আষাঢ়ে গল্পের আল ধরে পর্ব ১৫
তন্দ্রা ভট্টাচার্য্য
"শুভ কর্ম পথে ধর নির্ভয় গান"
" আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে ভুলেছি নিজের ঘর, আমি এক যাযাবর"
ভূপেন হাজারিকার বিখ্যাত গান আমরা সবাই জানি। যাযাবরের পেশা নিয়ে কখনো ভেবেছেন?
যাযাবর সম্প্রদায়ের লোকদের নিজেদের কোনো আবাস ভূমি নেই। ভারতের মহারাষ্ট্র এবং রাজস্থানে এদের বেশি দেখা যায়। এই উপজাতিরা মূলত পশুপালন, বিভিন্ন রকম কবজ, তাবিজ, গাছের শেকড় বাকড়, পশুর চর্বিজাত তেল, চিনেমাটির জিনিস এসব বিক্রি করে। রাজস্থানে এদের কে জিপসি বলে। কেউ কেউ আছেন আধা যাযাবর, মানে বছরের কিছুটা সময় নিজের ঘরে কাটায় আর বাকিটা ভ্রাম্যমান জীবন কাটায়, হাতে গড়া বিভিন্ন সামগ্রী এরা বিক্রি করে। এদের মধ্যে বেদ, বেদেনী, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি দেখতে পাওয়া যায়। সাপ ধরা, খেলা দেখানো এদের অন্যতম পেশা। অনেক সময় বাঁদর এবং কালো ভল্লুক নিয়েও এরা ডুগডুগি বাজিয়ে খেলা দেখায়। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের balance এর খেলা বিখ্যাত মাদারিকা খেল এরাই তো দেখায়। দেখে খুব কষ্ট হয় খুব বিপজ্জনক খেলা এটি। একটি সরু দড়ির উপর লম্বা বেণী ওলা বাচ্চা মেয়েটি কত লোকের সামনে বিভিন্ন ধরনের balance এর খেলা দেখাচ্ছে। ওরও তো শৈশব আছে। আছে খেলার অধিকার, তা কিনা ঐটুকু বাচ্চা আমাদের মনোরঞ্জনে ব্যস্ত। হায়রে ভুখা পেট তোরে সেলাম।
বর্তমানে পেশা এবং নেশা দুই বদল হয়েছে। আগে দেখতাম প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়িতে আলতা পরাতে আসতো নাপিত বউ। মনে পড়ে গেল তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিখ্যাত গান " আলতা পায়ের আলতো ছোঁয়া পড়েছে "।
আমরা ছোটবেলায় যে স্কুল বক্স নিয়ে যেতাম ঠিক সেই রকম বাক্স করে শাঁখা, পলা, শঙ্খ, শাঁখের আংটি বিক্রি করতে আসত স্যাকরা।
গ্রামের মেয়ে বউ দের উজ্জ্বল মুখ গুলো দেখতে পেতাম। এসব তাদের জমানো পয়সা বরের পকেট কাটিং পয়সা থেকে তারা কিনত। তার একটা গোপন কারণ অবশ্য আছে ... বরকে শাঁখা বা সিঁদুর কেনার কথা নাকি বলতে নেই।
আর এক মজার পেশার কথা গ্রামে গঞ্জে দেখেছি বেশ মনে আছে। প্রায় অনেক বাড়িতেই বছরে একবার গুরুঠাকুর এবং গুরুমা আসতেন।
বললে হয়তো অবাক হবেন যেন রাজার মতো সেবা। গুরুঠাকুর তো গুরু মাকে সঙ্গে আনতেন। প্রায় এ বাড়ি তিনদিন তো ও বাড়ি দুদিন থাকতেন। প্রচুর লোক সমাগম হতো তিনি আবার কানে কানে মন্ত্র দিয়ে শিষ্য তৈরী করতেন। চলত নাম গান রামায়ণ, মহাভারত পাঠ, চন্ডীপাঠ,ভজন, কৃষ্ণকথা, ধর্ম কথা আলাপ আলোচনা।সারা বছর তাঁর ভ্রমণ লেগে থাকত। যাওয়ার সময় কত পোঁটলা পুটলি বেঁধে নিয়ে যেতেন।
আমি বেশ ছোট তবুও সে স্মৃতি আজও অম্লান আছে। সে গান আমার তেমন মনে নেই গাজীপীরের গান " "মুশকিল আসান হবে..." শুরু টা এটাই ছিল, অনেক বড় গান। দুজন মানুষ এক সঙ্গে গাইতেন চামর দুলিয়ে দুলিয়ে। আর সব শেষে আমার আর বোনের মাথায় চামর বুলিয়ে তিনবার ফুঁ দিতেন। আর মা চাল ডাল টাকা পয়সা দিতেন আমাকে হাত তুলে বলতেন নমো কর।
আপনারা কেউ কেউ নিশ্চয়ই বায়োস্কোপ দেখেছেন। টিনের কৌটের ঢাকনার মতো খুলে দিত আর সেইখানে চোখ রাখলেই দেখা যেত সিনেমা নায়ক নায়িকার ছবি। বা কোনো সিনেমার রঙচঙে দৃশ্য। এই পেশার মানুষ গুলো হারিয়েই গেল বলুন? সে সব এখন যেন ইতিহাসের গল্পকথা। আমাদের কিশোরীবেলায় দেখছি একজন রোগা কালো মতো মানুষ বাঁকে করে আনতেন মা শীতলা দেবীকে । মায়ের গায়ে যেন সিঁদুর মাখানো । এখন আর এসব মানুষদের দেখতে পাইনা।
এক ভদ্রলোকের কী noble নেশা ভাবুন! তিনি central government এ চাকরি করেন ।
তিনি রোজ রাত আটটা নাগাদ তাঁর এলাকার সমস্ত street dog দের রুটি খাওয়ান। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এর অন্যথা হয়না। আর একজন মানুষ কে জানি তিনি সবাই কে জল খাইয়ে বেড়ান সবাই তাঁকে জল বাবু বলে ডাকে। একজন আছেন পথে ঘাটে বৃক্ষরোপণ করে বেড়ান।
এক মিলিটারি অবসরপ্রাপ্ত অফিসার কে আমরা হ্যান্ডসেক দাদু বলতাম, তিনি অচেনা অজানা, কিংবা চেনা সবাইকে দেখলে নিজের হাতটি বাড়িয়ে দিতেন। সবাই করমর্দন করত।আমার ভারি মজা লাগত।
আর এক বাঁকুড়ার বয়স্ক ভদ্রলোকের একটা ভিডিও তে দেখেছিলাম তিনি বাজার, দোকান ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করেন এর বিনিময়ে কোনো টাকা নেননা। কিছু কিছু মানুষ আছেন নীরবে সমাজের উপকার করেন কোনো প্রত্যাশা ছাড়া।
রবিবার হলেই দেখতাম এক বৈষ্টম বৈষ্টমী বেশ মিষ্টি দেখতে দুজন কে, মাথায় তিলক কেটে জয় রাধে বলত । এরা আবার কারোর হাতে খান না।
তবে মা চা বা মিষ্টি দিলে ওদের সঙ্গে নারকেলের মালা থাকত তাতে খেত। ওরা নাকি স্বামী স্ত্রী নন একে অপরের সাধন সঙ্গী। কৃষ্ণ তো প্রেমের ঠাকুর তাই না?
আবার যদি বাউল কিংবা সুফীদের দের দেখা যায় ঈশ্বর বা আল্লাহর নাম গান গেয়ে বেড়ানো এক মাত্র পেশা ও নেশা। তবে এঁরা কেউ একা থাকেননা একত্রিত বা দলেই এঁরা থাকেন।
বাউল কিংবা বৈষ্ণব উভয় ক্ষেত্রে কিন্তু ভিক্ষা করা মাধুকরী নিয়মের মধ্যে পড়ে কারণ না হলে হাঁড়িতে চাল চাপবে না।
আমার সঙ্গে অনেক দিন পর টোকন হালদারের দেখা। আমি বললাম কী করছিস এখন? বললো " "দিদি চুলের ব্যবসা করছি " আমি ভাবলাম কী জানি কী হল গালাগাল দিচ্ছে নাকি? অবাক হয়ে বললাম পাগল তুই? বললো "না গো পাড়া পাড়া গাঁয়ে, গাঁয়ে ঘুরে চুল নিই বদলে স্টিলের জিনিস দিই"। ভাবুন কী অদ্ভুত পেশা মানুষের ? আমাদের রান্নামাসি চুল জমিয়ে নাকি অনেক বাসন কিনেছে।
এমন এক পেশার কথা শুনেছিলাম বৃদ্ধ বৃদ্ধা যাদের ছেলেমেয়ে বাইরে আছে তাঁরা দেশে একা থাকেন। খুব নিঃসঙ্গ জীবন। মাসে তিন হাজার টাকা নেয় একটি ছেলে সে ডাক্তার দেখাবে, বাজার ঘাট করে দেবে, সময়ে গল্পগুজব করবে, ভ্রমণেও সঙ্গ দেবে ঠিক যেন ছেলের substituted।
জীবনে অদ্ভুত নেশার কথা জানি একজন লোক সারজীবন কাঁচা সবজি খেয়ে কাটান। তিনি রান্না করা জিনিস খেতে পারেননা। প্রথমে শখে খেতেন তারপর অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আবার একজন নয় বেশ কয়েকজন আছে এরকম পোড়া মাটি খেয়ে থাকেন । একজনকে দেখেছিলাম টিভিতে তিনি আবার মাঝে মাঝে কাঁচ খেয়ে থাকেন .... ভীষণ অবিশ্বাস্য লেগেছিল। কাঁচ কী করে মানব দেহে হজম হবে? ডাক্তাররাই বলতে পারবেন। নদীয়ার শিমুরালির এক বয়স্কা ভদ্রমহিলা কে জানতাম তিনি কেবল লিকার চা খেয়েই বেঁচে আছেন। আর কিছু তিনি খান না, কী আশ্চর্য ভাবতে পারেন? এবার পুজোর সময় এক বৃদ্ধের দল কে দেখলাম হাঁ করে laptop এর দিকে তাকিয়ে আছেন সবাই। কারণ লটারির ফলাফল ঘোষণা হবে online এ। পরে শুনলাম এঁদের ভীষণ লটারির নেশা।
রুদালী এই এক আশ্চর্য পেশা রাজস্থানের লোকের। ভাড়া করা কাঁদুনি। মৃতের সামনে সুর করে কাঁদবে।
বিভিন্ন পার্কে যে সমস্ত রাইড আছে যেখানে কেউ না কেউ বমি করেন, মাথা ঘোরা ভার্টিগোর কারণে কিছু মানুষ আছেন যাদের কাজ বা পেশা হচ্ছে বমি পরিষ্কার করা। ভাবুন একবার বমি শুনলে কেমন গা ঘুলিয়ে ওঠে। আমাদের দেশে নয় বিদেশে এরকম পেশার লোক বহু দেখা যায়।
বহুরূপী ঠিক এঁরা নন, তবে এরা কোনো মেলা উৎসবে কখনও পশু কখনও মনীষী বা দেব দেবী সেজে থাকেন। একটুও নড়াচড়া করেননা ঘন্টার পর ঘন্টা সেজে এক ভাবে দাঁড়িয়ে বা বসে থাকেন।
আমি বহু বছর আগে একজনকে ধরে ছিলাম সে বারবার কাছা গলায় দিয়ে বলে পিতৃ বিয়োগ হয়েছে। আমার কাছে এসেছিল। প্রথম দুবার বুঝিনি তিনবারের বেলায় ধরেছি। স্বীকার করেছিল, এই পোশাকে দেখলে লোকে করুণা বশত ভিক্ষা দেয়।
ট্রেনে যে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেরা ঝাঁট দেয় সেটাও ওদের পেশা কিন্তু ঐ পয়সা তাদের মালিক কে দিয় দেয়। তখন মালিক ওদের রোজ টা দেয়, ওরা ডেনড্রাইটের আঠা কিনে নেশা করে। ছোট ছোট বাচ্চা এরাই পরে চোর গুন্ডা তে পরিণত হয়।
প্রবল জনসংখ্যার দেশ কে কার ভাত জোগাড় করবে?
দেশে ইএনটি ডাক্তার বা কানের ডাক্তার থাকতেও কিছু মানুষ কিন্তু এখনো সেই প্রাচীন পেশা নিয়ে আছেন কান সাফাইকারীরা। লোক বেঞ্চিতে বসবে আর সাফাইকারী তার ছোট্ট ব্যাগের যন্ত্রপাতি দিয়ে কান পরিষ্কার করে দেবে।
আর একটি পেশার কথা মনে পড়ল সব মাছের বাজারে গিয়েই দেখেছি একটি লোক একটি জল ভর্তি শিশিতে সর্না বা চিমটি করে মাছের কী যেন নিয়ে ঐ শিশিতে জমা করে। হয়তো মাছের প্রজনন এর জন্য লাগে।
শুনেছিলাম এটাই নাকি তার পেশা।
একবার ঝাড়খন্ড বা বিহারের রাস্তায় ঠিক কোথায় মনে নেই দেখেছিলাম ছুরি, কাঁচি, দা, কোঁদাল বিভিন্ন রকম কাটার জিনিস বিক্রি হচ্ছে। রাস্তার ধারে ছড়ানো অনেক দোকান এই সব লোহার অস্ত্রের । আসলে ফসল কাটতে লাগে। গম, ধান, ভুট্টা অনেক রকম ফসল হয় যে তাই হয়তো লাগে।
দীঘা,পুরীতে স্টিল ফটোগ্রাফার দের এখন সেই রমরমা ব্যবসাটা আর নেই। তবে সেই নুলিয়া পেশার লোকরা আছেন তারা তো থাকবেন জীবনের প্রয়োজনে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সুন্দরবনে যারা মধু সংগ্রহ করেন তাঁদের কথা একবার ভাবুন। অথচ আমরা ঠান্ডা মধু খেয়ে মধুর মধুর কথা বলি।
কাগজ কুড়ানী এবং ভাঙাচোরা, টিনালোহা বিক্রি করা মানুষ গুলো সারাদিন ময়লা ঘেঁটে নুন ভাতটুকু, ফেনভাত জোগাড় করতে তাদের কালঘাম চুটে যায়।
রক্ত বিক্রি করার পেশাও দেখেছি যেন চোখ গুলো ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। শরীরে কিছু নেই মানুষ গুলোর, ঠিক মতো খেতে পায়না। লেখক স্বপ্নময় চক্রবর্তীর এরকম একটা গল্পও পড়েছিলাম।
মহিলারা ডিম্বাণু বিক্রি করে এ পেশার এক মহিলার কথা শুনেছি। বউটি বলছে এই পেশার জন্য তার সংসারটা দাঁড়িয়ে গেল।
মহিলা সেক্স কর্মীদের কথা আমরা যেমন জানি তেমন পুরুষ সেক্স worker এর কথাও আমরা জানি।
হরিদ্বার এ গেলে এখনো জিনিয়ালজিস্ট দের দেখা যায়। আপনার পূর্বপুরুষের বা বংশের তালিকা নাকি এঁরা বের করে দেন।
কাকতাড়ুয়া কী কেবল খড়ের হয়? বিলাশবহুল বাড়ি বা হোটেল কিংবা বাগানে মানুষ কে স্কেয়ারক্রো সেজে থাকতে হয় এটাই তাদের পেশা।
পেশা আমার যাইহোক না কেন জীবনের জন্য অনেক কিছু করতেই হতে পারে। এখন সেই নবাব নেই আর আলসেখানাও নেই । তাই সৎ পথে আমাদের শ্রম করতে হবে । নিষ্ঠা এবং কর্মই আমার পরম দেবতা।
কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সেই বিখ্যাত কবিতা
কর্ম
যতীন্দ্রমোহন বাগচী
শক্তিমায়ের ভৃত্য মোরা-নিত্য খাটি নিত্য খাই, শক্ত বাহু,শক্ত চরণ,চিত্তে সাহস সর্বদাই। ক্ষুদ্র হউক,তুচ্ছ হউক,সর্ব শরম শঙ্কাহীন--- কর্ম মোদের ধর্ম বলি কর্ম করি রাত্রিদিন। চৌদ্দ পুরুষ নিঃস্ব মোদের- বিন্দু তাঁতের লজ্জা নাই, কর্ম মোদের রক্ষা করে,অর্ঘ্য সঁপি কর্মে তাই। সাধ্য যেমন, শক্তি যেমন,---তেমন অটল চেষ্টাতে দুঃখে সুখে হাস্যমুখে কর্ম করি নিষ্ঠাতে। কর্মে ক্ষুধার অন্ন জোগায়,কর্মে দেহে স্বাস্থ্য পাই, দুর্ভাবনায় শান্তি আনে- নির্ভাবনায় নিদ্রা যাই। তুচ্ছ পরিচর্যা গ্লানি--- মন্দভালো কোনটাকে--- নিদ্রা হাতে মুক্তি দিয়ে হাল্কা রাখে মনটাকে। পৃথ্বীমাতার পুত্র মোরা মৃত্তিকা তার শয্যা তাই; পুষ্পে-তৃণে বাসটি ছাওয়া, দীপ্তি হাওয়া ভগ্নীভাই। তৃপ্ত তারি শস্যে জলে ক্ষুৎপিপাসা দুঃসহ, মুক্ত মাঠে যুক্ত করে বন্দি তারেই প্রত্যহ।
0 Comments