জ্বলদর্চি

যেতে যেতে পথে-৪৫/রোশেনারা খান

যেতে যেতে পথে

রোশেনারা খান

পর্ব ৪৫

গত রাতেও দেরিতে ঘুম আসায় ঘুম ভেঙ্গেছেও দেরিতে। আজ ছোলারডাল দিয়ে  মাংস হবে বলে রাতে ডাল ভিজিয়ে রেখেছি। এখন ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলাম। চা পানের পর দই মাখিয়ে মাংস ম্যারিনেট করতে দিলাম। ছোলার ডাল প্রেসারকুকারে সেদ্ধ করতে বসালাম। তমাল গতরাতে বারবার বলে গেছে, ডাল মাংস খাবে। তাই তাড়াতাড়ি মাংস রান্না শেষ করে বেগুন, বড়ি ইত্যাদি দিয়ে একটা সবজি বানালাম। তারপর তমালদের কোয়ার্টারে দিতে গেলাম। 
    আজ আগে থেকেই সিটি সেন্টারে যাওয়ার প্ল্যান ছিল। এদিকে ওয়েদার রিপোর্ট জানাচ্ছে, আজ রোদ বৃষ্টির দিন, তবে বৃষ্টি তেমন হয়নি। দীপ বিরিয়ানি খেতে চেয়েছে, ওটা বাবলি রান্না করল। আমি খান সাহেবের জন্য ভাত আর সবজি রান্না করলাম। তিনটের সময় আমরা সবাই বাসে চড়ে সিটি সেন্টার গেলাম, জারা আজ ঘুমিয়ে ছিল, কান্নাকাটি করেনি। আমরা প্রাইমারকেই সপিং করে ফিরে এলাম। সন্ধ্যায় তমালরা এল, বনিটা পাগল না ছেলেমানুষ, বুঝিনা। ছেলেটারও ঠিকমত খেয়াল রাখে না। খিদে পেয়েছে বলাতে ওকে মাখন আর ডাল দিয়ে ভাতমেখে ডিমের অমলেট বানিয়ে খেতে দিলাম।
    আজ দীপের ড্রাইভিং টেস্ট আছে। আগের বার পাশ করতে পারেনি, এবার কি হয় কে জানে? এদেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া যত কঠিন ক্যানসেল হওয়া তত সহজ। ভুল করলে কারো রেহাই নেই, তিনি যত বড়ই সেলিব্রিটি হন না কেন।
১০ টার সময় ট্রেনার এসে দীপকে টেস্ট দিতে নিয়ে গেল এবং সুখবর নিয়ে ফিরল। পাশ করে গেছে। যাক, নিজের গাড়ি এবার ব্যবহার করতে পারবে। যখন যেখানে খুশী যেতে পারবে। এদেশে গাড়ি না হলে ভীষণ অসুবিধায় পড়তে হয়।বাবলিদের কোয়ার্টারের দুপাশে দুটি ইন্ডিয়ান ফ্যামিলি রয়েছে। ডানদিকে মধ্যবয়সী মি, রাও তাঁর স্ত্রী ও বছর ১৪র ছেলেকে নিয়ে থাকেন। মণিপালে  অধ্যাপনে করতেন। একমাত্র ছেলেকে ভালভাবে মানুষ করার জন্য অধ্যাপনা ছেড়ে এদেশে একটা ছোট চাকরি নিয়ে চলে আসেন, যা মাইনে পান তাতে ছেলের পড়াশোনা আর সংসার চালানোর পর খুব একটা টাকাপয়সা থাকে না, তাই গাড়ি কেনা ও মেনটেন করা মি রাও এর পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে তার জন্য খুব  একটা অসুবিধা হত না। কারণ ডান প্রান্তের কোয়ার্টারে একটি অল্পবয়সি ফ্যামিলি থাকে। মেয়েটির মাথা হিজাবে ঢাকা। সালোয়ার কামিজ জাতীয় পোশাক পরে। ড্রাইভ করে দুর্দান্ত। রাওয়ের ফ্যামিলির সঙ্গে এদের খুব ভাব। মিসেস রাওয়ের কোথাও যাওয়ার থাকলে মেয়েটির গাড়িতে যান। অনেক সময়ই খাবার আদান  প্রদান করতেও দেখেছি। মেয়েটি কোনো ইসলামিক কান্ট্রির মেয়ে। এদের মধ্যে কোনও ধর্ম বা জাতপাত নিয়ে বিভেদ নেই।
    আজ বাংলা দেশর টিভি চ্যানেল ‘এ টি এন’এ একটি অনুষ্ঠান দেখছিলামা। অনেকদিন থেকে এই অনুষ্ঠানটি চলছে। কিন্তু আমার চোখে না পড়ায় জানতে পারলাম না যে মেয়েটি প্রথম ‘বাবা দিবস’ পালন করা শুরু করেছিল, তার ও তার বাবার নাম জানতে পারলামনা। এই টুকুই জানলাম। এক মা তাঁর ষষ্ঠ সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা যান। মহিলার স্বামী সেই সদ্যজাত সন্তানটিসহ ৬টি সন্তানকে পরম মমতায় ও যত্নে একা বড় করে তোলেন। এই ভদ্রলোকের বড়মেয়ে  বড় হয়ে উপলব্ধি করেছিল তাদের বাবা কত কষ্টের মধ্য দিয়ে তাদের বড়  করেছেন। সেই মেয়েটিই ১৯০৯ সালে প্রথম ‘বাবা দিবস’ পালন করে। পরের বছর থেকেই এই দিনটি পরিচিত লাভ করে। ১৯৬৬ সাল থেকে  বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে ‘বাবা দিবস’ পালন করে চলেছে।
    এন ডি টিভির খবরে আজ দেখলাম  এখানকার পোশাক কোম্পানি ‘প্রাইমারক’ ভারত থেকে যে পোশাক নিত, তিন সাপ্লায়ারের থেকে পোশাক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। কারণ কোম্পানিটি জেনেছে ওনারা শিশু শ্রমিকদের দিয়ে কারখানায় কাজ করান। এদেশে শিশুদের ক্ষেত্রে কোনো বিচ্যুতি মেনে নেওয়া হয় না। ভাল লাগলেই অপরিচিত কোনো শিশুর গাল টিপে আদর করা যায় না। রাস্তাঘাটে কোলে নিয়ে বেড়ানো যায় না।
      বনি আজ আমাকে ধরেছে ওকে নিয়ে জিপসি মার্কেট যেতে হবে (নামটা আমার দেওয়া)। সপ্তাহে একদিন বসা এই মার্কেটে জিপ্সিরাও তাদের চুরিকরা জিনিস বিক্রি করতে আসে। পুরনো ও নতুন, সবরকম জিনিসই বিক্রি হয়। গাড়ির ভিতর থেকে মাংসও বিক্রি হয়। মেডিলিঙ্কের বাসে চড়ে এই মার্কেটে যাওয়া যায়। আমার ইচ্ছে ছিলনা, কিন্তু বনি চেনেনা বলে ওকে নিয়ে যেতে হল। ও তো একটার পর একটা জিনিস কিনেই চলেছে। ফিরতে চাইছে না। আমাকে রান্না করতে হবে। দীপের নাইট চলছে, হাসপাতাল থেকে ফিরে ও খাবে। অনেক জোরজার করে ওকে নিয়ে এলাম। সান বাবলির কাছে ছিল। ওকে নিয়ে গেল। কিন্তু কোয়ার্টারে নয়, আবার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে মেডিলিংকের বাসে চড়ে জিপসি মার্কেট গিয়েছিল। এটা অবশ্য পরে ওর ছেলে সানের থেকে জেনেছি।
      সকালবেলা ইন্টারনেটে ‘আজকাল’ এর খবর  পড়ছিলাম। ‘নাজিম আহমেদ যার, পৌরসভা তার’ এই শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সামনেই  পৌরসভার ভোট। খবর পড়ে জানলাম উনি আমাদের ২ নাম্বার ওয়ার্ডে দাঁড়িয়েছেন। ভদ্রলোক খুব প্রাণখোলা  সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ, আমাকে খুবই শ্রদ্ধা করেন। তাছাড়া যখন পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিলেন অনেক কাজ করে দিয়েছেন। তাই ভাবলাম ওনাকে একবার ফোন করি। কণ্ঠস্বর শুনেই উনি চিনতে পেরে  বললেন, আপনি কি দেশে ফিরেছেন? তখন ওনাকে জানালাম কোথা থেকে? এবং কেন ফোন করেছি। উনি তো ভীষণ উত্তেজিত ভাবে বললেন, আমার কী সৌভাগ্য! আপনি ইংল্যান্ড থেকে আমাকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন! উনিও আমাদের শুভেচ্ছা জানালেন। আরও অনেক কথা হল।
      জারাকে নিয়ে আজ সিটি সেন্টারে গেছলাম। প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কেনার পর একটা স্টুডিওতে ঢুকলাম। পাসপোর্টের জন্য জারার ছবি তোলা হল। মাঝে মাঝে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। বাস ধরার জন্য লম্বা লাইন পড়েছে। একটা  সুবিধা আছে, বাচ্চা এবং বৃদ্ধাদের আগে সুযোগ দেওয়া হয়। আমাদের বিলেত বাসের দিন যত কমে আসছে, ততই মায়ায় জড়িয়ে পড়ছি। ইন্দ্রনীল ও রিমা  বারমিংহাম থেকে ফোন করে আমাদের ওদের বাড়ি যাওয়ার জন্য বলেছে ।কিন্তু দীপের সময় হবেনা বলে যাওয়া হলনা।

    এদিকে আজ হিথরো থেকে এইয়ারইন্ডিয়া থেকে কেউ  ফোন করে ছি্লেন।  ওদের হিথরো থেকে দমদম এয়ারপোর্ট ডিরেক্ট উড়ান বন্ধ হয়ে গেছে। মুম্বাই ও দিল্লীর মধ্যে আমরা কোথা দিয়ে যেতে চাই? আমরা মুম্বাই দিয়ে যাওয়ার কথা বললাম। সবার জন্যই কিছু না কিছু কিনেছি ওজন বেড়ে যাবে কিনা জানিনা। বেড়ে গেলে এক্সট্রা টাকা লাগবে। তাই গোছগাছ শুরু করেছি, বাড়িতেই আগে ওজন করে দেখব।

    আজ ২৮ জুন, আমি আর খান সাহেব  সেরউড জঙ্গল বেড়াতে যাব। নটিংহাম থেকে সেরউড  জঙ্গলের দূরত্ব ১৭ মাইল। সকালে উঠেই চা খেয়ে কিছুটা চা ফ্লাক্সে ভোরে নিলাম, কয়েকটা পরোটা ভাজলাম, সঙ্গে কাবাব। ছাতা, ক্যামেরা চা, টিফিন ব্যাগে ভরে নিলাম। এরপর স্নান খাওয়া করে আমরা সিটিলিংকের বাস ধরে সিটি সেন্টারে পৌঁছালাম। ওখানে পৌঁছে ভিক্টোরিয়া বাস ষ্টেশন খুজে বের করলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম এখান থেকেই সেরউড যাওয়ার বাস ছাড়ে।  গাইড বুক থেকে আগেই সব জেনেছি। প্রত্যেকটি বাসের নাম্বার ও সময় অনুযায়ী বাস তার নির্দিষ্ট জায়গাতে দাঁড়াবে। ৯ নাম্বার যায়গাটি থেক ১০টার সময়  সেরউড যাওয়ার  বাস ছাড়বে। ৯ নাম্বার যায়গাতে একটি নিগ্রো ছেলে বসে আছে। আমরা তার পাশে বসলাম। এক বৃদ্ধ দম্পতি পায়চারি করছিলেন, তারাও এসে আমাদের পাশে বসলেন। ১০টা বাজতে মিনিট ১০ বাকি, কিন্তু এখনও বাসের দেখা নেই। অন্য বাসের ড্রাইভারকে জিগ্যেস করতে তিনি বললেন, মিনিট ৫ এর মধ্যে এসে যাবে। ১০ টা ২০ হয়ে গেল, এখনো বাস এল না। সবার হাতেই  গাইড বুক ও টাইম টেবিল রয়েছে, কিন্তু কেউ লক্ষ্য করেননি আজ শনিবার, ১০ টার বাস বন্ধ থাকে। খান সাহেবই দেখে সবাইকে জানালেন। এর পরের বাস ১০টা ৫০ মিনিটে।
                          ক্রমশ

পেজে লাইক দিন👇

Post a Comment

0 Comments