জ্বলদর্চি

দূরদেশের লোকগল্প—দক্ষিণ আমেরিকা (ব্রাজিল) /রাজার সাথে মস্করা /চিন্ময় দাশ

দূরদেশের লোকগল্প—দক্ষিণ আমেরিকা (ব্রাজিল) 
রাজার সাথে মস্করা

চিন্ময় দাশ


চিরকাল বানরের স্বভাব ভারি বদ। বদমায়েসি করবার সুযোগ পেলে, কিছুতেই ছাড়ে না তারা। আর বানরটা যদি কম বয়েসি হয়? তাহলে তো কথাই নাই। যাকে বলে—একেবারে সোনায় সোহাগা। 
একবার এক মা-বানর এক বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল। খাবার-দাবার কিছু পাওয়া যায় কি না, সেই খোঁজে। সেদিন তেমন কিছু জোটেনি তার কপালে। এঘর ওঘর করতে করতে, হঠাৎ একটা গিটার চোখে পড়ে গিয়েছিল তার। কী আনন্দ তখন তার! গিটারটা তুলে নিয়ে সরে পড়েছে সেখান থেকে। 
ডেরায় ফিরে, ছেলেকে বলল—সারা দিন তো টোটো করে ঘুরে বেড়াও। আজ থেকে তার বদলে, গিটারটা শেখো মন দিয়ে। ভালো করে বাজাতে পারলে, নাম হবে খুব। সাবাশি দেবে সবাই। 
সাবাশি-টাবাশি মাথাতেই ঢুকল না তার বানরটার। গিটার হাতে পেয়েই সে দারুণ খুশি। সারা তল্লাটে এমন জিনিষ আর কারও আছে না কি? 
সেদিন থেকে তার দেমাক দেখে কে? সারা দিন টুং-টাং আর টুং-টাং। এ গাছ ও গাছ। বনের এ মাথা ও মাথা। ঘুরেই বেড়াচ্ছে। আর সেই টুং-টাং বাজনা। 
এক দিন সকালের ঘটনা। একটা ঝাঁকড়া আমগাছের ডালে বসে আছে বানরটা। বাঘ বেরিয়েছে তার ডেরা থেকে। উপর থেকে বানর দেখতে পেয়েছে বাঘকে। অমনি বদবুদ্ধি চেপে বসল তার মাথায়। রাজার সাথে মজা করবার সুযোগ ছাড়া যায় নাকি? 
গিটার বাজাতে লাগল। আর ছড়া কাটতে লাগল জোর গলায়— 
ট্যাং-টুং টুং-ট্যাং।
ভাঙব আমি রাজার ঠ্যাং।
বানর তো জোর গলাতেই ছড়া কেটেছে। বাঘ শুনতেও পেয়েছে ঠিকঠাক। উপরে বানরটাকে দেখল চোখ তুলে। ভয়ানক মাথা গরম হয়ে গেল বাঘের। গরগর করে উঠল রাগে—এত আস্পদ্দা তোর? নেমে আয় হতভাগা। দেখাচ্ছি মজা। কে কার ঠ্যাং ভাঙে, এক্ষুনি দেখিয়ে দেব। 
রাগের চোটে মাটিতে লেজ আছড়াচ্ছে বাঘ। তা দেখে, বানরটার মনে সে কী আনন্দ। স্বয়ং রাজাকে রাগানো, চাট্টিখানি কথা না কি? ভারি মজা লাগল তার। গিটার বাজাতে লাগল টুং-টাং করে। মুখে নতুন ছড়া--  
রাজা গিয়েছে ক্ষেপে।
গিটার বাজাই মেপে।।
বাঘের তো মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড়। বাঘ যত রেগে যায়, বানর তত ছড়া কাটে। খানিক বাদে ভাবল, রাজামশাইকে একটু দৌড় করানো যাক। দেখতে ভারি মজা লাগবে।
হঠাত ঝুপ করে এক লাফ। পড়ল এসে বাঘের একেবারে সামনেটায়। বাঘ ঝাঁপ দিয়েছে বানরটাকে ধরবে বলে। অমনি সুড়ুত করে সামনের গাছটায় উঠে পড়ল বানর। বাঘ এসে ফোঁস-ফোঁস করতে লাগল গাছের নীচে।
এভাবে একবার মাটি একবার গাছ, নীচ উপর উপর নীচ, কিছুক্ষণ চলবার পর, আচমকা এক বিপদ। খেয়াল করেনি বানরটা, নীচে নেমে পড়েছে। কিন্তু কাছাকাছি কোন গাছ নাই। বাঘও তখন এসে পড়েছে একেবারে ঘাড়ের ওপর। ধরে ফেলল বলে। 
বরাতজোর বলতে হবে। হঠাৎই একটা গর্ত দেখতে পেয়ে গেল বানর। সুড়ুত করে সেটাতে ঢুকে পড়ল পড়ি কি মরি করে।
বাঘও এসে পড়েছে গর্তটার সামনে। কিন্তু ভেতরে সে  ঢুকবে কী করে? যদি একটা ঠ্যাং অন্তত ধরা যায়, টেনে বের করে আনা যাবে। এই ভেবে গর্তে থাবা ঢুকিয়ে দিয়েছে বাঘ। পেয়েও গিয়েছে নাগাল। খপ করে বানরের একটা পা ধরে ফেলল।
বানরের তো ভিরমি লাগার জোগাড়! সর্বনাশ। এবার কী হবে? টেনে বের করতে পারলে, ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে একেবারে। সাথে সাথে ভাবল, একটু মাথা খাটানো যাক। যদি কাজে লেগে যায়, বেঁচে যাওয়া যাবে।   
পা না ধরে, ধরল লাঠি—
রাজামশাইর মগজ এমন।
হিহি হিহি। হিহি হিহি
বুদ্ধু কেমন বুদ্ধু কেমন।।
বাঘেরও কানে গিয়েছে কথাগুলো। ভুল শুধরে, পা ধরবে ভাবল সে। যেই না থাবা একটু আলগা করেছে, অমনি বানরটা ছিটকে উঠে, আরও ভিতর দিকে সেঁধিয়ে গেল। ভিতর থেকেই চেঁচিয়ে বলল--  
আমার কথায় বোকা ব’নে
পা ছাড়ল রাজামশাই।
বরাত জোরে বেঁচে গেলাম
কী চাই আমার, আর কী চাই?
বরাতের জোরই বলতে হবে। বানর বেশ বুঝতে পেরেছে, তাকে না শায়েস্তা করে, এক পাও নড়বে না বাঘ। কিন্তু ভিতরেই বা কতক্ষণ বসে থাকা যাবে? এক সময় না এক সময় বেরোতেই তো হবে। খুঁজে খুঁজে গর্তটার অন্য একটা মুখ পেয়ে গেল বানর। আসলে, গর্তটা শেয়ালের। সব সময় একটার বেশি মুখ থাকে তাদের গর্তে।
এদিক ওদিক দেখে নিয়ে, সেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়ল বানর। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ঝাঁকড়া একটা গাছের একেবারে মগডালে পৌঁছে, বাঁচল হাঁফ ছেড়ে। 
সেবারের মত তো বেঁচে গিয়েছিল বানর। বিপদ এল মাস কয়েক পর। যখন গরম কাল এলো। মাঠ-ঘাট সব ফুটিফাটা। খালে-বিলে জল নাই কোথাও। ফি-বছরই হয় এমনটা। 
কিন্তু জল না হলে কারও চলে না। জল তো পেতেই হবে। গোটা বনের মধ্যে একটাই পুকুর সেখানে। জল থাকে কেবল সেই পুকুরটাতেই। বনের সব জীবকেই জল খেতে যেতে হয় পুকুরটাতে। বানরকেও যেতে হবে। 
এবার ভয় করতে লাগল বানর। পুকুরে গেলে যদি বাঘের সামনে পড়ে যায়। তখন বাঁচবে কী করে? 
এদিকে বাঘও ছিল এই গরমকালের অপেক্ষায়। গাছের মাথায় মাথায় লাফিয়ে, শেয়ালের গর্তে ঢুকে, অনেক হয়রাণ করেছে হতচ্ছাড়াটা। এবার জলে চুবিয়ে মারব ব্যাটাকে। আসুক  একবা্র এদিকে। তক্কে তক্কে থাকে বাঘ।
বানরটা একদিন পুকুরের কাছাকাছি হয়েছে, দেখতে পেয়ে গেল, বাঘ বসে আছে পুকুর পাড়ে। অমনি ঝড়ের বেগে সরে পড়ল সেখান থেকে। 
কিন্তু কতদিন আর সরে থাকা যায়? এবার পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ। বুক ধড়ফড় শুরু হয়ে যাচ্ছে। জল না হলে, বাঁচাই দায়। বানর ভাবল, কিছু একটা ফন্দি বার করতেই হবে। নইলে, আজই মারা পড়তে হবে। 
করল কী, একেবারে মড়ার মতটি হয়ে, রাস্তার উপর পড়ে রইল বানর। কতক্ষণ বাদে, এক বুড়ি যাচ্ছিল সেই পথে। মাথায় একটা ঝুড়ি। বানরটাকে মরে পড়ে থাকতে দেখে, মনে ভারি আহ্লাদ হোল বুড়ির। দারুণ ব্যাপার তো! সুন্দর এক জোড়া দস্তানা বানানো যাবে বানরটার চামড়া দিয়ে। বানরটাকে তুলে, ঝুড়ির একধারে রেখে দিল। 
ঝুড়ি মাথায় নিয়ে বুড়ি চলেছে। এবার মিট্মিট করে চোখ খুলল বানর। ঝুড়ির ভিতর ঢাকনা দেওয়া ডেকচি ছিল একটা। আলতো করে ঢাকনা তুলে, বানর অবাক! আধ ডেকচি টাটকা মধু নিয়ে চলেছে বুড়ি। এবার মধু দেখে, বানরের মনে আহ্লাদ। 
দু’হাতে তুলে তুলে সারা গায়ে মুখে মধু মেখে নিল বানর। ঘন লোম তার গায়ে। তাতে একেবারে আঠার মত লেপটে রইল মধু। বুড়ি চলেছে মনের আনন্দে। বানরের কীর্তিকলাপ টেরটিও পায়নি কিছু। 
চলতে চলতে এক জায়গায় একটা গাছের তলা দিয়ে যাচ্ছে বুড়ি। হাত বাড়িয়ে টুক একটা ডাল ধরে ঝুলে পড়ল বানর। বুড়ি কিছু বুঝতেই পারেনি। 
তখন সে কী আনন্দ বানরের মনে। এখন তো গিটার নাই হাতে। নিজের মনে ছড়া কাটতে লাগল—
ঝুড়ি ছিল বুড়ির মাথায়।
বানর গায়ে মধু মাখায়।
বুড়ি চলল ঘরে।
আমি পড়লাম সরে।
এদিকে পিপাসায় তো প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। হঠাৎই মাথাটা চিড়িক করে উঠল। একটা ফন্দি এসে গেল মাথায়। 
যে গাছে উঠে পড়েছিল, সেই গছের পাতা ছিঁড়ে ছিঁড়ে নিজের গায়ে চেটাতে লেগে গেল বানর। মধুর আঠায় বেশ ভালোভাবেই সেঁটে যাচ্ছে পাতাগুলো। তাতে বানরের মনে বেশ ফুর্তি। সারা গায়ে পাতা জড়িয়ে নেমে এলো গাছ থেকে। এখন অদ্ভূত রকম এক প্রাণীর চেহারা হয়েছে তার। সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করল না বানর। ছদ্মবেশ নিতে পেরেছে, এতেই তার ফুর্তি ধরে না।
নিজেকে সবুজ রঙের একটা সজারু সাজিয়েছে, এই ভেবে, বেশ হেলতে দুলতে পুকুর পাড়ে গিয়ে হাজির। চোখ টেরা করে, দেখে নিল, খানিক দূরে বাঘ বসে আছে ওৎ পেতে। বেশ পুলকিত মনে জল খেতে লাগল বানর। খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। যতটা বেশি পারা যায় জল খেয়ে নিচ্ছে। 
পেটে যখন আর এক্টুও জায়গা নাই, তখন থামল তার অবাক জলপান। মনে তখন কী শান্তি কী শান্তি! এবার ভাবল, গরমের দিন। শরীরটা একটু ঠান্ডা করে নেওয়া যাক। বাঘ যখন চিনে উঠতে পারেনি। একটু আয়েস করে নিতে দোষ কী? গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে রইল জলে। 
শরীর জুড়লো যখন, হেলে দুলে উঠে এলো পুকুর থেকে। অমনি ঠকঠক করে বুক কেঁপে উঠল। জলে ধুয়ে, কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে গায়ের মধু। পাতার আবরণ পুরো উধাও। সব খসে পড়ে গিয়েছে গা থেকে। যেই বানরকে সেই বানর! ছদ্মবেশ উধাও। এদিকে সামান্য তফাতেই সাক্ষাৎ যমদূত বসে আছে ওৎ পেতে। 
বাঘও দেখে ফেলেছে বানরকে। আবার তাকে ধোঁকা দিয়েছে শয়তানটা! বিশাল এক গর্জনে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠল—হালুম! 
বানরের তো প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়। বেদম ভয়ে  সেও দিয়েছে এক লাফ। কোন রকমে একটা গাছে চড়ে বসেছে বেচারা। বেঁচে গেছে যমের হাত থেকে। 
বাঘ তো রাগে ফুঁসছে। আর গাছের তলায় লেজ আছড়াচ্ছে মাটিতে। দেখে, বেশ কৌতুক হোল বানরের। কেমন নাস্তানাবুদ হচ্ছে রাজা। কিচ্ছুটি করতে পারছে না তার। 
গাছে বসে আছে, আর ছড়া কাটছে বানর—
রাজামশাই বোকা।
দিলাম কেমন ধোঁকা।।
লেজ উঁচিয়ে ঘরে যাই।
রাজার মাথায় মগজ নাই।।
      তখন থেকেই বাঘে আর বানরে ভারি বৈরি ভাব। বাঘ তক্কে তক্কে থাকে বানরকে পাকড়াও করবে বলে। আর, বানরেরাও পারতপক্ষে বাঘের ত্রিসীমানায় আসে না।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments