জ্বলদর্চি

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা-৪৫/প্রীতম সেনগুপ্ত

পর্ব ৪৫

শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানেরা

প্রীতম সেনগুপ্ত

 নানা সময়ে লেখা রামকৃষ্ণানন্দজীর পত্রগুলি থেকে অমূল্যরতন সব পাওয়া যায়। যেমন ২৬-১২-১৮৯৫ তারিখের পত্রে তিনি গুরুভ্রাতা বাবুরাম মহারাজকে (স্বামী প্রেমানন্দ ) লিখছেন--“My dear Baburam,
গতকল্য হৃদয় মুখোপাধ্যায় মঠে আসিয়াছিলেন। আমি তাঁহার নিকট হইতে শ্রীশ্রীগুরুদেবের বৃন্দাবন দর্শন যাহা শুনিলাম তাহা যথাযথ লিখিতেছি। শ্রীশ্রীগুরুদেব প্রথমত মথুরায় নামিয়া ধ্রুবঘাট প্রভৃতি দর্শন করেন। পরে শ্রীশ্রীবৃন্দাবনে আসিয়া শ্রীশ্রীগোবিন্দজীর মন্দিরের নিকটবর্তী একটি বাড়িতে থাকেন। সঙ্গে মথুর, হৃদয় প্রভৃতি ছিলেন। তিনি সর্বদাই ভাবাবেশে থাকিতেন এক পাও হাঁটিতে পারিতেন না। পালকি করিয়া লইয়া যাইতে হইত। পালকির দ্বার খোলা থাকিত। তিনি দর্শন করিতে করিতে যাইতেন। যখন ভাবে অধীর হইয়া পালকি হইতে লাফাইয়া পড়িতে চাহিতেন তখন হৃদয় নিবারণ করিত। হৃদয় পালকির বাড় ধরিয়া যাইত। তিনি ঐরূপে হৃদয়ের সহিত শ্যামকুণ্ড ও রাধাকুণ্ড দর্শনে যান। মথুরবাবুর সঙ্গে যান নাই। পথে যাইতে যাইতে শ্বেতময়ূরের পাল তিনি অগ্রে দর্শন করেন ও হৃদয়কে দেখান এবং ভাবে অধীর হইয়া পালকি হইতে লাফাইয়া পড়িতে চান। পরে হরিণের দল দেখিয়া তাঁহার খুব ভাবোদয় হয়। তিনি শ্রীশ্রীরাধাকুণ্ড ও শ্রীশ্রীশ্যামকুণ্ড দর্শন করত তাহাদের সমীপবর্তী সমুদয় দেবালয়গুলি দর্শন করেন। মথুর প্রায় ১৫০ টাকার সিকি ও দু আনি বিতরণের জন্য হৃদয়ের হস্তে দিয়াছিল। তিনি সাধু, বৈষ্ণব দেখিলেই হৃদয়কে কিছু কিছু দিতে বলিতেন। পরে গোবর্ধন দর্শনে যান। তথায় উলঙ্গ হইয়া একেবারে গিরিরাজের উপর উঠিয়া পড়েন। পাণ্ডারা ধরিয়া নামাইয়া আনে। তৎপরে নিধুবনে গঙ্গামাতার নিকট যান। গঙ্গামাতা তাঁহাকে দর্শন করিয়াই চিনিতে পারেন। তিনি তাঁহার নিকট প্রায় ৬/৭ দিন ছিলেন। তাঁহার ভালোবাসায় এমন আকৃষ্ট হইয়াছিলেন যে গঙ্গামাতার নিকট হইতে আসিতে চান নাই। শেষে মথুরবাবু ইহা শুনিয়া হৃদয়কে কহে যে তুমি যে কোন উপায়েই পার গঙ্গামাতার নিকট হইতে তাঁহাকে লইয়া আইস। আমরা উহাকে ছাড়িয়া কিরূপে শূন্য হৃদয়ে বাড়ি ফিরিব?

 হৃদয় তদনুসারে গঙ্গামাতা ও তাঁহার একান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিধুবন হইতে লইয়া আসে। সে সময়ে গঙ্গামাতা উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছিলেন। এইরূপে তাঁহার বৃন্দাবন দর্শন শেষ হইলে তিনি মথুরের সহিত মথুরায় ফিরিয়া আসেন ও তৎপরে কলকাতার দিকে প্রত্যাগমন করেন। তিনি বৃন্দাবনে ভেক গ্রহণ করিয়াছিলেন। তদ্বিষয়ে পরে লিখিব। ইতি
                                                               দাস শশী”

পরবর্তী পত্রে বাবুরাম মহারাজকে শ্রীশ্রীঠাকুরের ভেক গ্রহণ প্রসঙ্গে এইরূপ জানাচ্ছেন --“ শ্রীশ্রীগুরু মহারাজ রাধাকুণ্ডের নিকটবর্তী চতুরা পাণ্ডা নামে একজনের নিকট ভেক গ্রহণ করেছিলেন।  বৃন্দাবন দর্শনের সময় তাঁহার হাতে সর্বদাই একটি কাঁচা কঞ্চির ছড়ি থাকিত। তাহা যদি হৃদয় কখনও কাড়িয়া লইত তিনি তাহাতে অতিশয় কাতর হইতেন এবং যতক্ষণ না ফিরিয়া পাইতেন ততক্ষণ স্থির হইতেন না -- এক পাও হাঁটিতে পারিতেন না -- এমন কি পালকির ভিতর বসিয়া যমুনায় স্নান করিতেন!”
 স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী মহারাজের পত্রাবলী মাদ্রাজ রামকৃষ্ণ মঠ সংগ্রহ করে একটি ছোট পুস্তিকাকারে প্রকাশ  করেছিল ১৯২৭ সালে। পুস্তিকাটির নাম ‘CONSOLATIONS’। পুস্তিকাটিতে শুধুমাত্র নির্বাচিত অংশ আছে -- কাকে কোন্ সালে তিনি লিখেছিলেন সে-সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ নেই। এই পুস্তিকাটির পুরো বাংলা অনুবাদ ‘উদ্বোধন’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। নাম ছিল “রামকৃষ্ণানন্দের পত্র সংকলন”। এই সংকলন থেকে কিছু অংশ এখানে তুলে দেওয়া হল। অধ্যাত্মপিপাসু পাঠকের কাছে যা পরম সম্পদ। একটি পত্রে তিনি লিখছেন -- “তুমি জানতে চেয়েছ -- এই ভব-বন্ধন থেকে কিভাবে মুক্ত হওয়া যায়? এর উত্তর তোমাকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জন্ম-জন্মান্তরের প্রারব্ধের ফল একদিনেই কাটানো যায় না। তুমি অবশ্য ঠিকই বলেছ যে, আমাদের কর্তব্য এই মুহূর্তেই সংসার-পাশ থেকে মুক্ত হওয়া। কারণ কে জানে কখন মৃত্যু এসে প্রিয়জনের স্নেহ-ভালোবাসার আলিঙ্গন থেকে আমাদের ছিনিয়ে নিয়ে যাবে? কিন্তু তার মানে এই নয় যে, এই জন্মেই আমাদের হঠাৎ করে একটা সংকল্প করে বসতে হবে। সাফল্য লাভের শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে -- শ্রীভগবান দয়া করে আমাদের যে অবস্থায় রেখেছেন তাতেই সন্তুষ্ট থাকা। সেই সঙ্গে তোমার মনকে সর্বদাই তাঁতেই নিমগ্ন রাখতে হবে -- যেমন শিশু তার মা-বাপের মুখের দিকে সর্বদা তাকিয়ে থাকে সাহায্যের জন্য। প্রভু দয়া করে যেখানে রেখেছেন, সেখানে শান্তিতে থেকে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী পাঠ করে সেগুলির অনুধ্যান কর। তাঁর কথায় ‘চারাগাছকে সযত্নে বেড়া দিয়ে ঘিরে রক্ষা করতে হয়, যাতে ছাগল মুড়িয়ে না দেয়। কিন্তু চারাগাছটা বড় হয়ে গেলে শত শত ছাগল তার ছড়িয়ে পড়া ডালপালার তলায় আশ্রয় নিতে পারে।’ তাই সৌভাগ্যক্রমে কারো মনে যদি বিশ্বাস ত্যাগের ভাব একটুও অঙ্কুরিত হয়ে ওঠে, তাহলে বিষয়ীদের সংসর্গ এড়িয়ে তাকে বিশেষ যত্নে সংরক্ষণ ও পরিপুষ্ট করা একান্ত কর্তব্য। তারপর অন্তরে সেটির মূল যখন দৃঢ়বদ্ধ হবে, তখন তাকে নড়াবার সাধ্য আর কারো হবে না।” ( স্বামীরামকৃষ্ণানন্দের স্মৃতিমালা, পত্র ও রচনাসংগ্রহ, স্বামী চেতনানন্দ ও স্বামী বিমলাত্মানন্দ সম্পাদিত ও সংকলিত, উদ্বোধন কার্যালয় ) 
 শশী মহারাজ আধ্যাত্মিক সাম্রাজ্যের বেতাজ বাদশা (অধ্যাপক বিনয় সরকার যাকে Ramakrishna empire বলে অভিহিত করেছেন ) শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের অন্তরঙ্গ পার্ষদ। যে তরুণ সন্ন্যসী দলের বীজ প্রোথিত করেছিলেন ঠাকুর তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। শ্রীরামকৃষ্ণ জানতেন তাঁর একান্ত প্রিয় নরেন্দ্রনাথের নেতৃত্বে এইসব শুদ্ধসত্ত্বের দল এক আধ্যাত্মিক বিস্ফোরণে সমগ্র বিশ্ব আলোড়িত করবে। রামকৃষ্ণানন্দজী তাঁর জীবন দিয়ে নেতা নরেন্দ্রনাথের আদেশ পালন করছিলেন, দাক্ষিণাত্যে ঘটিয়েছিলেন রামকৃষ্ণ বিপ্লব। দধীচির মতো মৃত্যুবরণ তাঁর। সেও এক ইতিহাস! পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা সেই বিষয়ে আলোচনা করব, দেখব কী অসাধারণ আত্মোৎসর্গতার ইতিহাস! বরানগর মঠে সেই জীবনদানের ভিত্তি নির্মিত হয়েছিল নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে। শরৎ-শশী দুই ভাইকে ‘ঋষি-কৃষ্ণে’র ( যিশু খ্রিস্ট ) দলে ভাবচক্ষে দেখেছিলেন ঠাকুর। নিষ্ঠুর মানুষের হাতে যেভাবে ক্রুশবিদ্ধ হয়েছিলেন যিশু, সহ্য করেছিলেন অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, মানুষের কল্যাণার্থে সেই যন্ত্রণাই ভোগ করেছিলেন স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ। রামকৃষ্ণ আন্দোলন তো বটেই, সমগ্র জগতের ইতিহাসে যা অবিস্মরণীয়।

 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments