জ্বলদর্চি

আভড়াপুনেই /ভাস্করব্রত পতি

পশ্চিমবঙ্গের লৌকিক উৎসব, পর্ব -- ৪৮

আভড়াপুনেই

ভাস্করব্রত পতি 

'আভড়াপুনেই' অর্থাৎ অবিবাহিতদের পূর্ণিমা। আশ্বিন মাসে কোজাগরী পূর্ণিমাতে লক্ষ্মীপূজার দিন দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তবাংলার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে সুবর্ণরেখার পাড় বরাবর পালন করা হয় এই 'আভড়াপুণেই' বা 'অব্যূঢ়া পূর্ণিমা' বা 'অব্যুঢ়া ব্রত'। ঝাড়গ্রাম, বাঁকুড়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পুরুলিয়ার প্রান্তিক এলাকায় শিশু বয়স থেকে ষোলো বছর বয়স পর্যন্ত ছেলে মেয়েদের জন্য নির্ধারিত এই উৎসব।

অব্যূঢ় (অপসারিত) > আবড়া > আভড়া > আইবুড়ো ( সংস্কৃত শব্দ 'ব্যূঢ়' অর্থে বিবাহিত)
অব্যূঢ় অর্থে অবিবাহিত বা আইবুড়ো। ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের 'পারিবারিক প্রবন্ধ'তে আছে, "মনুষ্যে অব্যূঢ় জড় পদার্থের ধর্ম্ম, উদ্ভিদের ধর্ম্ম, পশুর ধর্ম্ম এবং মনুষ্যের ধর্ম্ম, এই চারিটি ধর্ম্মই একত্র মিলিত"। 'পুনেই' অর্থে পূর্ণিমা। আভড়াদের মঙ্গলার্থে যে পূর্ণিমা, সেটাই 'আভড়াপুনেই'।

'কোজাগর' অর্থে দ্যূতপূর্ণিমা বা লক্ষ্মীপূর্ণিমা। 'তিথ্যাদিতত্ত্ব'তে লক্ষ্মী বলেন, এই পূর্ণিমায় যে জাগে তাহাকে ধন দিব। এই তিথিতে অক্ষক্রীড়া - নারিকেলজল - পান - চিপিটক ভক্ষণ বিহিত। 'দাশরথী রায়ের পাঁচালী'তে (১৩০৯) পাই "ঘুমে লক্ষ্মী হন বিরূপা, জাগরণে লক্ষ্মীর কৃপা, নৈলে কেন জাগে কোজাগরে"। আর পূর্ণিমার চাঁদ হলো পূর্ণশশী। কোজাগরীতে পূর্ণাবয়ব চাঁদ আকাশে ওঠে। আর তাই এই দিনে এই 'আভড়াপুনেই' পালিত হয় চাঁদের মতো চাঁদপানা মুখের জীবনসঙ্গীর কামনায়। 

পশ্চিমবঙ্গের এই লৌকিক উৎসবটি অবিবাহিত ছেলে মেয়েদের জন্য করা হয়। পার্শ্ববর্তী রাজ্য ওড়িশার 'কুমার পূর্ণিমা'র আদলে আয়োজিত হয় 'আভড়াপুনেই'। ওড়িয়া সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটেছে এখানে। কালক্রমে যা হয়ে উঠেছে বাঙালির নিজস্ব একটি লৌকিক উৎসব। 

এদিন সকালে স্নানপর্ব সেরে নতুন পোশাক পরানো হয়। যাঁদের পোশাক দেওয়ার সামর্থ্য নেই তাঁদের ক্ষেত্রে নতুন ঘুনশী কোমরে পরানো হয়। এরপর বাড়ির মা স্থানীয় মহিলারা অবিবাহিত সন্তানের মঙ্গলকামনায় কপালে চন্দনের মঙ্গল টিকা পরান। মূলতঃ এই উৎসবে বাড়ির মা ঠাকুমা দিদিমা কিংবা বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা 'আভড়া' তথা অবিবাহিত ছেলে মেয়েদের কপালে চন্দনের ফোঁটা পরিয়ে মাথায় ধান দুর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করে মঙ্গল কামনা করেন। যাতে তাঁদের অবিবাহিত সন্তান সন্ততিগণ ভবিষ্যতে যোগ্য, ভালো এবং পছন্দমতো জীবনসঙ্গী বা জীবনসঙ্গিনী পায়। তাঁদের বিবাহিত জীবন যেন ফুলপ্লবিত হয় -- এই কামনা করা হয়। একটু বেশি বয়সের অনেক ছেলেমেয়ে এই সময় নিজেদের ভবিষ্যৎ জীবনে কার্তিকের মতো স্বামী বা লক্ষ্মী প্রতিমার মতো স্ত্রী পাওয়ার বাসনায় সারাদিন উপবাসে থেকে ব্রতকার্য শেষ করেন। 

এদিন বাড়িতে পায়েস, পিঠা, লুচি, সুজি, ক্ষীর সহ নানারকম নিরামিষ খাবারের ঘনঘটা দেখা যায়। যাঁদের এই 'আভড়াপুনেই' হয়, তাঁদের অর্থাৎ অবিবাহিত ছেলে মেয়েদের সারাদিন ভুজা বা মুড়ি খাওয়ায় নিষেধ। এতে 'বুড়ি যাওয়া'র তথা ডুবে যাওয়া বা এই উৎসব পালনে ছেদ পড়ার ভয় থাকে। মানুষের বিশ্বাস যে, মুড়ি খেলে এ ব্রত ঠিকঠাক পালিত হবেনা। উদ্দ্যেশ্য সাধিত হবেনা। ফলে মনোবাঞ্ছা পূরণ হবেনা। তাছাড়া এদিন বাড়িতে কোনো রকম পোড়া জাতীয় খাবার রান্না করার নিয়ম নেই।

পূর্ণিমার আকাশে গোলাকার চাঁদ ওঠার পর এই ব্রত পালন শেষ হয়। তখন বাড়ির উঠোনে থাকা তুলসীমঞ্চে জল ঢালে ঐসব ছেলেমেয়েরা। কখনো কখনো মায়েরাও ঢালেন। সূবর্ণরৈখিক সংস্কৃতি ও ভাষার ছাপ মেলে পরতে পরতে। একসময় ছেলে মেয়েদের মাথায় আশীর্বাদ করে মা ঠাকুমারা বলতেন, "পো পৈসা ঝি কৌড়ি, / নাড়িয়া নাড়ু কুঁদরি খাড়ু / পো মেনেকার নিস বাড়ু, / ঝি মেনেকার আইস বাড়ু"। অর্থাৎ 'ছেলে টাকা হলে মেয়েও কড়ির সমান'। এই 'পো মেনেকার নিশ বাঢ়ু' অর্থে ছেলে ছোকরাদের গোঁফ বাড়ুক। আর মেয়েদের উদ্দেশ্যে বলা হতো, 'ঝি মেনেকার আইস বাঢ়ু'। অর্থাৎ মেয়েদের আয়ু বাড়ুক। বিশিষ্ট গবেষক শিক্ষক সুদীপ কুমার খাঁড়া জানান, "আমাদের বাড়িতে এখনও এই লৌকিক উৎসবটি পালন করা হয় শ্রদ্ধা সহকারে। তবে বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগ লোকজনের কাছেই এ সম্পর্কে তীব্র অনীহা লক্ষ্য করা গিয়েছে। মূলতঃ ছেলে মেয়েদের সমানাধিকার বোঝানোর জন্য এই 'আভড়াপুনেই' উৎসবের আয়োজন আজও পালিত হয় সূবর্ণরৈখিক এলাকায়"।
 
পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

1 Comments

  1. বাঃ! দারুণ তো! এই অনুষ্ঠানটি মনে হয় আপনাদের এলাকাতেই হয়। বাংলা জুড়ে নয়। আমি তো নামই শুনিনি। চমৎকার সামাজিক অনুষ্ঠান। শুভেচ্ছা। —যযাতি দেবল

    ReplyDelete