্ট কাঠের ঘর ছিল, সেখানে খোঁজ নিয়ে এসে জানালেন, ওটি লঞ্চের টিকিট ঘর। ওখনে টয়লেটও আছে। আরও বললেন, আখানে লঞ্চে চড়তে হলে নিজেদের টিকিত কেটে চড়তে হবে। অত্যুৎসাহী কয়েকজন নিজেদের টাকায় টিকিট কেটে জলবিহারে গেলেন। এই লেকটির নাম ‘লেমণ্ড’। লেকের ওপাড়ে সবুজ পাহাড় দেখা যাচ্ছে। আমরা কয়েকজন জেটিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। এখানেও দুজন স্কটিশ মহিলা আমার ড্রেসের, মানে শাড়ির প্রশংসা করছিলেন। ওদের সঙ্গেও ছবি তুললাম। লেকের পাড়ে উঠেই গাইডের সামনে পড়তেই উনিও বললেন, এরকম সুন্দর ড্রেস কতগুলো নিয়ে এসেছেন? সেগুলো নিশ্চয় আপনার স্বামীকেই বহন করতে হয়েছে?
      লেকের পাড় বরাবর জঙ্গলের ভিতর পায়েচলা একটা রাস্তা চলে গেছে, তমাল বনি ওই পথে কোথায় গেল, কে জানে? আমি আর খান সাহেবও কিছুটা গিয়ে দেখলাম, অপ্রসস্থ একটি জলের স্রোত জঙ্গলের ভিতর থেকে গড়িয়ে এসে  লেকের জলে মিশেছে। সেইজলে একটি হাঁস কয়েকটা ছানাপোনা নিয়ে ভাসছে। দেখে কি ভাল লাগল! লেকে ভেসেছে যারা, তারা এখনো ফেরেননি। তাই আমরা কয়েকজন বেঞ্চে বসে আলাপ জমালাম। এক বয়স্ক মারাঠি দম্পতি জানালেন তাঁরা ৩৫ বছরেরও বেশি সময় লন্ডনে বাস করছেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন লন্ডন বেড়ানো হয়েছে কি না? কি কি দেখেছি? ইত্যাদি। কোহিনূর মণি দেখা  হয়নি  শুনে বললেন, লন্ডন গেলেন! অথচ কোহিনূর মণি দেখলেন না?

                                ক্রমশ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments